নাসরিন সিরাজ
বেশ কয়েক মাস আগে রোকেয়া প্রাচী ও প্রসূন আজাদ একটি বিবাদে জড়িয়েছিলেন। কাজটি ছিল একটি টিভি-নাটক বানানো যেখানে প্রাচী ছিলেন পরিচালকের দায়িত্বে আর প্রসূণ ছিলেন অভিনেত্রী। আমার ফেসবুকের সীমিত নিউজফিডে দেখতে পাচ্ছিলাম বন্ধুরা কেউ প্রাচীর পক্ষে কেউ প্রসূণের পক্ষে মতামত প্রকাশ করছে। কেউ কেউ প্রসূণকে বাহবা দিচ্ছিলো কারণ তাদের মনে হচ্ছিল প্রসূন সমাজে দাপটের সাথে বিরাজমান মুরুব্বীয়ানার কাঠামোটি লংঘন করেছে। অন্যদিকে যারা প্রসূণকে তিরষ্কার করছিল তাদের মনে হয়েছে কাঠামোটি লংঘন করা প্রসূণের মোটেই ঠিক হয়নি, বরং বেয়াদপি হয়েছে।
আমি লক্ষ্য করছিলাম যে বিবাদটি কর্মক্ষেত্রে দুই নারী-সহকর্মীর বিবাদ হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছিলো না। কারণ হয়তো “মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু” এরকম অথর্ব বোঝাবুঝির বাইরে পাঠকরা যেতে পারেন নি। অথবা কর্মক্ষেত্রে নারীতে নারীতে প্রতিযোগিতা মূলক আচরণকে গুরুত্ব দেয়া তাদের দরকারই মনে হয়নি। রেচেল রেইনকে নামে এক গবেষকের লেখায় দেখলাম মার্কিন মুল্লুকে কর্মক্ষেত্রে নারীতে নারীতে প্রতিযোগিতাকে কৌতুক করে ডাকা হয় “বিড়ালের লড়াই”। এবং পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীতে একে এমনকি যৌন রসাত্মক ও আবেদনময়ীও বিবেচনা করা হয় (এক পুরুষ [প্রেমিক বা স্বামী] নিয়ে দুই নারীর, ছেলের (হবু) স্ত্রী ও ছেলের মায়ের মধ্যে ফ্যাসাদকেও এরকম বিবাদের উদাহরণ হিসেবে এখানে বিবেচনা করা যায়)। আমি এখানে নারীতে নারীতে বিবাদ, দ্বন্দ্ব ও অনৈক্য গুরুত্ব সহকারে দেখার ও বিশ্লেষণ করার দাবী নিয়ে লিখতে বসেছি। মেয়েদের ঘরের বাইরের কর্মক্ষেত্রে আরও অধিক সংখ্যায় আসা ও এই পরিসরে তাদের নেতৃত্ব জোরদার করতেই দ্বন্দ্বটিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাববার এবং বিশ্লেষণ করার দরকার বলে আমি মনে করি।
নারীদের ভেতর অন্য নারীর বিপক্ষে কতৃত্বপরায়ণ লক্ষণটি বর্ণনা করতে বাংলায় একটি উপমার প্রয়োগ দেখা যায়। সেটা হল মক্ষিরাণী। এই উপমাটির সাথে বাঙালী পাঠক, লেখকরা কম বেশী পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ইউরোপের ডায়েরী-এর সূত্রে। ঐ উপমা দিয়ে ও বর্ণনা করেছিলো ওখানকার “সমঝদারদের” (মূলত পুরুষদের) আড্ডায় মাত্র একজন শিক্ষিত ভদ্রমহিলা থাকতো যে আড্ডার সকল পুরুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো। উপমাটা ও ধার করেছিল মৌমাছিদের মৌচাক থেকে যেখানে মাত্র একটি মেয়ে-মৌমাছিকে সব মৌমাছিরা মিলে পেলে পুষে উৎপাদনশীল বানায়, ডিম পাড়ার ক্ষমতা একমাত্র তারই থাকে। ঐ উৎপাদনশীল মৌমাছিকেই রানী মৌমাছি বা মক্ষিরাণী বলে। দ্বিতীয় কোন মেয়ে-মৌমাছির যদি ভুলেও উৎপাদনশীল হয়ে ওঠার ক্ষমতা/সম্ভাবনা তৈরী হয় তখন তাকে সকল মৌমাছি মিলে বিষাক্ত হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলে। কারণ, একটি মৌচাকে মাত্র একটিই মক্ষিরাণী থাকার নিয়ম নেহাতই প্রাকৃতিক।
মানুষেরা প্রাণীর মত আচরণ করে এরকম ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন হানা আরেন্ড্ট বলে এক রাজনীতি-দার্শনিক। তিনি উল্টো প্রস্তাব করেন ভাবুন না কেন যে প্রাণীরাই মানুষের আচার আচরণ নকল করে। মানুষ (বহু বচন) হবার শর্ত নিয়ে তাঁর লেখা বইয়ে তিনি দেখান মানুষের প্রতিটি আচরণ রাজনৈতিকভাবে নেয়া সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত ও সেই অনুযায়ী সম্পাদিত। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে নারীতে নারীতে বিবাদ মৌমাছিদের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাবে না। তাকাতে হবে রক্তমাংসের নারীর দিকেই।
ঢাকার একজন নারী-সম্পাদক একবার আমাকে ব্যাখ্যা করছিলেন কেন তাঁর পত্রিকায় পিতৃতান্ত্্িরক ও পুঁজিবাদী মতাদর্শ প্রসূত এবং নারীমুক্তি বিরোধী লেখা ও বিজ্ঞাপন পার পেয়ে যাচ্ছে। তাঁর অভিজ্ঞতায় পত্রিকা চলার নীতিমালা বিষয়ক সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয় তখন তিনি তাঁর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ্য ও উচ্চপদস্থ নারী সহকর্মীর কাছ থেকেই সহযোদ্ধাসূলভ আচরণ পান না। এই যে নারী সহকর্মীদের মধ্যে নারীমুক্তির পক্ষে রাজনৈতিক সংহতি তৈরী না হওয়া এর কারণ এক শব্দে বর্ণনা করতে গিয়ে আমার উত্তরদাতা বন্ধুটি বলছিলেন মক্ষিরাণী লক্ষণটির কথা। তাঁর মনে হয়েছে একে তো সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর দৌরাত্বে মেয়েরা সম্পাদকের মত উচ্চ পদে প্রায় নেই বললেই চলে, তার ওপর উচ্চপদে আসীন নারীদের মধ্যে কাজ করে “নিজের রাজত্ব হাতছাড়া হয়ে যাবে” -এরকম আশংকা। ফলে পরষ্পরের সাথে দ্বন্দ্ব ও ফ্যাসাদ করতে করতেই কর্মঠ মেয়েদের সময়, শক্তি, মেধা নষ্ট হয়।
শ্যারন মাভিন নামে এক গবেষক নারীতে নারীতে সংহতি মূলক আচরণ দিয়ে কর্মক্ষেত্র ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা করা যাবে কি না এরকম প্রশ্ন নিয়ে একটি লেখা লিখেছেন। সেটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম নারীতে নারীতে সহযোদ্ধাসূলভ সংহতি ও ঐক্য সহজ, স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক তো নয়! মানে, “মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু” এটা যেমন একটা অথর্ব ভাবনা “মেয়েরাই মেয়েদের কষ্ট বোঝে” এটাও তাই। শ্যারন মাভিন দেখান যে নারী-সংহতি অবশ্যম্ভাবি ধরে নিয়ে বিভিন্ন কর্পোরেট সংগঠনগুলোর উচ্চপদস্থ বয়জেষ্ঠ্য নারীদের ভেতর একটা ভুল আশা তৈরী হয়, যেটা কখনই পূরণ হবার নয়। আসলে আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে সংগঠনের ভেতর বিদ্যমান আধিপত্য পরম্পরা ভেঙ্গে নারী-সংহতি তৈরী করা একটা সক্রিয় প্রক্রিয়া, যেটা আবার সমাজের নানা রকম শর্তের অধীনও বটে।
নিজের কর্ম-অভিজ্ঞতার দিকে খেয়াল করে দেখি মক্ষিরাণী লক্ষণ আমার সাথে আমার নারী সহকর্মীদের সাথে সংহতি তৈরী করতে দেয়নি এরকম ঘটনা রয়েছে অনেক। একটা উদাহরণ দিচ্ছি:
একুশে টেলিভিশনের টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচারের অনুমতি তখনও বাতিল হয়নি যখন আমি দায়িত্ব পেয়েছিলাম “ছানাপোনা” (পরে এর নাম রাখা হয় “স্বপ্নপুরী”) নামে শিশুদের জন্য বিনোদন ও শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনার। পুরুষ সহকর্মীদের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, (প্রচ্ছন্ন) আগ্রাসী আচরণ, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য, অস্বীকারের ফলে আমরা মেয়েরা তখন টিভি-অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও নির্দেশনার কাজে সংখ্যায় ও পদমর্যাদায় কোনঠাঁসা অবস্থায় ছিলাম। তাই দায়িত্বটি আমি মেয়েদের যোগ্যতা, কর্ম দক্ষতা ও নিষ্ঠা প্রমাণ করতে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই। আমাদের দল প্রতি সপ্তাহে তিনটি ২৫ মিনিটের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানের এরকম একটি চুক্তিও মেনে নিই। ক্যামেরার পেছনে কলাকুশলী পর্যায়ে মেয়েদের নিয়োগ করলে তাদের সাথে আপনা আপনিই সংহতি তৈরী হবে এরকম একটা কল্পনা আমার ছিল। ঐ দফায় একুশে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস আমাদের দল নিয়মিত অনুষ্ঠান সরবরাহ করে, প্রতি পণ্যের পেছনে খরচ হয় মাত্র ৮ হাজার টাকা। তার মানে টাকা পয়সার বিচারে আমরা সফল উৎপাদক ছিলাম। কিন্তু এই সময়ে আমার জন্য সবচাইতে কঠিন ছিল সহকারী পরিচালকের সাথে নারী-সংহতি তৈরী করা। কাজের এক পর্যায়ে নির্দিষ্ট সময় ও খরচের মধ্যে অনুষ্ঠান সরবরাহ করার চাপে নারী সহকর্মীটিকে দল থেকে আমি বাদ করে দিই।
এই লেখা লেখার সময় আমার সেই সময়কার আচরণকে একই সাথে স্মরণ ও বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখি আমার আচরণ আসলে একুশে টিভির অর্থনৈতিক লাভ লোকসানের কাঠামোর দ্বারা বেশী প্রভাবিত হয়েছিল। এখানে লাভটা পরিমাপ হচ্ছিল কম সময়ে ও খরচে বেশী পণ্য উৎপাদন। এখানে নারী সংহতি তৈরী করার মত কার্যকলাপে মনোযোগ দেয়া হয়নি, অর্থনৈতিক ভাবে তো নয়ই, রাজনৈতিকভাবেও নয়, না করেছে প্রতিষ্ঠানটি বা ব্যক্তিগতভাবে আমি।
কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতাধর নারী ও তার অধিনস্ত সহকর্মীর সাথে অনৈক্য ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে মহিক্ষরাণী লক্ষণ নিয়ে ভাবতে ভাবতে পাতা উল্টাচ্ছিলাম সুজান স্ট্যানফোর্ড ফ্রাইডম্যানের লেখা। তিনি লিখেছেন নারীদের ভেতর যৌন ও লিঙ্গীয় শাসন-শোষণ এর অভিজ্ঞতটা সাধারণ। এটার ওপর ভিত্তি করে নারীতে নারীতে একটা ঐক্য হতে পারে, কিন্তু নারীদের মধ্যে ভিন্নতাও যে সীমাহীন সেটি গত শতাব্দীর শেষের দিকে নারীবাদীরা তাদের গবেষণায়, লেখালেখিতে তুলে ধরেছেন। এই ভিন্নতা হতে পারে শ্রেণীর, বয়সের, জাতের, বর্ণের, ধর্মের, যৌনতার, ইত্যাদির। নারীতে নারীতে ঐক্য সম্ভবপর নয় এরকম একটা হতাশায় পর্যবসিত হতে হতে বইটার ৪৯ পাতায় এসে চোখ আটকে গেল। এখানে তিনি আলোচনা করছেন ক্যারিবিয়ান-আমেরিকান এক বর্ণবাদ বিরোধী কবি জুন জর্ডানের লেখা “রিপোর্ট ফ্রম দি বাহামাস”-এর। জুন জর্ডান লিখেছেন:
“আমি ওদের পেছন পেছন হাঁটছিলাম…তরুন আইরিশ মেয়েটি আর তরুন দক্ষিণ-আফ্রিকান মেয়েটি, আর দেখছিলাম তাঁরা হাঁটছে বোনের মত, দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরছে, ফিসফিস করছে, পরষ্পরকে নিয়ে তারা নিঃসংশয়, আর আমি উপলব্ধি করলাম ওদের (জাতিগত) কী পরিচয় তার চেয়ে ওরা দু’জনে কী জানে এবং সেই জানাজানির ভিত্তিতে তারা কী করবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে সেটিই তাদেরকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দেবে”।
তার মানে জাতি, বর্ণ, শ্রেণী, পেশা, লিঙ্গ এরকম কোন ধারণাই আপনা আপনি নিপীড়িত নারীতে নারীতে সংযুক্তি তৈরী করবে না। সংহতি শত্রুর সাথেও হাবে না। বরং, মানুষে মানুষে সত্যিকারের সংযোগ হবে কি না সেটা নির্ধারিত হবে আমরা পরষ্পরের মুক্তির জন্য কী করতে পারি সেটার ওপর ভিত্তি করে। আর সেটা পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্য দিয়ে অর্জিত হবে না । বরং মুক্তি কিসে আসবে আর কিসে নারীতে নারীতে সহকর্মীর মত যুক্ততা ঘটাবে সেটা আমাদের নিজেদেরই সক্রিয়ভাবে বের করতে হবে। যেমনটি বলেছেন নৃবিজ্ঞানী ও লেখক রেহনুমা আহমেদ :
“মুক্তি কোন বিমূর্ত ধারণা নয়, এটা কোন পণ্যও নয় যে ক্ষমতাসীন কেউ সেটা সরবরাহ করবে। মুক্তির জন্য শুধু আকাঙ্খা থাকলেই চলবে না, মানুষকে মুক্তির চর্চা করতে হবে।”
আগ্রহী পাঠকরা আরও পড়তে পারেন:
- Mavin, Sharon. (2006). “Venus envy: Problematizing solidarity behaviour and queen bees”, Women in Management Review, 21(4): 264-276.
- Reinke, Rachel. (2010). “Catfight: A feminist analysis”, Chrestomathy: Annual Review of Undergraduate Research, 9: 162-85.
- Arendt, Hannah. (1958). On Human condition
- Ahmed, Rahnuma. (2013). Tortured Truths, Drik Books.
- Freidman, Susan Stanford. (1998). Mappings, feminism and the cultural geographies of encounter. Princeton University Press.
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply