নারী কি মর্ষকামি? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “ফুলচোর” উপন্যাসের পুনর্পাঠ

phulchor

হাবিবা নওরোজ

“ফুলচোর”(১) শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি অখ্যাত উপন্যাস। ৬২ পৃষ্ঠার এই রচনাকে ছোট উপন্যাস বলাই উপযুক্ত। কৈশোরে শীর্ষেন্দুর উপন্যাস সবচাইতে বেশি পড়েছি। তার লেখা আমাকে যে ঘোর লাগা বিষণ্ণ পৃথিবীতে নিয়ে যেত তাতে বিষাদের সাথে সাথে সরল জীবনের প্রতি আকুতি ছিল। “ফুলচোর” আমার প্রিয় উপন্যাস নয়। কিন্তু এটা আমি অনেকবার পড়েছি, যেমন পড়েছি তার বাকি রোম্যান্টিক উপন্যাসগুলো। তার নারী চরিত্র গুলোর সাথে আমি নিজের মিল খুঁজে পেতাম, যেমন হয়তো অনেক নারী পাঠকই পান। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র কাটুর প্রতি আমি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতাম। কল্পনায়, দিবা স্বপ্নে আমার ইচ্ছা হত কাটুর মত ডাকসাইটে সুন্দরী হতে। মনে হত আমার জীবন অনেক সহজ হত যদি আমি রূপবতী হোতাম। এই একমাত্র গুন দিয়ে আমি আমার জীবনের সমস্ত বাঁধা দূর করতে পারতাম যেমন পারে জনপ্রিয় উপন্যাসের কাটুর মত চরিত্রগুলো।

প্রথম দর্শনে কর্ণ মল্লিক কাটুকে নিয়ে যা ভাবেন তা হোল “ভাবলে, সৌন্দর্যটা সকলের পক্ষেই বেশ সুবিধাজনক। আদতে ওটা একটা ফালতু উপরি জিনিস। কেউ কেউ ঐ ফালতু জিনিসটা নিয়েই জন্মায়, আর তারাই দুনিয়ার বেশির ভাগ পুরুষের মনোযোগ কব্জা করে রাখে। যারা সমান অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে বিস্তর মারদাঙ্গা, হামলা আন্দোলন চালাচ্ছে তারা এ ব্যাপারটা বুঝতে চায়না। একজন সুন্দরীর যে অধিকার, একজন খেঁদি বা পেঁচী কোনকালে সে অধিকার অর্জন করতে পারেনা। প্রকৃতির নিয়মেই সমান অধিকার বলে কিছুই নেই।”(পৃষ্ঠাঃ২৭)

আমেরিকান নারীবাদী লেখক নাওমি উলফের ভাষায় সৌন্দর্যের পুরাকথা বা বিউটি মিথ একটা গল্প বলেঃ সৌন্দর্য নামের বৈশিষ্ট্য বস্তুনিষ্ঠভাবে এবং সার্বজনীনভাবে আছে। নারীর একে ধারন করার আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে এবং পুরুষের সেই নারীদের অধিকার করার আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে যারা এটা ধারন করে। এই ধারন করাটা নারীর জন্য বাধ্যতামূলক পুরুষের জন্য নয়, এই ব্যবস্থাটা প্রয়োজনীয় এবং প্রাকৃতিক কারন এটা জৈবিক, যৌন এবং বিবর্তনবাদীঃ শক্তিশালী পুরুষ রূপবতী নারীর জন্য যুদ্ধ করে, এবং রূপবতী নারী প্রজননগতভাবে বেশি সফল। নারীর সৌন্দর্য তার উর্বরতার সাথে সম্পর্কিত হতে হবে, এবং যেহেতু এই ব্যবস্থার ভিত্তি যৌন নির্বাচন এটা অবশ্যম্ভাবী এবং অপরিবর্তনীয়।  

এর কিছুই সত্য নয়। সৌন্দর্যস্বর্ণমানের মত একটি মুদ্রানীতি। যে কোন অর্থনীতির মতই এটা রাজনীতি দিয়ে নির্ধারিত, এবং আধুনিক যুগে পশ্চিমে এটা সর্বশেষ এবং সর্বোত্তম বিশ্বাস ব্যবস্থা যা পুরুষাধিপত্য অটুট রাখে।এটা একটা ক্ষমতা সম্পর্কের প্রকাশ যাতে নারীকে চরম নিষ্ঠুর ভাবে সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয় যা পুরুষ নিজেদের জন্য বণ্টন করেছে (পৃষ্ঠাঃ১২, নিজের অনুবাদ) 

নারীর সৌন্দর্যের অতি উচ্চ মূল্য দান যে নারী পুরুষ ক্ষমতা সম্পর্কের প্রকাশ তার প্রমান পাওয়া যায় “ফুলচোর” উপন্যাসেই। ধনী ঘরের রূপবতী কন্যা বলে কৈশোরে পা দিতে না দিতেই বড় ঘরের প্রতিভাবান বর জুটে যায় কাটুর। লিচু সম্ভাবনাময় গায়িকা হয়েও নিম্নবিত্ত, আর কুৎসিত হবার দোষে খারাপ বিয়ে হবার আতঙ্কে থাকে, হীনমন্যতায় ভোগে। কাটু লিচুর প্রতিভা মনে মনে হিংসা করে উপরে শ্লেষাত্নক কথা শোনাতেও ছাড়েনা। দুই বান্ধবীকে দেখি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যে প্রতিযোগিতায় কাটু আগে থেকেই এগিয়ে আছে সৌন্দর্যে, বিত্তে। উদাস, খেয়ালি, হাস্যকর হলেও পুরুষ কর্ণ মল্লিকই প্রতিযোগিতার চুরান্ত লক্ষ্য যাকে অর্জন করার জন্য দুই বন্ধু প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় নেমেছেন, নারী হওয়ায় তাঁদের কর্ণ মল্লিককে অর্জনের প্রধানতম যোগ্যতা সৌন্দর্য।

আবার নাওমি উলফের মতে “‘সৌন্দর্যধারনা ব্যাবহার করে এটা নারীদের বিকল্প জগত পুনর্নির্মাণ করেছে নিজেশ্ব আইন, অর্থনীতি, ধর্ম, যৌনতা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি দিয়ে, প্রত্যেক উপাদান পূর্বের চলে যাওয়াগুলোর মতই দমনমূলক(পৃষ্ঠাঃ১৬,নিজের অনুবাদ)

এক ভিন্ন জগতেই থাকে কাটু। সেই জগত নারী আর পুরুষের বৈষম্য আরও গভীর করতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার সৌন্দর্যকে উচ্চ মূল্য দেয়, তাকে মিথ্যা বলে যে নারীর জীবনে সকল জাতের অর্জন সম্ভব করতে পারে এই কৃত্তিম মুদ্রানীতি। কাটু আর দশজন কিশোরীর মতই আত্নরতিতে ভোগে। মামাতো ভাই শঙ্গুকে প্রথম দেখে ভাবে “কাছাকাছি একটা কাঁচা বয়সের ছেলে রয়েছে, অথচ আমাকে দেখে হাঁ করে চেয়ে থাকছে না। নিজের কেরদানি দেখানোর জন্য নানা বোকা বোকা কাণ্ড করছে না বা নিজের কৃতিত্বের কথা বলতে গিয়ে আগড়ম বাগড়ম বকছে না- সেটা আমার অহংকারে লাগে।”(পৃষ্ঠাঃ৪১-৪২)

নিত্য এই প্রেমে পরার ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে কাটু অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ নিতে চায়। খানিকটা আনন্দ সে পায়ও কিন্তু শঙ্গুর প্রতারনায়, হয়রানীতে সে বোঝে নারী হিসেবে তার সীমারেখা। সৌন্দর্য তার আনন্দের পথ সহজ করে বটে কিন্তু দিতে পারেনা মুক্তি, আত্নপরিচয়। পুরুষ ঝুঁকি নেয়, কর্তা সত্ত্বা রূপে সে আবির্ভূত হয় তার নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রনে, আত্নপরিচয় নির্মাণের এই রোমাঞ্চকর অভিযানে সৌন্দর্য কোন বিশেষ দক্ষতা হিসেবে প্রতিভাত হয়না। জন্মগতভাবে প্রাপ্ত কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে না যেমন হয় নারীর ক্ষেত্রে। রূপবতী নারীও সম্পূর্ণরূপে নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা হিসেবে আবির্ভূত হননা, যেমন সৌন্দর্য না থাকলেও নিজের ভাগ্যের কর্তা হন পুরুষ।  সৌন্দর্যের উচ্চ মূল্য দানের যে প্রতিশ্রুতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে করে তা ভঙ্গ হতে দেখি গল্প, উপন্যাসেই। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের “সরীসৃপ” গল্পের সুন্দরী বিধবা  পরীকে দেখি সৌন্দর্য আর তারুন্য দিয়ে বনমালীর মন ভুলাতে। প্রাথমিক মোহ কেটে গেলে বনমালীর অনুগ্রহ লাভের সকল রাস্তা হারিয়ে পরী আয়নায় নিজের মুখ দেখে বলে ওঠে “আরশি কি প্রত্যহ তাহাকে মিথ্যা বলিয়াছে?” আত্নরতিবতীর মত সে ভাবে “আজন্ম দেখিয়া আসিয়াও আরশিতে নিজেকে তাহার প্রত্যহ নূতন মনে হয়, আপনার রূপ ও যৌবনের এক-একটা অভিনব ভঙ্গিমা আজও সে প্রত্যহ আবিষ্কার করে। আর বনমালীর কাছেই এর মধ্যে পুরানো হইয়া গেল।”(পৃষ্ঠাঃ৪২) অবশেষে বনমালীর ঘরে নিজের ও তার একমাত্র সন্তানের আশ্রয় লাভের সমস্ত সম্ভাবনা হারায় পরী। আদর্শ সৌন্দর্যের যে ধারনা তা নারীর জন্য যে জগত তৈরি করে তা আত্নরতির, অন্য নারীকে নিজের গোত্র ভুক্ত বন্ধু নয় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখার, হীনমন্যতার, সন্দেহ প্রবনতার।

গৃহ শিক্ষক অবনী রায়ের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কাটু। অবনী রায় যখন অমিতা নামের একজন নারীকে বিয়ে করেন তখন তার প্রতি কাটুর মনোভাব দেখি “…অবনী বিয়ে করলেন গার্লস স্কুলের একজন শিক্ষয়িত্রী অমিতাদি কে। যেমন কালো তেমনি মোটা। তার উপর দাঁত উঁচু ঠোট পুরু এবং যথেষ্ট বয়স্কা। অমিতাদি কে বেছে বের করে অবনী বিয়ে করেছিলেন বোধ হয় আমার ওপর প্রতিশোধ নিতেই। নইলে ও রকম কুচ্ছিৎ মেয়েকে বিয়ে করার অন্য কোন মানেই হয় না।”(পৃষ্ঠাঃ৩২)

বোঝা যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেমন নারীর সৌন্দর্যকেই সর্বোচ্চ মূল্য দেয় নারীও বাধ্য অনুগত ছাত্রীর মতই সেই দীক্ষা গ্রহন করে। অমিতাদি তার কাছে কালো, মোটা, বেটে, বেশি বয়সের একজন “কুচ্ছিৎ” মেয়ে। তার অন্য সকল যোগ্যতা মুছে যায় এই দোষে। ব্যক্তি হিসেবে তিনি যা তার গুনে অমিতাদিকে যেন ভালোবাসা যায়না, বিয়েতো করাই যায়না! “কুচ্ছিৎ” অমিতা শেষ পর্যন্ত একজন বলির পাঁঠা যাকে অবনী রায়ের মত ধনী, প্রতিভাবান পুরুষ বিয়ে করতে পারেন একমাত্র কাটুর মত রূপবতী নারীর উপর প্রতিশোধ নিতেই!

কাটু তাঁদের ছোট শহরের প্রতিষ্ঠিত ধনী পরিবারের অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী। জীবন তার সকল আলোকেই কানায় কানায় পূর্ণ। অভিজাত বংশের গুনবান শিক্ষক অবনী রায় রূপমুগ্ধ হয়েই তাকে পড়াতে আসেন। তার হাতে কাটু জীবনের প্রথমবার ভালো ফল করে। সৌন্দর্যের বাইরে এটাই কাটুর জীবনে প্রথম অর্জন। তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আমেরিকা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে, তারাও ধনী। কাটুর জীবনে অনিশ্চয়তার কোন জায়গা নেই, সংশয় নেই, তাই হয়তো দৃঢ়প্রতিজ্ঞার প্রয়োজনও নেই। “ফুলচোর” উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও কাটু কোন বিষয়ে আগ্রহী এমন কোন উল্লেখ নেই। কাটু গান শিখতে চায় সেটা যতটা না নিজের আগ্রহে তার চাইতে বেশি পারার প্রতিভাবান গায়িকা লিচুকে টক্কর দিতে। গানের মাস্টার, তবলচি, হারমোনিয়াম সবই মহাসমারোহে হাজির হয় কাটুর সামনে কিন্তু মনে মনে সে ঠিকি বোঝে গানের প্রতি তার নিজেকে সম্পূর্ণরুপে নিবেদন করার আকাঙ্ক্ষা নেই। কোন কিছুর প্রতি সত্যিকার আগ্রহের অভাবের কারনেই কি কাটু নিজের সৌন্দর্যের বিষয়ে এতটা সচেতন এতটা আত্নরতিবতী হয়ে ওঠে? নাকি সৌন্দর্যের উচ্চ মূল্য প্রাপ্তি তাকে বাকি সব বিষয়ে অনাগ্রহী করে রাখতে পারে? উপন্যাসের পুরোটাই বলা যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সুন্দরী তরুণীর রূপ কিভাবে সবাইকে মোহগ্রস্ত করতে পারে তার বিবরন। ভিতরে ভিতরে কাটু কিন্তু প্রায়ই ভিন্ন মেজাজে থাকে।

“বাইরে থেকে আমাকে যতই সুখী আর শান্ত দেখাক, ভেতরে ভেতরে আমার অসহ্য ছটফটানি। যতই সেই ভেতরের উত্তরোল ঢেউ চেপে রাখি ততই আমি বদ মেজাজি হতে থাকি মন তত খিঁচরে থাকে। এই ছটফটানি কোনো কাম নয়, প্রেমও নয়। শুধু এই বাধানো সুন্দর জীবন থেকে একটু বাইরে যাওয়া, একটু বেনিয়মে পা দেওয়ার ইচ্ছা।”(পৃষ্ঠাঃ৩২)

কাটু শৈশব থেকে যৌবনে পা দিয়েছে। গঠনের বছরগুলোতে নারীর এই বিচিত্র মানসিক অবস্থার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গের শৈশব অধ্যায়ে। তার ভাষায়দমিত হয় মেয়েদের প্রাণোচ্ছলতা, তাদের নিষ্ক্রিয় শক্তি রুপান্তরিত হয় স্নায়বিক দৌর্বল্যে; তাদের অতিশান্ত কাজগুলো নিঃশেষ করতে পারেনা তাদের শক্তির প্রাচুর্য; তারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে ওঠে, এবং অবসাদের মধ্যে দিয়ে  ও তাদের হীন অবস্থার ক্ষতিপূরণের জন্যে নিজেদের তারা সমর্পণ করে বিষাদগ্রস্ত ও রোম্যানটিক দিবাস্বপ্নের কাছেতাদের আবেগের কাছে তারা ধরা দেয় অদম্য উত্তেজনায়খুবি স্বাভাবিকভাবে তারা হয়ে ওঠে ছেনাল ও নাটুকে, এ ত্রুটিগুলো লক্ষণীয় হয়ে ওঠে বয়ঃসন্ধিকালে। তাদের অসুস্থতা ধরা পড়ে ধৈর্যহীনতায়, বদমেজাজের ঘোরে, অশ্রুপাতে…”(পৃষ্ঠাঃ১৮১)

বোভোয়ারের উল্লেখিত সকল বৈশিষ্ট্যই দেখা যায় কাটুর মধ্যে। নাটুকে, ছেনাল, বিষাদগ্রস্ত, দিবাস্বপ্ন প্রবন সবগুলো প্রবনতাই কাটুর মধ্যে দেখি। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহবশতই পুরুষ চরিত্রগুলোর সাথে তাকে দেখা যায় নাটুকে ও ছেনাল হিসেবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার সৌন্দর্যকে এত উচ্চ মূল্য দেয় যে কাটুর আসে পাশে কোন ছেলে তার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ না করলে তার অহংকার একরকম আহত হয়। নাটকে, ছেনালিপনায় সে তার আশে পাশের পুরুষদের স্বেচ্ছাচারীর মত চালাতে চায়। যেন দুঃসাহসিক অভিযানের আনন্দ পায় সে তাতে। কিন্তু যে যোগ্যতা অর্জনে তার বিশেষ কোন হাত ছিলনা তা তাকে মনের গভীরে তৃপ্ত করতে পারেনা। রূপবতী নারী হবার যে সংকীর্ণ পরিচয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে নির্দৃষ্ট করে দেয় তা সে আন্তরিকভাবেই অতিক্রম করতে চায়। তার এই অস্থিরতা, অতৃপ্তি আসলে গঠনের দিনগুলোতে নারীর আত্নপরিচয় নির্মাণের দুর্বার কিন্তু ব্যার্থ বাসনার প্রকাশ।

“আমার ভিতরে এক বদ্ধ পাগলীর বাস। সারাদিন হোঃ হোঃ করে হাসতে চায়, হাউ মাউ করে কাঁদতে চায়…উঃ বাবা! জ্বলে গেল! মদ খেয়ে যদি মাতাল হই একবার! যদি সাতজন বা জোয়ান মিলিটারি আমাকে তাদের ব্যারাকে টেনে নিয়ে যায়!

এইসব নিয়মভাঙা কথা সেই পাগলী সব সময়ে ভাবছে। যত ভাবে তত গা নিসপিস করে, হাত পা সুল সুল করে, মন গলায় দড়ি বাঁধা হনুমানের মত নাচতে থাকে।”(পৃষ্ঠাঃ৩২-৩৩)

“যদি সাতজন বা জোয়ান মিলিটারি আমাকে তাদের ব্যারাকে টেনে নিয়ে যায়!” এই লাইনটিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। বক্তব্যের দুটি অংশ। প্রথম অংশে কাটু ভাবছে সাতজন পুরুষ যদি তাকে টেনে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় অংশে কাটু ভাবছে যদি জোয়ান মিলিটারি তাকে তাঁদের ব্যারাকে টেনে নিয়ে যায়। আমি মনে করি কাটুর দিবাস্বপ্নের এই লাইন দুটিতে অপহরণ, এবং গণ ধর্ষণের মত সহিংস অপরাধকে যৌন কল্পনা বা ফ্যান্টাসি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই বক্তব্যে মনে হতে পারে গণ ধর্ষণের মত নিকৃষ্ট সহিংসতা গল্পের মূল নারী চরিত্র কামনা করছে। মনে হতে পারে গল্প, উপন্যাস যেহেতু বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি নারী সত্যি হয়তো ধর্ষিত হতে চায়!

পুরুষ সব সময় নারীকে ধর্ষণ করেছে, কিন্তু সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং তার অনুসারীদের আগমনের পরই পুরুষের ধর্ষণের ভাবাদর্শ, ধর্ষণ এমন একটা বিষয় যা নারী কামনা করে এই আদর্শের উপর নির্ভর করতে শুরু করলো। নারী প্রাকৃতিকভাবে মর্ষকামী এবং যন্ত্রণা কামনা করে প্রথম এই প্রস্তাবনা করেন ফ্রয়েড ১৯২৪ সালের “দা ইকোনমিক প্রবলেম ইন ম্যাসোকিজম /(The Economic Problem In Masochism) নামের একটি রচনায়” তার নারী অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান হ্যালেন দইচ ১৯৪৪ এবং ১৯৪৫ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত “সাইকোলজি অফ উইমেন/ Psychology of Women” বইতে নারীর মনস্তত্ত্ব বিষয়ে তার মতবাদ প্রকাশ করেন। আমেরিকান নারীবাদী সুজান ব্রাউনমিলারের ভাষায় “আমি দইচের তত্ত্ব থেকে জানলাম যে মর্ষকামিতা নারীস্বভাবের অপরিহার্য উপাদান, এবং কাম তৃপ্তির একটা শর্ত…”(পৃষ্ঠাঃ৩১৬, নিজের অনুবাদ) দইচের সাহসী, মৌলিক তত্ত্বায়নের প্রচেষ্টা প্রশংসা করলেও ব্রাউন মিলার বলেন “বলার অপেক্ষা রাখেনা ফ্রয়েডের তুলনায় আমি বিশ্বাস করি সে নারীর প্রকৃত এবং ধারণাতীত ক্ষতি করেছে।”(পৃষ্ঠাঃ৩১৬) দইচ মনে করেন যে অল্প বয়স্ক মেয়েদের কল্পনার জগত সচেতন এবং অবচেতন ধর্ষণের চিন্তা দিয়ে পূর্ণ থাকে। ফুলচোর উপন্যাসের কাটুর দিবাস্বপ্ন এই ধারনার প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু ব্রাউনমিলার একে ভিন্নভাবে দেখেন। ব্রাউনমিলারের ব্যাখ্যা করেন যে পুরুষের যৌন কল্পনা স্থুলভাবে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে প্রকাশিত। কিন্তু নারীর যৌন কল্পনা ভিন্ন বিষয়। খুব কমই নারীকে কার্যকর যৌন দিবাস্বপ্ন অনুসন্ধান আবিষ্কারের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সঙ্গমের বিষয় আসলে এই ইচ্ছাকৃত সাংস্কৃতিক গড়মিলের কারনে তিনি মনে করেন বেশিরভাগ নারী অতৃপ্ত কল্পনার অধিকারী। সত্যিকার বিকল্প না থাকায় নারীর উপযুক্ত যৌন কল্পনার পুরুষালী ধারনায় নারীকে নিমজ্জিত হতে হয়েছে অথবা তারা নিজেদের কল্পনা করতে অক্ষম হিসেবে পেয়েছে। তাই সচেতন, অবচেতন ধর্ষণ দিবাস্বপ্ন(২) আসলে অল্প বয়স্ক মেয়ে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর পুরুষের যৌনতার পৃথিবীতে নিজেদের যৌনতা খুঁজে পাবার, সংজ্ঞায়নের প্রচেষ্টা।

কাটুর দিবাস্বপ্নে স্পষ্টভাবেই সহিংসতার সাথে যৌনতা মিলিয়ে ফেলেছেন লেখক যা ব্রাউন মিলারের ব্যখ্যা মতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষালী যৌনতার প্রতিফলন।

যৌনতায় সহিংসতা, বৈরিতা বিষয়ে আন্দ্রিয়া ডরকিনের তত্ত্বায়নের দিকে লক্ষ্য করি। তার ভাষায়শত্রুতা পুরুষের যৌন চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত যৌন উত্তেজনার মূল উপাদান হিসেবেসাধারনভাবে সঙ্গতিপূর্ণ সঙ্গীদের যোগাযোগের তুলনায় সামাজিক স্তরের মধ্যে,জাতির মধ্যে, সঙ্গীর মধ্যে যারা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভিন্ন, সংঘর্ষ (যৌন)উত্তেজক পরিস্থিতিতে বেশি সহজে চালিত হতে পারেপুরুষালী ব্যবস্থায় যৌন তৃপ্তির উৎক্রান্তি দাবি করে শত্রুতার উৎক্রান্তি, বিপদের তীব্রতা।(পৃষ্ঠাঃ১৫৯, নিজের অনুবাদ)

অর্থাৎ বৈরিতা, শত্রুতা পুরুষের যৌন চিন্তায় যৌন উত্তেজনা ও তৃপ্তির শর্ত হিসেবে কাজ করে। গল্প, উপন্যাস, চলচিত্রে প্রায়ই এরকম উদাহরন দেখতে পাওয়া যায়। বউ পেটানোর ঘটনা প্রায়ই চিত্রিত করা হয় খুবি আকর্ষণীয় পুরুষালী কাজ হিসেবে, দেখানো হয় হয় এই ধরনের শারীরিক নির্যাতনের পর স্ত্রী স্বেচ্ছায়, তৃপ্তির সাথে স্বামীর বশ মানছে। ভারতীয় উপমহাদেশের লেখকরা একা নন বিশ্ব সাহিত্যের রথী মহারথী লেখকেরা বউ পেটানোকে যৌন উদ্দিপ্পক একটা কাজ হিসেবে চিত্রিত করেছেন এমন উদাহরন পাওয়া যাবে। ও’হেনরীর ছোট গল্প ‘এ হারলেম ট্র্যাজেডি’ র অনুবাদ ‘দুই বান্ধবীর ঘরকন্না’ এরূপ মর্ষকামি চিত্রায়নের প্রকৃষ্ট উদাহরন। গল্পে সদ্য বিবাহিত দুই বান্ধবীর একজন মাতাল সহিংস স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন নিয়মিত। সে গায়ে, চোখে কালশিটের দাগ সগর্বে বান্ধবীকে দেখিয়ে বলেন “তোর জন্য সত্যি বড় দুঃখ হয়রে ম্যাগি! কিন্তু সব্বাই তো জ্যাকের মতো বর পেতে পারে না। তাহলেও তো আর এত তালাকের হিড়িক পড়তো না। একটা কথা তোকে কানে কানে বলি, ঐ সকল অতৃপ্ত বৌদের কি দরকার জানিস, অমন একজন পুরুষ যে কিনা সপ্তাহে অন্তত একদিন তাঁদের আচ্ছা করে ঠেঙাতে পারে। তারপর আদর করবে, চুমু দেবে, এমনকি চকলেট এনে দেবে। তাহলে দেখতিস, ওদের জীবনের প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গিই বদলে যেতো।”(পৃষ্ঠাঃ৬৩) কাটুর কল্পনার “জোয়ান মিলিটারি” সেই পুরুষালী সহিংসতার সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি। বেশিরভাগ নারীর মতই কাটু এই সহিংস পুরুষালী ভাবমূর্তিকে কামনা করার দীক্ষা পেয়েছে। তাই জোয়ান মিলিটারি ব্যারাকে টেনে নিয়ে যাবার মত অপহরণ, এবং গণ ধর্ষণের ইঙ্গিতবাহী দিবাস্বপ্নে কাটু উত্তেজিত বোধ করে বলে দেখানো হয়।

আবার কাটুর মনের অবস্থার দিকে তাকাই। “মানুষের মনে কত কি থাকে তার হিসেব নেই। সেই হোটেলের ঘরে আবার যখন ঢুকছিলাম তখন খুব খারাপ লাগল না। বরং মনে হোল দোষ কি? কে জানবে? আমার জীবনটা বড় বাঁধা পথে চলছে। একটু এদিক ওদিক হোক না। কিন্তু শঙ্গুদা যখন দরজার ছিটকানি তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল তখন সমস্ত প্রস্তুতিটা কেটে গেল। ছেলেদের মুখে ওরকম কাঙালপনা আমার এমন ঘেন্না হয়!…আমি চেয়ারে বসে রইলাম। বুকের উপর একটা হাত আড়াআড়ি রেখে দৃঢ়ভাবে। তারপর সারারাত চলল অনুনয় বিনয়, পায়ে ধরা, মাথা কোটা, কান্না হাসি। আক্রমন এবং প্রতিরোধ। একটা রাত যে কত লম্বা হতে পারে তার কোন ধারণা ছিলনা আমার।”(পৃষ্ঠাঃ৪৪-৪৫)

আতঙ্কিত, ভীত অবস্থায় সারাদিন পার করে হোটেল ঘরে যাবার পর সে কৌতূহলী বোধ করে। কিন্তু অবদমিত নারী হলেও সে শেষপর্যন্ত একজন ব্যক্তি যার নিজস্ব রুচি, ইচ্ছা, অনিচ্ছা আছে। তাই শঙ্গুর হয়রানীমূলক যৌন আক্রমন সে খারিজ করে “ছেলেদের মুখের কাঙালপনা” নামের মেয়েলী দোষ হিসেবে। সে “জোয়ান মিলিটারির ব্যারাকে টেনে নিয়ে যাওয়া” মত অপহরণ, ধর্ষণের ইঙ্গিতবাহী কল্পনা করলেও শঙ্গুর যৌন আক্রমন সে ঠিকি খারিজ করে। খুবি স্পষ্ট পুরুষালী দিবাস্বপ্ন কাটুকে তার নিজের শরীর ও যৌনতা নিয়ে স্পষ্ট কোন ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করেনি, যেমন করেনা বাস্তবেও।

জনসন যেভাবে বলেন  “‘পুরুষতন্ত্রে নারী হিসেবে জন্মানো হোল শত্রু সীমার পেছনে জন্মানোসেখানে টিকতে হলে নারীকে তাদের নিজের এবং পুরুষের দ্বিখণ্ডিত বাস্তবতায় বাঁচারসাথে সংগ্রাম করতে হয়। পুরুষের পৃথিবীতে নারী এখন এবং সব সময়ই আগন্তুক ছিল, পুরুষের কাছে এবং তাদের নিজেদের কাছেও…”(পৃষ্ঠাঃ৯৬, নিজের অনুবাদ)   

কাটুর যৌনতা নিয়ে এই অস্পষ্ট মনোভাব নারী, পুরুষের দ্বিখণ্ডিত বাস্তবতায় নারীর যৌনতার ভাষা খুঁজে পাবার সংগ্রামের দিকে ইঙ্গিত করে। জনপ্রিয় চলচিত্রে, গল্পে, উপন্যাসে নারীর প্রতি হয়রানিমূলক, সহিংস আচরণের যৌন উত্তেজক ছবি আমরা সব সময়ই দেখি। নারীর মনও এমন দিবাস্বপ্নে পূর্ণ থাকতে পারে কিন্তু তার অর্থ এই নয় নারী যৌনতায় বৈরিতা, সহিংসতা কামনা করে।

নারী নিজেই ধর্ষণের জন্য দায়ী এই ধারণা পুরানো। পূর্ব, পশ্চিম সকল দেশেই এই পুরুষতান্ত্রিক ধারণা বিভিন্ন মাত্রায় প্রচলিত। উপন্যাসের চরিত্রও সমাজে বিদ্যমান ধারণার প্রতিধ্বনি করবে এটাই হয়ে আসছে। “ভৈরব কাকা একবার দারোগা কাকার সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে বলেছিলেন যেসব মেয়েদের উপর অত্যাচার হয় তারা হয় নিজের ইচ্ছেতেই বশ মানে না হলে ভয়ে হাল ছেড়ে দেয়। কথাটা ঠিক। শঙ্গুদা রাজি করাতে না পেরে শেষ রাতে জোর খাটাতে লাগল। সে এক বীভৎস লড়াই। কিন্তু সে লড়াই শেষ হওয়ার আগেই ভোর হয়ে গেল। আমার গায়ে কয়েকটা আঁচড় কামড়ের দাগ বসে গিয়েছিল শুধু। আর কিছু নয়।”(পৃষ্ঠাঃ৪৫)

ফুল চোর উপন্যাসের একটি ছোট্ট চরিত্র ভৈরব কাকা। তার ধারণা মতে নারীরা পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছাতেই বশ মানে নয়তো হাল ছেড়ে দেয়। যদি এই ধরনের বক্তব্য পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতার শিকার নারীকে দোষারোপ করে অভিযোগ খারিজ করতে ব্যাবহার করা হয় তবে তা সন্দেহাতীতভাবে নারী বিদ্বেষী। কিন্তু যদি এই বক্তব্যের মাধ্যমে নারীকে সামাজিক,সাংস্কৃতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে তোলার দিকে ইঙ্গিত করা হয় তবে তা নারীবাদী বিশ্লেষণের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। অনুমান করি এখানে নারীর নিষ্ক্রিয় অবস্থা বোঝাতেই এখানে ভৈরব কাকা নামের চরিত্র এমন বক্তব্য দেন। নারীর এই নিষ্ক্রিয় অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেন সুজান ব্রাউনমিলার। তার মতে যৌন সহিংসতার প্রথম ধাক্কায় নারীরা ইন্দ্রিয় বৈকল্যের একটি দশার মধ্যে দিয়ে যায়। এর সাথে নারীর জীবনব্যাপী নারী হয়ে উঠবার যে সামাজিক সাংস্কৃতিক দীক্ষা তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। সুজান ব্রাউনমিলার তার “Against Our Will, Men Women And Rape” শীর্ষক গ্রন্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ধারাবাহিক ধর্ষক ও হত্যাকারীর বর্ণনা দেন। রির্চাড স্পেকের একটি ঘটনা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এর মধ্যে দিয়ে শারীরিক সহিংসতার প্রেক্ষিতে নারীর ইন্দ্রিয় বৈকল্যের দশা খুব স্পষ্টভাবে পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন। ১৯৬৬ সালের সিরিয়াল ধর্ষক রির্চাড স্পেকের ঘটনায়, শিকাগোতে আটজন নার্সিং ছাত্রী একজন পুরুষ এবং একটা ছুরির হুমকিতে বিছানার চাদরের পট্টি দিয়ে নিজেদের বেঁধে ফেলতে এবং ঘর থেকে একজনের পর একজনকে সরিয়ে নিতে দিল। হত্যাকাণ্ডের একমাত্র টিকে যাওয়া কোরাজন আমুরাও, ২৩ বছর বয়েসী ফিলিপিনো বাকিদের পরামর্শ দিয়েছিল দলবদ্ধ হয়ে পালাতে। অন্যরা তাকে বলে আতঙ্কিত হয়ে এমন কিছু না করতে যা ধর্ষককে উস্কানি দিবে, কারণ তারা ভেবেছিল অন্য ঘরে যা হচ্ছে তা ছিল “কেবল ধর্ষণ”। কোরাজন আমুরাও বিছানার নীচে গড়িয়ে নিজেকে লুকালো এবং স্পেক সমহিমায় গুনতে ভুল করলো। বাকিরা ভেড়ার পালের মত তাঁদের হত্যাকাণ্ডের দিকে পরিচালিত হোল। পরদিন সকালে আটটি মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। প্রত্যেককেই ছুরিকাঘাত এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণের শিকার নারীরা ভেবেছিল ধর্ষণে বাঁধা না দিলে তারা হয়তো প্রানে বেঁচে যাবেন কিন্তু দুঃখজনকভাবে রির্চাড স্পেক তাঁদের প্রাণভিক্ষাও দেননি। বর্ণনা অনুযায়ী অনেকক্ষেত্রে খুনি এবং ধর্ষক এমন মনোভঙ্গী প্রকাশ করেন যাতে বোঝা যায় যে ধর্ষণে বাঁধা না পাওয়ার জন্যই তারা জীবন বাঁচানোর শর্ত জুড়ে দেন, কিন্তু বাঁধা না দিলেও তারা ধর্ষিত নারীদের হত্যা করেছেন। প্রাণ নাশের আতঙ্কও নারীকে বিবশ করে দেয়। তাই ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের মত সহিংসতায় নারীর কার্যকর প্রতিরোধ না করতে পারার, নিস্ক্রিয়তার পেছনে ইন্দ্রিয় বৈকল্যের মত বহু কারণ আছে।

ব্রাউন মিলারের ভাষায় এটা কোন বিস্ময় না যে শারীরিক আগ্রাসনের সম্মুখীন হলে বেশিরভাগ নারী গোড়াতেই ভেঙ্গে পড়ে এবং ইন্দ্রিবৈকল্যে ভোগে। আমরা প্রশিক্ষিত হয়েছি কাঁদতে, মিষ্টি কথায় ভুলাতে, অনুনয় করতে, পুরুষ রক্ষাকর্তা খুঁজতে, কিন্তু আমরা কখনই লড়াই করতে এবং জিততে প্রশিক্ষিত হইনি। (পৃষ্ঠাঃ৪০২, নিজের অনুবাদ)  

আবার কাটুর মুখে শোনা যায় “তবে একটা কথা আমি জানতাম। কোন মেয়ে যদি ইচ্ছে করে না করে তবে দশটা পুরুষেরও সাধ্য নেই তাকে রেপ করে। মেয়েদের তেমনি ক্ষমতা প্রকৃতি দিয়ে রেখেছে। মেয়েরা যে ভোগের জিনিস তা কি ভগবানের মত চালাক লোকে জানেন না?”(পৃষ্ঠাঃ৪৫)

মূল চরিত্র কাটু এখানে পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়েই কথা বলে ওঠেঃ “কোন মেয়ে যদি ইচ্ছে করে না করে তবে দশটা পুরুষেরও সাধ্য নেই তাকে রেপ করে, মেয়েদের তেমনি ক্ষমতা প্রকৃতি দিয়ে রেখেছে।” শীর্ষেন্দু আমার কৈশোরের প্রিয় লেখক, তার অনেক উপন্যাস পড়েছি আমি। আজ বুঝি তার নারী, পুরুষেরা বাস্তবের মানব মানবীর মতই পুরুষতান্ত্রিক। প্রকৃতির দোহাই দিয়ে নারীর অধস্তনতা বৈধ করার যে ঐন্দ্রজালিক সাহিত্য রচনা পদ্ধতি শীর্ষেন্দু তার বাইরে নন মোটেও। তাই ধর্ষণ যে নারীর দোষেই ঘটে তা একজন নারীর মুখেই শুনতে হয়। নারীর যেমন “প্রাকৃতিক ক্ষমতা” আছে যখন খুশি যৌন উত্তেজনা একেবারে রুখে দিতে তেমনি তার “প্রাকৃতিক ক্ষমতা” আছে দশজন পুরুষের ধর্ষণের আক্রমন রুখে দিতে! তাহলে যুদ্ধ, তথাকথিত শান্তির সময়ে, পূর্ব, পশ্চিমের সকল দেশে ধর্ষণ, গণ ধর্ষণের যে খবরগুলো প্রতিনিয়ত বেরোয় তাতে নারীর আসলে সম্মতি আছে! এমন কথা যদি নারীই বলে ওঠে তাতে সর্বসম্মতিক্রমে যেন জয়ী হয় পুরুষতন্ত্র। আর ধর্ষণের প্রতিবাদকারী নারীবাদীরা পরিনত হন কিছু উন্নাসিক মহিলায় যারা হয়তো যৌন অতৃপ্তিতে ভুগছে! গল্প, উপন্যাস, চলচিত্রে এমনকি বাস্তবেও নারীকেই তাই সবচাইতে নারীবিদ্বেষী কথা বলতে শুনি কারন তাতে পুরুষতান্ত্রিক ধারণা পুনপ্রতিষ্ঠিত হয় খুব সহজেই আর প্রমানিত হয় নারীই কামনা করে তার ধর্ষণ। আর যে নারী ধর্ষণের পেছনে নারীর আকাঙ্ক্ষার ঘোষণা দেন তিনি পুরুষতন্ত্রের কাছে প্রমান করেন তার বিশ্বস্ততা। যখন প্রমান করা যায় ধর্ষণ আসলে নারীর আকাঙ্খিত তখন তা আর অভিযোগ হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারেনা। তাতে সবচাইতে বড় সুবিধাপ্রাপ্ত হন অভিযুক্ত ধর্ষক এবং তাকে নীতিগতভাবে সমর্থনকারীরা। পুরুষতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষায়, বৈধকরণে তাই এটা খুব জরুরী যে নারীও বলে উঠবে নারীর সম্মতি ব্যাতিত ধর্ষণ ঘটেনা।

 

টিকা, তথ্যসূত্রঃ  

(১) “ফুলচোর” উপন্যাসের সংক্ষেপঃ

গল্প শুরু হয় কর্ণ মল্লিক নামের এক সরকারী চাকরিজীবীর পারার প্রতিভাবান অথচ গরীব গায়িকা লিচুর হারমোনিয়াম কেনার ঘটনা দিয়ে। কর্ণ মল্লিক খুবি উদার ও উদাসি এক তরুন চাকুরে। সরকারী নিয়ম ভেঙ্গে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রান বিতরনের দোষে সে প্রশাসনের কোপানলে পড়েন। তাকে কলকাতা থেকে বদলি করা হয় কাটু নামের চরিত্রের শহরে। কাটুর হবু শ্বশুরবাড়ির আত্নীয় কর্ণ মল্লিক। ধনী পরিবারের অপরূপ সুন্দরী কন্যা কাটুর গোছানো সুন্দর জীবনে কর্ণ মল্লিকের আবির্ভাব একটা হুমকি স্বরূপ। বছর কয় আগে কাটু কলকাতা যায় মামার বাড়ি। মামাতো ভাই শঙ্গু তার প্রেমে পড়ে কিন্তু যখন বোঝে কাটুর সম্মতি নেই তখন হোটেলে তার সাথে রাত কাটাতে বাধ্য করতে চায়। সামাজিক “মান সন্মানের” চাপে পড়ে কাটু যেন তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় তাই সাক্ষী হিসেবে সে সেদিন তার সকল বন্ধুদের দাওয়াত করে, তাঁদের আগাম জানায় যে “এই আমার ভাবী ওয়াইফ।”(পৃষ্ঠাঃ৪৩) সেই বন্ধুদের একজন কর্ণ মল্লিক। প্রথম দর্শনে কাটুর মনে হয় কর্ণ মল্লিক কে সে যেন কোথায় দেখেছে, কর্ণ মল্লিকও তেমনি মনে করে। কিন্তু দুজনের কেউই মনে করতে পারেনা কোথায়। অবশেষে বজ্রাহতের মত কাটুর মনে পড়ে যায় শঙ্গুর বন্ধু সে এবং তার জীবনের সেই ভয়াবহ দিনের সাক্ষী তার শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়। কিন্তু কর্ণ মল্লিক কোনভাবেই মনে করতে পারেনা কাটুকে। পুরোপুরি বিভ্রান্ত করতে কাটু তাকে মিথ্যা বলে যে সে কখনো কলকাতা যায়নি। কর্ণ মল্লিকের জানালার পাশের বাগানে সে প্রতি ভোরে ফুল চুরির নামে হাজির হত। সে নিশ্চিত করতে চাইত যেন তার কোনভাবেই সেই দিনের কথা না মনে পড়ে। কাটুর ঠাট্টা, রসিকতা, ছেলেমানুষি এবং সৌন্দর্যে কর্ণ মল্লিক এতটাই মোহগ্রস্ত থাকে যে সে তার মাথার আঘাতকেই স্মৃতি বিভ্রান্তির জন্য দোষারোপ করতে থাকে। কিন্তু তবুও মনে পড়ে যায় তার কলকাতার কাটুকে, সাথে সাথে “শঙ্গু বিষণ্ণ গলায় বলে দোষটা আমারই। ও রাজি ছিলনা।… কাটু নরম হয়নি, হলে আজ আমাদের ফ্যামিলিতে একটা বিরাট গণ্ডগোল হয়ে যেত।”(পৃষ্ঠাঃ৫৭) কর্ণ মল্লিক দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে কাটুর প্রতি, তার নিজের বাগদত্তা শায়ান্তনীর চেয়েও বেশি। কাটুও প্রেমে পড়ে তার। ট্রেনে ডাকাতের আক্রমনে গুরুতরভাবে আহত হয় কর্ণ মল্লিক। শরীরে ভঙ্গুর, মনে বিভ্রান্ত অবস্থায় সে ভাবেতে থাকে কাটুর কথা যে প্রতি ভোরে ফুল চুরির নামে তাকে এলোমেলো করে দিত।

(২) ধর্ষণ দিবাস্বপ্নঃ

ব্রাউন মিলার হেলেন দইচ “ধর্ষণ দিবাস্বপ্ন” শব্দবন্ধটি ব্যাবহার করেন বলে উল্লেখ করেন। একই সাথে এর সমালোচনাও করেন। তার মতে অতিরঞ্জিত পুরুষালী চরিত্রের স্বপ্নে নারীকে আক্রমন করার পেছনে নারীর ধর্ষকামী যৌনতা নয় বরং ভিন্ন যৌক্তিক কারণ আছে। আর তা হোল ডাকাত, সৈনিক ইত্যাদি আগ্রাসী পুরুষালী চরিত্রগুলোর প্রতি স্বাভাবিক ভয়। এগুলোকে ধর্ষণ দিবাস্বপ্ন নাম করণ করা অপ্রয়োজনীয়। অনুমান করি সমালোচনার সুবিধার্থেই তিনি একটি অধ্যায়ের নাম রাখেন ধর্ষণ দিবাস্বপ্ন।

হৃদয় বৃত্তান্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৯, প্রথম সংস্করন ডিসেম্বর ২০০৯

নোবেল পুলিৎজার ও বুকার বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ গল্প, অনুবাদ মোবারক হোসেন খান, পলল প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃ ৬৩

শ্রেষ্ঠ গল্প, মানিক বন্দোপাধ্যায়, অবসর, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮,পৃ ৪২

সিমোন দ্য বোভোয়ার, দ্বিতীয় লিঙ্গ, অনুবাদ হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃ ১৮১

The Beauty Myth, How Images of Beauty Are Used Against Women, Naomi Wolf, Perennial, First Published in 1991, Page 12, 16

PORNOGRAPHY MEN POSSESSING WOMEN, ANDREA DWORKIN, A PLUME BOOK, First Published in 1989, Page 158, 159

Against Our Will, Men Women And Rape, Susan Brownmiller, Fawcett Books, First Published in 1975, Page 316, 402

SEXUAL HARASSMENT, Contemporary Feminist Perspectives, OPEN UNIVERSITY PRESS, Buckingham. Philadelphia, First Published in 1997, Page 96



Categories: সংস্কৃতি-রাজনীতি

Tags:

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: