সম্মতি নিয়ে ধর্ষণ?

cs 06

পরিমলের শাস্তির দাবীতে ২০১১ সালে শহীদ মিনারে জন সমাবেশ

সম্মতি নিয়ে ধর্ষণ?

নাসরিন সিরাজ

আজ (২৫ নভেম্বর ২০১৫) ভিকারুন্নিসানুন স্কুলের শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে আদালত শাস্তি দিলেন ঐ একই স্কুলের দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করার অপরাধে।

ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালে। আমাদের দেশের এমনই দুরাবস্থা যে ছাত্রীটি তার ওপর ঘটা এই ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের ঘটনার কথা স্কুল কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ আকারে জানালে তারা আইনের আশ্রয় না নিয়ে উল্টো অপরাধীকে রক্ষা করার যাবতীয় চেষ্টা চালায়। ছাত্রীদের পোষাক ও আচরণ ধর্ষণকে আমন্ত্রণ জানায় এরকম প্রচারণাও চালায় স্কুল কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু বাংলাদেশের একমাত্র আশার স্থল তারুণ্য ও শিক্ষর্থী সমাজ এই ভয়াবহ অন্যায় ও ধর্ষণকে প্রশ্রয় দানকারী কোন প্রচারণা মেনে নেয়নি। সেই সময় খুব দ্রুত ভিকারুন্নিসানুন স্কুলের ছাত্রীরা ধর্ষণকারীকে আইনের আওতায় আনার জন্য, তাদের সহপাঠীর প্রতি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। স্কুলের ভেতর থেকে শুরু করে আন্দোলনটি জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে যায় শিক্ষর্থীদের প্রতিবাদের জোয়ারে।

আজ ধর্ষক পরিমল জয়ধরের শাস্তির পেছনে রয়েছে শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনের শক্তি।

অবশ্য আমার আজকের লেখার বিষয় ছাত্রীদের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন নয়। আমি লিখছি ধর্ষক পরিমল জয়ধরের উকিলের একটি মন্তব্য নিয়ে। টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিককে তিনি মন্তব্যটি করেন। তার মক্কেল যে নিরাপরাধ সেটি প্রচার মাধ্যমে প্রচার করতে তিনি মন্তব্যটি করেন। আর সাংবাদিকে বাবাজিও এমন ধর্ষক-পক্ষ যে পাল্টা প্রশ্ন না করে অমোঘ সত্য আকারে দিব্যি সেই মন্তব্যটি টিভিতে প্রচার করে দিলেন।

মন্তব্যটি কি? খবরে দেখলাম আদালত প্রাঙ্গনে দুই পক্ষের উকিলের মন্তব্য নিচ্ছে সাংবাদিকরা। খবরের ইন্ট্রোতে মূল হাইলাইট ছিল তদন্তকারী কর্মকর্তাদের চরম গাফিলতি নিয়ে আদালত যে মন্তব্য করেছেন সে বিষয়টি। মানে, অপরাধী উচ্চ আদালতে যাবে সে বিষয়টি মাথায় রেখেই যেন সংবাদ করা হচ্ছে। সাংবাদিক বাবাজি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে প্রচার করতে যে ধর্ষক পরিমল নিরাপরাধ। এভাবে ধর্ষক-পক্ষ রিপোর্টের এক পর্যায়ে ধর্ষক পক্ষের উকিল বললো, “…এমনকি মেডিকেল রিপোর্টে প্রমাণ মেলেনি যে জোরপূর্বক ধর্ষণ ঘটেছে”।

এই মামলায় অভিযোগকারী হল একজন স্কুল পড়ুয়া, আইনের ভাষায় নাবালিকা, অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক। আইনের ভাষায় সম্মতি দেবার বয়স হয়নি তার। সেই বিচারে যৌন সঙ্গমে অভিযোগকারী কাউকে সম্মতি দিলেও সেটা আদালতের কাছে ধর্ষণই। এই যুক্তিতেই এই মন্তব্যটি টিভি প্রচার মাধ্যম প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে পারতো। কিন্তু সম্ভবত তারা ধর্ষক পরিমলের পক্ষে সাফাই গাইবে কসম কেটেছে তাই অভিযোগকারীর “নাবালিকত্ব ” বিবেচনা করে তারা এমনকি পাল্টা প্রশ্নও করেনি । এটা হল এক নম্বর সমস্যা।

দ্বিতীয়, এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল ধর্ষণ হয়নি দাবী করতে গিয়ে বেআক্কেল বা বেশী আক্কেল সম্পন্ন উকিলটি বলে বসেছেন ধর্ষণটি আসলে মেয়েটির সম্মতিতে ঘটেছে। আমার প্রশ্ন উকিলটি আসলে ধর্ষণ বলতে কি বোঝেন? উনি কি ধরে নিয়েছেন সকল যৌন সঙ্গমের নামই ধর্ষণ? নাকি সকল ধর্ষণই সহবাস?

“জোরপূর্বক ধর্ষণ ঘটেছে”, “জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে” এরকম বাক্যগঠন ধর্ষণ সংক্রান্ত রিপোর্টে অহরহ দেখতে পাই। এর মানে দাঁড়ায় যে ধর্ষণ আছে দুই রকম: ১. সম্মতির ধর্ষণ ২. জোরপূর্বক ধর্ষণ। কিন্তু ধর্ষণ মানেই তো এমন এক আগ্রাসী যৌন আচরণ যেটায় বলপ্রয়োগ, ভয় দেখানো অবধারিত। নয় কি? সম্মতি থাকলে তো সেই আচরনের নাম হয় প্রেম, ভালবাসা বা সহবাস।

আমার মনে হয় আসলে এটা ঠিক ভাষার ব্যকরণগত সমস্যা নয়। এটা আসলে বক্তার সহবাস ও ধর্ষণ দুটো আচরণকে মগজের ভেতরের ভাবনায় আলাদা করতে না পারার অক্ষমতা বা শয়তানি ক্ষমতা। শয়তানি ক্ষমতা বললাম কারণ এটা আসলে লেখক ও বক্তারা ভুল করে লিখে ফেলে বা বলে ফেলে এরকম আমার মনে হয় না। বরং আমার মনে হয় ধর্ষণের সময় নারীটির সম্মতি ছিল বা সে যথেষ্ট বাধা দেয়নি এসব যুক্তি দিয়ে ধর্ষককে বাঁচিয়ে দেবার রাস্তা আগাম তৈরী করে রাখে “জোরপূর্বক ধর্ষণ” ধারণাটি।



Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ

Tags: ,

2 replies

Trackbacks

  1. What is Consent Rape? | Shunyastan
  2. Consensual Rape? | Alal O Dulal

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: