মৃত্যুঞ্জয়ী সোহাগ ও নূন্যতম মজুরী আন্দোলন, মে ২০০৬

মৃত্যুঞ্জয়ী সোহাগ ও নূন্যতম মজুরী আন্দোলন, মে ২০০৬

সাভার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, মে ২০০৬

সাভার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, মে ২০০৬

শহিদুল ইসলাম সবুজ

২০শে মে, ২০০৬।

তখন শ্রমিকদের মাসিক মজুরীর বদলে পিস রেট্ হিসেবে যখন ইচ্ছা তখন বেতন দেয়ায় রেওয়াজ ছিল । ছিল না নির্ধারিত কোনও মজুরী কাঠামো । ওভারটাইমতো দূরের কথা নূন্যতম পাওনা পরিশোধের ধারধারতো না মালিকপক্ষ। মাস্তানতন্ত্রের কায়েম করে মালিকরা কারখানা চালাত। এখনও চালায়, কিন্তু তখনকার বাস্তবতা ছিল অবর্ণনীয়। ছাটাই, মারধর, যৌন হয়রানিই ছিল নিয়ম, শ্রমিকের অধিকারের কোনও ধারণা মালিকপক্ষের কাছে পরিচত ছিল না। আজ থেকে ৯ বছর আগে, এই দিনে চলমান এ মাস্তানতন্ত্রের বিরুদ্ধে গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকায় শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ একটা সুনির্দিষ্ট আন্দোলনের রূপ নেয়।

প্রতিবাদ করলেই শ্রমিকদের ধরপাকড় ছিল রোজ দিনের ঘটনা। কিন্তু শ্রমিকরা আর মেনে নেবে না। এফ এস ফ্যাক্টরির ১০০০ শ্রমিকগণ তাদের তিনজন গ্রেপ্তারকৃত সহকর্মীদের ছেড়ে না দেয়া পর্যন্ত কাজ করবে না বলে ঘোষণা দেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ বিদ্যুত ও পানি সংযোগ বন্ধ করে ধর্মঘটরত শ্রমিকদের বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেয়। গরমে অতিষ্ট হয়ে বেলা ১১টার দিকে শ্রমিকরা কোনো মতে কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকা ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করে। প্রতিবাদ দমনে শ্রমিকদের উপর গুলি ছোড়ে পুলিশ। বেলা পৌনে বারোটার দিকে কারখানার সামনে পুলিশের গুলিতে এস.এফ সোয়েটার কারখানার শ্রমিক এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সদস্য সোহাগ খুন হন।

সোহাগের মৃত্যুর খবর দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে।

সাভার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের ইউনিভার্স সোয়েটার ফ্যাক্টরির ৪০০০ শ্রমিক পুলিশের গুলি, মালিকপক্ষের গুন্ডাবাহিনীর হামলা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। হাজার হাজার শ্রমিক আশুলিয়া, সাভার, মিরপুরের রাস্তা মিছিলে উত্তাল করে তোলে।

২২শে মে, ২০০৬।

পুলিশের গুলিতে রানা নামের আরও একজন শ্রমিক খুন হন।

২৩শে মে, ২০০৬।

আন্দোলন দমনে সরকার র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়নকে মাঠে নামায়। ৩০ জনের অধিক শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রদ্রোহসহ অন্যান্য মামলা দিয়ে হেনস্থা করার যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়।

কিন্তু, এই আন্দোলন গার্মেন্টস সেক্টরে মালিকপক্ষের অরাজকতা, অব্যস্থাপনা জনগনের সামনে নিয়ে আসে। শ্রমিকদের ক্রোধপ্রতিরোধের মুখে সরকার ও মালিকপক্ষ নূন্যতম মুজরী (১৬৬২.৫০ টাকা) নির্ধারণে বাধ্য হয়, গঠিত হয় একটি মজুরী বোর্ড। একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি (সরকার, BGMEAও কিছু শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের মধ্যে) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি শ্রমিকদের সকল দাবির প্রতিফলন না ঘটলেও, বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই আন্দোলন, আর সোহাগ ছিলেন এই আন্দোলনের সুচনাকারীদের একজন।

সম্প্রতি, বিশেষ করে বিভিন্ন জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশে পোশাক শিল্প কারখানায় শ্রম সম্পর্কের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে নানা খবর চোখে পড়েছে। কারখানা পরিদর্শন ও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও নিয়মতান্ত্রিকায়নে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে বেশ কিছু জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা। এই সাংগঠনিক মনোযোগ ও আর্থিক বিনিয়োগ বাস্তবে কি ফল বয়ে আনবে তা সময় বলবে। আমরা এখনও জানি না। কিন্তু দৈনন্দিন কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকের প্রতি মালিক ও সরকার পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনও পরিবর্তন আসেনি। এই বছরের জানুয়ারী মাস থেকে এই পর্যন্ত অন্তত ১০টি কারখানা মালিকপক্ষ অবৈধভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে, শ্রমিকের পাওনা পরিশোধের তোয়ক্কা করেনি। বাড্ডা সাতারকুলের চুনঝি নীট লিমিটেডের শ্রমিকরা পাওনা আদায় ও বন্ধ ফ্যাক্টরী খুলে দেয়ার দাবীতে আন্দোলন করছে। একই দাবীতে সোয়ান গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা ১৭ই মে শ্রম মন্ত্রনালয় ঘেরাও করেছিল।

তাই সরকারবিজিএমইএআইএলওকে বাংলাদেশে গার্মেন্টস সেক্টরের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে যখন নিজেদের পিঠ চাপড়াতে দেখি তখন সোহাগ, রানাসহ আরও নাম না জানা শ্রমিক যারা নূন্যতম মজুরী আন্দোলনে খুন হয়েছেন তাদের কথা ভাবি। সোহাগ বা রানার জীবন সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। মৃত্যুই তাদের পরিচয়।

আজকে গার্মেন্টস শ্রমিক সোহাগের মৃত্যুবার্ষিকী।

সোহাগ, রানা ও তাঁদের সকলের স্মরণে একটা কথা আজকের দিনে স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে যা কিছু পরিবর্তন এসেছে, তা শ্রমিকের রক্তঘাম ঝরা অর্জন। আন্দোলনের ইতিহাস।



Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: