ওরা ৭২-জন

Photo: Pallab Chakma

Photo: Pallab Chakma

পল্লব চাকমা

১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলন সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়।শুরু হয় ব্যাপক সামরিকায়ন। সাথে চলে বহিরাগত বাঙ্গালি পূনর্বাসন। পুরোদমে চলতে থাকে ভূমি বেদখল, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, নির্যাতন! রাজনীতির নির্মম কূটচালে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত দংশনে সারা পার্বত্য সবুজ চট্টলা হয়ে উঠে বিবর্ন বিধ্বস্ত এক জনপদ। প্রতিহিংসার রোষানলেপুড়ে যায় আদাম! পুড়ে যায় দেবালয়!পুড়ে যায় পাহাড়ি শিশুর ‘আদর্শ ধারাপাত’ ‘আদি বাল্যশিক্ষা’ সব।

১৯৮০’র দশকে এই হামলা, হত্যা, নির্যাতন, জ্বালাও পোড়াও আরো বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে।বাপ-দাদার ভিটা-মাটি ছেড়ে শুরু হয় প্রাণভয়ে পাহাড়ি মানুষের পলায়ন, বনে-বাদাড়ে তাদেরউদ্ভাস্তু জীবন। কেউ ফেলে যায় নিজেদের সাজানো সুখের সংসার, শান বাঁধানো পুকুরঘাট, সত্যিকারের ‘গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু’।পড়ে থাকে চেঙ্গে-মেয়োনী নদী তীরের অবারিত সবুজ ফসলী জমি, পাকা ধান ক্ষেত।নিথর পড়ে থাকে গেংহুলির অর্ধদগ্ধ বেহালা, বাঁশি। দূর দিগন্তে কাল ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

এরপর জীবন নিয়ে কেবল ছুটে চলা আর চলা। দিনে-রাতে পায়ে হেঁটে পাহাড় ভাঙা। জংলী পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া। একটা নিরাপদ জায়গায় নিরাপত্তা খোঁজা। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাতের অন্ধকারে নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সবাইকে নিয়ে বিপদ সংকুল কঠিন সেইযাত্রা। যাত্রাপথে ক্ষিধার জ্বালায় অবুঝ শিশুর কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, ডায়রিয়া আক্রান্ত বৃদ্ধ দাদু-নানু’র পরপারে চলে যাওয়া কিংবা পরিচিত স্বজনের অসহায় মৃত্যু ছিল নিত্যদিনের দেখা ঘটনা। দিন যায় রাত আসে। থেমে থাকেনা পথ চলা। এভাবেই কমে আসে পথের দূরত্ব। সেই সাথে দিনে দিনে কমে আসে পরিবারের সদস্য সংখ্যাও!

আপন বসতভিটা হারানোর বেদনা, বর্ননাতীত কষ্ট আর প্রিয়জন হারানোর শোক বুকে নিয়ে হাজার হাজার পাহাড়ি মানুষ এভাবেই পাড়ি দেয় সীমান্ত, হয়ে যায় শরনার্থী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের থাকুম বাড়ি, খরবুক, পঞ্চরাম, শিলেছড়ি, লেবাছড়া প্রভৃতি শিবিরে আশ্রয় হয় এই অসহায় উদ্ভাস্তু মানুষের। ভিন দেশে প্রতিকূল পরিবেশে শুরু হয় তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

এই পরিস্থিতিতে শিশুদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে সংকটাপন্ন।

একদিকে খাদ্যাভাব অন্যদিকে নানান রোগ, মহামারি। রিফিউজি ক্যাম্পে বাড়তে থাকে শিশু মৃত্যু!সমানতালে বাড়ে অসহায় বাবা-মায়ের আহাজারি! শিবিরের এক কোনায় কান্নার রোল শেষ হতে না হতে আরো ২/৩ জায়গা থেকে ভেসে আসে স্বজন হারানোর আর্তনাদ। কী করুন সেই দিন!

দিঘীনালার বোয়ালখালীতে ছিল এক অনাথ আশ্রম। কয়েকজন মানব হিতৈষী বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা পায় অনাথ ছিন্নমূল অসহায় শিশুদের বিদ্যাশিক্ষার এই আশ্রয়স্থল। কিন্তু অসহায় শিশুদের এই আশ্রমও আক্রান্ত হয় সেই উত্তাল দিনগুলিতে। অনাথ শিশুরাও বাধ্য হয় সীমান্ত পাড়ি দিতে। তারা কেউ মামা-কাকার সাথে, কেউ গ্রামের দূর সম্পর্কীয় আত্ত্বীয়ের সাথে, কেউবা অপরিচিত মানুষের সাথে চলে আসে ত্রিপুরার শরনার্থী শিবিরে। তাদের কয়েকজন মারাও যায় পথিমধ্যে।

১৯৮৭ সালে মানবতাবাদী কয়েকজন ব্যক্তির বদান্যতায়,বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় বিমল তিষ্য ভিক্ষুর প্রচেষ্ঠা শরনার্থী শিবির থেকে ৭২ জন পাহাড়ী শিশু পাড়ি জমায় ফরাসী দেশে। তাদের অধিকাংশ ছিল বোয়ালখালীর অনাথ আশ্রমের শিশু।

যে বয়সে বনে-বাদাড়ে ঘুরে ‘বাদোল’ হাতে পাখি শিকার করার কথা, ‘থুম্মুক’ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার ছলে পুরো ‘আদাম’ মাতিয়ে রাখার কথা, কিংবা বাবা-মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে সদলবলে চিগোন ছড়ার ‘মাছ-কাঙ্গারা’ ধরতে যাওয়ার কথা! সেই বয়সেই তারা শরনার্থী জীবনের চরম দূর্বিসহ দিন কাটিয়েছে। দিনের পর দিন অনাহারে, অর্ধাহারে থেকেছে। প্রিয় স্বজনের মৃত্যুর মিছিল দেখেছে, দেখেছে ‘টাংগোন-হানি’ উড়ানো! সেই ছোট্ট বয়সেই তারা জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। তারা দেখেছে হিংসার আগুন, প্রতিহিংসার নৃশংসতা। দেখেছে অসহায় মানুষের বুক ভাঙা কান্না।

যে বয়সে বাবার ভালবাসায়, মায়ের মমতায় কিংবা আজু-নানুর ‘পজ্জন’ শুনার নেশায় বিভোর থাকার কথা, সেই বয়সেই তারা ভালবাসার সকল বন্ধন তুচ্ছ করে হাজারো অজানা শঙ্কা নিয়ে দুরু দুরু বুকে ফরাসী বিমানের সিঁড়ি ধরেছিল। তাদের সবার একটাই স্বপ্ন ‘নতুন একটা জীবন’ পাওয়া।

হয়তো বিমান যখন আকাশে উড়ছিল কেউ কেউ অঝোরে কেঁদেছে প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের জন্য, কেউ মলিন মূখে মায়ের কথা মনে করেছে, কেউবা গুমরে কেঁদেছে বাবার জন্য। আবার কেউ হয়তো নিরবে চোখের জল ফেলেছে শিবিরে বিনা সিকিতসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া আশ্রমের প্রিয় বন্ধুর জন্য। হয়তো কল্পনা করেছে এই স্বপ্ন-যাত্রায় সে যদি পাশে থাকতো!

সেই ৭২ জন পাহাড়ি ‘দেবশিশু’র কথা আমি অনেক শুনেছি, কয়েকবার কাগজেও পড়েছি। বিমান থেকে নেমে তারা তাদের দত্তক বাবা-মা’র হাত ধরে চলে গেছে ফরাসী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সেখানে তারা নতুন পরিবেশে লেখাপড়া করেছে, বেড়ে উঠেছে। তারা এখন আর কেউ শিশু নেই। ‘নতুন জীবনে’ তাঁরা এখন কারো বাবা, কারো স্বামী। কেউ কেউ নামের সাথে জুড়ে দিয়েছেন সাহেবি নাম ডেভিড, মাইকেল কিন্তু বাবা-মায়ের দেয়া ‘কালাধন’ ‘লক্ষ্মীমণি’ ‘সুরেশ’ ‘শান্তি লাল’ এখনো রেখেছেন। যান্ত্রিক জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু সময় পেলেই তাঁরা সবাই একত্র হন স্বপরিবারে, কিছু সময় কাটিয়ে দেন একসাথে গল্পে, আড্ডায় কিংবা নিজেদের খেলাধুলায়। সাথে নিজেদের শিখড়ের কথা বলতেও ভু্লেন না।

ফান্সের ছোট্ট এক শহরে কয়েকদিন আগে তেমনি এক মিলন মেলায় দেখা হল তাঁদের ১৫/২০ জনের সাথে স্বপরিবারে। আমাদের কাছে পেয়েও তাঁরা জুড়ে দিলেন হিল চাদিগাং এর কথা।তাঁদের জীবন বদলে দেয়া ফরাসী বিমানের স্বপ্ন যাত্রার সৃতি রোমন্থন করলেন দুয়েকজন। আমি মনযোগী শ্রোতা হয়ে শুনে যাই তাদের অল্প অল্প জীবনের গল্প! পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন কেউ কেউ। আবার অনেকে আশাবাদী হয়ে বললেন আমাদের সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে আমাদের সবার জন্য, শান্তির জন্য।

তবে তাঁদের আন্তরিক আথিতেয়তা ছাপিয়ে আমার মনে দাগ কেটে থাকলো এত দীর্ঘ বছর পর তাঁদের মূখে শোনা চাকমা ভাষা– ‘ভেইবো, হোমলে এচ্চো?’[ভাই, কবে আসলেন?] … ‘এধক হি হম সময় লইনেই ইচ্চো’ [কেন এত কম সময় নিয়ে কেন আসলেন] … ‘আরো বেড়েয়োগি’[আবার আসবেন বেড়াতে] – কথাগুলো শুনে মনে হয়েছে তাঁরা আমার কত দীর্ঘ দিনের পরিচিত, আমার কত আপন!

 

* এই লেখায় উল্লেখিত কয়েকটি চাকমা শব্দের অর্থঃ বাদোল – বাঁশ ও বেতের তৈরি ধনুক; থুম্মুক – বাঁশের তৈরি খেলনা অস্ত্র; পজ্জন – রূপকথা।



Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: