বুক্কু চাকমা
বান্দরবান হতে ফিরলাম। সমতলে যতটুকু পর্যটক মুড নিয়ে বেড়ানো যায়, আমাদের পাহাড়ীদের পক্ষে পাহাড়ে তা সম্ভব নয়। কারন পাহাড়ে আমাদের রক্ত মিশে একাকার হয়ে আছে, সেই রক্ত কোথাও ঝড়তে দেখলে বুকটা নাড়া দেয়, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
পাহাড়ের জাতিগত উগ্র আগ্রাসনের স্যাম্পল হিসেবে আজকের বান্দরবান জেলার কোন জুড়ি নেই। আজকের বান্দরবান জানান দিচ্ছে ভবিষ্যত খাগড়াছড়ি-রাঙামাটির নমুনা। এখানকার কোন আদবাসী পাহাড়কে নিয়ে স্বপ্ন দেখে না আর মনে হয়। তাদের মাঝে যারা স্বপ্ন দেখে তারা হয় “পাগল” নাহয় দালাল, তারা পাহাড়কে ধর্ষনেরই স্বপ্ন দেখে স্বার্থপর হয়ে।
দুর্গম বান্দরবানের সবুজ উচু উচু পাহাড় আজ ন্যাড়া হয়ে গেছে। সেখানে বসানো হয়েছে মিলিটারী ক্যাম্প, বনায়নের নামে চলছে আদিবাসী উচ্ছেদ আর পাহাড়ের জবরদখল। আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে চিড়িয়াখানার চিড়িয়া বানিয়ে আবালদের মনোরঞ্জনে তাতে স্থাপন করা হয়েছে নীলাচল নীলগীরি। প্রতিবাদকারীদের ঠেকাতে মিলিটারী ক্যাম্প দিয়ে পাহাড়কে ভরিয়ে ফেলা হয়েছে উন্নয়ন আর নিরাপত্তার ধোঁয়া তুলে!
বান্দরবানের লামা থানায় দেখলাম মধ্যযুগীয় বর্নবাদ প্রথা। এখানে ক্ষেতে খাওয়া মলিন বেশভুষার কোন আদিবাসীকে গাড়ির সিটে বসতে দেওয়া হয়না, এমনকী পুরো গাড়ি খালি থাকলেও না। তাদের নির্ধারিত বসার জায়গা গাড়ির ছাদ। সিটগুলি অলিখিতভাবে নির্ধারিত থাকে সেটেলার, বাঙালী আর কিছু আদিবাসী কেরানী বাবুদের জন্যে।
বান্দরবানে শত বছরের পুরনো আফ্রিকাকে বাস্তবায়নের কাজ আজ প্রায় শেষের দিকে। ন্যাড়া পাহাড়ে পড়ে থাকা কান্ডহীন বড় বড় গাছের গোড়াগুলি দেখে বুঝা যায় এখানে কি ধংসযজ্ঞ আর লুটপাত হয়ে গেছে। পাহাড়ের চির পরিচিত পিনোন-হাদি বা থামেই পরা কোন আদিবাসী মহিলাকে ঝর্না হতে পানি আনতে দেখা যায় কদাচিৎ। সেই পাহাড়ী ঝর্নায় বিচরন করে বেড়ায় এখানকার সেটেলার মহিলারা। সেই সেটেলার মহিলারাই আবার মহল্লার সখিদের সাথে দুপুরের খোশগল্পটা সেরে নেয় রাষ্ট্রীয়মদদে দখলসূত্রে পাওয়া জুম পাহাড়ের স্বপ্নগাথা নিয়ে।
এখানকার সমতল হতে বসতি স্থাপনকারী সেটেলাররা দিনে দিনে তেল চকচকে হয় আর স্থানীয় ভুমিপুত্র আদিবাসীর মলিনমূখ দিনে দিনে হয় আরো মলিন।
আর এসব হতে লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে আরেকটি ভিন্ন গ্রহে আমাদের তথাকথিত আন্দোলনকারী নেতারা আন্দোলনের বালটা ছিড়ে যাচ্ছে এসিরুমে আফিমের ঘুমটা দিয়ে।
সম্পাদকীয় টীকা: ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে র্পাবত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে র্পাবত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ রাষ্টের শাসন কৌশলে ও কাঠামোয় গুরুত্বর্পূণ বদল ঘট। এই বদলগুলোর অন্যতম ও বহুল প্রচারিতটি হচ্ছে সেখানে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের তথাকথিত অবসান।বাস্তবে এখনও র্পাবত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসনই চলছে। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় একদিকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের লোকবল বাড়ানো হয়ছে। অন্যদিকে সিভিল প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু র্পাবত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসনের কৌশল ও চরিত্র নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণে যে বিষয়টি সচরাচর আলোচিত হয় না, সেটি হল , সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে র্পযটন শিল্পের বিকাশের নামে পাহাড় দখল ও পাহাড়ি আদবিাসী জনগোষ্ঠীকে নিজ ভূমি থেকে ধারাবাহিক উচ্ছেদ। বান্দরবনের নীলগিরি রিসোর্ট তার অনন্য উদাহারণ।
বুক্কু চাকমার অভিজ্ঞতা ভিত্তিক এই বয়ানটি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে র্পযটন শিল্পের আগ্রাসনরে বিরুদ্ধে প্রতবিাদী একটি কণ্ঠস্বর। বাংলাদেশের অন্যতম র্পযটন আর্কষণস্থল যে বাস্তবে রাষ্ট্রের জাতিগত সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে গরীব আদিবাসীদের ওপর বৈষম্য র্চচার চরমতম একটি স্থান — সেটাই আমরা আবার লক্ষ্য করলাম। আরও লক্ষ্য করলাম কিভাবে একজন সাধারণ নাগরিক আরকেজন সাধারণ নাগরকিকে দৈনন্দিন জীবন চর্চাতেই বৈষম্য করছে। এখানে একজন গরীব আদিবাসীর জন্য বাসে নির্ধারিত জায়গা হয় ছাদ, না হয় মেঝে। এই বৈষম্য, বান্দরবনরে লামা থানায় বাসের সিট্ বিলি-বণ্টন ব্যবস্থা আমাদের রোজা র্পাকস ও মন্তগমেরী বৈষম্য ব্যবস্থার (Montgomery Apartheid System) কথা মনে করিয়ে দেয় । মন্তগমেরীতে তখন (১৯৫৫ সাল) কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের বাসের সামনের সারিতে বসার অধিকার ছিল না, বাসে শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত সিট্ খালি থাকলওে নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে র্পাবত্য চট্টগ্রামে এসব জাতিগত/রেসিস্ট/বর্ণবাদী বৈষম্য করার কথা হয়তো কোথাও লেখা নেই যেমন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু বুক্কু চাকমা বান্দরবনে একই রকম জাতগিত/র্বণবষৈম্যবাদের র্চচা লক্ষ্য করে তার ক্রোধ প্রকাশ করছেন। আমরা তার এই ক্রোধের সাথে সংহতি জানাই।
তবে বুক্কু চাকমার লেখায় র্পাবত্য চট্টগ্রামে দরিদ্র বাঙালী অভিবাসীদের ঢালাওভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে, আমরা এর থেকে দূরত্ব প্রকাশ করছি। আমরা মনে করি সাংস্কৃতিক, র্ধমীয়, ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্র, তার পেটোয়া বাহিনী ও তাদের এলিট দোসরদের আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে গিয়ে এ ধরণরে কটাক্ষ দরদ্রি খেটে খাওয়া বাঙ্গালীদের আদিবাসীদের দুশমন প্রতিপন্ন করছে। দ্বিতীয়ত, বুক্কু চাকমা পাহাড়ী আদবিাসী নারীকে দেখেছেন পিনন-হাদি পরে র্ঝণার ধারে ঘুর ঘুর করতে । পাহাড়ী আদবিাসী নারীরা ’পানি আনা’ আর ’স্বপ্ন বোনা’ ছাড়াও আরও নানাভাবে সমাজে, রাজনতৈকি সংগ্রামে যুক্ত যা লেখকের উপস্থাপনায় খুঁজে পাওয়া যায় না। পাশাপাশি, লেখক পাহাড়ী আদিবাসী নারীদের বিপরীতে দরিদ্র বাঙালী অভিবাসী নারীদের শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যেটা সবক্ষেত্রে সবসমসয় সত্য নয়।
সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, র্বণবৈষম্যবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টভঙ্গি ও ভাষাকাঠামো ঠোঁটকাটা সর্মথন করে না, তবে লেখাটিতে প্রকাশিত ক্রোধ ও প্রতিরোধের স্পৃহার সাথে ঠোটকাটার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে -ঠোঁটকাটা]
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply