১৪ ফেব্রুয়ারী ‌স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিব‌সে ঠোঁটকাটার সাথে কমরেড মোশরেফা মিশু

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম আর্কাইভ
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম আর্কাইভ

ঠোঁটকাটা: ঠোঁটকাটা থে‌কে অামরা স্বৈরাচার বিরোধী অা‌ন্দোলন সংগ্রা‌মে ছাত্রী‌দের অংশগ্রহন‌কে ধী‌রে ধী‌রে লি‌পিবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছি । তারই সূত্রধ‌রে অাপনার সা‌থে অালাপ কর‌তে এ‌সে‌ছি। সেই অান্দোল‌নে অাপ‌নি নি‌বিড়ভা‌বে যুক্ত ছি‌লেন। ১০মাস জেল খে‌টে‌ছেন। অামরা অাজ‌কে ১৪ ফেব্রুয়ারী স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিব‌সে অাপনার অ‌ভিজ্ঞতা জানতে চাই। কেমন ছিল সময়টা?

মোশরেফা মিশু:  ১৯৮৩ সা‌লে অা‌মি ছাত্রী কর্মী। অা‌মি তখন ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভা‌গের ১ম ব‌র্ষের ছাত্রী।
‘৮২ সা‌লের ২৪ মার্চ এরশাদ রাতের অন্ধকা‌রে ক্ষমতা দখল ক‌রে। রাজ‌নৈ‌তিক দলগুলো শুরু‌তেই অান্দোল‌নে অংশগ্রহন নি‌য়ে দোদুল্যমানতার ম‌ধ্যে ছিল। এরই ম‌ধ্যে এরশা‌দের শিক্ষামন্ত্রী ম‌জিদ খান শিক্ষানী‌তি ঘোষণা ক‌রে। ছাত্ররা ম‌জিদ খা‌নের স্বৈরতা‌ন্ত্রিক গণ‌বিরোধী এই  শিক্ষানী‌তির বিরু‌দ্ধে অা‌ন্দোলন শুরু ক‌রে। ম‌জিদ খা‌নের স্বৈরতা‌ন্ত্রিক শিক্ষানী‌তি বা‌তি‌লের দা‌বি‌তে ছাত্র‌দের স‌চিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারী । ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের মধুর কে‌ন্টিন থে‌কে ছাত্রছাত্রী‌দের মি‌ছিল স‌চিবাল‌য়ের দি‌কে যাওয়ার প‌থে বর্তমান শিক্ষাভব‌নের অন‌তিদূ‌রে পু‌লিশ অত‌র্কিতে মি‌ছি‌লে হামলা ও এলোপাথারি গু‌লিবর্ষণ ক‌রে। পু‌লি‌শের গু‌লি‌তে সে‌দিন অ‌নেক ছাত্রীছাত্র হতাহত হয়। নিহত‌দের ম‌ধ্যে জাফর, জয়নাল, অাইয়ূব, মোজা‌ম্মেল, কাঞ্চন, দিপালী সাহা নিহত হন। শতা‌ধিক ছাত্রছাত্রী অহত হয়।

স্বভাবতই স্বৈরাচা‌রের সাম‌রিক শাসনবিরোধী ছাত্র অা‌ন্দোল‌নের একজন কর্মী ছিলাম। সেই  অা‌ন্দোল‌নে ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের ছাত্রীরা অত্যন্ত সাহসী ভূ‌মিকা পালন ক‌রেছে। ‘৮২ থে‌কে ৯০ পর্যন্ত ছাত্র অা‌ন্দোল‌নের ছ‌বিগুলো য‌দি অাপনারা দে‌খেন তাহ‌লে ছাত্রী‌দের এই সাহসী ও অগ্রগামী ভূ‌মিকার বিষয়‌টি স্পষ্ট হ‌বে। এই  অা‌ন্দোলন কর‌তে গি‌য়ে অা‌মি ও অন্যান্য ছাত্রী কর্মীরা বহুবার পু‌লিশী অাক্রম‌নে মারাত্মক অাহত হ‌য়ে‌ছি। তারপরও সাম‌রিক স্বৈরাচারবিরোধী এই  অা‌ন্দোল‌নে ছাত্রীরা বীর সৈ‌নি‌কের ভূ‌মিকা থে‌কে পিছপা হন‌নি। এমন‌কি অামরা রা‌তেও রোকেয়া  হল, সামসুন্নাহার হলের ছাত্রীরা হ‌লের ভিত‌রে সাম‌রিক স্বৈরাচারবিরোধী মি‌ছিল সমা‌বেশ ক‌রে‌ছি। অা‌মি রোকেয়া হ‌লের অাবা‌সিক ছাত্রী ছিলাম। অামরা হ‌লের ভিত‌রে ছাত্রী‌দের রু‌মে রু‌মে লিফ‌লেট বিতরন ক‌রি এবং  হ‌লের ভিত‌রে পোস্টার  লাগাই ও দেয়াল লিখন ক‌রি। রাত ৮ টায় অামরা বি‌টি‌ভি’র সংবাদ দেখার জন্য হ‌লের টি‌ভি রু‌মে জমা‌য়েত হতাম। বি‌টি‌ভি’র সংবাদ দে‌খে অামরা স্বৈরাচার এরশা‌দের কর্মকান্ড জানার, বোঝার  চেষ্টা করতাম। সংবাদ কিম্বা নাট‌কের বির‌তিতে টি‌ভির ভ‌লিউম ক‌মি‌য়ে দি‌য়ে অামরা ছাত্রী‌দের ম‌ধ্যে লিফ‌লেট বি‌লি‌য়ে দিতাম এবং অা‌ন্দোল‌নের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করতাম। ছাত্রী‌দের‌কে কর্মসূচী‌তে অংশগ্রহ‌নের অাহবান জানাতাম এবং কেন এই  কর্মসূচী‌তে অংশগ্রহন করা উ‌চিৎ তা বক্তৃতার মাধ্য‌মে ছাত্রী‌দের সাম‌নে তু‌লে ধরতাম।

ছাত্রছাত্রী‌দের চলমান অা‌ন্দোল‌নে ভীত হ‌য়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার কিছু‌দিন পর পরই বিশ্ব‌বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করত, হলগুলো খা‌লি ক‌রে দেয়ার নি‌র্দেশ দিত। টি‌ভি‌তে এই  সংবাদ দেখার সা‌থে সা‌থে প্র‌ত্যেক‌টি হ‌লে হ‌লে ছাত্রীছাত্ররা “‌স্বৈরাচা‌রেরঘোষণা, ছাত্র সমাজ মা‌নে না” এই শ্লোগান দি‌য়ে মি‌ছিল করত। এই  শ্লোগান দি‌য়ে অামরা রোকেয়া হ‌লের মধ্যরাত পর্যন্ত মি‌ছিল সমা‌বেশ করতাম। সে সময় অামরা বি‌টি‌ভি ও বি‌বি‌সি”র সংবা‌দ শুনতাম রাজ‌নৈ‌তিক প‌রি‌স্থি‌তি বোঝার  জন্য। মা‌ঝে মাঝেই  অামরা দেখতাম জ‌হিরুল হক হল, সূর্য‌সেন হলসহ ছাত্রহলগুলো থে‌কে মি‌ছিল নি‌য়ে রোকেয়া হ‌লের সাম‌নে দি‌য়ে প্রদ‌ক্ষিন করত। রোকেয়া হ‌লের ছাত্রীরা মি‌ছিল কর‌ছে এইটা দে‌খে ছাত্ররা উল্লা‌সে ফে‌টে পরত। ছাত্ররা শ্লোগান ধরত – “রোকেয়া হল এ‌গি‌য়ে চল, অামরা অা‌ছি তোমাদের  সা‌থে”। “ছাত্রী বোনেরা এ‌গি‌য়ে চল, অামরা অা‌ছি তোমাদের সা‌থে”। সে সময় ছাত্রছাত্রী‌দের ম‌ধ্যে একটা চমৎকার কম‌রেড‌শিপ ছিল। অামা‌দের ম‌নে হত অামরা সব ছাত্রছাত্রীরা একই প‌থের প‌থিক। অামরা যে কেউ যে কোনদিন  লাশ হ‌য়ে যে‌তে পা‌রি এই  অনুভূ‌তি অামা‌দের‌কে পরস্প‌রের প্র‌তি সন্মান, শ্রদ্ধা ও সহমর্মীতার বন্ধ‌নে অাবদ্ধ ক‌রে রাখত। সময়টা ছিল উত্তাল, অাগুনঝরা। ম‌নে হত অামরা ছাত্রছাত্রীরা মি‌ছি‌লে মি‌ছি‌লে কথা বল‌ছি। সে সময় বহুবার অামরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ক‌রে‌ছি। সাম‌রিক স্বৈরাচা‌রের তাক করা রাই‌ফে‌লের সাম‌নে দি‌য়ে অামরা ছাত্রছাত্রীরা বীরদ‌র্পে মি‌ছিল নি‌য়ে এ‌গি‌য়ে গে‌ছি।

অামার জীব‌নে প্রথম জেলখা‌টি ছাত্র রাজনী‌তি  করার সময়।

ঠোঁটকাটা: অাপ‌নি গ্রেফতার হ‌লেন ক‌বে?

মিশু:  সাম‌রিক স্বৈরাচার এরশা‌দের পত‌নের পর, তত্ত্বাবধায়ক সরকা‌রের অধী‌নে নির্বাচ‌নের মধ্য দি‌য়ে BNP সরকার গঠন করার ৫ মা‌সের ম‌ধ্যে অা‌মি মিথ্যা অস্ত্র ও ডাকা‌তি মামলায় গ্রেফতার হ‌ই। ‘৮৩ সা‌লে পু‌লিশী নির্যাত‌নের শিকার হ‌য়ে‌ছি কিন্তু গ্রেফতার হই‌নি।

ঠোঁটকাটা: অাপনার নারী কম‌রেড‌দের কথা বলুন,

মিশু:  সে সময় বি‌ভিন্ন ছাত্র সংগঠ‌নে বিপুল সংখ্যক ছাত্রী কর্মী স্বৈরশাসন বিরোধী অা‌ন্দোল‌নেশক্তিশালী ভূ‌মিকা রা‌খে। সক‌লের নাম এই  মূহু‌র্তে স্মরণ কর‌তে পার‌ছি না। ত‌বে জাসদ ছাত্রলী‌গের শি‌রিন অাক্তার, ছাত্র ঐক্য ফোরামের প‌লি অাপা, ছাত্র ইউ‌নিয়‌নের মৌসুমী দাস পুরকায়স্থ এরা ছি‌লেন অগ্রগন্য।

ঠোঁটকাটা:  আমরা এই ছবিতে মিছিলে সবার সামনে দাড়ানো সাহসী নারী কমরেডকে সনাক্ত করার চেষ্টা করছি, এই ছবিটা কি আপনার চেনা, আপনি তাঁকে চিনতে পারছেন?

আলোকচিত্র: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
আলোকচিত্র: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

মিশু:  চিন‌তে পার‌ছি না,অ‌নেক অা‌গের ছ‌বি। ঐ সময়কার অামার নি‌জের ছ‌বিও চিন‌তে কষ্ট হয়।

ঠোঁটকাটা: অন্যসকল সংগ্রা‌মের ই‌তিহা‌সের মতন এই  ক্ষে‌ত্রেও দেখা গে‌ছে নারীর ইতিহাস অাড়া‌লেই থে‌কে গে‌ছে। কিন্তু আলোকচিত্র ভিন্ন কথা ব‌লে—

14 feb pic 2


মিশু: 
একদম তাই। পুরুষতা‌ন্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যাবস্থার কার‌নে নারীর ভূ‌মিকা সব সময়ই অবমূল্যা‌য়িত হ‌য়ে‌ছে। ‘৫২ এর ভাষা অা‌ন্দোলন, ‘ ৭১ এর মু‌ক্তিযুদ্ধের মত ঘটনায়ও অামরা দে‌খি নারীর ভূ‌মিকা যথাযথভা‌বে মূল্যা‌য়িত হয়‌নি। যে কার‌নে ‘৮৩ সা‌লের ১৪ ফেব্রুয়ারীর নারীর ভূ‌মিকা‌টিও সাম‌নে অা‌সেনি। কিন্তু আলোকচিত্র  বাস্তব কথাই বল‌ছে। পুরুষতা‌ন্ত্রিক এই দুনিয়া‌তে এই রকম ঘ‌টেই  চ‌লে‌ছে। এই  অবস্থা প‌রিবর্ত‌নের জন্যই অামা‌দের লড়াই।

অামরা ৮০’র দশ‌কে সাম‌রিকশাসন বিরোধী  লড়াই ক‌রে‌ছি।  জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহা, সে‌লিম, রাউফুল বসু‌নিয়াসহ অসংখ্য ছাত্রছাত্রী সহযোদ্ধার র‌ক্তে ভেজা ই‌তিহাস‌কে কোনভাবেই ভূ‌লে যাওয়া সম্ভব নয়। ১৪ ফেব্রুয়ারী মানুষ যখন ভ্যা‌লেন্টাইন ডে পালন ক‌রে তখন অা‌মি বিষ্ম‌য়ে তা‌কি‌য়ে দে‌খি অার ভা‌বি এ‌দেশ কি অামা‌দের রক্তঝড়া ১৪ ফেব্রুয়ারীর কথা ভু‌লে গে‌ছে?! স‌ত্যিকা‌রের ই‌তিহাস প্র‌তিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র ও সরকা‌রের কোনো ভূমিকা নেই?

ঠোঁটকাটা: ইতিহাসে নারীর সংগ্রামের যে কথা নারী আন্দোলনের কর্মীদের বলার কথা ছিল, দু:খজনক হলো তারাও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে, দেশের ইতিহাসের ডাকে সাড়া না দিয়ে OBR [One Bilion Rising]-এর ডাকে সাড়া দিচ্ছে..

মিশু: অথচ এরশাদ সরকার যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করলো, তখন নারী সংগঠনগুলোর কি বলিষ্ঠ ভূমিকাই না ছিল। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের এই দশাকে বুঝতে হবে আমাদের। যাই হোক,  ৮২ থে‌কে ৯০ পর্যন্ত এ  অা‌ন্দোলন ছিল গণতন্ত্র প্র‌তিষ্ঠার লড়াই। এ  দে‌শে গণতন্ত্র প্র‌তিষ্ঠার লড়াই‌য়ের ই‌তিহা‌সে ১৪ ফেব্রুয়ারীর ঘটনা মাইল ফলক হ‌য়ে স্বর্নাক্ষ‌রে লেখা থাক‌বে। আমার জন্য ১৪ই ফেব্রুয়ারী ভ্যালেনটাইন ডে নয়, OBR- এর Risingও নয়, আমার জন্য আমৃত্য়ু এটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিব‌স হয়েই থাকবে ।

ঠোঁটকাটা: অাপনা‌কে ধন্যবাদ।

মিশু:  ঠোঁটকাটাকেও ধন্যবাদ।

 

[ঠোঁটকাটার জন্য সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেছেন শহিদুল ইসলাম সবুজ]

Leave a comment

Trending