নাসরিন সিরাজ
বায়স্কোপটি প্রদর্শনী শেষ হলে চলচ্চিত্রকার যখন দর্শকদের জানালেন যে রাগধা আমাদের মাঝে আজ উপস্থিত আছে সাথে সাথে সিনেমা হলটিতে যেন আনন্দের তরঙ্গ বয়ে গেল। রাগধা মঞ্চে উঠলো তুমুল করতালির বৃষ্টির মধ্যে। ছবি নির্মাতার সাফল্য হয়তো সেটিই যে তিনি রাগধার মত শক্তিশালী একটা চরিত্রের ওপর হামলে না পড়ে ধীরে ধীরে চরিত্রটির শক্তিমত্তা উপস্থাপন করেছেন। কিংবা হয়তো রাগধা নিজেই এতো বারুদের মত যে আর সকল চরিত্রের ভেতর থেকে সে আলাদা করে উঠে দাঁড়ায়। অথবা, হয়তো এটা আমারই চোখের সংকীর্ণতা যে নারী চরিত্রের শক্তিমত্তা আলাদা করে আমার নজর কাড়ে, নাড়া দেয়। আমার ভাবনা শুনে পাশে বসা আমার ক্রোয়েশিয়ান-ডাচ বান্ধবী আন্দ্রেয়া কান্না মুছতে মুছতে বললো, “ওরা প্রত্যেকে এতো সুন্দর মানুষ! কিন্তু আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। কারণ আমি নিজেও রাগধার সাথে আমার নিজেকে মেলাতে পরছিলাম। ফিল্মটা দেখতে দেখতে আমি যেন বুঝতে পারছিলাম ওর ভেতর কী ঝড় চলছে।“
কথা বলছি শন ম্যাকঅলিস্টার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র “এ সিরিয়ান লাভ স্টোরি” নিয়ে। ছবিটি সম্প্রতি ইডফা (international documentary filmfestival amsterdam) প্রদর্শন করে। ৯০ মিনিটের ছবিটি ২০১৫ সালে সম্পূর্ণ করতে শন পাঁচ বছরের মত কাজ করেন, শুটিং করেন সিরিয়া, লেবানন ও ফ্রান্সে। ছবিটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইডফা লিখেছে: দুই বিপ্লবীর বিপ্লব, দেশ ও পরষ্পরের জন্য আশা, স্বপ্ন ও হতাশার এক যাত্রাপথে মুক্তির লড়াই নিয়ে এই গল্প।
যদিও সম্প্রতি গৃহযুদ্ধ আক্রান্ত সিরিয়া থেকে সে দেশের নাগরিকদের গণহারে দেশত্য়াগ করে ইউরোপে অভিবাসন/আশ্রয় প্রার্থনা প্রচার মাধ্যমগুলো লুফে নিয়েছে, ভোক্তাদের আগ্রহী করেছে সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে, কিন্তু ছবিটিতে সিরিয়ার সাম্প্রতিক যুদ্ধের মূল্যায়ন বা তারিফ দেখবো এরকম লক্ষ্য আমার ছিলোনা। বরং আমার লক্ষ্য ছিল প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের রচনাশৈলী দেখা। সৌভাগ্য, শন আমাকে হতাশ করেননি। তাঁর নির্মাণশৈলীকে ঠিক নতুন ওয়েভ বলা যাবে না, কিন্তু তিনি যা করেছেন সেটা মাস্টারির সাথেই করেছেন। সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধ নয় তিনি দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন কিছু জীবন্ত রক্ত মাংসের মানুষকে।
তিনি ক্যামেরাসহ এমনভাবে চরিত্রগুলোর দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে গেছেন যে একটা সময় তার উপস্থিতি তিনি নেই করে ফেলতে পেরেছেন। ছবি প্রদর্শণ শেষে প্রশ্ন উত্তর পর্বে তাঁকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “রাগধা আর আমের যে তাদের জীবনে আমাকে প্রবেশ করতে দিয়েছে সেই আস্থার সম্পর্ক তৈরী হতে সময় লেগেছে অনেক…একটা সময় গেছে আমাকে তারা সন্দেহের চোখে দেখতো…পরে এমন একটা সময় এসেছে যে আমিই হয়ে গেছি তাদের ফেলে আসা জীবনের স্বাক্ষী, একটা সূত্র। যেমন, ওরা যখন ফ্রান্সে একসাথে থাকতো সেই সময়ে একমাত্র আমিই জানতাম পালমিরায় তাদের ফেলে আসা জীবনের কথা। আসলে আমি তো জানতামই না ছবির গল্পটা কোথায় যাচ্ছে। আমি গল্পটা তৈরী হতে দিয়েছি।” রাগধা পরে শনের সাথে যোগ করে, “আসলে ছবিটা আমাদের জীবনের সম্পূর্ণ গল্প তো নয়, এটা আমাদের জীবনের একটা টুকরো মাত্র এবং বাছাইটা পুরোপুরি শনেরই।“
ওপরের কথাগুলো বোধগম্য করতে ছবিটার গল্প আমি যেভাবে দেখলাম সেটা না বললেই নয়। শন সম্ভবত কোন এক টিভি চ্যানেলের হয়েই সিরিয়ায় একটা গল্প খুঁজতে গিয়েছিল। তখনও আরব বসন্ত নামক গণঅভ্যুত্থানটি ঘটেনি। সিরিয়ায় আসাদের দমনমূলক শাসনের আলামত চারিদিকে শনের নজরে পড়ছিল। মানুষ গুম, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাবন্দী করা, নির্যাতন চলছিল দেদারসে যদিও সাধারণ নাগরিকেরা সে বিষয়ে শনের ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজী হচ্ছিলো না। অনেক নাগরিক আবার মিথ্যা বিশ্বাসও করছিল যে সিরিয়ায় যে সব হাঙ্গামা চলছে সেটা নিতান্তই বহিরাগতদের বা বহিঃশক্তির কারসাজি। এরই মধ্যে শনের সাথে পরিচয় হয় আমেরের যার স্ত্রী রাগধা একটি প্রেমের উপন্যাস লেখার দায়ে কারাবন্দী জীবন কাটাচ্ছিলো। আমের প্যালেস্টিনিয়ান আর রাগধার সাথে তার পরিচয়, প্রেম হয় সিরিয়ার জেলখানাতেই। রাগধাকে আমের যখন প্রথম দেখে, আর প্রথম দেখাতেই সম্ভবত তাদের প্রেম হয়, তখন রাগধা চোখ খুলতে পারছিলো না। রাষ্ট্রের পেটোয়া বাহিনীর পিটুনিতে তার চোখ মুখ ঠোঁট ফুলে ঢোল হয়ে ছিল।
গল্প এগুতে থাকে। রাগধা জেলে আর আমের তাদের তিন ছেলে সন্তান নিয়ে সংসার সামলায়। রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্ত করতে আমের সহ আরও বিপ্লবীরা আসাদের দমন-পীড়ন মূলক রেজিমের মধ্যেই মিছিল করে। এক সময় তারা সফলও হয়, আরও অনেকের সাথে রাগধাও জেল থেকে বাড়ি ফিরে। কিন্তু তাদের মুক্তির আনন্দ স্থায়ী হয় না। আসাদের জেলে এবার যেতে হয় শনকে। শনকে শারিরীক নির্যাতনের শিকার হতে হয় না, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনী কিভাবে সিরীয় নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে সেটার একটা ছিটে আমাদের দেখানোর জন্য় সে ভিডিও করার সুযোগ পায়। দৃশ্যটি ছিল এরকম: উর্দি পরা তিন/চারটা লোক এলোমেলোভাবে দাঁড়ানো আর একজন ক্রমগত চড় মেরে যাচ্ছে হাত পেছন থেকে বেঁধে রাখা এক তরুনকে। চড় মারনেওয়ালার সেই তরুনের প্রতি শুধু একটিই প্রশ্ন, যেটা সে চড় মারতে মারতে একই সাথে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিলো- “মুক্তি চাই তোমার? স্বাধীনতা?”
শনকে আসাদের বাহিনী ধরে নিয়ে গেলে তখন তখনই আমের আর রাগধারা পালিয়ে যায় লেবানন, সাথে শুধু একটা ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু কিছুদিন পর রাগধা লেবানন থেকে সিরিয়া ফিরে আসে। এ সময় থেকেই ছবিটিতে স্পষ্ট হতে থাকে শনের গল্পের দুই বিপ্লবীর পরষ্পরের সাথে এবং নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বগুলো। একদিকে আমের, যে বুঝে গেছে বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে সিরিয়ায় ফেরা সম্ভব নয়। আরেকদিকে রাগধা, যে বুঝে গেছে সিরিয়ায় তাকে ফিরতেই হবে। এই বুঝ থেকে স্বামী সন্তান ফেলে রাগধা একাই সিরিয়া ফেরে কিন্তু বেশী দিন সেখানে টিকতে পারে না। এবার তাদের সবাইকে পালাতে হয় ফ্রান্স।
ফ্রান্সে আমের আর রাগধার এসব দ্বন্দ্ব আরও চরমে ওঠে। একদিকে আমের, যে চায় রাগধা যেন মন শান্ত করে, বাচ্চা-কাচ্চাদের দিকে নজর দেয়, আমেরকে ভালবাসে। অন্যদিকে রাগধা, যে সিরিয়া ছেড়ে এসে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে রাগধার অস্থিরতায় অতিষ্ঠ হয়ে আমের নতুন করে ভালবাসা খুঁজতে শুরু করে, ভেঙ্গে পড়ে তাদের আস্থার, শ্রদ্ধার আত্মীয়তাও।
শন ছবি শেষ করে এভাবে: আমের তিন ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছে ফ্রান্স। শন আমেরকে উত্যক্ত করে- “বিপ্লবী থেকে শেষ পর্যন্ত পরিণত হলে কৃষকে?” রাগধা চলে গেছে তুর্কেতে, যোগ দিয়েছে তুর্কের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে, সেখান থেকেই কাজ করছে সিরীয় নাগরিকদের মুক্তির লক্ষ্যে। “আমি আমার রাস্তা খুঁজে পেয়েছি”, শনকে বলে সে।
সিরীয়দের মুক্তি কিভাবে হবে?- এই প্রশ্নটা অবধারিতভাবেই ছবি শেষে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। “আসাদকে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে”, উত্তর করে শন, খুব ক্যাজুয়ালি। মৃদু হাসির একটা গুঞ্জন গুঞ্জরিত হয় সিনেমা হলটিতে। নাকি সেটা ছিল সম্মিলিত সিনিক্য়াল একটা আচরণ-ভাবি আমি। আমাদের চোখের সামনে দুনিয়াতে একটার পর পর একটা যুদ্ধ শেষ হচ্ছে, শুরু হচ্ছে, চলছে। আমরা সবই দেখছি, শুনছি, বুঝছি কিন্তু যেন কিছুই দেখছি না, কিছুই শুনছি না কিছুই বুঝতে পারছি না।
ইউরোপীয়রা কিভাবে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করতে পারে?- প্রশ্ন ওঠে। সাধারণত যা হয়, এরকম বিশেষ চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে উপস্থিত থাকে কিছু এলিটিস্ট মানুষজন, যাদের মনে হয় তাদের মনে করুণা উদ্রেক করাই সকল প্রামাণ্য় চলচ্চিত্রের যোগাযোগের লক্ষ্য। যেন তাদের হাতেই আছে অনেক ক্ষমতা, দূর থেকে লোকালদের বাস্তবতা পাল্টে দেবার। অন্তত প্রশ্নটা শুনে তাৎক্ষনিকভাবে আমার সেরকমই একটা রিএ্য়াকশন হল। রাগধা প্রশ্নটির উত্তর করল, “আমি তো মনে করি সিরিয়ার মানুষ আর ইউরোপের মানুষ একই রকম অসহায়। তোমরা বা আমরা কেউইতো আসলে আসাদকে নামাতে পারছি না।“
একজন স্বৈর-শাসক একটা দেশের জন্য়, সেই দেশের সীমানায় বসবাসকারী মানুষের জন্য় কত ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে সিরিয়ায় আমরা সেটা দেখেছি। রাগধার ঐ উত্তরটা প্রায়ই আমার মনে ফিরে ফিরে আসে। বাংলাদেশে সম্প্রতি বিদেশী নাগরিক খুন হবার পর যেন নতুন করে ওর কথাটা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিরিয়, ইউরোপীয় নাগরিকদের মত বাংলাদেশের নাগরিকেরাও হয়তো অসহায় হয়ে পড়ছে দেশীয় স্বৈর-শাসক আর আন্তর্জাতিক যুদ্ধবাজদের কাছে।
Categories: সংস্কৃতি-রাজনীতি
Leave a Reply