পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসের অন্য পাঠ: যুগতারা দেওয়ানের জীবন পর্ব ২
রনজিৎ দেওয়ানের* নেতৃত্বে সংগঠনের প্রথম পাঠ
সমারী চাকমা
রাংগামাটিতে ৭২/৭৩ সালের(সঠিক সময় মনে নেই) দিকে রনজিৎ দেওয়ান ও তাঁর বন্ধুরা একটা সাংস্কৃতি দল গঠন করেন। তিনি আর তাঁর বন্ধু প্রমদেন্দু চাকমা, কলেজের ছাত্র, দুজনে মিলে দিঘীনালায় আমাদের গ্রামে এসে হাজির হলেন। সেটা কোন সালে আমার মনে নেই। সম্ভবত: লারমা বনই এমপি হবার পরে। উনারা এসে প্রথমেই আমাদের নিয়ে একটা বনভোজনের আয়োজন করলেন সেখানে আমরা সকলেই যোগ দিলাম। তাঁরা সাথে করে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে এসেছিলেন। ওখানেই আমি প্রথম ‘ঝিমিত ঝিমিত জুনি জ্বলের, মুর দেজর দেবাত তলে, ইয়ান আমা দেজ, ইয়ান বেগ দেজ’ এই চাকমা গানটি শুনি। আর গানটি শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো গান এর সুর আর কথা শুনে। কী গান এটা! এভাবেই তাদের সাথে আমার পরিচয় আর পরে নানান কাজের মধ্যে দিয়ে আমাদের কাজের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। তাদের সাথে আমি ঘুরতে লাগলাম এখানে ওখানে। ওরা যে কাজ করতে বলে আমি সেকাজ বিনাবাক্যে করে দিতাম। আমার জীবন বদলে যায় তাদের সংস্পর্শে এসে। বলতে পারো রনজিৎ দেওয়ান হচ্ছে আমার রাজনীতির প্রথম গুরু। এভাবে তারা রাংগামাটি থেকে প্রায়ই আসতে লাগলেন। আমিও তাদের সাথে ঘুরতে আর কাজ করতে লাগলাম। অনেক সময় তাদের সাথে দূর কোন পাহাড়ে গ্রামে চলে যেতাম। ফলে আমার অনেক লোকের সাথে পরিচয় হয়ে গেল যারা জুম্ম জাতির জন্য কাজ করে।
আমার এসব কাজ করা নিয়ে বাড়ী থেকে কোন বাধা ছিলনা। বাবা যদিও মেয়েদের পড়াশুনার পক্ষে ছিলেননা কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আমি একেবারে স্বাধীন মানুষ হিসেবে নানা কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে দিলাম। বলতে পারো একপ্রকার কোন বাধা ছাড়াই নিজের মনের মত কাজ করতে পেরেছি। মাঝে মাঝে এমন হতো, ধান লাগানোর মৌসুমে জমিতে ধান চারা লাগানোর পর সেই যে আমি বাড়ী থেকে বের হতাম আর ফিরতাম ধান পাকার মৌসুমে(হাসি)। তবে গ্রামের লোকেরা প্রতিবেশীরা অনেকে অনেক কথা বলতো। অমুকের মেয়ে, সে একাজ করে। কেন করে, মেয়ে, বিপদে পড়লে কি হবে ?? কিন্তু আমার কানে সেসব কিছুই ঢুকতো না। ঠিক ঠিকানা নেই এমন কত জায়গায় গেছি কাজে, বেড়াতে। এখন মনে হয় তাঁদের সাথে পরিচয় না হলেই হয়তো জীবনে এত কাজ করা হতোনা, কত কিছু দেখা আর অনেক বড় বড় লোকের সাথে পরিচয় হতোই না। আর আমার জীবন এত বৈচিত্রময় হতো না। জানো আমার জীবন নিয়ে আমার বড় রকম কোন দুঃখ বোধ নেই। দেশকে নিজের অস্তিত্বকে ভালবেসে কিছু কাজ করতে পেরেছি, এটাই অনেক আমার জন্য।
তাই বলতে কোন দ্বিধা নেই আমার জীবনের রাজনীতির প্রথম পাঠ আমি রনজিৎ দেওয়ান থেকে পেয়েছি। তিনিই আমার লীডার। আত্মীয়তার সূত্রে তিনি আমাকে নানু বলে সম্বোধন করতেন। প্রায় সময় তিনি আমাদের বুঝাতেন সমাজে দেশে নারীর গুরুত্ব কতটুকু। নারীদের ছাড়া কোন কাজই সম্ভব নয়। পরে রনজিৎ দেওয়ান সরাসরি আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যান। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যার মননে শুধু দেশ প্রেম। নিজের জন্য কিছুই ভাবেননি। দেশের জন্য কত সুন্দর সুন্দর গান লিখেছের গান করেছেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁেক পার্টি থেকে যর্থাথ মূল্যায়ণ করা হয়নি। সেখানে তিনি কিছুই করতে পারলেননা। পরে তিনি স্যারেন্ডার করে দেশে ফিরে আসেন।
চলবে
*রঞ্জিত দেওয়ান,পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবদন্তি, বিপ্লবী সুরকার। তাঁরই হাত ধরে যুগতারা সাংগঠনিক রাজনীতিতে আসেন ।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ, যাপিত জীবন
Leave a Reply