ধর্ষণ: রিপোর্টিং ও আন্দোলন ব্যানারে কাদের আধিপত্য?

নাসরিন সিরাজ

“রাতে ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য তাদের তিন থানায় ঘুরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়ে বলেও জানান তিনি।
তুরাগ থানার কাছে হয় বলে মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তারা সেখানে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়।
এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে।
শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে।
এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয় বলে মেয়েটির বড় বোন জানান।”

ওপরের বর্ণনা ২২ মে প্রকাশিত খবরের বাছাই করা একটি অংশ। ঘটনাটি হল: কুড়িল বিশ্বরোডে একজন খেটে খাওয়া মানুষ, কর্মজীবি নারী কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হন। এরপরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটি রাষ্ট্র ও সরকার বাহাদুরদের পেটোয়া বাহিনীর কাছে নালিশ নথিভুক্ত করতে যান। ওপরের বর্ণনা থেকে জানা যায় ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিক রাষ্ট্রের আইন শৃংখলা রক্ষার সিস্টেম ও আমলাতন্ত্রে এরপর কি নাজেহাল পোহান।

লক্ষ্যনীয়- পাবলিক স্পেসে, বর্ষবরণ উৎসবে অংশগ্রহণকারী নারীদের ওপর ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের গুন্ডা ও চ্যালাপ্যালাদের যৌন-আক্রমনের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় করা স্বত্তেয় পুলিশ অপরাধী ধরতে সক্রিয় না হয়ে বরং নানারকম তামাশার অবতারণা করেছে। অবশ্য, কবে যে বাংলাদেশ পুলিশ এবং তার সরকার বাহাদুরেরা নারীর নিরাপত্তা সংরক্ষণে সক্রিয় ছিল সেটার খোঁজ ঐতিহাসিকদের রেকর্ডে পাওয়া মুশকিল হবে।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেন যে ক্ষমতাসীন বাহাদুরেরা ধর্ম, আইন, পেটোয়া বাহিনী সব মূলত চালায় তাদের নিজেদের স্বার্থে প্রজা/নাগরিকদের নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য। সমাজবিজ্ঞানী না হয়ে পত্র-পত্রিকার খবরে আমরা আম-জনতারা মন্ত্রী-আমলা-পুলিশ-কর্মকর্তাদের অপকর্মগুলো লক্ষ্য করে আমাদের দুর্দশা বুঝতে পারি। পহেলা বৈশাখের পর যেন আমরা আমাদের দুর্দশাটা আরো ভালভাবে বুঝতে শিখেছি কারণ ‘সুশীল সমাজ’ বলে পরিচিত সমাজের মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন এলিট লেভেলে যারা বসবাস করেন তারা পর্যন্ত দেশের “দিন আনি দিন খাই”-দের মত এখন বলছেন যে বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তারা লক্ষ্য করছেন।

প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় মিডিয়া এই সংস্কৃতিরই ধারক ও বাহক বলেই হয়তো পুলিশের ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিক বিরোধী কীর্তি উল্লিখিত খবরের উপস্থাপনায় গুরুত্ব পায়নি। বরং খবরের বর্ণনায় গুরুত্ব পেয়েছে পুলিশ কি কি দায়িত্ব পালন করেছে সেই বর্ণনা, কুইকরেন্টাল খাতে রাষ্ট্রের রাজস্ব লুটকারী-গার্মেন্টস শ্রমিকদের রক্ত আর লাশের উপর দাঁড়ানো বিজিএমই-এর নেতা এবং ঢাকা-উত্তরের বর্তমান মেয়র আনিসুল হকের পাবলিক রিলেশানের বিষয়টি। আর সংস্কৃতি অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে রিপোর্টার যথারীতি থেকেছেন নিরপেক্ষ। ভাবখানা- ক্ষতিগ্রস্ত কি আসলেই ক্ষতিগ্রস্ত? তার স্বাক্ষ্য প্রমাণ কই? থানার কর্মকর্তাদের অপকর্ম ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজ পেলে হয়তো রিপোর্টার একটি বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট করতে পারতেন। তবে বিচারহীণতার সংস্কৃতি অনুযায়ী ধর্ষণের ফুটেজ পেতেই হয়তো মিডিয়া বেশী আগ্রহী হবে।

ধর্ষণের সিসিটিভ ফুটেজ না পাওয়া গেলেও লেখার মধ্য দিয়ে যতটুকু সম্ভব ধর্ষণের বর্ণনা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবার রেওয়াজ বরাবরের মত এই রিপোর্টেও প্রকাশিত। বর্ণণাগুলোতে রিপোর্টার ধর্ষিত’র পক্ষে দাঁড়ানোর একটা ছদ্মবেশ ধারণ করেন। যেমন, রিপোর্টটা প্রকাশ করা; ধর্ষণ-খুন-জখম তো চলছেই আমাদের সাধারণ জীবনে তাই খবরটা প্রকাশিত হয়েছে বলে হয়তো পুলিশ তাদের জমানো কাজের পাহাড়ের তলায় চাপা পড়া এই কেইসটা নিয়ে ফলোআপ নাইবারের জায়গায় একবার অন্তত করবে। কিন্তু খবর প্রকাশের এই  আপাত মহান কাজের আড়ালে রিপোর্টারদের বর্ণনায় শব্দ এবং ধর্ষণের আসপেক্ট বাছাই আসলে ধর্ষণকে পাঠকদের জন্য ভোগ্যপণ্য বানিয়ে ফেলে, ধারাবাহিকতা বজায় রাখে বিচারহীনতার সংস্কৃতির।

আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাটি খবর করতে গিয়ে যে আসপেক্টটি পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে সেটা হল একজন কর্মজীবি নারী নিরাপদে যে বাড়ি ফিরতে পারেননি সে বিষয়টি। ফলে বাংলাদেশে সাধারণভাবে বিরাজমান নিত্য নৈমিত্তিক নিরাপত্তাহীনতার সাথে এই ঘটনাটাকে সম্পূর্ণ অসম্পর্কিত মনে হয়েছে। সকল মনোযোগ গিয়ে পড়েছে চলন্ত গাড়ীতে ধর্ষণ আসপেক্টটিতে। যেন চলন্ত গাড়ীতে ধর্ষণ আগে কখনো ঘটেনি বা ঘটনাটা বেশ রেয়ার। ধর্ষণ কোথায় কোথায় ঘটে থাকে এটা নিয়ে যে যথেষ্ট গবেষণা রিপোর্টার করেনি এই অজ্ঞানতাই এই শিরোনাম থেকে ধরা পড়ে আর ধরা পড়ে চলন্তগাড়ীতে যৌনসঙ্গম করা নিয়ে সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় সব ফ্যান্টাসীর গণযোগাযোগ। যোগাযোগ হয়নি ধর্ষণের মত একটি নিদারুন অভিজ্ঞতা যার মধ্য দিয়ে একজন আক্রান্ত, বিপর্যস্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতি বা নৈকট্যবোধ তৈরী হতে পারতো।

garo adibashi nari dhorshon

লেখাটি শেষ করবো গারো এথনিসিটির ভিক্টিমহুড নিয়ে যারা রাজনীতি করছেন সেই সব সংগঠকদের প্রতি একই সাথে আমার সংহতি এবং দূরত্ব ঘোষণা করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙালী জাত্যাভিমানকে অপব্যবহার করে গারো, সাঁওতালসহ সমতল ও পাহাড়ের বিভিন্ন জাতকে কোনঠাসা করেছে, তাদের নাগরিক অধিকারের অমর্যাদা করেছে। ১৯৯০ এর পর সারা বিশ্বজুড়ে আদিবাসী আন্দোলনের গতিবেগের সাথে যুক্ত হবার কারণে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান হয়েছে, স্বীকার করি। কিন্তু ধর্ষিত একজন গারো-আদিবাসী এই বিশেষ পরিচয় ব্যানারে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার বিশেষ কোন অর্থ আছে কি?

একজন কর্মজীবি নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে চলাচলের আন্দোলনের সাথে “আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে” এই আন্দোলনের তো বিরোধ নেই। কিন্তু ব্যানারটিতে “কিশোরী” যুক্ত করে আমার গারো বন্ধুরা কিন্তু সংহতি তৈরী করেছেন বাংলাদেশের বিরাজমান পুরুষাধিপত্যবাদী সংস্কৃতির সাথে আর “গারো-আদিবাসী” ব্যবহার করে সংহতি তৈরী করেছেন “আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে” এই আন্দোলনের সাথে। গারো আর বাঙালী উভয় কর্মজীবি নারীই যে পথে-ঘাটে দৈনন্দিন নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন সেই সংহতি এই ব্যানারে অন্তত ধরা পড়ে না।



Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ

Tags: , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: