আমাদের অনেকের বন্ধু জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয়

মাহমুদুল সুমন

 

সম্ভবত আমেরিকার কোন ছোট শহরের গল্প। একজন মানুষকে একবার একদল মানুষ মেরে ফেল্ল। মানুষটির হাটার মধ্যে একটা ভঙ্গি ছিল, স্মৃতি থেকে যতটা মনে পড়ে, মানুষটা কোমর দুলিয়ে হাটতো। লোকে তাকে নিয়ে হাসতো। কিন্তু বিপর্যয় ঘটলো একদিন। একদল লোক মানুষটাকে মেরে ফেলে। আমাদের সময়ের খুবই প্রভাবশালী দার্শনিক ও লেখক জুডিথ বাটলারের কোন একটা লেখা বা ইন্টারভিউ পড়তে যেয়ে প্রথম জেনেছিলাম ঘটনাটা। যেকোন সংবেদনশীল মানুষের মত বাটলারের মনে এই ঘটনাটি ভীষণ দাগ কেটেছিল। তাঁর একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম জেন্ডার ট্রাবল যেখানে তিনি দেখিয়েছেন, জেন্ডার বিষয়টি একটা পারফর্মেন্স বা নির্মাণের বিষয়। মানুষ আগে থেকেই নারী আর পুরুষে বিভক্ত থাকেনা, বা জেন্ডার আমাদের শরীরে লেখা থাকেনা। বরং চর্চার মধ্য দিয়েই জেন্ডার গঠিত হয়। এই চর্চা নির্ভর করে ডিসকোর্সের উপর, আর এই ডিসকোর্সটাই হচ্ছে সংস্কৃতি বা কোন একটি সমাজের নির্দিষ্ট ইতিহাস। এসব বলবার মধ্য দিয়ে নারী পুরুষের বিভাজনের যে স্বাভাবিকতাবাদী পূর্বানুমানগুলো জনমনে সাধারণত কাজ করে, সেগুলোকেই প্রত্যাখ্যান করতে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি।
জেন্ডার নিয়ে তাবৎ দুনিয়ার অধ্যয়ন নানা গভীরতা অর্জন করেছে। শুধু নারী আর পুরুষ এভাবে না বলে অনেকেই এখন জেন্ডার গ্যালাক্সির কথা বলছেন, বলছেন প্লস্টিসিটির কথা এবং দেখাচ্ছেন কীভাবে এই প্লাস্টিসিটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কেবল নারী ও পুরুষ, এই দুই জেন্ডারে পর্যবসিত। অনেকে আবার ট্রান্সজেন্ডার শব্দটির মধ্যে ধারণ করতে চাইছেন নাানাবিধ লিঙ্গীয় ও যৌনতার আভিজ্ঞতা সমূহকে। এলজিবিটিও (যাতে হয় লেসবিয়ান, গে, বাইসেকসুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) সেইরকম একটি আন্দোলন যা ১৯৭০ এর দশকে ব্যাপক মাত্রায় শুরু হলেও সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ১৯৯০ এর দশক থেকে আমাদের দেশে একটি ভাষা পাচ্ছিল।

 

 

12795396_10153241142831895_4835162406148724333_n

Art work by Hannah Hoch, a dadaist who rearranged photos of white and black body parts in assemblages, interweaving raced beauty ideals. Image: Internet.

 
জুলহাস মান্নান, যিনি এলজিবিটি আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠক ও তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়ের খুনের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন একটা ধাক্কা খেল। পৃথিবীতে ভিন্নতাকে বা ডিফারেন্সকে স্বীকার করে নেবার একটি প্রবণতা ১৯৮০র দশক থেকেই চলছে। ভিন্নতা নানা দিক থেকেই হতে পারে। ভাষা বা এথনিক/ জাতিগত ভিন্নতা বা লিঙ্গীয় ভিন্নতা। মোটা দাগে এটিকেই বলা হয় আইডেন্টিটি পলিটিকস। সেকসুয়াল অরিয়েন্টেশানও একটি ভিন্নতা। এরও রয়েছে দীর্ঘ্য ইতিহাস। সমকামীতা প্রশ্নে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবস্থান উপনিবেশিক একটি আাইনের ভেতর আটকে গেলেও হিজড়া জনগোষ্টীর ক্ষেত্রে (ট্রানসজেন্ডার, যা কিনা এলজিবিটির শেষ পদটিকে প্রতিনিধিত্বি করে) বাংলাদেশ রাষ্ট্রও স্বীকৃতির পথেই গেছে দক্ষিন এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশের মত করে। কিন্তু সমকামীতার প্রশ্নে রাষ্ট্র কোন সুস্পষ্ট অবস্থান নেয় নাই। উপনিবেশিক একটি আইনের বিদ্যমানতা বরং এই ধারণা পোষন করতে সাহায্য করে যে, বাংলাদেশে সমকামীতাকে অপরাধ হিসাবে দেখা হয়। এল জি বি টি আন্দোলন খুব ছোট পরিসরে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে আসছিল। মূলত এই আন্দোলনের লক্ষ্য, সমকামী মানুষ সহ ভিন্ন ভিন্ন সেকসুয়াল অরিয়েন্টেশানের মানুষের মধ্যে যোগযোগ বাড়ানো, নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতার সমবায়ের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের, আস্থার ও নির্ভরতার একটি পরিসর তৈরী করা।

 
এটা সত্য যে বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে পৃথিবীর আরো অনেক দেশের মানুষের মতোই এই ধরনের যৌন অনুশীলনকে সমর্থন করেনা। বাংলাদেশে এই সমর্থন না করবার কারণ হিসাবে অনেক সময় ধর্মকে কারণ হিসাবে দেখানো হয়। বলা হয় ইসলামে এটি নেই। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি একদেশদর্শী। বরং বলা যায় ইসলামের প্রভাব নেই, এমন দেশেও এই ধরনের মতাদর্শ রয়েছে। আফ্রিকার কোন কোন দেশেও এটিকে খারাপ চোখে দেখা হয়। ধর্মগ্রন্থগুলোতে আনেক ক্ষেত্রেই মনে করা হয় যে নারী ও পুরুষ, এ দুটিই হচ্ছে ঈশ্বর প্রদত্ত লিঙ্গ। নারী ও পুরুষের ভেতরকার সম্পর্ককেই স্বাভাবিক মনে করা হয় বই ভিত্তিক ধর্মগুলোতে। সম্প্রতি আইডেন্টিটি নামের বিবিসি ডকুমেন্টারিতে দেখছিলাম, আফ্রিকার কোন একটি মেয়ে, যে কিনা ছোট থেকেই উপলব্ধি করতো যে তাঁর ভিতর ছেলের বৈশিষ্ট্য বেশী (ট্রাপট ইন দ্যা রং বডি), ব্রিটেনের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেক্স পরিবর্তন করে দশ বছর পর দেশে ফেরে। এটি ইন্টারসেক্স একজন মানুষের অভিজ্ঞতা। প্রথমে এই বদল ছেলেটির বোন, বাবা ও মাকে কষ্ট দিলেও পরে এটা তারা অস্বীকার করতে পারেনা যে ছেলেটি তাদেরই সন্তান। উল্লেখ্য, যে পরিবারটির কথা বললাম, তারা একটি খৃষ্টান সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবার।
প্রযুক্তির বদলের ফলে আল্লাহ প্রদত্ত অনেক কিছুতেই মানুষ হাত লাগিয়েছে। সেই সুবিধা পেয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজ, সম্প্রদায় ও ধর্মগোষ্ঠীর মানুষ। আশির দশকের মাঝামাঝি সৌদি আরবে একবার দেখেছিলাম কোন এক সৌদি প্রিন্স এর মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে টিভিতে ভীষণ মাতামাতি। ঐ দেশটি শরীয়া আইনে চলে, বাদশাহদের নামের সাথে সবসময়ই জুড়ে দেয়া হয় কাস্টডিয়ান অব দ্য টু হলি মস্ক এর কথা অর্থাৎ সৌদি বাদশা হচ্ছেন মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত খাদেম। কিন্তু দেশটিতে প্রিন্স এর মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে উল্লাসের শেষ ছিলনা! সেই স্কুল বয়সের আমি তখনও ভেবেছিলাম, প্রিন্সতো চাঁদে যায়নি! শুধু মহাকাশে অভিজ্ঞ নভোচারীদের সাথে মহাকাশ যাত্রী হওয়াতে এত সেলিব্রেশনের কী আছে? মাস জুড়ে সৌদি সরকারী টিভিতে সেই সেলিব্রেশান চলেছে। প্রযুক্তি ও নতুন জ্ঞানকে খুব কম সমাজই এড়াতে পেরেছে। এই আজকের আমাদের ট্রান্সজেন্ডার বা ট্রান্স সেক্স নিয়ে ভাবনা নানা রকম প্রযুক্তি ও জ্ঞানের বিকাশের মধ্য দিয়েই সম্ভব হয়েছে। তাই আগে আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে যাই ভাবিনা কেন এবং আমাদের এই বিষয়ে সামাজিক জানা বোঝা, মতাদর্শ যাই থাকুক না কেন তার বদল ঘটছে।
এখানে মনে রাখা জরুরী, প্রযুক্তির বাহিরে আমরা কেউ নেই। প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনাও প্রযুক্তির সুবিধা পায়। বলা বাহুল্য, আমেরিকায় ডান পন্থার (নিও কনস) উত্থানের পেছনে টেলিইভানজেলিজমকে দায়ী করা হয়, আর এই ক্ষেত্রে ইসলামও পিছিয়ে নেই দক্ষিন এশিয়ায়। এই মত ভিন্নমত চলতেই পারে এবং প্রযুক্তি বিকাশের কারণে আমাদের সামনে আরো বড় হয়ে হাজির হতেই পারে। এতে কিন্তু আপত্তি দেখিনা। সাঈদিকে চাঁদে দেখতে পাবার কথা আমার পরিচিত একজন মুঠোফোন মারফতই পেয়েছিলেন এবং আকাশে উঁকি দিয়ে চাঁদটাকে একবার দেখতেও চেষ্টা করেছিলেন। যদি কিছু দেখা যায়। এই চেষ্টাতে আপত্তি দেখিনা। বোঝাপড়ার এই ধরনের এপিস্টেমলজি পশ্চিমেও একেবারে অপরিচিত নয়। সো এনজয় ইয়োর রেসপেক্টিভ এপিস্টেমলজিক্যাল পারফরর্মেন্স!

 

আপত্তি দেখি তখনই, যখন মানুষ তার যৌনচর্চার জন্য হত্যার শিকার হয়। জুলহাস ও তনয়ের বেলায় তাই হল। তবে এরকম পরিকল্পিত হত্যাকান্ড এখন এই দেশে ২০১৩ থেকে নিয়ম করেই চলছে। অনেকে বলছেন ’নিউ নর্মাল’। এই সকল হত্যাকান্ড কারা করলো তাঁর বেশিরভাগ সম্পর্কে আমরা এখনও জানিনা। এতগুলো হত্যাকান্ডের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তদন্ত খুব বেশী এগোয়নি। সরকারের দিক থেকে এই সকল হত্যাকান্ডের দায়ভার সরকার বিরোধী পক্ষদের হাতে তুলে দেবার একটা সাধারণ প্রবণতা আছে। জুলহাস মান্নানের হত্যাকান্ডের পর সরকারের মন্ত্রী যখন মন্তব্য করলেন যে সমকামীতা আমাদের সমাজে মানানসই নয়, তখন মনে হল তিনি যেন একধাপ এগিয়ে গিয়ে প্রকারান্তরে হত্যাকেই সমর্থন করলেন। এই ধরনের উচ্চ পদস্থ মন্তব্য তদন্ত কাজকে বাঁধাগ্রস্ত করে বলেই মনে হয়। তাই সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে সকলেরই উচিৎ একটু চুপ থেকে তদন্তের কাজে সহায়তা করা। তা না করে ঢালাও মন্তব্যে পলিটিক্যাল মাইলেজ (পলিটিক্যাল মাইলেজ সরকারের পক্ষে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে আমি অবশ্য নিশ্চিত নই!) পাওয়া গেলেও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারীর সংখ্যাও কিন্তু বাড়বে। এসব মন্তব্য না করে বরং খুনীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ মানুষের বিচার চাওয়া যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে সরকারের প্রয়োজনও ফুরাবে। তাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান খুনীদের।

 

এই দাবী তোলার জন্য আমাকে/ আমাদের ‘অন্য’ বানাবেন না প্লিজ!



Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ

1 reply

  1. I condemn the keeling of Zulhas and Tnony and it would be better if the political administration let the killings to be investigated in a normal process rather than the comma inverted comma guided process .Which at the end of the day put this process in to an archive of special cases and committee

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: