শারমিন আক্তার শিল্পী*
১০ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে ৫টায় শিহাবের আব্বু ঘর থেকে বেরিয়ে অফিসে যায়। ছেলেকে বলে যায়ডিউটি সেরে বিকেলে তাকে নিয়ে কোররবানির গরু কিনতে যাবে।আগের দিন গিয়েছিল কিন্তু পছন্দ হয় নাই। ডিউটি ছিল দুটায়, শিফ্ট চেইঞ্জ করে ‘এ’ শিফট নিয়েছিল, ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত। ছেলে তো সেই যে বসে আছে কিন্তু সেতো আর ফিরে এলোনা। টাম্পাকোর অগ্নিকাণ্ডে তাকে আর পাওয়া গেল না।
আমি ঘুমিয়েছিলাম, ৫:৩০টা বাজে আমার শাশুড়ি এসে ডাকে, আনিস কোথায়? আমি বললাম, ও তো ডিউটিতে গেছে। পরে বলল, টাম্পাকোতে তো আগুন ধরছে, কি করা? আমার মোবাইল খুঁজে পাই না, অনেক্ষণ পরে দেখি মোবাইল বালিশের নিচে, কল দিলাম, প্রথমে একবার রিং হয়েছে, তারপর বন্ধ হয়ে গেছে। আর রিসিভ করে না। ভয় পেয়ে আমরা সবাই মিলে গেলামটাম্পাকোর সামনে। অনেক কান্নাকাটি করেছি, অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি। ওখানে পুলিশরা দাঁড়িয়েছিল, পরে আমাদের আর ঢুকতে দেয় নাই। অনেক হুড়াহুড়ি করার পর টঙ্গী মেডিকেল, উত্তরা, বাংলাদেশ মেডিকেল-টেডিকেল, ঢাকায় যত জায়গা আছে, সব জায়গায় লোকজন খুঁজে দেখেছে, আমরা এদিকে আবেদা, শেফা, সব জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছি, যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কোনো জায়গায়তেই তাকে পাই নাই।
টঙ্গী মেডিকেলে গিয়ে দেখি সাঈদ ভাই বেড-এ শোয়া। ওনার তো এইখানেই বাসা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাইয়া আপনার ভাই কই। উনি অবাক হয়ে ‘আনিস ভাই কই, আনিস ভাই কই’ বলে পাশের বেডগুলি খুঁজতেছে। ‘আনিস ভাই আর আমি তো একসঙ্গে ঢুকছি, আনিস ভাই বাঁয়ে গেছে, আমি ডাইনে গেছি। আমি বের হইছি, আর সে আর বের হতে পারে নাই।’
আমরা আশা ছাড়ি নাই। মনে করলাম হয়ত বেঁচে আছে, হয়ত কোনো চিপে-চাপায় পড়ে আছে, বের হতে পারছে না।আমার ভাই-দেবর-ভাসুর এরা তো ফ্যাক্টরির ভিতরে ঢুকে গেল। প্রায় ১০জন ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারীদের সাথে দিনরাত কাজ করল। নিজ হাতে অনেকের লাশ বের করেছে শুধু তাকে পাওয়ার জন্য কিন্তু তার লাশটা পেলাম না। লাশ বের করছে আর মোবাইল করছে আমাদেরকে, এই লাশ বের করছি, ওইটা বের করছি, আনিস ভাইকে পাচ্ছি না। আমরা মোবাইলে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি আর এদিকে ঘুরছি, অনেক খোঁজাখুঁজি করছি, কোত্থাও তাকে পাই না। অনেক কান্নকাটি করেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে, অনেক লাশ পাশে পড়েছিল।
নয় জন নিখোঁজ তার মধ্যে আটটি লাশ পাওয়া গেছে, সেগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। আমরা সি.আই.ডি অফিসে নমুনা দিলাম, আমার শ্বশুর-শাশুড়ির রক্ত, আমার ছেলের মুখের লালা। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলাম কতদিন লাগবে রিপোর্ট আসতে।তারা বলল, দেড় মাস। তখন মনে করলাম আর দেড় মাস ধৈর্য্য ধরিকিন্তু দেড় মাস ছয় মাস হয়ে গেল। ১৯ জানুয়ারি রিপোর্ট এলো পাঁচ জনের, তার মাঝে আমাদের রিপোর্ট নাই।চারটি লাশের নমুনা ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে। আবার নমুনা দিয়ে রিপার্ট তৈরি করতে হবে, আরও কত দিন লাগবে জানি না।
থানায় যোগাযোগ করলে বলে কোর্ট থেকে ডিএনএ টেস্টিংয়ের নতুন অর্ডার পাশ হবে, তার পরে। আমি বলি, স্যার, আর কতদিন লাগবে বলেন, আগের মতো সময় লাগবে? আগে তো ৫-৬ মাস লেগেছে। কখনো বলে লাগবে, কখনো বলে, না অত দিন লাগবে না। আমার দেবর-ভাসুর যোগাযোগ করলেএকেক দিন একেক কথা বলে। এখন তাহলে আমরা কি করব, কোথায় যাব,কদ্দিনে লাশ বুঝে পাব কে ঠিক-ঠিক বলতে পারবে? ছয় মাসে যেই লাশ পেলাম না, সেই লাশ আর কত দিনে পাব?
