কাকে বলি প্রাকৃতিক, কাকে বলি স্বাভাবিক?

কাকে বলি প্রাকৃতিক, কাকে বলি স্বাভাবিক?

 আলোকচিত্র সুত্র: buzzfeed.com

আলোকচিত্র সুত্র: buzzfeed.com

আহমেদ শামীম, অতিথি ব্লগার

ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক কথাটা আমরা ব্যবহার করি খুব। মূল অর্থে, প্রকৃতিতে মানুষের যোগসাজস ছাড়া যা ঘটে বা অস্তিত্বশীল থাকে তা প্রাকৃতিক বলে জ্ঞান করি; যেমন, প্রাকৃতিক দৃশ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। মানুষ যে সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে তা প্রকৃতির বিপরীত অর্থে ব্যবহার করা হয় ঠিকই, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিকে আমরা কেউই অপ্রাকৃত, অতিপ্রাকৃত, অপ্রকৃতস্থ ইত্যাদি বলি না। কারণ হয়ত, মানব প্রকৃতি নামে একটা কিছু আমরা ধারণা করে নিয়েছি; মানব প্রকৃতি নিছক প্রকৃতির এক বিশেষ অংশ; ফলে, মানব প্রকৃতির বাবদে সংস্কৃতি আদতে প্রকৃতস্থই। আবার, মানুষ মানব প্রকৃতির সীমা কোথায় মানুষ তা জানে না। সেখানে মানুষের অমিত সম্ভাবনা। কিন্তু মানুষ তার সংস্কৃতিকে জানে; অন্য কথায়, মানব প্রকৃতির যেটুকু সম্পর্কে মানুষ চেতন তার নাম দিয়েছে সংস্কৃতি। এখন আমাদের সংস্কৃতির নিয়ে আমরা সবসময় সুখী না। আমরা চাই প্রাকৃতিক হতে; অর্থাৎ অচেতন হতে; আমাদের ধারণা প্রাকৃতিক হলে আমাদের দুঃখ দূর হয়ে যাবে। কিন্তু অচেতন আর মানুষ দুই বিপরীত চিজ। ফলে প্রাকৃতিক হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব না; আমাদের মুক্তি সংস্কৃতির মাধ্যমেই আসবে। আমাদের কাজ হবে আমাদের সংস্কৃতি প্রকৃতির সঙ্গে যাতে সাংঘর্ষিক না হয় তার চেষ্টা জারি রাখা; আর সেই আলোকে মানব প্রকৃতির দিগন্ত উন্মোচন করা। এই কাজটির কত জটিল এবং এর জন্য কতটা সংবেদনশীল আমাদের হওয়া দরকার, তার একটা আবছা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি এই লেখায়।

দেখা যাচ্ছে, চেতনা দিয়েই আমরা সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মধ্যে এখন বিভাজন করি। চেতন বা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে কি নাই তা নিয়ে অনেক তর্ক আছে, থাকবে। তবে, যে চেতন সে পছন্দ করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে, এটা নিয়ে তর্ক দেখা যায় না। এখন সেই পছন্দটি প্ররোচনা পায় সে কোথা থেকে? মানব প্রকৃতি থেকে না নিছক প্রকৃতি থেকে- এই প্রশ্ন অবান্তর, কেননা কোথায় মানব প্রকৃতির শেষ আর কোথায় নিছক প্রকৃতির শুরু তা মানুষ এখনও জানে না। তাই প্রশ্নটি হতে পারে, সেই পছন্দটি প্ররোচনা পায় কোথা থেকে- নিছক প্রকৃতি থেকে না সংস্কৃতি থেকে? উত্তর সহজ, দুই জায়গা থেকেই আসে। তবে, আমাদের একটা ধারণা হল, আমাদের পছন্দের পেছনে প্রণোদনা তা নিছক প্রকৃতি থেকেই আসা ভাল। কেন ভালো? কারণ আমাদের সংস্কৃতি আমাদের মনদৈহিক ও আধ্যাত্মিক সুখ দিতে সক্ষম হচ্ছে না, বরং যা ছিল, যা আছে তাও কেড়ে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের অভিধান মতে প্রাকৃতিকতো সাংস্কৃতিকের বাইরে সবি। তো, কোথায় আমরা হাত বাড়াবো?

প্রকৃতিতে যত কিছু ঘটে তা নির্বিচারে মানুষ গ্রহণ করে না। ফলে মানুষ যখন প্রাকৃতিক হতে চায়, সে বাছবিচার করা প্রাকৃতিক হতে চায়। প্রায়শই দেখা যায়, মানবের জন্য মঙ্গলজনক বিষয়গুলোই প্রকৃতিতে থেকে মানুষ বেছে নেয়। মানুষ ভিগান হবে, নিরামিষাশী হবে, না মাংসাশী হবে এটা তার পছন্দ, সেই পছন্দে পরিস্থিতির যোগসাজশ থাকতে পারে বই কি; কিন্তু সেটা মানুষ হিসেবে তার বিবেচনাপ্রসূত পছন্দ। গরু, গাছ, মাছ, বাতাস বা বাঘ সেই বিচার ব্যবহার করতে পারে না। ফলে, মানুষ যে প্রাকৃতিক হতে চায়, তা নিছক প্রকৃতির প্রাকৃতিক নয়, বরং সেই প্রকৃতিকে সংস্কৃতির সাপেক্ষে মানব প্রকৃতির একটা সচেতন নির্মাণ মনে হয়। সেখানে আরেক সমস্যার জন্ম। অচেতন বা অজ্ঞান একই সমতলে দাঁড়িয়ে; কিন্তু চেতনের মাত্রাভেদ, স্তরভেদ আর বৈচিত্র্য আছে। চেতনের একচিত্র আরেক চিত্রকে পছন্দ নাও করতে পারে। এক স্তর আরেক স্তরকে উঁচু বাঁ নিচু বলে মূল্যায়ন করতে পারে। মোদ্দা কথা হল, যে যার প্রাকৃতিককে নির্মাণ করে নেয়, আর অন্যের প্রাকৃতিককে নির্মিত বলে গালাগাল দেয়।

এখন, নির্মিত যে প্রাকৃতিক তাতো সাংস্কৃতিকই। তাই সাংস্কৃতিককে অশুদ্ধ আর প্রাকৃতিককে বিশুদ্ধ বলার জায়গা থাকে না। উদাহরণ দেয়া যাক সমকামিতা নিয়ে। মানুষের মধ্যে সমকামিতাকে অশুদ্ধ বলা আর প্রকৃতির অন্যান্য জীবের সমকামিতাকে শুদ্ধ জ্ঞান করা আসলে তাহলে প্রাকৃতিক কিছু নয়, বরং মানুষেরই নির্মাণ। এখন গোত্র-গোষ্ঠী বলি, ধর্মসমাজ বলি কিংবা রাজনৈতিক সমাজই বলি সংখ্যাগুরু হওয়া তার সার্ভাইবালের একটা উপায়; ফলে ধর্মছাড়াও সমাজেও সমকামিতার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে, সমকামিতা সরাসরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে না বলে। নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে একাধিক কারণে। যেমন ঈর্ষাকাতর বিষমকামীবর্গ যারা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতা রাখেন, সমাজের হর্তাকর্তা হন, বংশরক্ষার জন্য মাথা ঘামান, তারা ভাবতেই পারেন, সমকামীরা সমাজের সাংখ্যিক শক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে না (গুণগত শক্তিতে অবদান রাখছে, কিন্তু সেটা তাদের বিবেচনায় আসছে না)। ফলে, সমকামীদের আলাদা করে দেখছেন তারা। এগুলো অনুমানমাত্র, তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, সে কারণগুলো সাংস্কৃতিক। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা না থাকাই বরং নিছক প্রাকৃতিক। মানুষ সমকামিতার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কোন না কোন ছক সাপেক্ষে।

তো, প্রাকৃতিকের সঙ্গে আরেকটি শব্দ ব্যবহার হয়, তাহল স্বাভাবিক। স্বাভাবিক কথাটা স্বভাব থেকে আসা। কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা স্বাভাবিক না তা জানতে হলে জানতে হয় যার জন্য প্রযোজ্য কথাটা তার স্বভাব কী। হায়েনার যা স্বভাব, যা স্বাভাবিক গরুর তা না। এখন মানুষের স্বভাব পরিমাপ করার মত জ্ঞান মানুষ খুঁজে চলছে এখনো। এরা চেতন তাই, সেই একই সমস্যা। সবাইকে একসূত্রে গাঁথা যাবে না। এমন অনেক বিষয় আছে, থাকবে, যা একজনের জন্য স্বাভাবিক, অন্য জনের জন্য তা স্বাভাবিক হবে না। যার যার স্বভাব অনুসারে তার তার স্বাভাবিক বিবেচ্য। মানুষের গড় স্বভাব নির্ণয় করে, তার বাইরে সবাইকে অস্বাভাবিক দাগানো আধিপত্যবাদী, নিপীড়নমূলক হতে বাধ্য। আমরা নিশ্চয়ই যে মানব প্রকৃতিটি নির্ণয় করতে চাই তাতে আধিপত্য আর নিপীড়নকে জায়গা দিতে চাই না। আমরা চাই যার যে প্রকৃতি বা স্বভাব সে অনুযায়ী সে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক- এই মন্ত্রে সমাজ গঠন করতে। এই জন্য আমাদের স্ব-ভাব বোঝার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন মনীষীগণ। বস্তুর স্ব-ভাব ই বস্তুর ধর্ম। ব্যক্তির বেলায়ও তাই; কেবল তা খুঁজে বের করতে হবে। এই সন্ধান সহজকর্ম নয়, সকল সংবেদন সজীব রাখুন, তাতে যদি কিছু হয়। আলেক সাঁই।



Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , ,

1 reply

  1. ‘Amra Ki Etoi Bhinno… Are we so different’ is a documentary film on Bangladeshi Hijra, Gay and Bisexual community. It was awarded the ‘The Best Documentary Short Film 2012’ at “Kashish 2012– 3rd Mumbai International Queer Film Festival”, India’s (and South Asia’s) biggest Queer Film Festival. Kashish 2012 was held from May 23 to May 27, 2012 in Mumbai, India, and featured 120 films from 30 countries.

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: