উমে মারমা`

১লা মে আক্রমণের পরে মাজন পাড়ার এই বাড়িতে আরো ৫টি পরিবারসহ সামারি চাকমা প্রায় দেড় বছর ছিলেন, সেই সময়কার নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে আছে বাড়িটা
বিস্মৃতির বিরুদ্ধচারণ: খাগড়াছড়ি ৮৬’র গণহত্যা
আজ ১লা মে ২০১৭। আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবস। এই শ্রমিক দিবসের দিনে ৩১ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলাধীন ৩ উপজেলা পানছড়ি, দিঘীনালা এবং খাগড়াছড়ি সদর এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এক নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। পানছড়ি গণহত্যায় ঠিক কতজন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে সে সংখ্যা আজও অজানা। আর তার তিন দিন পর ৪ঠা মে মাটিরাংগা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়ন-এর রামবাবু ডেবা বর্তমান চংরাছড়ি ৩ নম্বর এলাকায় ত্রিপুরা অধ্যুষিত গ্রামে বাঙালীরা আর সেনাবাহিনী মিলে এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলে। এই ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায় প্রথমে সেনাবাহিনী সব গ্রামবাসীকে গ্রামের পাশে একটা উপতক্যায় জড়ো করার পর সেটেলার বাঙালীদেরকে ডেকে নিয়ে আসে। ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে ঘিরে রাখে সেনাবাহিনীরা। বাঙালীরা এরপর শুরু করে তাদের নৃসংশতা। ঘটনাস্থলেই ৪৩ জন ত্রিপুরা জাতির লোককে হত্যা করা হয়। পরে ঐ এলাকার চাকমাদের গ্রামে হামলা চালিয়ে ঘর বাড়ী পুড়িয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া গেলেও কোন চাকমা হতাহতের খবর পাওয়া যায়না।
এই প্রতিবেদক যে সময়ের কথা বা ঘটনা তুলে আনার চেষ্টা করছে তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম চলছে, এ সময় জুম্ম জনগনের উপর যে সামরিক নিযাতন হয়েছে তা অবর্ণনীয়। সেসব ঘটনা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কাছে আজও অজানা।
আজ চলুন আমরা খাগড়াছড়ি সদর উপজেলাধীন মহাজন/মাজন পাড়া গ্রামে হামলার কথা শুনে আসি। ১মে ১৯৮৬। সকাল ১০ ঘটিকা থেকে ১২.৩০ ঘটনা। স্থান মহাজন পাড়া, খাগড়াছড়ি সদর, খাগড়াছড়ি।
মে দিবস। সঙ্গত কারণেই সেদিন সরকারী ছুটি। চাকুরীজীবী যারা তারাও বাড়ীতে। সেদিন সকাল থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। মহাজন পাড়াটি অবস্থিত একেবারে খাগড়াছড়ি শহরের মূল রাস্তার ধারে। মূলত যে কয়েকটি গ্রামকে কেন্দ্র করে আজকের খাগড়াছড়ি শহর, চাকমাদের ভাষায় হাগরাছড়ি, মারমা ভাষায় খাখ্্ড়া, ত্রিপুরা ভাষায় খাগড়া শহরের গোড়া পত্তন হয় তার মধ্যে এই মহাজন/মাজন পাড়াটি প্রধান। এই গ্রামকে ঘিরেই মূল শহরটি আবর্তিত। আর স্বাভাবিক কারণে এই গ্রামের বাসিন্দারা প্রায় সকলেই চাকমা তবে ত্রিপুরা জাতির কয়েকটি পরিবারের বসবাস আছে।
এদিন আগে খাগড়াছড়ি/হাগারাছড়ির বাসিন্দারা জেনে গেছে যে, মাটিরাংগার তবলছড়ি এলাকায় একজন বা দু’জন সেটেলার বাঙালী মারা গেছে এবং তাদের মৃত্যুতে তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সদস্যদের দায়ী করা হচ্ছে। তো এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে থমথমে খাগড়াছড়ি/হাগারাছড়ি। বাঙালীরা মিছিল শুরু করেছে। সেই মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুরাতন বস্তির বাঙালীর সন্তান জাহেদুল আলম। বর্তমানের খাগড়াছড়ি আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। মিছিল একবার হয়ে গেছে। দ্বিতীয়বারের মিছিল শেষে সেই মিছিল থেকে বাঙালীরা মহাজন পাড়ায় ঢুকে মারধোর, খুন, লুটপাত আর অগ্নিসংযোগ করে। যে হামলায় একজন প্রতিবন্ধী চাকমা নির্মম ভাবে খুন হন আর ১২ টি বাড়ি পুড়ে যায়। সেদিনের বাঙালীদের কর্তৃক পাহাড়ি গ্রামে হামলা নিয়ে কথা বলতে প্রায় ৩১ বছর বাদে খাগড়াছড়ির মহাজন পাড়ার নিবাসী কয়েকজনের সাথে এই প্রতিবেদক কথা বলেন তাদেরই বাড়িতে।
প্রত্যক্ষদর্শী পবন বিকাশ চাকমা (৭৯) এবং তাঁর পরিবার
তিনি স্মৃতি হাতরিয়ে বলতে শুরু করেন, ‘আমার পূর্ব পুরুষরাই এই গ্রামের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। সম্ভবত: ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের সময়। তখন খাগড়াছড়িতো শুধু ঘন জংগল। মানুষজন খুবই কম। বাঙালীতো নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র বাঙালীরা হাটবাজারের সময় হাগারাছড়িতে আসতো। আবার হাটবাজার শেষ হলেই নৌকা করে চলে যেতো। ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দের পরেই হাগারাছড়িতে বাঙালীর বসতি শুরু হয়, এবং তা বেড়ে যায় ৮০’র দশকের সময়। আমাদের গ্রাম হাগারাছড়ি ছড়ার পাড়ে। প্রথমে আমার আজুরা ছিলেন হাগারাছড়ি ছড়ার পূর্ব পাড়ে, বর্তমানের মাষ্টার পাড়ায়। পরে কোন এক সময় ছড়ার পশ্চিম পাড়ে বসতি গড়ে তোলেন। সেই থেকে আমরা এখানে।
পুরোনো দিন ছিল শান্তির দিন। মাজন পাড়ায় ছিল বিশাল বিশাল আম গাছ। নদীর পাড়ে বিশাল একটা তেতুল গাছ ছিল। আর সেসব গাছ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। কি যে সুখ আর শান্তির দিন ছিল তখন। আমরা কোন সময়ও ভাবিনি আমাদের জীবনে এমন দিন আসবে।
১৯৮৬ সালে ১লা মে’র কথা আমাদের সকলের মনে আছে। সেদিন সম্ভবত বৃহস্পতি বার। অফিস ছুটি। তাই আমরা বাড়ীতে সকলেই উপস্থিত ছিলাম। সকাল ১০ টার পরে প্রথমে বাঙালীরা মিছিল করে। আমাদের বাড়ী একেবারে বড় রাস্তার ধারে তাই সবকিছু আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। এখন যেমন অনেক বড় রাস্তা তখন কিন্তু এমন বড় ছিলনা। তবে হাগাড়াছড়ির মেন রাস্তাতো এটাই। রাস্তার সাথে আমাদের অনেক বড় বড় কাঠাল গাছ ছিল। আম ও ছিল। কিন্তু কাঠাঁল গাছ বেশী। তো বাড়ী থেকে সব দেখা আর শোনা যেত। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। প্রথমে মিছিল করে ওরা চলে গেল। তারপর আরো একবার মিছিল করে বর্তমান চেঙ্গী স্কোয়ার পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসার সময় তারা গ্রামের সূর্য শিখা ক্লাবের রাস্তা আর আমার বড় ভাইযের বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে গ্রামে ঢুকে। প্রথমেই তারা মাজন পাড়ার মাঝের অংশে গিয়ে হামলা চালায়। আমরা তখন সবে মাত্র খেতে বসেছি। আমার মায়ের বয়স ৮০’র কাছাকাছি। আমার মেজ ছেলের বয়স তখন ৮ কি ৯ বছর। সে খেতে খেতে বলল ঐযে বাঙালী , বাঙালী। আমরা তাকিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি লাঠি-সোটা নিয়ে বাঙালীরা আক্রমণ করতে এসেছে। আমার জীবনে এই প্রথম দেখছি যে তারা গ্রামে ঢুকে আক্রমন করছে। এক হিসেবে আমরা আসলে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তাদের প্রতিরোধ করার কথা তখন মাথায় আসেনি। আবার আরেকটা বিষয় ছিল সেনাবাহিনীরা।
তো একটু পর বাঙালীরা আমাদের বাড়ীর দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করলো। অবশ্য আমি তার আগেই বড় একটা টেবিল দরজায় রেখে দিয়েছি যাতে দরজা খুলতে না পারে। বাইরে রাখা থুনি মানে খাম্বা দিয়ে তারা জোরে জোরে ধাক্কা মারছিল। আমি আর আমার মেজ ছেলে যতদূর সম্ভব ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। পরে তারা যখন দরজা খুলতে র্ব্যথ হলো তখন নতুন চাল সেলাই করার জন্য রাখা শন থেকে শন নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ঘরের চালে লাগিয়ে দিল। আমাদের বাড়ীর মূল ছাউনিটা ছিল টিন দিয়ে কিন্তু বারান্দাটা ছিল শন দিয়ে। তাই আগুন ধরে গেল। সংগে সংগে পুরো বাড়ী ধোয়াঁয় ভরে গেল।’
পবন বিকাশ চাকমা কথা বলা থামাতেই উনার স্ত্রী যোগ করলেন,‘ধোঁয়ায় পুরো বাড়ী ভরে গেলে আমি আমার ছেলেদেরকে আর আমার শাশুড়িকে সাথে নিয়ে বাড়ী থেকে বের হবার চেষ্টা করা শুরু করলাম। বাঙালীরা যখন গ্রামে ঢুকলো সেই সময় আমার শাশুড়ি সব দরজা শক্ত করে বেঁেধ রেখে দিয়েছিল। এর আগে আমি আমার ৪ ছেলেকে একটা আলমারীতে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিলাম ওরা চুপচাপ যেন ওখানে বসে থাকে। যাই হোক আমি আমার সন্তান আর শাশুড়িকে নিয়ে তাড়াহুড়া করে কোনমতে রান্না ঘরের দরজা খুলে ঘর হতে বেরিয়ে আমাদের বাড়ীর পাশে আমার ননাসের গুদাম বাড়ী আছে সেখানে আমরা চলে গেলাম। আগে থেকেই সেই বাড়ীতে আমার ভাসুর আর তারঁ পরিবার চলে গিয়েছিল। তারা জানলা দিয়ে আমাদের দেখতে পেয়ে দরজা খুলে দেয়। এবং আমার ভাসুর আমাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কোথায়? আমি উনাকে বললাম বাড়ীতে রয়ে গেছে। এদিকে বাড়ী তখন দাউদাউ করে জ্বলছে। হঠাৎ পুড়ে যাওয়া চামড়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে আমরা সবাই ধরেই নিলাম আমার স্বামী হয়তো বাড়ীর ভিতরে পুড়ে যাচ্ছে। (দীর্ঘশ্বাস) কিন্তু খানিক্ষণ পর আমার স্বামী একটা লাল চাদর নিয়ে এই বাড়ীতে চলে এলেন। এই লাল চাদরটাই আমাদের একমাত্র আগুন থেকে বেঁেচ যাওয়া চাদর। পরে ঐ চামড়া পোড়ার গন্ধের উৎস বুঝা গেল। পিনন খাদি বুনার জন্য থাস্যিচাম লাগে এবং সেটা মহিষের চামড়ার ছিল। বাড়ী পুড়ার সময় সেটাও পুড়ে যাচ্ছিল তাই চামড়ার গন্ধ বের হয়েছিল। আমাদের চাকমা কথা আছে — চোরে যদি সবকিছু চুরি করে নিয়ে যায় তাও এককোণ থাকে, কিন্তু ব্রম্মা নিলে সব কোণ নিয়ে যায়। বাড়ী পুড়ে শেষ। আমরা কোন কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। যাকে বলে নিঃস্ব। একমুঠো চালও অবশিষ্ট নেই । আমরা বাড়ী থেকে বের হবার পর বাঙালীরা আমাদের বাড়ী লুট করে আলমিরা খুলে সব নিয়ে যায়। অফিসের একটা সাইকেল ছিল সেটাও নিয়ে যায়।’
মা’র কথা বলা শেষ হবার পর পরই মেজ ছেলে যোগ করলেন, ‘আমার বয়স তখন অনেক কম হলেও আমার সব ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে। ওরা জেঠাবাবুদের বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে ঢুকে প্রথমে জেঠা সখিনা বাবাদের বাড়ীতে হামলা আর আগুন দেয়। পরেই তারা আমাদের দিকে চলে আসে। আমরাতো তখন এতো ছোট প্রতিরোধ করার ভাবনা আসার কথা না। মা আমাদের ৪ ভাইকে একটা আলমারীতে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো যেন আমরা সেখানে থাকি। কিন্তু সেখানে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তাই আমি বের হয়ে আসি এসে দেখি বাবা বাড়ীর সদর দরজায় টেবিল রেখে দিচ্ছে যাতে খুলতে না পারে। আমি গিয়ে দরজার খিল ধরে থাকলাম যাতে খুলে না যায়। বাঙালীরা বাইরে থেকে ধাক্কা মারে আর আমরা ঠেলতে থাকি। সে এক করুণ অবস্থা। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর খুলতে না পেরে ওরা বাড়ীর অন্য দিকে চলে যায়। আর আমি বেড়ায় চোখ লাগিয়ে দেখতেছিলাম এরপর ওরা কি করে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম আমাদের এক পিসীমার স্বামীকে বাঙালীরা ছুড়ি নিয়ে তাড়া করছে আর তাকে ছুড়ি মারছে। হঠাৎ বাঙালীরা বেড়ায় এমন একটা বাড়ি মারলো আর তা একেবারে আমার গালে। সংগে সংগে আমার গাল লাল হয়ে ফুলে গিয়েছিল। কী যন্ত্রণা! তারপর মা আমাদেরকে আর নানুকে নিয়ে সে ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে পিসিদের গুদাম ঘরে চলে গেলেন। বাবা তখনও আমাদের বাড়ীতে। বাঙালীরা তখন আমাদের বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।’
সরকার থেকে কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি ?
ক্ষতিপূরণ! সেওতো এক অপমান। তখন এরশাদের উপদেষ্টা ছিলেন উপেন্দ্রলাল চাকমা। আর খাগড়াছড়ির ব্রিগেডিয়ার ছিল অলি আহম্মদ। মাজনপাড়ার প্রাইমারী স্কুল মাঠে এই অলি আহম্মদ ৫০০ টাকা করে দিতে চাইলে আমরা নেবনা বলার পর উপেন বাবু আমাদের বুঝালেন এই বলে যে তিনি পরে আরো বেশী ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দিবেন। এরপরে কোন খবর নেই। তবে কিছু চাল পেয়েছি। আমার ৪ ছেলের জন্য একটা শার্ট, ২ টা বাসন ২ টা পাতিলা, বললেন পবন বিকাশ চাকমার স্ত্রী।
প্রত্যক্ষদর্শী শুভাশিষ চাকমা (৪৪)
সেদিনের কথা কেউ ভুলতে পারবেনা। আমরাতো পারবোইনা, কারণ সেদিনের বাঙালীদের হামলায়, আমি বলবো বাঙালীদের হামলা কেননা এখন যেমন প্রায় সব হামলা সেটলাররা করে থাকে তখন কিন্তু সে হামলায় অংশ নিয়েছিল অনেক পুরোন বস্তির বাঙালীরা। যাদেরকে আমরা জন্ম থেকে চিনি। যাদের সাথে আমাদের উঠাবসা। সেটেলাররাতো ছিলই। সকাল থেকে মিছিল হচ্ছিল আর সে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগের খাগড়াছড়ির জেলা সম্পাদক জাহেদুল আলম। সাথে আরো কয়েকজন ছিল যাদেরকে আমি দেখলেই চিনি, একজনের নাম পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি সে হচ্ছে এস এম শফি। সেও আওয়ামীলীগের নেতা। আরেকজনের কথা না বললে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবেনা, অরুন ভট্টচার্য। বর্তমান সাংবাদিক তরুন ভট্টচার্যের ভাই। অরুন ভট্টচার্য একেবারে মিছিলের সামনের সারিতে ছিল। সবাই যখন নারায়ে তকবির বলতো সেও আগে ভাগে মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে নারায়ে তকবির বলে শ্লোগান দিত। আমরাতো জানি তিনি একজন হিন্দু ধর্মীয় লোক। যাক
ওরা প্রথমে ঢুকে মধ্য মাজনপাড়ার এলাকা দিয়ে। পরে আমাদের বাড়ীর দিকে আসে। ঘটনায় হতভম্ব হয়ে আমরা হাগারাছড়ির ছড়ার ওপাড়ে পুলিশ লাইনে পালিয়ে যায়। ওখানে গ্রামের অনেকেই ছিল। ওখানে পৌঁছার পরপরই কালো ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। মানে বাড়ী পুড়ে যাচ্ছে। আর সেটা যে আমার বাড়ী তখনতো জানতাম না। এরপর পুলিশরা পাগলা ঘন্টা বাজালেও ওরা পুলিশ লাইন থেকে বের হলনা। যাহোক ঘন্টা খানেক পর আমরা পুলিশদেরকে সাথে গ্রামে ফিরে এলাম। আমরা পরিবারের লোকেরা কে কোন দিকে পালিয়ে গেছি কেউ জানতাম না। আস্তে আস্তে সবাই পোড়া বাড়ীর উঠোনে জড়ো হলাম। সবাই ফিরে আসলেও আমার বুদ্ধি প্রতিবন্ধি জেঠা বাবু ফিরলেননা। আমরা সকলেই ভাবলাম হয়তো কমলছড়িতে চলে গেছে। কেননা কেউ কেউ তাকে বাজারের নীচের দিকে যেতে দেখেছিলেন। পাশের বাড়ির গুদাম ঘরে অনেক পরিবার মিলে রাতটা কাটানোর পর সকালে পোড়া বাড়ীর জঞ্জাল সরাতে শুরু করে দিলাম আমরা। ঘরের অর্ধপোড়া টিন সরাতে গিয়ে আমার বুদ্ধি প্রতিবন্ধি জেঠা বাবুকে মূর্তির মত বসা অর্ধপোড়া অবস্থায় আবিস্কার করলাম ঘটনার ১ রাত পর। আমাদের সকলের ধারণা হলো উনি হয়তো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন পথে তাকে ছুড়ি মারা হলে সে বাড়ীতে ফিরে আসে কিন্তু বাঙালীরা বাড়ীতে আগুন লাগালে আর বের হতে পারেনি। এতে তার মৃত্যু হয়। মাথায় ছুড়ি মারার দাগ ছিল। এরপর পুলিশ আসে, আমরা চেয়েছিলাম পোষ্ট-মর্টেম হোক। পুলিশ পোস্ট-মর্টেম করার জন্য থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু একদিন পর কোন পোস্ট-মর্টেম ছাড়া লাশ আমাদের হাতে ফিরিয়ে দেয়। প্রশাসন থেকে এই লাশের প্রাণের দাম দেয় ৫০০০ টাকা। মাজন পাড়ার ১২টি বাড়ী পুড়ে যায়। সেদিন একই সাথে এই খাগড়াছড়ি শহরের আশপাশ হরিন্যা এলাকায় আর পানখাইয়া পাড়ার একটা অংশে হামলা করে কিছু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
শুধু তাই নয়, আমাদের এক আত্মীয়কে তারা ছুড়ি মেরে খুন করতে চেয়েছিল। তার নাম চপ্পলাল চাকমা। আর যারা তাকে ছুড়ি মারে তাদেরকে সে চিনত। তারা একসাথে উপেন বাবুর স’মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। ঐ বাঙালীরা যখন তাকে ছুড়ি মারতে আসে তখন চপ্পলাল চাকমা বলে এই তোমরা না আমার বন্ধু। আমরা না এক সাথে কাজ করি। তখন তারা নাকি উত্তর দেয় না এখানে কোন বন্ধু তন্ধু নেই। তারপর মাথায় ছুড়ি মারে। ছুড়িটা হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে হাত জখম প্রাপ্ত হয়। পরে সে দৌড়ে এসে গুদাম ঘরে ঢুকে।
প্রত্যক্ষদর্শী সমারী চাকমা (৪২)
আমি তখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি। সেদিন আমাদের বাড়ীতে একটা অনুষ্ঠান ছিল কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ দেখে তারা দুপুরের ভাত না খেয়েই চলে যান। টিপ টিপ বৃষ্টি সকাল থেকে হচ্ছিল। তখন প্রায় ১২ টা বাজে। আামাদের দুপুরের ভাত খাওয়া শেষ। তাই আমি আর দিদি রুমে শুয়ে আছি। এমন সময় আমাদের বাড়ীর ঠিক উপরে চিৎকার চেঁচামেচি, ধুম-ধাম শব্দ। আমরা জানি যে সকাল থেকে বাঙালীরা মিছিল করছে। সকাল বেলায় বাবার অফিসের একজন বাঙালী কলিগ এসে বলে গেছেন যেন আমরা রাস্তায় বের না হই। কারণ রাস্তায় পেলে বাঙালীরা মারবে। তাই ঘরের ভিতর থাকো। যেহেতু তখনও পর্যন্ত বাঙালীরা শহরে পাহাড়ি গ্রামে ঢুকে হামলা করেনি তাই কেউ আমরা ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি যে এই হামলা হবে। যা হোক ঐ চেচাঁমেচি ধুম-ধাম শব্দ শুনে দিদি এক দৌড়ে খাট থেকে নেমে এসে, সেও চিৎকার করতে শুরু করলো, এই বলে যে বাঙালীরা এসেছে আমাদের মারতে। তাড়াতাড়ি বাইরের বেড়ার গেট বন্ধ করে এসে ভিতরের দরজা শক্ত করে বেঁেধ আমরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলাম বাইরের ঘটনা। একটু পর দেখি একজন বাঙালী বড় একটা লাঠি নিয়ে আমাদের বাড়ীর বাউন্ডারীতে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলোনা। হয়তোবা একা বলে। চলে গেলো। আমরা নি:শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। আমি এখন বলতে পারবোনা কিসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেটা কি মৃত্যু না আক্রমন। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের পাশের বাড়ীর লোকেরা বাড়ীর পাশের হাটা পথ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আমরাও সংগে সংগে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেলাম ছড়ার ওপাড়ে পুলিশ লাইনে। কে কিভাবে গেলাম সেটা আর মনে নেই। ভাগ্যিস ছড়ার পানি বাড়েনি। পুলিশ লাইনে পৌঁছার পর দেখি গ্রামে কালো ধোঁয়া। এরপর আমাদের কান্না শুরু হলো। পুলিশদের কত অনুরোধ অনুনয় যে তারা যেন গ্রামে যায়। কিন্তু তারা হাসছিল আর আমাদের সাথে পুলিশ লাইনের বারান্দায় দাড়িঁয়ে দেখছিল কালো ধোঁয়া। পাগলা ঘন্টা বাজা শেষ। ‘ধীরে সু¯ে’’ পুলিশদের কথা মত আমরা গ্রামে ফিরলাম। আমাদের বাড়ী পুড়ে গিয়েছে, ধানের গোলার স্তুপ থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছিল। অনেক ধান তখনও পুড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি পানি দিলাম সেই পুড়ে যাওয়া ধানের স্তুপে। পোড়া ধান থেকে আর্ধেক পুড়ে যাওয়া ধান ভাগ করে নিলাম। আমার পরনে ছিল একটা ছেড়া ফ্রক। আর কিছুই নেই। আর্মি এলো পুলিশ এলো। তারা কাদের জন্য এলো সেটা তারাও জানে আমরাও জানি।
আমরা সাময়িকভাবে আশ্রয় নিলাম পাশের বাড়ীর মাটির একটা ঘরে। মোট ৬ পরিবার একসাথে। প্রথমবারের মতো শরনার্থীর স্বাদ। যে ধানগুলো আধাপোড়া ছিল সেগুলো ঢেকিতে চাল বানিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত সেই আধা পোড়া চাল আমরা খেয়েছি। আজো সেই পোড়া চালের ভাতের গন্ধ নাকে লেগে আছে। সেটা এক অন্য ধরনের তীব্র গন্ধ। খাওয়া কঠিন। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। কত স্মৃতি এখনও মনে। সবকি লেখা যায়। এরপরতো আমাদের পরিবারের একের পর এক বির্পযয়। বাবার যক্ষা ধরা পড়লো। তখন যার হয় যক্ষা তার নেই রক্ষা টাইপ অবস্থা। প্রতিদিন কত গুজব কানে আসে। রাত হলে আতংকে প্রাণ যায় যায়। প্রতি রাতে আর্মিরা এসে বাড়ীতে বাড়ীতে তল্লাশী চালায়। রাতে ঘুমন্ত মানুষকে বের করে লাইনে দাঁড় করিয়ে বাড়ীর সদস্যদের নাম ধরে ধরে মাথা গুনে। যদি মাথা বেশী হয় তাহলে সে নির্ঘাত শান্তিবাহিনী। মা বাবাদের চিন্তা যুবক ছেলেদের যদি ধরে নিয়ে যায়। কিভাবে রক্ষা করবে। থাকা নাই ঠিকমতো খাওয়া নাই ঘুম নাই সবাই অসুস্থ। দিনের আলোতে কোনমতে সময় কাটে। রাত মানেই আতংক। রাত মানেই অন্ধকার।
ঠোটকাটার জন্য এই মৌখিক ইতিহাসভিত্তিক সাক্ষাতকারগুলো গ্রহণ করেছেন উমে মারমা, এপ্রিল ২০১৭।
Categories: আন্দোলন বার্তা, প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে
Leave a Reply