আমাদের সব হারিয়েছি, জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছি, আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু দুটো ছেলে আছে, ছোটটিকে এক মাসের আর বড়টিকেপাঁচ বছর বয়সে রেখে গেছে, এরা বাবার আদরসোহাগ সব কিছু থেকে বঞ্চিত হলো।সরকার, কর্তৃপক্ষের কাছে হাড়-হাড্ডি যে টুকরাই থাক, সেটা আমাদের ফিরিয়ে দিন যাতে ছেলেরা বাবার কবরে এক মুঠো মাটি দিতে পারে, বাবার কথা মনে পড়লে কবরের পাশে গিয়ে কান্না করতে পারে, কবর জিয়ারত করতে পারে। তাদের বাবার এটুকু স্মৃতি যাতে থাকে।
৯ই ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশান টঙ্গী আইআরআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান করে নিহতদের পরিবারকে আর আহতদেরকে আর্থিক সহায়তা দেয়। প্রতিমন্ত্রী, এমপি সাহেব, সচিব, এরা এসেছিল। কারো কারো মুখে শুনেছিলাম ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে যেতে বলেছে, আবার কেউ কেউ বললনা, শুধু যাদের ডিএনএ ম্যাচ হয়েছে তারা, আমি ভাবলাম টাকা না পাই, ওখানে গেলে নিশ্চয়ই জানতে পারব কবে আমাদের বাকি ৪টি লাশ দিবে, মন্ত্রী থাকবে, আরো অনেকে থাকবে। অনেক আশায় আমার বড় ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলাম, আমার দুঃখের কথা শোনা তো দূরের কথা,বিল্ডিংয়ের ভিতরেও ঢুকতে দেয় নাই।ছেলেকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরলাম।
আমাদের ডিএনএ নমুনা নষ্ট হয়ে গেছে এটাতো আমাদের দোষ না। শিহাবের বাবা অনেক কষ্ট করে অল্প কিছু টাকা ব্যাংকে জমিয়েছিল আমাকে নমিনি করে। টাকার জন্য ব্যাংকে গিয়ে অনেক্ষণ বসেছিলাম, ব্যাংক আমাদের টাকা দিল না,তারা বলে ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া দেওয়া যাবে না।মনে হয়চারপাশে মানুষ আমাদের নিয়ে ছেলেখেলা করে। আজ প্রায় ৭ ১/২ মাস, আমাদের উপার্জনের লোক নাই, সরকার বা ট্যাম্পাকো, কেউ দুটো টাকা দিয়ে সাহায্য করলনা, কীভাবে আমাদের সংসার চলে খোঁজও নিতে আসল না।
সব জায়গায় আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে। এই কি আমাদের দেশের নিয়ম? মানুষ মারা যায়, মাটি দেয়, ভুলে যায় কিন্তু আমারা কী করে ভুলব? মনে হয় এই যেন সে হেঁঁটে আসছে। তার লাশ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের মনে কোনো শান্তি নেই।
*লেখক টাম্পাকো অগ্নিকাণ্ডে নিহত মেশিন অপারেটার আনিছুর রহমান এর স্ত্রী।
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply