পাহাড়ি বাবু সমাজ ও চেতনার দহন
পাইচিংমং মারমা, অতিথি ব্লগার
বলুনতো,
মানুষের যাপিত জীবনে চেতনার অবস্থান কোথায়? চেতনা মানে কোন একটা রাজনৈতিক-মতাদর্শিক বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী কারোর আচরণ, বিচরণ, আহার, বিহার, আচার, বিচার ইত্যাদি। আমাদের অনেকের যাপিত জীবনে এই বিশ্বাসের ছাপ আছে, অনেকের নেই। যেমন ধরা যাক, অনেকে আছেন যে ইসলামী ব্যাংকে লেনদেন করতে চান না। কেন চান না? কারণ তা পাকীপন্থী জামাতে ইসলামীর মালিকানাধীন তাই। এমন ছোট খাটো অনেক ঘটনা দেখা যায় যাতে মানুষের বিশেষ কোন বিশ্বাস বা ধারণা বা ব্যক্তির রাজনৈতিক/ সামাজিক/ মতাদর্শিক/ ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন দেখা যায়। আমি একজনকে চিনি যিনি ঢাকায় থাকেন, বচ্ছরে এক আধবার খাগড়াছড়ি যান । বিষ্যুদবার-সোমবারে হাটের দিনে দূর দূরান্ত থেকে যারা বনের বা পাহাড়ের ফল-সবজি বেচতে আসে আর সপ্তাহের খোরাকি কিনে নিয়ে যায়, তাদের কাছ থেকে আলু-সবজি-বেগুন এসব কেনার সময় তিনি কক্ষনো দরদাম করেন না। তাঁর মতে, আরে ভাই, এরা বাঁচার জন্য এসব বেচতে আসে। দু চার টাকা লাভ হলে একবেলা মাছ বা মাংস খেতে পাবে। এরাই তো আমাদের শেকড়ের কাছের মানুষ। এদের কাছে দু তিন টাকা কম দিয়ে আমি জিতবো না। সেই যার কথা আমি বলছি, তিনি কানাডায় স্কলারশিপ নিয়ে পড়ে গেছেন। যদ্দূর শুনেছি তিনি যেখানেই গেছেন, পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় জাতিগত নিপীড়ন নিয়ে কথা বলেছেন। পাহাড়ে আর্মি-সেটলারের বিচারহীন ধর্ষণ, পাহাড়িদের মাটি থেকে উৎখাত করা, পাহাড়ে ঘটে যাওয়া গণহত্যা- কোন কিছুই তিনি মনে মনে পুষে রাখেননি। যেখানেই গেছেন সেখানেই তিনি আওয়াজ তুলেছেন। প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রতিরোধের আহবান জানিয়েছেন। মানুষকে জানিয়েছেন- ক্লাসে, ডাইনিং টেবিলে, কনফারেন্সে, সমুদ্র সৈকতে, শপিং মলে…
কি ছিলো সেই দহন? কি ছিলো সেই বোধ যাতে তিনি আর সবার মতন বিদেশে আমোদ ফুর্তি করে বেড়াননি বরং একটা কনফারেন্স থেকে আরেকটা কনফারেন্সে “ইনসাফ চাই, ইনসাফ চাই বলে” চিৎকার করে বেড়িয়েছেন?
হয়তো এর নাম চেতনার দহন। এর জন্যই আমি আজও অব্দি ইন্টেরনেটে লিখি। এর জন্যই যখন পাহাড় পোড়ে তখন তার আঁচ এসে লাগে আমার সত্তায় আর তার দহন ছড়িয়ে যায় রক্ত শিরায় শিরায়। এর জন্যই আমি কোন আর্মি রিজোর্টে যাই না- তা হোক নীলিগিরি, সাজেক রিজোর্ট, তারেং বা অন্য কিছু। যে আর্মি পাহাড়ে এথনিক ক্লিনজিং পলিসির বাস্তবায়ন করে চলেছে, যে আর্মি গনহত্যা করে পাহাড়কে পাহাড়িশূন্য করতে চেয়েছে তাদের দোকানে গিয়ে আমার একটা লজেন্স পর্যন্ত কেনা উচিৎ নয়। একটা ফুটো কড়িও আমার সেখানে খরচ করা নৈতিক নয়। তাদের বানানো প্রমোদস্থলে গিয়ে আমোদ-ফুর্তি করা দূরে থাক, সেখানে কখনোই আমার পায়ের ছাপ পড়বে না। এটাই নৈতিক অবস্থান- এটাই আচার-বিচারে আর বিহারে চেতনার চর্চা। একজন আমার এমন আচার-বিচার-আচরণ-বিচরণের বর্ণনা শুনে বলেছিলো, আমার সবই নাকি লোক দেখানো। তাকে বলা হয়নি, “ Before you judge my life, my past or my character… walk in my shoes, walk the path I have traveled, live my sorrow, my doubts, my fear, my pain and my laughter…”
আমরা সবাই যার যার অভিজ্ঞতা থেকে মানুষকে বিচার করি। আবার আমরা যেভাবে বাঁচি সেভাবে আমাদের বিচারপদ্ধতি নির্ধারিত হয়। আমরা যেভাবে বাঁচি একে আমরা Mode of existence বলতে পারি। আগে একটা লেখায় বলেছিলাম যে আমাদের পাহাড়ি বাবুসমাজ আসলে কাউন্টার ইনসারজেন্সির ভ্যাক্সিন খাওয়া একটা দালাল সুবিধাবাদী মধ্যজীবি সমাজ যার কোন সুনির্দিষ্ট কোন আদর্শিক অবস্থান নেই। এই বাবুসমাজ যখন যেদিকে সুবিধা সেদিকে হেলে পড়ে। এই শ্রেণীটা অনেকটা তরল বস্তুর মতন, যখন যে পাত্রে রাখা হয় তখন সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। ফলে দেখা যায়, এই বাবুসমাজের বাবুমশাই বিকেলের আড্ডায় ফাটিয়ে দেশপ্রেমের লেকচার দেন আর সকালে হাত কচলে জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর করেন সামান্য কোন আর্মি ক্যাপ্টেনের সামনে। এই বাবুসমাজের সবটাইতেই মেকি বিনয় আর সস্তা ইগোপ্রবনতা দেখা যায়, এমনকি ধর্ম চর্চাতেও। তারা মন্দিরে বেশি দান দিয়ে বাহবা পেতে চায়, ঘুষের টাকা বা চুরির টাকায় বৌদ্ধ গয়া ঘুরে এসে সামাজিক কদর পেতে চায়। ফলে এমন সমাজে যাদের বেড়ে উঠা, তারা সবটাতেই মেকিত্ব খুঁজে বেড়াবে আর মেকিত্বের চর্চা করবে সেটাই স্বাভাবিক। এই বাবুসমাজের কোন নৈতিক-আদর্শিক অবস্থান না থাকায় তারা সকালে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে গরম বক্তৃতা দেয় আর বিকেলে আর্মিদের রেস্তঁরায় গিয়ে চা খায়। এই শ্রেণির আদুরে দুলাল আর দুলালীরা শহরে বেড়ে উঠে আর শহুরে মধ্যবিত্তের প্রবৃত্তি-প্রবনতা-মুদ্রা সবকিছুকে রপ্ত করে।
সত্তুরের দশক, আশির দশকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভিকটিম হয়েছে দূর্গম বনপাহাড়ের প্রান্তিক মানুষেরা, শহরের বাবুসমাজ নয়। অদূর ভবিষ্যতেও যদি কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় তো সবার আগে তার ভিক্টিম হবে সমাজের নীচুতলার মানুষেরা, শহরের উঁচুতলার বাবুরা নয়। সমাজের নীচুতলার উপমানুষেরা সীমানা পেরিয়ে ওপারে চলে যাবে বা তারা চিরকালই নিপীড়িত রয়ে যাবে এবং উঁচুতলার বাবুদের সেবা করবে। একটা শ্রেণি বিভক্ত সমাজের এমনটাই নিয়ম। যেমন ধরা যাক, সাজেকের বম, লুসাই আর ত্রিপুরারা- উন্নয়নের কষাঘাতে কিছু পরিবার, যাদের এক পা এই সিমান্তে আর আরেক পা আরেক সীমান্তে, তারা অচিরেই ইন্ডিয়ায় পাড়ি দেবে। আমি তাদের গত বছর দেখে এসেছি। তারা দেশান্তরী হলে দেশের জিডিপির কিচ্ছু যায় আসে না। করপোরেট আর্মির মুনাফাটাই আসল কথা।
রাষ্ট্রের এথনিক ক্লিনজিং পলিসির চাইতে বরং Assimilation, Acculturation, transculturation, ethnocide করে গোটা জনগোষ্ঠিকে মূলধারার জনগোষ্ঠির মধ্যে একীভূত করে ফেলা সহজ। এটা একটা স্টেইট পলিসি। রাষ্ট্রের পক্ষে একবারে গোটা জনগোষ্ঠিকে এলিমিনেইট করা সম্ভব না। তারচেয়ে বরং ধীরে ধীরে এই জনগোষ্ঠিকে মেইন্সট্রিমে নিয়ে আসা গেলে আর কিছুর দরকার হয় না। যেভাবে মার্কিনিরা মেল্টিং পট থিওরি অনুযায়ী গোটা জনগোষ্ঠিকে আমেরিকানাইজ করেছে, তেমন করে সব পাহাড়িকে বিশ-তিরিশ বছরে বেঙ্গলাইজ করলে আর কিচ্ছু করার দরকার পড়ে না।
সংস্কৃতির জায়গাতে একটা জনগোষ্ঠীর শেকড় নেই হয়ে গেলে আর কিসসু লাগে না। শুধু সংস্কৃতি নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবে এবং জীবনবোধ-জীবনাচরণে কেউ যদি মূলধারার জনগোষ্ঠির মতো হয়ে যায় তাহলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির পালস ধরে তার পক্ষে কথা বলবে কে? যে চাকমা মেয়েটা রিফিউজি হয়ে কোনমতে প্রাণে বেঁচে শেষতক ইতালি অব্দি পৌঁছেছে- সে যদি ঢাকার ক্রিম সোসাইটির মতো করে ভাবতে থাকে আর ঢাকাতেই থিতু হয়ে যায়, আর সে যদি তার শেকড়ের কথা ভুলে যায়, আর সে যদি আর্মির গুলির ভয়ে সে যে একদিন রাতের অন্ধকারে ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলো সেকথাও ভুলে যায়, তাহলে রাষ্ট্রের পক্ষে নিপীড়ন করাটা আরও সহজ হয়ে যায়। কেননা যে আধুনিক শিক্ষা পেয়ে দাসত্ব আর বিলাসব্যসনকে জীবন যাপনের মূলমন্ত্র ভেবেছে আর নিয়ত নিপীড়িত তার শেকড়ের মানুষকে ভুলে গেছে তাকে দিয়ে তো আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা বিদ্রোহ সম্ভব না। সে যদি কোনদিন রেডিওতে যেমন করে লুতুপুতু সোনারা ছ্যাবলামী করে ভ্রমনবিলাসের গপ্পো শোনায় তেমন করে পাহাড়ে পর্যটন পণ্যের বিজ্ঞাপন করে তাহলে তো সোনায় সোহাগা…
আমার এক বন্ধু সম্প্রতি রেডিওতে বান্দরবানে পর্যটন পণ্যের বিজ্ঞাপন করে এসেছে। সে না করলেও আর কেউ হয়তো করতো তবু সে কেন করেছে- এটা ভেবে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। রেডিওতে আমার মতন বোকাচোদারা যেতে পারে না। যদি কোনদিন আমি রেডিওতে যেতেও পারি, ছাড় দেবো না… আজ এখানে যা বলছি সেটাই সেখানে বলবো। যে দহনে আমার চেতনা জ্বলছে, তার উপশম না হওয়া অব্দি ইথারের একটা কণাও ছাড়বো না… প্রত্যেকটা কণায় দ্রোহের পদ্য লিখে যাবো। স্লোগান জ্বালিয়ে যাবো।
আমি হয়তো মানুষের কাছে বেশিই আশা করি… যারা নিয়ত নিপীড়নের মুখে আছে তারা জীবনের সাথে যুঝে আছে-এটা আমার বোঝা দরকার। তারা জীবন থেকে পালাতেই পলকা সুখের ভান করে আছে। আমি মনে করি তাদের চেতনায় একটা জোরে ধাক্কা দেওয়া দরকার। তাদের এটা জানিয়ে দেওয়া দরকার যে তারা এসকেইপিজমের চর্চা করছে। তারা একটা মিথ্যার ঘোরে বাঁচতে চেয়ে জীবনের সত্যকে অস্বীকার করছে।
আমি আমার চারপাশের মানুষের কাছে, যারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে বা হচ্ছে তাদের কাছে অন্তত একটা আদর্শিক অবস্থান প্রত্যাশা করি। খুব উঁচুদরের চেতনার চর্চা বা রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম না হোক, অন্তত সবার প্রতিদিনের জীবনে কিছু রাজনৈতিক-আদর্শিক চর্চার দরকার আছে। লেখার শুরুতেই আমি তার উদাহরন দিয়েছি। আর কিছু না হোক, অন্তত, অত্যাচারী- নিপীড়কের সঙ্গ পরিত্যাগ করে নিজের সংক্ষুদ্ধ অবস্থানটা জানানো দরকার। আমি জানি যে আমাদের বাবুসমাজের বেশিরভাগই Apolotical, Apathetic আর এমনটা বলেই তারা সমাজের প্রিভিলেজড গ্রুপে আসতে পেরেছে। কিন্তু তবু, মানুষের একটা ন্যুনতম আদর্শিক-নৈতিক অবস্থান থাকা দরকার। দশটা পাস দিয়েও কেউ যদি নিপীড়িতের পক্ষে কোন কাজে না আসে তাহলে তার দশটা পাস দিয়ে কি হবে? কেউ যদি কোন আদর্শিক অবস্থানে না দাঁড়ায় তাহলে সে তো যেকোন কিছুর সংস্থানেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়বে মেরুদন্ডহীনের মতো।
তবে- “If you do not stand for something, you will fall for anything.” এই মেরুদন্ডহীন, লুম্পেন, দালাল প্রবৃত্তি দিয়ে দিব্যি আপোষ করে বাঁচা যায় বটে কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হওয়া যায় কি?
একই বিষয়ে লেখকের আরো একটি লেখার জন্য দেখুন, “এই বাবুসমাজ লইয়া আমরা কি করিবো ?” chtbd.org
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply