বিচ্ছেদ ও মায়ের আইনি অধিকার
ফারজানা মনি
বাংলাদেশের সমাজ বিবাহ বিচ্ছেদকে এখনো স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। হ্যাঁ এটা সত্য যে আগের তুলনায় বিচ্ছেদের হার বেড়ে গেছে।কিন্তু তাতে করে মানসিকতা এতটুকু বদলায়নি। স্বামী– স্ত্রীর বনিবনা না থাকলেও সমাজে তাদের মান রক্ষার অজুহাতে সংসার টিকিয়ে রাখার লড়াই করতে থাকেন তারা। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এই লড়াইয়ে নারীকে একক ভাবে সংগ্রাম করতে হয়। কারন মেয়েদের শিখানো হয় এই বুলি, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে’। রমণীর অনেক গুন থাকলেও সংসার ভেঙ্গে যেতে পারে। ভেঙ্গে গেলে কিছু বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হতে। প্রথমত, স্বামী তার স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা, ইদ্দতকালিন সময়কার ভরণপোষণের টাকা পরিশোধ করবেন। এটি বাদ দিয়ে তাদের দুজনের নাবালক সন্তান থাকলে তার ভরণপোষণের টাকাও যৌক্তিক পরিমানে বাবা দিয়ে যাবেন।
আইনজীবী হিসেবে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হোল এই টাকা দিতে বেশীর ভাগ স্বামীই অনীহা প্রকাশ করেন এবং দেন না। যারা শিক্ষিত তাদের কেউ কেউ আইনজীবীর কাছে ছুটেন ঠিকই কিন্তু তাতে করেও সেই নারী তার অধিকার সঠিক ভাবে পাচ্ছেন তা বলা যাবে না। কারন তারা তাদের স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্য দেনমোহর, ভরণপোষণ থেকে বঞ্চিত হলেও আদালতের দ্বারস্থ হতে চান না।
আমার বাস্তব একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। ১২ বছর সংসার করার পর বিচ্ছেদ হয়ে গেলো এক দম্পত্তির। তাদের ঘরে সাত বছরের বাচ্চা আছে। সমস্যা দেখা দিলো বাচ্চার ভরণপোষণ নিয়ে। মুসলিম পারিবারিক আইনে তো বাচ্চার ভরণপোষণ একমাত্র বাবা বহন করবেন। বাবাটি খুব ভালো। তিনি মাসে মাসে বাচ্চার খরচ বাবদ ১০ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও এই অঙ্ক থেকে এক বিন্দু সরে আসেন নি। মুশকিল হচ্ছে বাচ্চার স্কুলের বেতনই শুধু ১২ হাজার টাকা। যা না উল্লেখ করলেই নয়, বাবা যে চাকরি করেন সেখান থেকে প্রতি মাসে বেতন পান সারে কয়েক লক্ষ টাকা।কিন্তু মা এই টাকার অঙ্কেই রাজি হয়ে গেলেন। সন্তানের পিতা যেহেতু এর বেশী দিতে রাজি নন তার মানে আদালতে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী আল্লার হাতে বিচারের ভার দিয়ে সন্তান নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করলেন। আমার চোখের সামনে কারো অধিকার বঞ্চিত হবার সাক্ষী আমাকে হতে হয়।আইনজীবী হিসেবে এই দুর্ভাগ্য আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। আমার হতাশার জায়গাটুকু আরো বেড়ে যায় যখন আমি দেখি শিক্ষিত, সচেতন নারীরাই আদালত থেকে দূরে রাখছেন। যে সকল নারী শিক্ষা বঞ্চিত, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করেন তাদের থেকে কি পার্থক্য রইলো।
খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে দুটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। ১। বাবারা তাদের নিজ সন্তানকে টাকা দিতে বেশীর ভাগ সময়ই অনীহা প্রকাশ করেন। তার কারন কি?২। মায়েরা কেন আদালতের যেতে চান না? এই প্রশ্নগুলো আমাকে খুব ভাবায়। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই।এর উত্তর আমার জানা নাই। কিন্তু ছাড়াছাড়ি হবার পরের লড়াইটা নারীকে একাই করতে হয়। এবং সেটা নানা ভাবেই প্রথমত সামাজিক। সংসার ভেঙ্গে যাবার দায়টা যে নারীকেই নিতে হয় বেশী, এখনো সমাজ মেয়েটাকেই দোষী মনে করে।পড়ে আসে অর্থনৈতিক লড়াই, নিজের ভরণপোষণ এবং সন্তানের ভরণপোষণের আকস্মিক ভাবে নিজের একার কাধে চলে আসে। সবশেষে আসে মানসিক লড়াই। সেটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি অনেক সংগ্রামী মায়েদের দেখেছি কি ভয়ানক কষ্ট করে সে লড়াই তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরকে স্যালুট।
ফারজানা মনি একজন আইনজীবী।
Categories: যাপিত জীবন
Leave a Reply