হাবিবা নওরোজ*
ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের ভালো চাকরি পাবার চেষ্টা দেখা একটা বেদনাদায়ক বিষয়। এরা ক্ষমতার সামনে যে আচরণ করে তা থেকে মধ্যবিত্তের নৈতিক অধপতন টের পাওয়া যায়। ভালো চাকরি পাওয়ার আশায়, সফল, চকচকে জীবন পাওয়ার আশায় তারা ক্ষমতার সামনে যেভাবে মাথা নত করে তা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর অর্থ দাঁড়ায় স্রেফ সমস্ত সৃজনশীলতা বর্জন করে কেরানীর মত হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো। আশ্চর্যজনকভাবে এর চর্চা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। সবচাইতে বেশি যে শিক্ষক এনজিওর প্রোজেক্টে কাজ করেন তাঁর আশে পাশেই পাওয়া যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের “বিরল প্রতিভাদের”। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে তর্ক, বিতর্ক, আলোচনা, তত্ত্ব তালাশের সূতিকাগার হবার কথা সেখানে বিপরীত চিত্রটাই সাধারন ঘটনা। শুনতাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের মাস্টারের বাড়ির বাজার করলে, ফাই ফরমাশ খাটলেই নাকি শিক্ষক হওয়া যেত! ছাত্ররা হয়তো এতটুকু করেই পার পেতেন, অনুমান করি ছাত্রীদের আরও অনেক কিছুর ঝুঁকি ছিল। রাজি না হলে, অন্তত দাস সুলভ আনুগত্য না দেখালে ছাত্রীর চরিত্র হনন। আমি নিজেওতো এর শিকার। বিশ্বাস হয়না এরা দেশের সর্বচ্চো ডিগ্রিধারী, সর্বচ্চো নম্বর পাওয়া ছাত্র, ছাত্রী। এতো কেবল আচরণগত দিক!
আমার বিভাগের সিলেবাসে এনজিওর প্রকল্পের এত জাতের বিবরনের হেতু আমি কোনভাবেই খুঁজে পেতামনা! উন্নয়ন বিষয়ে বিভাগ, পড়াশোনা আপেক্ষিকভাবে নতুন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এর বাস্তবতা তৈরি হয়েছে কিন্তু তাতো মৌলিক বইগুলো থেকে কোনভাবেই বেশি জরুরী হতে পারেনা। নারীবাদের মৌলিক বইগুলোর সাথে আদর্শিক বৈপরীত্যের সাথে সাথে এনজিওর ভাষার যে পার্থক্য তাতে অবাক না হয়ে পারতামনা। আশ্চর্য হয়ে দেখতাম নারীবাদের ক্ষুরধার, স্বচ্ছ রাজনৈতিক বক্তব্যের সামনে এনজিওর, প্রোজেক্টের ভাষা কি পরিমান নির্বিষ আর ভোঁতা!
আমার সময়ের জরুরী লেখক অরুন্ধতীর কথা না বলে পারিনা। ২০০০ সালের মার্চে তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ফোরামে আলোচক হিসেবে হেগে যান। সাড়ে তিন হাজার প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, নীতি নির্ধারক, ব্যাবসায়ী, মন্ত্রী, ব্যাংকার পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে একত্রিত হন। প্রত্যেক বক্তৃতা সেখানে শুরু হয় “নারীর ক্ষমতায়ন”, “জনগণের অংশগ্রহন” শব্দবন্ধ দিয়ে অথচ তারা যা করতে চাইছে তা হোল বিশ্বের পানির প্রাইভেটাইজেশন! কে না জানে এতে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রামীণ নারীরা যাকে মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করতে হয়?! অরুন্ধতীর মতে তাই ঐ ফোরামের অভিজ্ঞতা ছিল একজন লেখকের দুঃস্বপ্নের মত। একজন লেখক যেখানে সারাজীবন পার করেন ভাষা এবং চিন্তার মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে সেখানে ঐ ফোরামে চেষ্টাই যেন ছিল নিজেদের অসৎ, অন্যায্যভাবে মুনাফা কামানোর উদ্দেশ্যকে ভাষার মুখোশ পরানো! এনজিওর প্রোজেক্টের ভাষার এই ফাঁদ, চাতুর্য অরুন্ধতীর ঐ লেখায় আমার কাছে সবচাইতে ভালোভাবে স্পষ্ট হয়। মারিয়া মিজ তাঁর “সার্চ ফর এ নিউ ভিশন” বইতে প্রায় একই কথাই বলেছেন। তাঁর সময়ের নারী আন্দোলনের কর্মীরা আবিষ্কার করে যে তাঁদের নারী আন্দোলনের ইতিহাস কিভাবে প্রণালীবদ্ধভাবে একাডেমীর পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তারা এই সত্যও উপলব্ধি করেছে যে তাঁদের পূর্বের নারী আন্দোলনের কর্মীদের দাবি দাওয়া তাঁদের তুলনায় ছিল বহুলাংশে র্যাডিকাল।
আজকের দিনে ফেয়ার এন্ড লাভলি আমাকে সমান অধিকারের জ্ঞান দেয়। নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ যখন ঘোষণা দেয়া হয় তখন সমান অধিকার ইসলাম পরিপন্থী বলে যারা মাঠ গরম করছিলেন জানতে ইচ্ছা করে আজ তারা কোথায়? নাকি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা আর অর্থের সামনে তাঁদের ঈমানি জোশ ঝিমিয়ে পরে?!
