নাসরিন সিরাজ
“…নয়-দশ বছরের মেয়েটির কাপড় ছেঁড়া, শরীরে মানুষের দাঁতের দাগ। কামড়ে মাংস থেতলে গিয়েছে…দৃষ্টিসীমায় ছিল বহু পুলিশ…ভুভুজেলার তীব্র চিৎকারের ফাঁকে শুনতে পেলাম আশপাশের লোকজন বলছে, ‘ভিডিও কর! এইটা ভিডিও কর’…”
-প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ১৪২২ পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে ঘটে যাওয়া যৌননিপীড়নের ঘটনা।
১৭ মে ২০১৫ খবরে প্রকাশ বাংলাদেশ পুলিশ এবারের পহেলা বৈশাখে যৌননিপীড়নের ঘটনায় আট জনকে আংশিকভাবে সনাক্ত করেছে। এখন পুলিশ জনগণের সাহায্য চাচ্ছে এই আট জনকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে। তথ্য দাতার জন্য পুরষ্কার হিসেবে পুলিশ আট লক্ষ টাকা দান করবে বলেছে। এই সব ঘোষণা যে অপরাধী পাকড়াও করতে পুলিশ বিভাগের ব্যর্থতা ঢাকা দেয়ার কৌশল সেটা বুঝতে এ প্রসঙ্গে মনে করতে পারি ঘটনাস্থল থেকে পাকড়াও করা যৌননিপীড়কদের পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে এবং কেন দিয়েছে তার কোন সদুত্তর এখনো পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জানা যায়নি। অফিসিয়ালি পুলিশ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রথমে জানিয়েছে ঘটনাটি আসলে ঘটেইনি, পরে বলেছে যে বর্ষবরণ উৎসবে যৌননিপীড়নের ঘটনাগুলো আসলে গুটিকয় দুষ্টু ছেলের দুষ্টুমি। এর মধ্যে পুলিশ তাদের আমানত থেকে পাবলিক পরিসরের, উৎসবের সিসিটিভি ফুটেজ দিব্যি হস্তান্তর করেছে একাত্তর টেলিভিশন নামে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন টিভি চ্যানেলকে। তারা যৌননিপীড়নের ঘটনাটি ইসলামিক মিলিট্যান্ট গ্রুপের কারসাজি এরকম একটা অপপ্রচার চালিয়েছে একটা সময়। এর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের যৌননিপীড়ন বিরোধী কর্মসূচী- ডিএমপি ঘেরাও- এ বর্বর হামলা চালানো হয়েছে। কিভাবে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর পুলিশের এন্টি রায়ট গাড়ি তুলে দেয়া হয়েছে, জল-কামান ব্যবহার করা হয়েছে এবং ছাত্রী-ছাত্রদের নির্যাতন করা হয়েছে সেটা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অর্থাৎ, যৌননিপীড়কদের পাকড়াও করার বদলে তাদের রক্ষা করার এবং তাদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য যথেষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্নতা তৈরীর কাজটি পুলিশ বিভাগ নিষ্ঠার সাথে করে এসেছে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের প্রকৃত দায়িত্ব যে ক্ষমতাসীনদের পা-চাটা নয় বরং যৌননিপীড়কদের পাকড়াও করে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা এই দাবী থেকে আমরা সরে আসিনি।
কিন্তু যথেষ্ট অন্ধকার তো তৈরী হয়েছে, এ অন্ধকারে কিভাবে যৌননিপীড়ককে চিনবো? এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই “যৌননিপীড়ন ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকল্প” লেখাটির কথা। লেখাটিতে আমি বলেছি যে পহেলা বৈশাখের ঘটনায় আবার দৃশ্যমান হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি হালে বিরাজমান। রাষ্ট্র শাসনে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করা, তাদের সারাক্ষণ একটি আতংক আর অনিশ্চয়তা/অস্থিরতার মধ্যে রাখা এই রাষ্ট্রের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অনেক হতাশাবাদী আহাজারি করেন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করি। “জাতীয় কমিটি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে” লেখায় নৃবিজ্ঞানী ও আফ্রিকা বিশেষজ্ঞ জেমস ফার্গুসনের তত্ত্ব ধার করে আমি বলেছি যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সফল একটি রাষ্ট্র। আর তার সফলতা বুঝতে আপনার নজর দিতে হবে এর আমলা-মন্ত্রীদের দিকে যারা সকলে মিলেমিশে জনগণের স্বার্থের বদলে ট্রান্সন্যাশনাল পুঁজির স্বার্থ দেখতে নিজেদের পুরোপুরি নিয়োজিত রেখেছে, রাষ্ট্রের সেবাখাত তুলে দিয়েছে এনজিও/প্রাইভেট উদ্যোক্তাদের হাতে। সম্প্রতি সুন্দরবন ধ্বংস নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার যেভাবে এগুচ্ছে তাতে তাদের সফলতা (বা গণবিরোধী কর্মযজ্ঞ) আমাদের আবারো নজরে পড়ছে।
ওপরের আলোচনা থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গণবিরোধী ক্ষমতা চর্চার যে আলামত দেখা যায় সেটা বেশ ভীতিকর। ভীতিটা অবশ্য শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যেই খেয়াল করেছি আমি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার বেশীরভাগ মানুষকেই যেহেতু শিক্ষা-দীক্ষা পরিষেবার আওতায় আনতে পারেনি তাই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ “দিন আনি দিন খাই” মানুষের মধ্যে একধরণের এনার্কি বিরাজমান আছে বলে লক্ষ্য করা যায়। এর আলামত আমরা পাই যখন দেখা যায় গ্রামবাসী দ্বারা পুলিশ প্রহার বা দৌড়ানির শিকার হয়, অথবা মহামাণ্য আদালতের অবমাননা হবে কি হবে না তার তোয়াক্কা না করে যে কোন দিনমজুর বলে বসে- “দেশে কোন বিচার নাই”। কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্ত এতোই সিস্টেম্যাটিক যে তারা রাষ্ট্র ও তার প্রচার মাধ্যমের তৈরী অন্ধকারে বিভ্রান্ত হবার জন্যই যেন অপেক্ষা করে থাকে। এবং আমার ধারণা রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী দানবীয় ক্ষমতার প্রতি তাদের ভীতিটাকে আড়াল করতেই তারা এই বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত হয়। এবং তখন তারা এলোপাথাড়ি হাত পা চালাতে শুরু করে।
রাষ্ট্র ও তার প্রচার যন্ত্রের তৈরী অন্ধকারে ইচ্ছে করে পড়ে গিয়ে যৌননিপীড়ককে না চেনার এই যে মধ্যবিত্তীয় ভ্রান্তি তার উপযুক্ত উদাহরণ: ১. যৌননিপীড়নকারীদের হাতে নাতে ধরে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলার পরামর্শ। এই পরামর্শ প্রচার আমার নজরে পড়েছে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি অপ-এডে। একই পরামর্শ অনেকে শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। ২. একটি সমাজে কিভাবে যৌননিপীড়ন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে সেটা বিচার বিবেচনা না করে “এবার নেমে পড়বো পুরুষাঙ্গ কর্তনে” টাইপ এন্টি-ফেমিনিস্ট অবস্থান ৩. যৌননিপীড়নকারীকে আইনের আওতায় না আনতে পারার ব্যর্থতা ঢাকতে ফেসবুকে অভিযুক্তদের ছবি প্রচারণা করে সামাজিকভাবে হেনস্থার পরামর্শ।
বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেভাবে অব্যাহত আছে তাতে মনে হতে পারে যে উপরের উদাহরণগুলো বুঝি ন্যায়-বিচার প্রত্যাশীদের হাহাকার/হতাশার বহি:প্রকাশ। আমি সেটা মনে করি না। কারণ, বাংলাদেশের “দিন আনি দিন খাই” মানুষ যারা, যাদের আমি এনার্কিস্ট বলে একটু আগেই বিশ্লেষণ করেছি, যাদের কাছে “দেশে বিচার নাই” বোঝা হয়ে গেছে অনেক দশক হল তাদের তো এই হতাশায় পর্যবসিত হতে দেখি না। রানা প্লাজায় অফিসিয়ালি ১২০০ শ্রমিক নিহত হয়েছেন, আহত/নিহত শ্রমিকদের সব আত্মীয়-স্বজন মিলেও যদি গুলশানের গার্মেন্টস মালিকদের বাড়ি ঘেরাও করে তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে উদ্যত হয় ঠেকাতে পারবে কেউ? অথবা শহরের হাজার হাজার বাস্তুহারা মানুষ যদি সীজ করে কাঁচ ঘেরা সব খাবারের দোকান, শপিং মল, পারবে রাষ্ট্রের সব লাঠিয়াল বাহিনী একযোগ হয়ে বাঁচাতে মধ্যবিত্তীয় এই আরাম আয়েশ? অথবা যে মেয়েগুলো যৌনআক্রমনের শিকার হয়েছে টিএসসিতে বা কুড়িল বিশ্বরোডে তারা কি রক্ত পান করতে চায় কারো? জিজ্ঞেস করেছেন কখনও? ভীত কি তারা? বরং “দিন আনি দিন খাই” সাধারণ মানুষের ন্যায়-অন্যায় বিচার বোধ খুব টনটনে। আর পেটি-ক্যাপিটালিস্ট বা মধ্যবিত্ত, যারা সকল আরাম আয়েশের মধ্যে আছে তারাই ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান হারিয়ে দিশেহারা।
সম্প্রতি যমুনা ফিউচার পার্কের একজন কর্মজীবী নারী বাড়ি ফিরতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হলে র্যাব দেখলাম পাঁচজনের বদলে দুজন ধর্ষণকারী ধরেছে। পুলিশের বদলে র্যাব কেন ধর্ষণকারী ধরছে?- শিক্ষিত সমাজ, তথা সাংবাদিকরা নির্বিকার। আর র্যাব কাউকে তাদের হেফাজতে আনলে বুকে নাম-অন্যায় লিখে প্রচারমাধ্যমে বিলি করা এটা দেশের আইনে কি বৈধ?-প্রশ্ন আমার। একজন সাংবাদিককে এই প্রশ্ন করলে তিনি আমাকে উল্টো ধমক দিলেন- “আপনি কি বিদেশ থাকেন না কি! এটাই তো ওরা সবসময় করছে, এতে অবাক হবার কি আছে! আর ধর্ষকদের সামাজিক হেনস্থা একদম ঠিক আছে”। তার ধমকে আমার র্যাব-এর ক্ষমতা অপব্যবহার নিয়ে তৈরী ফিয়ার ফোর্স এন্ড ফেব্রিকেশন ছবিটির কথা মনে পড়ে আমার। স্রেফ মিডিয়াতে এ্যাটেনশান পাবার জন্য র্যাব কিভাবে একটা ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে তার একটি ভাল নমুনা দেখিয়েছে চলচ্চিত্রটি।
ধীর ও দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া আমাদের দেশের, তারউপর আইনজীবীরা নিজেরাই মক্কেলের পকেট কাটার জন্য মামলার গতি ধীর করে ফেলে-বলছেন আমাদের প্রধান বিচারপতি। তার মানে র্যাব-পুলিশ-প্রশাসন মিলে অভিযুক্তদের কাছ থেকে ম্যালা ম্যালা টাকাকড়ি হাতাবে, নির্যাতিত নারীটি ন্যায় বিচার পাবে কি না সেই গুড়ে বালি আর অদূর ভবিষ্যতে দেশের যৌননিপীড়নের সংস্কৃতি পাল্টাবে না সেটাও পরিষ্কার। তাহলে কি এটাই মনে হয় না যে শহুরে মধ্যবিত্ত ইচ্ছে করেই চোখে ঠুলি পরে বসে আছে? চোখের ঠুলিটি সরালেই হয়তো যৌননিপীড়নকারী তৈরীর এবং তাকে টিকিয়ে রাখার নেটওয়ার্কটি চোখে পড়বে।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
Leave a Reply