স্বপ্নে দেখলাম একটা সাদা রঙের হাঁস বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। হাঁসটার চেহারা দেখলাম না কিন্তু জানতাম আসলে ও অতুল্য – আমার ছেলে। ঘুমটা ভেঙ্গে গেলে আমার কেবল মনে হল যে বাস্তবের সাথে এতো মিলিয়ে এর আগে কোনদিন আমি স্বপ্ন দেখিনি। ঘুমাচ্ছিলাম ব্যাঙালুর শহরের নারায়ানাম হৃদয়ালাম হাসপাতাল সংলগ্ন একটি হোস্টেলে। ছারপোকার ভয়ে ঘরের বাতি নেভানো হয়নি। আমিও বাম কাতে ঘুমাচ্ছিলাম, দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। রাত গভীর হলেও বাইরে দিওয়ালীর বাজি পোড়ানোর শব্দ তখনও শোনা যাচ্ছিলো। চোখ মেলে আমি নোংরা দেয়ালটির দিকেই তাকিয়ে থাকলাম। বুঝতে পারছিলাম অতুল্য’র বাবা আর দাদীও চুপ মেরে পড়ে আছে সকাল হবার অপেক্ষায়। আমরা কাল দেশে ফিরবো কারণ আমাদের ব্যাঙালুরে কাজ শেষ। সন্ধ্যায় আমাদের অতুল্য’র মাত্র ছয় মাসের জীবনাবসান ঘটেছে। সে রয়েছে হাসপাতালের হিমাগারে।
আমার এ লেখা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে নয়। মহান রাষ্ট্র ও তাঁর আইন কানুন কোন কিছুকেই আঘাত, অবমাননা করার কোন খায়েশ আমার নেই। এটা স্রেফ সন্তান হারা এক নারীর বুকের ভার হালকা করার এক তুচ্ছ ব্লগ, নিখাদ বর্ণনা।
অতুল্য’র মৃত্যুর খবর পেয়ে অনেকে আমাদের স্বান্তনা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। সেসব দিনে ফেসবুক ছিল না কিন্তু ইমেইল ছিল। অতুল্য’র চিকিৎসার অগ্রগতি জানাতে ওর বাবা দৈনিক সব বন্ধুদের গ্রুপ করে লম্বা লম্বা ইমেইল করতো। অনেকের হয়তো সেসব ইমেইল পেতে ভাল লাগতোনা কিন্তু বিদেশে বন্ধুহীন পরিবেশে হয়তো স্বান্তনা পেতে আর কোন অবলম্বন ও খুজেঁ পাচ্ছিলোনা। ঢাকা এয়ারপোর্টে যখন নামলাম তখন বন্ধু আত্মীয় স্বজনের ঢল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, বুঝতে পারছিলাম এ’সব নয়নের ইমেইল-আপডেটের ফলাফল। অবশ্য এয়ারপোর্টে নেমেই নয়ন লাশের কোর্গো খালাস, সেটাকে বাসায় নেয়া, কবরের জায়গা কেনা তারপর লাশ দাফন এসব নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সকলের চোখের আড়ালে চলে গেল। ওর কাছ থেকে একবার শুধু এসএমএস পেলাম “অতুল্য কবরে ঘুমাচ্ছে, ঠিক তোমার স্বপ্নের মত”। আমি নয়নকে আমার বুকের মধ্যে চেপে স্বান্তনা দেবার, নিজে স্বান্তনা পাবার জন্য কাছে পাচ্ছিলাম না শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম মুরুব্বীরা সব বলাবলি করছে এই এক ঘটনায় ও কেমন বড়দের মত দায়িত্বশীল আচরণ করছে। সব কাজ শেষ করে রাতে আমাদের ঘরে দেখা হল আমাদের। ঘুমাবো বলে যখন লাইট অফ করলাম শুধু তখনই ও আমার বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। ঐ একবারই, ঐ শেষবার ওর কান্নার আওয়াজ কেউ শুনেছিল।
আর আমি? আমার কান্নার কোন শেষ নেই। মায়ের মন নাকি এরকমই। কিন্তু তাৎক্ষনিকভাবে আমার মাথায় প্রাণহীন মানব শরীর আর মানুষের আত্মা ও পরকালের অস্তিত্ব নিয়ে তর্ক চলছিল। নয়নের বড়বোন লাশ গোরস্থানে নিয়ে যাবার প্রাক্কালে আমাকে শেষবারের মত আমার সন্তানের চেহারা দেখার জন্য ডাকতে আসলো। আমি টের পেলাম আমার মন বলছে মৃত দেহটি অতুল্য নয়। অতুল্য’র মৃত শরীরটা কতটুকু আমার আর কতটুকু ওর নিজের-প্রশ্ন করছে আমার মন। বাচ্চাটাতো পেট থেকে এতোটুকুই বের হল, এখনো আমার বুকের দুধ ছেড়ে শক্ত খাবার ধরেনি তাহলে অতুল্য কি আমিই? আমার মাথায় অতুল্যকে নিয়ে যতসব স্মৃতি সে অতুল্য কোন অতুল্য? সেই কি আসল অতুল্য? লাশ দেখার কোন তাগিদ বোধ করলাম না আমি। অতুল্য’র লাইফ সাপোর্ট যখন খুলে নেয়া হয় সে মুহূর্তে ওর মাথায় হাত রেখেছিলাম, টের পেয়েছিলাম সেটা ঠান্ডা। ডাক্তার আমার কথা শুনে ওর মাথায় একটা লাইট দিয়ে সেটা বৃথা গরম করার চেষ্টা করেছিল। হার্টবিট দেখা যায় যে মনিটরে সেটা এক দুই করে শূণ্য হয়ে গেল আর আমি সেই সময়ে, “আমি তোকে ভালবাসি…আমি তোকে ভালবাসি” বলছিলাম। জানিনা সেটা ও শুলতে পাচ্ছিল কি না বা বুঝতে পারছিল কি না হয়তো আসলে ওর মৃত্যু ঘটেছিল অনেক আগেই, লাইফ সাপোর্ট খোলাটা হাসপাতালের একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কিন্তু মৃত্যুটা মৃত্যু আমি ঠিকঠাক বুঝেছিলাম- সেখান থেকে ফেরা যায় না, কোনমতেই না, কিছুতেই না, মৃত মানুষকে জীবন্ত করা যায় না, কোন উপায় নেই তাকে নাগাল পাবার, পাওয়া যায় না, সে শেষ, সে নাই…সে কি শূণ্যতা, হাহাকার।
কিন্তু মানুষের হৃদয়, সন্তান হারা বাবা-মায়ের শূণ্যতা বোঝেনা রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রের প্রথম কাজ বিদেশী মরা মানুষের পাসপোর্টটা “বাতিল” বলে মার্ক করা। অতুল্যর জীবনের প্রথম পাসপোর্ট সাইজ ছবি ক্রস চিহ্ণ দেয়া…তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমি …ভাষা খুজেঁ পাচ্ছিনা সেটা দেখতে কি ভয়ংকর অপমান লাগছিল আমার সেটা বর্ণনা করতে। লাশটা রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে যাবে তাই এয়ার টাইট কফিনে পুরে সেটাকে কাস্টম্স ক্লিয়ারেন্স পাওয়া কনটেইনার বানানো হল, সীল-ছাপ্পর পড়লো সেটায় কড়া পুলিশ পাহারায়। শুকনো চোখে, পাথরের মত সব দেখলাম আমরা।
কিন্তু ভারত পুলিশের ক্লিয়ারেন্স মানলো না কলকাতার বাংলাদেশ দূতাবাস। হৈ চৈ করে প্লেনের উড্ডয়ন পর্যন্ত বিলম্ব করালো তারা। কেন? হয়তো এক রাষ্ট্রের পাসপোর্ট আরেক রাষ্ট্রের পুলিশ বাতিল করেছে বলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা হানি হয়েছিল। শুনছিলাম কে যেন হুঙ্কার ছাড়ছে, “ওরা কারা আমাদের পাসপোর্ট বাতিল করার? বাতিল তো করবো আমরা।” আমাদের তখন একবিন্দু শক্তি নেই কাউকে কিছু বলার। অতুল্য’র দাদী এক কোনায় কাঁদছে আর আমি শক্ত হয়ে বসে আছি কখন আমার নিজের মায়ের বুকটা পাবো আর সেখানে মুখ গুজেঁ নালিশ করবো, “ আম্মু, দেখো আমার ছেলেটাকে ওরা কত কষ্ট দিল”।
অতুল্য’র লাশটা প্লেনে তোলার অনুমতি পেতে এয়ারপোর্টে আমাদের রেখে নয়নকে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হয়েছিল। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্তাব্যক্তিদের কাছে ভারত পুলিশের হয়ে শাস্তি পেতে হয়েছিল নয়নকে। শাস্তিটা এরকম যে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে ফটোকপির দোকান খুঁজে অতুল্য’র বাতিল হওয়া পাসপোর্ট এর পুরো বইটা ফটোকপি করে জমা দিতে হবে। এর মধ্যে যদি প্লেন ছেড়ে দেয় তো বাংলাদেশ দূতাবাসের আইনীভাবে তাতে কোন কিছু করার নেই। আমাদের কাছে কোন টাকা ছিল না কারণ ব্যাঙ্গালুর ছাড়ার আগে সব টাকা আমরা ব্যাঙ্গালুরের হাসপাতালে শিশুদের জন্য দান করে দিয়েছিলাম। নয়নের কাছে শুনেছি যে একজন ভারতীয় বাঙালী অফিসার দয়া করে ফটোকপির দোকান চিনিয়ে দেয়া, পয়সাটা দিয়ে দেয়া এসব সাহায্য করেছিল। আর এতো হেনস্থা হয়ে করা ফটোকপিটা যখন ও দূতাবাসে জমা দিল তখন ওরা এমন একটা ভাব করলো- আচ্ছা কাগজগুলো ঐ টেবিলে রেখে যান, পরে দেখবো।
Categories: সীমানা পেরিয়ে
Leave a Reply