একদিকে ধর্মান্ধদের চোখ রাঙ্গানি, অন্যদিকে ফান্ডের টাকায় “নারী আন্দোলনের” গতি প্রকৃতি নির্ণয়। আরও আছে অধিকারের নামে রাষ্ট্রের ভাঁওতাবাজি। এতসবের মাঝে সাধারন শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত পেশাজীবী নারীর যে নিত্যদিনের সংগ্রাম তা দিশা হারাতে থাকে। পৃথিবীর তাবৎ বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষের বিদ্রোহের ভাষা যেভাবে ছিনতাই হয় নারীর বিদ্রোহের ভাষা, ধিক্কারের ঝাঁঝ তেমনিভাবে ছিনতাই হয় প্রতিদিন। খণ্ডিত, লাঞ্ছিত হয়ে ঠাই নেয় প্রোজেক্ট পেপারে। এ আর অবাক কি প্রোজেক্টের উচ্ছিষ্টভোগীরাই বলবে “ফান্ড ছাড়া বাংলাদেশে কোন নারী আন্দোলন হবেনা”!
আন্তর্জাতিক নারী বর্ষও তাঁর দ্রোহের আগুনে পোড়া ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কে নারী শ্রমিকদের সফল সম্মেলন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের ঘোষণা দেন ক্লারা জেটকিন। আজকের অফিসিয়াল দলিলে ক্লারা জেটকিনকে যেমন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর তেমনি দুষ্কর সমাজতন্ত্রী শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নারী দিবসকে খুঁজে পাওয়া।
“দ্বিতীয় লিঙ্গের” লেখক সিমোন দ্য বুভোয়ারের নারী দিবস নিয়ে সন্দেহ যায়না। তিনি এটাকে শ্রমজীবী নারীর সংগ্রামের অর্জন হিসেবেই জানেন। তাঁদের সংগ্রামের ইতিহাস থেকে ছিনতাই হয়ে তাই ৮মার্চ যখন কেবল জাতিসংঘের ঘোষিত দিবসে পরিনত হয় তখন তিনি সাবধানবানী উচ্চারন করেন। নারী আন্দোলনকে কব্জা করার জন্যই, ঝড়কে শান্ত করার জন্যই আজকের এই নারী দিবস।
মধ্যবিত্তের মানস কাঠামোয় ফেয়ার এন্ড লাভলির সমঅধিকারের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তাঁদের কাছে নারীর সমঅধিকার মানে মধ্যবিত্ত, অভিজাত নারীর পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে গ্লসি, চকচকে জীবনের অধিকার। গালভরা নামের, বড় বড় আন্তর্জাতিক এনজিওর নানান প্রোজেক্টের বাক বাকুম! সমাজ, রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন এই গ্লসি সমঅধিকারের ডামাডোলে শ্রমজীবী নারী, বৃত্তের বাইরে এসে আত্নপরিচয় সন্ধানী মধ্যবিত্ত নারীর কণ্ঠস্বর চাপা পড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। বাবা, মার সাথে টিভি দেখতে বসে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির গ্ল্যামারাস সমঅধিকারের প্রচারনা দেখে আমি লজ্জিত হই। ভাবি আত্নপরিচয়ের সংকটে থাকা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঐ গালভরা নামগুলো জপতে না পারলে নারীর অধিকারও বোঝে না, তাঁর নিত্যদিনের সংগ্রামও বোঝেনা। নারীর অধিকার অত সহজ কথা না, প্রতিনিয়ত যুদ্ধ ছাড়া একে অর্জন করা যায়নি কখনো যাবেওনা।
এই আমি ছোটবেলায় আঁকিয়ে হতে চেয়েছি। সেই ইচ্ছা হত্যা করা হয়েছে ইসলামের নামে। বিজ্ঞান না মানবিক শাখায় পড়তে চেয়েছি, সেই ইচ্ছা হত্যা হয়েছে সফল জীবনের নামে। আজ শ্রমজীবী, নিগৃহীত মধ্যবিত্ত নারীর স্বার্থের পক্ষে থাকতে চাই সেই সম্ভাবনা হত্যার পায়তারা চলছে ফেয়ার এন্ড লাভলির গ্ল্যামারাস সমঅধিকার, আর গালভরা নামের প্রতিষ্ঠানের চকচকে চাকরির নামে। তবুও আমি সমঅধিকারের ন্যায্যতায় দৃড় বিশ্বাসী, তাই অরুন্ধতীর কথা দিয়েই শেষ করি “আমার বিশ্বাস এই মানচিত্রের প্রতিটি নাগরিকই সাম্রাজ্যবাদের ভোক্তা নয়। কম হোক বেশি হোক তাঁদের কেউ কেউ অন্যদের নিয়ে ভাবে………আসল সত্য বুঝতে হলে এই বৃত্তের বাইরে এসে অন্যদের কথা, অন্য গল্প শুনতে হবে।”
তথ্যসূত্রঃ
১) দ্বিতীয় লিঙ্গের পরে, সিমোন দ্য বুভোয়ার ও অ্যালিস শোয়া্রজার-এর আলাপচারিতা, আলম খোরশেদ সম্পাদিত
২) সার্চ ফর এ নিউ ভিশন, মারিয়া মীজ
৩) দি অ্যালজেব্রা অফ ইনফিনিট জাস্টিস, অরুন্ধতী রায়
৪) মুক্তস্বর, বিপ্লবী নারী সংহতি
৫) দানবের রূপরেখা, অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকার, হাসান মোরশেদ
হাবিবা নওরোজ একজন আলোকচিত্রী
Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply