চলুন রংধনুর কারিগর হই….

আনমনা প্রিয়দর্শিনী

জাবিতে পড়ার সময় আমার খুব প্রিয় এক শিক্ষক বলেছিলেন যে “আমাদের মাঝে এত ভেদাভেদের একটা বড় কারণ হলো যা কিছু অন্য, যা কিছু ভিন্ন, তা আমাদের কাছে খুব ভয়ের, ঘৃণার একটা বিষয়।” নৃবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী হিসাবে আমার মাথার ওপর দিয়ে কথাটা চলে গেছিল। এর পর বহু বছর পেরিয়ে গেছে, এখন প্রায়ই আমার সেই শিক্ষকের কথাটা মনে পড়ে যায়….আসলেই ভিন্নতার প্রতি আমাদের একটা চরম ঘৃনা, বিরক্তি, ভয় আছে… আমরা শুধু ভিন্নতাকে ভয়-ই পাই না, যা কিছু ভিন্ন তার গায়ে ‘খারাপ,’ ‘অনগ্রসর,’ ‘গোড়া,’ ‘মৌলবাদী,’ ‘কাফের’ ইত্যাকার তকমা লাগাই। আমি যা তার সবটাই যেন শ্রেষ্ঠ, এবং আমি যা করি সেটাই যেন একমাত্র জীবন পন্থা। ..এর বাইরে সব কিছুই যেন ভীষণ খারাপ “ছি: ছি:” টাইপ এর বিষয়। এই চর্চা ঘর থেকে শুরু করে, অফিস, আদালত, বাজার, ঘাট, সাহিত্য, শিল্প চর্চা সব কিছুর মধ্যে আছে। যে শুটকি খায় না সে শুটকি খাওয়া মানুষ দেখলে নাক সিটকায়, আবার যে শুটকি ভুনা খায় সে শুটকির ঝোল দেখে বমির ভান করে। যে বোরখা পড়ে সে হয়তো খোলা হাতা জামার মেয়ে দেখে চোখ উল্টায়, আবার যেই ছেলে নাইকির কেডস আর হাফ প্যান্ট পরে সে টুপি দাড়ি পরা মানুষ দেখলেই ভাবে এই বেটা ‘অশিক্ষিত গোড়া।’ মাদ্রাসার ছেলে দেখলেই আমাদের ‘প্রগতিশীল’ মধ্যবিত্ত মন ভাবে “দেশটা আফগানিস্তান হয়ে যাবে,’ আবার “নাস্তিক” বলে পরিচয় দিলেই একদল ‘আস্তিক’ ভাবে এরে কোপানো দরকার।

ybJrDA0

ভিন্নতার প্রতি আমাদের এই ভীত-সন্ত্রস্ত, আগ্রাসী আচরণ বহাল রয়েছে সমকামী বিবাহ ইস্যুর ক্ষেত্রেও। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট নারী-পুরুষ গলা ফুলিয়ে, জিভ কামড় দিয়ে, ধর্ম, পরিবার, প্রো-ক্রিয়েশান, এইডস, সামাজিক অনুশাসনের অজুহাত দিয়ে সমকামী পরিচিতি ও বিবাহ অধিকারের বিপরীতে কথা বলে যাচ্ছে। আমার ফেস-বুক ভেসে গেছে রংধনুর রঙ্গে, সেই সঙ্গে সমকামী-বিদ্বেষী কথা বার্তায়। কেউ কেউ সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে যা লিখেছেন তা না লিখলেই বরং বেশি ভালো হতো, কেউ কেউ আবার খুব সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন, তাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। আমার প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট হচ্ছিল মানুষের এত ঘৃনা, রাগ দেখে। কিন্তু পরে রংধনুর বিরোধিতাকারীদের জন্য একটু মায়াই হলো। দোষ আসলে কোনো ব্যক্তির না, দোষ আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার। সারা জীবন পরিবার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যা কিছু অন্য, ভিন্ন, তাকে ঘৃনা করতে, ছোট করে দেখতে শিখি, আর নিজেকে, নিজের ধর্ম, নিজের বিশ্বাস, যৌন চর্চাকে দেখি একমাত্র ‘আদর্শ’ হিসেবে ।

সমাজ বই-এ ইসলাম হয়ে ওঠে জাতীয় ধর্ম, ঈদ, রোজা, নামাজ হয়ে ওঠে ‘স্বভাবিক’ এবং একমাত্র উৎসব, নিয়ম, ধর্মীয় আচার-নিষ্ঠার বিষয়। বিপরীতে, মন্দির, প্যাগডা, পূজা হচ্ছে ব্যাতিক্রম, ভিন্ন কিছু। বাঙালির বিপরীতে আদিবাসী হয়ে ওঠে ‘অন্য,’ ‘অনগ্রসর,’ ‘অনুন্নত’ । মনে পেড়ে যে কোনো একটা বই এ ‘হিজড়া’ দের উপস্থাপন করা হয়েছিল ‘ত্রুটি’যুক্ত ‘অপূর্ণ’ মানুষ হিসেবে। সমকামীদের নিয়ে তো কোনো লেখাই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে বিবাহ বলতেই বোঝানো হয় এক নারী-এক পুরুষের বন্ধন। বিবাহের শুধু একটা প্রয়োজনকেই সামনে আনা হয় – সন্তান জন্মদান। বাজার, পুঁজিবাদ, রাষ্ট্র কিভাবে নারী-পুরুষের একক পরিবারকে আদল দেয় সেই গল্প হাপিস হয়ে যায় প্রো-ক্রিয়েশন এর প্রলাপে।

যত দিন না আমরা আমাদের পাঠ্য-পুস্তকে ‘ভিন্নতাকে’ কোনো একটা আদর্শ নিয়ম, নীতি, পরিচিতি, চর্চা- এর ‘বিপরীত কিছু হিসেবে উপস্থাপন করা বন্ধ করছি, মানুষজনকে sex, gender, sexual orientation সহ আরো নানা পরিচিতি ও চর্চার সঠিক তথ্য দিতে পারছি, যতদিন না আমরা ভিন্নতার মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছি ততদিন হয়ত আমাদের ভিন্নতা নিয়ে ঘৃনা, ভয় থেকেই যাবে। তাই চলুন নতুন এক শিক্ষা ব্যাবস্থার দাবি জানাই, নতুন কারীকুলাম তৈরী করি, যার যা যোগাযোগ আছে তাকে কাজে লাগিয়ে একে বাস্তবায়ন করি। যতদিন তা না পারছি ততদিন নিজের পরিবার, কর্মক্ষেত্র, খেলার মাঠ, আড্ডাস্থল হয়ে উঠুক ‘ভিন্নতাকে’ জানার, ভালবাসার ক্ষেত্র। আপনার, আমার মধ্যে মতের, বিশ্বাসের, চর্চার, রঙের ভিন্নতা থাকতে পারে।..কিন্তু সম্পর্কটা যাতে হয় ভালবাসা, সমতার। রংধনু একদিন উঠবেই, কিন্তু তার আগে চলুন রংধনুর কারিগর হই।

পিএইচডি শিক্ষার্থী ইউনিভিার্সটি অব পিটসবার্গ, ইউ এস এ।



Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , ,

1 reply

  1. যারা রংধুনুর কারিগর হতে আগ্রহী, বোধ করি তারা সমতাবাদী সমাজ গঠন কল্পে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভিন্নতাকে অন্তর্ভূক্ত করে নিতেই আগ্রহী। কিন্তু, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফাঁক গলে যদি এমন চিন্তা, মতবাদ অথবা চর্চা ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে যেটা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা করার ক্ষেত্রেই হুমকির কারন হয়ে দাঁড়ায় তবে সেক্ষেত্রে কী অনুদার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে না? তাই প্রশ্ন থেকেই যায় যে রংধনুর সব রঙই কী উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অনুকুল হিসাবে আমন্ত্রিত হতে পারে, হয়?

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: