নাসরিন সিরাজ
১৮ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশ “বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ –এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে একের পর এক বাংলাদেশী নিহত হবার ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন – এক হাতে তালি বাজে না। বাংলাদেশের মানুষ যদি সীমান্ত পার হয়ে না যায় তাহলে এ ধরণের ঘটনা ঘটেনা”।
প্রথম আলোর খবরটা পড়লে বোঝার কোন উপায় নেই কেন তারা খবরটা করেছে। বিজিবির মহাপরিচালকের এই আপাত আইনী মহান বানীকে তারা কোন পাল্টা প্রশ্ন করেনি। সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ হতে হয় বলে জানি কিন্তু সরকার পক্ষ কোন বক্তব্য দিলে সেটার বিশ্লেষণ করে পাল্টা প্রশ্ন করাটাই যে তাদের পেশাদারিত্ব সেটা ১৯৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পরের যুগের সাংবাদিকরা দিব্যি ভুলে বসে আছেন। বলা যায় গত দুইযুগের বেশী সময় ধরে ধীরে ধীরে সরকার ও সংবাদ মাধ্যমের একটি সুখী দাম্পত্য জীবন রচিত হয়েছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা আজকাল হয়েছে লক্ষী বউয়ের মত যে সরকার স্বামীটির পদলেহন করছে। আর তাদের পদলেহনকারী ভূমিকার কারণে সরকার সারাক্ষণ এ ধরণের বানী প্রচার করার সুযোগ পাচ্ছে যে বাংলার মানুষ একেকটা অপরাধী। এবারের অপরাধ রাষ্ট্র সীমানা পার হওয়া।
ভাবনারই বিষয় যে বাংলাদেশের মানুষ আইন না মেনে দেশের সীমানা পার হয়ে ভারতে গেলে বিএসএফ গুলি করার হক রাখে কি? বিজিবি প্রধানের কি হক আছে মানুষকে আইন মানছেনা অপবাদ দিয়ে বিএসএফের হত্যাকান্ডগুলোকে বৈধতা দেয়া? থাইল্যান্ডে যে মানুষগুলো মরে গেল সেটা কি তাহলে তাদের তথাকথিত অপরাধের উচিত শাস্তিই হল? মৃত্যুই তাদের হক পাওনা ছিল?
লাশের পাহাড় কোন উত্তর আমাদের দিতে পারবে না।বরং চলুন আপনাদের ঢাকা এয়ারপোর্টের একটা গল্প বলি। যে মানুষগুলো মরে গেল বা যাদের বাঁচা মরায় সরকার বাহাদুরদের কিছু যায় আসে না তাদের দেশ ছাড়ার প্রেক্ষাপটটা হয়তো কিছুটা আঁচ করা যাবে এ গল্পে। কার কি হক সেটা বুঝতে হয়তো দিশা পাওয়া যাবে।
১৭ জুলাই ২০১২ সাল। স্থান ঢাকা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট।ঘটনাটা আসলে খুব সাধারণ আর খুব সাধারণ ঘটনা বলেই এটার গুরুত্ব বেশী। যেমন, বাংলাদেশের সমাজে স্বাভাবিক জীবনে খেটে খাওয়া মানুষের সাথে প্রতি মুহূর্তে ঠোক্কর খেলেও আমরা তাদের উপেক্ষা করি। কারণ, খেটে খাওয়া মানুষের ধুঁকে ধুঁকে মরা আমাদের কাছে স্বাভাবিক লাগে। এরা আমাদের ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশ “সবচাইতে কম উন্নত” দেশ। কিন্তু এসব কিছুর ভয়ংকর দিক হল আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, সরকারের সিদ্ধান্ত, ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ এবং তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের মতাদর্শ আমাদের গরীব মানুষদের অস্বীকার করতে শেখায়। সবার জন্য ভাত, কাপড়, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থা করলে আমরা সকলেই সমান মর্যাদা সম্পন্ন বাংলাদেশী হতে পারতাম। কিন্তু এসব মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে আজকাল মনোযোগ সবচাইতে কম। যে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য আমরা হা পিত্যেশ করি আর পেলে বর্তে গেছি বলে প্রচার করি সেটাও সবচাইতে বেশী (প্রায় ৯০ ভাগ) আসে টেলিযোগাযোগ, জ্বালানী-বিদ্যুৎ এর মত অনুৎপাদনশীল খাতে। কৃষি ও শিক্ষা যেগুলো আমাদের মেরুদন্ড (আত্মমর্যাদা অর্থে) ও পায়ের জোর (দক্ষতা অর্থে) বাড়াতে সাহায্য করতে পারে সেগুলো সরকার বাহাদুরদের অবহেলার পাত্র।
গল্পে ফেরত আসি। বিদেশে যারা যাতায়াত করেন তারা জানেন ঢাকার বিমানবন্দরে প্রথমেই যাদের সাথে আপনার গায়ে ধাক্কা লাগবে তারা হল বিদেশগামী বাংলাদেশের “জনশক্তি”। এরা বাংলাদেশের সমান হকদার কিন্তু তারা কোনদিন স্কুলে যেতে পারেননি। ঢাকা বিমান বন্দরে লজ্জিত, বিভ্রান্ত মুখে ও ‘এমবারকেশন ফর্ম’ হাতে বিদেশগামী শ্রমিকরা “শিক্ষিত” বাংলাদেশীদের পেছনে পেছনে ঘুরছেন এটা সাধারণ একটি দৃশ্য। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন ডেস্কের কর্তব্যরত পুলিশ তাদের ধমক দেয় ঠিকমত কাগজপত্র পূরণ করা হয়নি বলে, বা “এই লাইনের পিছনে অপেক্ষা করুন” লেখা নির্দেশ অমান্য করার জন্য। এয়ারপোর্টে বিদেশগামী শ্রমিকদের সাহায্য করার একটা ডেস্ক আছে বটে, তবে দিব্যি দেখেছি যে এয়ারপোর্টের ‘ভলান্টিয়ার’ -রা বিদেশগামী শ্রমিকদের নিরক্ষতার সুযোগে তাদের কাছ থেকে টাকা খসিয়ে নিচ্ছে ।
এসব স্বাভাবিকতার মধ্যে প্রতিবারই বিদেশে যেতে ও ফেরত আসার পথে এয়ারপোর্টে দুই একজন যাত্রীর সাথে আমার আলাপ হয়। এবার যার সাথে আলাপ হল তাকে প্রথম খেয়াল করি ‘চেক ইন’ করতে গিয়ে। আমি ‘চেক ইন’ করছিলাম, আর তিনি তার সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান সেই নিয়ম না অমান্য করে “ভাই, এটা কোন দিকে?” কথাবার্তা বলে চলে গেলেন। বুঝলাম তিনি তাঁর ‘এয়ার লাইন্স’ এর ডেস্ক খুঁজছেন। সবাই জানে এয়ারপোর্ট একটা দৌড়াদৌড়ির জায়গা। এখানে সবাই যার যার প্লেন ধরতে, প্লেনে চড়ার আগে কাগজপত্র ক্লিয়ার করতে ও মালপত্র গোছগাছ করতে ব্যস্ত থাকে। ঢাকার এয়ারপোর্ট তো কিছুই না। বেশীরভাগ এয়ারপোর্টে হাজার হাজার যাত্রী, শত শত বিমান উঠানামা করে, দুর্বোধ্য ইংরেজীতে ঘোষণা শোনা যায় এবং কড়া কড়া সব নিয়ম কানুন ও নির্দেশ মেনে চলতে হয়। “শিক্ষিত” হয়েও যেখানে আমি এয়ারপোর্টে তালগোল পাকিয়ে ফেলি সেখানে এই মহিলা এখানে ও প্রবাসী জীবনে কি করুণ দশার মধ্যে পড়তে পারে ভাবতেই আমি শিউরে উঠি। তখনও বুঝিনি যে তিনি একদমই লেখাপড়া পারেন না।
মহিলার পরনে নেভি ব্লু রঙ্গের ফুল ফুল প্রিন্টের একটা জর্জেটের শাড়ী। সেটা বেশ পুরোনো ও বহু ব্যবহৃত। তাঁর পায়ের হাই হিলটাও বহু পুরোনো ও ব্যবহৃত। উপরন্তু সেটা মহিলার পায়ের পাতার সাইজের চেয়ে দুই সাইজ বড়। মহিলার বাহুতে ঝুলানো অবস্থায় থাকা একটি পুরোনো ভ্যানিটি ব্যাগ ছাড়া আর কোন ‘লাগেজ’ দেখলাম না। তার কাপড় চোপড় দেখে আমার মনে হল তিনি সেগুলো পুরোনো কাপড়ের দোকান থেকে কিনেছেন।
ইমিগ্রেশন ডেস্কের সামনে মহিলার সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা। প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করার পর তিনি যখন ইমিগ্রেশন পুলিশকে তার কাগজপত্র জমা দিলেন তখন আমরা জানতে পারলাম যে তিনি এমবারকেশন কার্ড পূরণ করেননি। নিশ্চিত হলাম যে তিনি লেখা পড়া পারেন না। আমি তাঁকে সাহায্য করতে চাইলাম কিন্তু পুরোটা পারলাম না। তাঁর ভিসা নম্বর খুঁজতে গিয়ে দেখি ভিসাটা আরবী ভাষায় লেখা। একজন এয়ারপোর্ট পুলিশকে ডাকলাম ওনাকে সাহায্য করতে। এমবারকেশন ফর্ম পূরণ করে মহিলাটি আবার প্রায় ২০ মিনিট লাইনে অপেক্ষা করে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে কাগজ জমা দিলে পুলিশের উচ্চ স্বরের ধমকানিতে আমরা জানতে পারি যে তিনি ‘বোর্ডিং কার্ড’-ই করেননি। আমি গেইটের দিকে এগিয়ে গেলাম আর তিনি বোর্ডিং কার্ড করতে পেছনে ছুটলেন।
গল্পটা এখানেই শেষ। প্রতিবার এরকম না শেষ হওয়া গল্প পাই আমি।বন্ধুদের সাথে চায়ের আড্ডায় বা পারিবারিক দাওয়াতে ঢাকার এয়ারপোর্টের প্রসঙ্গ তুললে অন্যরাও একই রকম গল্প শেয়ার করেন আমার সাথে, স্রেফ স্কুলে যায়নি বলে মানুষের দিশেহারা অবস্থার গল্প।বিজিবি মহাপরিচালকের বক্তব্য পড়ে আমার সেই সব দিশেহারা মানুষের কথা মনে পড়ে। লাশের পাহাড়ে তো সেই দিশেহারা মানুষেরাই শুয়ে আছেন। এক হাতে তো অবশ্যই তালি বাজে না। সরকার বাহাদুরদের না-হক কাজ কর্মের জন্য যে এতোগুলো দিশেহারা মানুষ মরলো, তার বেলা ?
Categories: সীমানা পেরিয়ে
Leave a Reply