পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসের অন্য পাঠ: যুগতারা দেওয়ানের জীবন পর্ব ৩

পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র* সাথে পথ চলা  ও সদস্যপদ গ্রহণ

সমারী চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতিতে (জন সংহতি সমিতির অংশ) যোগদান করার আগেই থেকেই আমি রনজিৎ দেওয়ান তার বন্ধুদের সাথে কাজ করতাম। এখন বুঝতে পারি তাঁরা আসলে জেএসএস এর হয়ে ফিল্ড ওর্য়াক করতে আসতেন দিঘীনালায়। তো একদিন আমাকে জানানো হলযে জেএসএস তার নারী শাখা মহিলা সমিতি গঠন করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে মাধবীলতা চাকমাকে সভাপতি, দিপ্তী চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক মেয়ে সহ আমাকেও সদস্য করা হয়েছে, যাতে আমরা সকলে বিভিন্ন জায়গায় পার্টির প্রতিনিধিত্ব করতে পারি। তাদের মধ্যে মিতা চাকমা,(পানছড়ি বাড়ি এখন রাংগামাটি থাকে), আলো চাকমা, মিনা ত্রিপুরা- বান্দরবানের মেয়ে। তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবেনা, মিনা দেখতে কী সুন্দর ছিল। আরেকজন বান্দরবানের তঞ্চংগ্যা মেয়ে নাম ভূলে গেছি। এলাকা ভিত্তিক হিসেবে প্রথমে মহিলা সমিতির সদস্যদের অর্ন্তভুক্ত করা হয় পরে আমাদেরকে ডেকে কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়। এরপরে কোন এক সময় মাধবীলতাদি’র সাথে গিয়ে আমরা সকলেই পার্টি প্রধান মানবেন্দ্র লারমা বনই এর সাথে পানছড়ির আদারক ছড়ার ক্যাম্পে গিয়ে দেখা করি। তিনি আমাদের বুঝিয়ে দেন আমাদের সমিতির কাজের ক্ষেত্র। তার পরামর্শ অনুসারে আমরা পরে মহিলা সমিতির আঞ্চলিক শাখা বানিয়ে দিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়।

তবে কখন কোন সালে গঠন করা হয়েছে তা আমরা মনে নেই। আমি সব কিছু লিখে রেখেছিলাম। কিন্তু জীবনে এতবার বাড়ী, ঘর বদলাতে হল, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে হল, আর তাতে আমার সঞ্চিত সব কিছু হারিয়ে গেল (দীর্ঘশ্বাস)।

এভাবে ধীরে ধীরে জনসংহতি সমিতির কাজের গভীরে ঢুকে গেলাম। অনেক সময় শান্তিবাহিনীর ব্যারাকেও চলে যেতাম কাজে বা কারোর সংগে কথা বলতে। জেএসএসএর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া বা কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ আনা নেওয়া বা গ্রামে গ্রামে নারীদের আন্দোলন বিষয়ে বোঝানো সেগুলো আমাদের অনেক কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল। আসলে সবকিছুতো খোলসা করে বলা যায়না। আর সব কাজের বিস্তারিত বর্ণনাও দেয়া সম্ভবনা। তবে অনেক রিস্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি। তাছাড়া গ্রামের মেয়েরা যাতে মহিলা সমিতির অধীনে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারে এই চিন্তা মাথায় রেখে মহিলা সমিতি থেকে আমরা তাঁত, পিনন খাদি, ঝোলা বুনতাম। হাঁস মুরগী গরু ছাগলও পালন করা হতো। আর আমাদের বোনা গামছা লুঙ্গি ঝোলা জেএসএস সদস্যদের সরবরাহ করা হতো তাদের প্রয়োজন অনুসারে। এছাড়াও মহিলা সমিতির উর্পাজিত টাকার কিছু অংশ পার্টিকে দেয়া হতো।(আমি যেসময়ের কথা বলছি তখন মাত্র জেএসএস গঠন হয়েছে, আমাদের মুক্তির জন্য লড়াই করছে। তাছাড়া সেসময়ে উঠতি বয়সের ছেলেরা, পুরুষরা বাজারে যেতে পারত না, কোন পাহাড়ি ছেলেকে বা পাহাড়িকে যদি একবার সেনাবাহিনীর সন্দেহ হতো তখন সংগে সংগে তাকে ধরে নিয়ে যেত তাদেরকে হয়ত আর পাওয়া যেতনা অথবা তাদেরকে মেরে পিটিয়ে পঙ্গু করে ছেড়ে দিত। এভাবে কত হাজার হাজার নিরাপরাধ পাহাড়িকে ‘শান্তিবাহিনী’ তকমা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে বা পঙ্গু বানানো হয়েছে। তাই নিরাপত্তার কারণে তখন বাজার সদাই সহ অনেক কাজ পাহাড়ি নারীদেরকে করতে হতো। আর সেসময়ে কোন আত্মীয় স্বজন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বেড়াতে গেলে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে রির্পোট করতে হতো।) এসব কাজে সকল স্তরের মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু এখন যেভাবে সহজে বলতে পারছি তখন কিন্তু এত সহজ ছিলনা। এখনতো যারা সংগঠন করে তারা কত সুবিধা নিয়ে কাজ করে। আমাদের সময় এত সুযোগ সুবিধা ছিলনা।

এভাবেই জীবনপণ বাজি রেখেই সংগঠন দেশ ও জাতির জন্য কাজ করেছি। তখনতো সবকাজ আমাদের লুকিয়ে পালিয়ে করতে হতো। আর্মির হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। আর পরিচয় পত্র ছাড়া কোথাও যাবার জো ছিলনা। প্রতি পদে পদে চেক হতো। শুধু ছেলেদের মারত না কোন মেয়েকে সন্দেহ করলেও তার গায়ে হাত তুলতে সেনাবাহিনী দ্বিধা করতনা। এসবের মধ্যেই পার্টির কাজকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের সহযোগীতা করার চেষ্টা করেছি। শুধু আমি না আমাদের মহিলা সমিতিতে অনেক মেয়ে ছিল, যারা জীবন বাজি রেখে কাজ করেছে। কারণ তখন ধরা পড়লেই তো মরা।

জেএসএস গঠন হবার পর সে সময় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোন মেয়ে ছিল কিনা আমি জানিনা। তবে আমি সবসময় লতাদি (মাধবীলতা)কে জেএসএস এর প্রতিনিধি হয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে দেখেছি। হতে পারে তিনিই একমাত্র নারী যিনি জেএসএস’র কমিটিতে ছিলেন। আর এজন্যই বোধহয় জেএসএস যখন স্যারেন্ডার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে তখন তাদের তালিকায় ৫০ হাজার সদস্যের মধ্যে নারী হিসেবে একমাত্র লতাদির নাম ছিল এবং সেইই একমাত্র নারী যে আঞ্চলিক পরিষদের সরকারী ভাতা, সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু এটা না বললেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবেযে পার্টিতে নারীদের অনেক অবদান ছিল। নারীরা হয়তো সম্মুখ সমরে গিয়ে যুদ্ধ করতে পারেনি, কিন্তু গুরুত্বপূণ হাজারো কাজ করেছে। আর রাত বিরাতে দিনে যে কোন মুহুর্তে পার্টির সদস্যদের রান্না করে দেয়া সে কথা নাইবা বললাম। অথচ পার্টি নারীদের কোন স্বীকৃতিই দিলনা। এই বিষয়টা কোন হিংসার বিষয় নয়। পার্টি চাইলে এমন অনেক পাহাড়ি নারীকে স্বীকৃতি দিয়ে সন্মান জানাতে পারতো যারা সারাজীবন পার্টিকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। হয়তো একটা বিশেষ খবর দিয়ে পার্টির সদস্যদের সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাচিঁয়েছে। ছোট ছোট কাজ মিলিয়ে তো অনেক বড় কাজ করা হয়। এটা আমার কিন্তু অনেক দুঃখ।

চলবে



Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ, যাপিত জীবন

Tags: , , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: