গৃহকর্ত্রী নারীবাদীরা

শবনম নাদিয়া

অনেকদিন আগে শ্রম-অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় গার্মেন্টস কর্মী এক মেয়ের সাথে আলাপকালে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলাদেশে নারীবাদ সম্পর্কে তার ধারণা কী। একটু হেসে উনি বলেছিলেন, ওইটা আপনাদের বিষয়, আপনারাই করেন।

উনার কথাগুলো তখনও আমাকে খুব ভাবিয়েছিল, আর আজকে, খুব তিক্ততার সঙ্গে, নতুন করে বুঝলাম কথাটা কতখানি সত্য।

সুপ্রীতি ধরকে চিনি বামপন্থী এবং নারীবাদী একজন মানুষ হিসেবে। তিনি তাঁর জনপ্রিয় নারীবাদী ব্লগ উইমেন চ্যাপ্টারে একটা লেখা লিখেছেন, যার শিরোনাম হলো ‘গৃহকর্মিরা যখন গৃহকর্ত্রী হতে চায়’।

এই শিরোনামটার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল যে এতে মারাত্মকরকম স্পষ্ট যে ২০১৭-তে এসেও বাংলাদেশী নারীবাদ ‘আমাদের’ বিষয়, ‘ওদের’ না। সে কথায় পরে আসছি, তার আগে লেখার বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষিত নিয়ে দুয়েকটা কথা বলতে চাই।

সুপ্রীতি ধরের লেখাটি পোস্ট করার পর অনেক মন্তব্য দেখলাম মধ্যবিত্ত/উচ্চ্ মধ্যবিত্ত নারীদের যেখানে তারা গৃহকর্ত্রী হিসেবে তারা গৃহকর্মী দ্বারা কতখানি ‘নির্যাতিত’ তা নিয়ে আহাজারি।

বাংলাদেশী সমাজে মধ্যবিত্ত নারীর যন্ত্রনা কম না, কর্মজীবী নারী হলে তো কথাই নেই। তাকে ঘর-বার সব সামাল দিতে হয়। খুব কম সংসারেই সে এক ইঞ্চি ছাড় পায়; ঘরের সামলে, বাইরে সামলানো বেশিরভাগ স্ত্রী/মাকেই আমি করতে দেখেছি, এবং দেখেছি সেটা করতে গিয়ে তাদের কী পরিমাণ মানসিক চাপের মুখে দিনযাপন করতে হয়। কিন্তু সেই সব সামলানো যে হয় ‘কাজের মেয়ের’ ঘাড়ে বন্দুক রেখে, এটা খুব কম মধ্যবিত্ত নারীকেই আমি স্বীকার করতে দেখেছি। ওই মুখসালাতি ‘আমার হেলপার না থাকলে তো আমি চলতেই পারতাম না’ জাতীয় স্বীকার না, বলছি সত্যিকার অর্থে নিজে বুঝতে পারা যে তার জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আরেক মেয়েকে এক্সপ্লয়েট করার মাধ্যমে অর্জিত সেই বুঝতে পারার কথা।

এই মন্তব্যকারীদের আহাজারি এবং সুপ্রীতি ধরের লেখাতেও যে মৌলিক বিষয়টি প্রায় অনুপস্থিতই বলা যায়, তা হলো ক্ষমতা কার হাতে এ সম্পর্কে কোন বোধ। এদের কান্নাকাটি এবং এই লেখা পড়লে মনে হবে যে গৃহকর্মী এবং গৃহকর্ত্রী ক্ষমতার একই সমান্তরালে দাঁড়ানো; একজনের জীবনের ওপর যে আরেকজনের কর্তৃত্ব রয়েছে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই।

তাদের আহাজারির মধ্যে একটুও এই বোধ নেই যে দারিদ্র্যের কারণে নিজের ঘরসংসার, পরিবার ফেলে একটা মানুষ অন্যের বাড়িতে যখন জীবনযাপন করে, জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়, তখন সেই জীবন একটা ট্রমাটিক জীবন।

গৃহকর্মীর সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর সম্পর্কে মানবিক দিক অবশ্যই গড়ে ওঠে; সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা গৌণ, মূল বিষয় হল এটা একটা অর্থনৈতিক ট্রানসাকশান। সেই দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতেই এই সম্পর্ক, সেটা গৃহকর্ত্রী মনে না রাখতে চাইতে পারেন, কারণ ক্ষমতার আসল জায়গা তার হাতে, সুতরাং সেটা ভুলে যাওয়ার মতো বিলাসিতা তিনি করতেই পারেন। গৃহকর্মী ভুলতে পারে না, ভোলার কথাও না: গৃহকর্ত্রীর ইচ্ছে বা অনিচ্ছের ওপর গৃহকর্মীর থাকা বা চলে যাওয়া নির্ভরশীল, এবং এই থাকতে দেয়া বা বের করে দেয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গৃহকর্মীর বা তার পরিবারের অন্নসংস্থান হয়।

গৃহকর্ত্রীও কিন্তু আসলে সেটা ভোলেন না। এক মুহূর্তের জন্য না। তিনি নিজেকে এবং অন্যদেরকে এই সত্যটি ভোলান মাত্র। ভোলেন না যে তার প্রমান হলো আসলে যদি ভুলতেন, তো গৃহকর্মীর বিরুদ্ধে তাদের এত পদের অভিযোগ থাকতো না।

বাংলাদেশী নারীবাদের ব্যর্থতা খুব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই আলোচনা:
এই আলোচনা কেন আসল জায়গায় ঘা দেয় না? কেন গৃহকর্ত্রী প্রশ্ন করতে পারেন না যে একাধিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একটা বাড়িতে থাকলে সেখানে কেন এক বা একাধিক গৃহকর্মী লাগে? কেন গৃহকর্ত্রী গৃহকর্তাকে বলতে পারেন না সপ্তাহে তিনদিন রান্নার দায়িত্ব তোমার? কেন গৃহকর্ত্রী দাবি তুলতে পারেন না যে এত এত কর্মজীবী মা, কেন আমাদের এখনো একটা সুষ্ঠ, সুস্থ শিশু পরিচর্যার সিস্টেম তৈরী হচ্ছে না? কেন গৃহকর্ত্রী দাবি করতে পারেন না যে এ বাড়িতে যতজন মানুষ বসবাস করে, তাদের সক্কলেরই গৃহস্থালীর সব কাজে হাত লাগাতে হবে? সে পুরুষ হোক, নারী হোক, শ্বশুরকূলের হোক আর বাপের বাড়ির হোক?

শিরোনামটিতে ফিরে আসি। আমি যদি গৃহকর্মী হতাম, তো আমি নিশ্চিত গৃহকর্মী হওয়ার বদলে গৃহকর্ত্রীই হতে চাইতাম। যে কোন মানুষই তা চাইবে। চাইবে না কেন? Aspiration তো মানুষের ধর্ম: যে অবস্থায় আছি তার চাইতে ভালো থাকতে মানুষ চাইবেই।  আমি আমার চাকরির ক্ষেত্রে আরেকটু ভালো বেতন, আরেকটু ভালো পসিশন চাই। শিরোনামে বোঝা যায় যে এই aspiration বিষয়টা গৃহকর্মীদের থাকা উচিত না –সে গৃহকর্মীই থাকবে, সে কেন গৃহকর্তৃত্বের দিকে নজর তুলবে?

অথচ আমার বা আপনার চাকরির সাথে গৃহকর্মীর চাকরির তুলনা করাও হাস্যকর। তার নির্দিষ্ট সময়ে কাজ বাঁধা থাকে না, জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ তার কাছ থেকে নিত্যই আশা করা হয়, এবং অন্যায় বরখাস্ত, বেতন কাটা, বয়সে অবসরে যাওয়া এবং অবসরে যাওয়ার জন্য কোন ফান্ডিং গড়ে তোলা, ইত্যাদি হাজার রকমের safeguard তার কাজের ক্ষেত্রে পায় না।  আমি আপনিও যে তার সব পাই, তা না, কিন্তু যেরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে তার কর্মজীবন অতিবাহিত হয়, তা-ও ঠিক আমার আপনার অভিজ্ঞতার মধ্যে নেই।

তার সাথে যোগ করি : আমি যদি গৃহকর্মী হতাম, তো অবশ্যই গৃহকর্মী হওয়ার বদলে গৃহকর্ত্রীই হতে চাইতাম।আরেকজন মানুষের ভৃত্যগিরি করতে ভালো লাগার কোন কারণ নাই। আমি প্রতিদিন অন্যের বাড়িতে ঘর ঝাঁট দিতে চাই না, চা খেতে খেতে অন্য্ কাউকে ঘর ঝাঁট দেয়ার নির্দেশ দিতে চাই। সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্ত তার লেখাটিতে গৃহকর্মীর গৃহকর্ত্রী হওয়ার যে বিষয়টি ধর উত্থাপন করেছেন, তা হলো গৃহকর্মী ভুলিয়ে ভালিয়ে গৃহকর্তাকে বাগিয়ে ফেলছে। উনি নিজের একটা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন: লক্ষ্মী নামের এক গৃহকর্মী তাকে যৌন নির্যাতন করতো । সাথে উল্লেখ করেছেন সেই গৃহকর্মীর তার পরিবারের পুরুষদের সাথে ‘দহরম মহরম’ করার। গৃহকর্মীর বয়স ১৪/১৫। মেয়েটি সুপ্রীতি ধরের সাথে যা করেছে, তা অবশ্যই যৌন নির্যাতন, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু উনি তার আত্মীয় পুরুষদের আচরণের যৌন নির্যাতন কিভাবে এড়িয়ে গেলেন? সেটা কিভাবে ‘দহরম মহরম’ হয়ে যায়?

এই মেয়েটি যদি ‘কাজের মেয়ে’ না হয়ে, ধরা যাক স্কুলছাত্রী হতো, তাহলেও কি উনি একে ‘দহরম মহরম’ বলে আইডেন্টিফাই করতেন নাকি নির্যাতন বলতেন? ১৪/১৫ বছরের মেয়ের যৌন আকাঙ্খা থাকে –কিন্তু যে বাড়িতে সে দারিদ্র্যের কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় কর্মরত, সেখানে পুরুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়ার কতটুকু ক্ষমতা থাকে? গৃহকর্মী হলে কি তাদের বেলায় statutory rape বিষয়টি হাওয়া হয়ে যায়?

আরো ভয়ংকর কথা হলো সুপ্রীতি ধরে এই লেখার প্রেক্ষিত এই মুহূর্তে একটি ১০/ ১১ বছরের মেয়ের তার গৃহকর্ত্রী/মালিক কর্তৃক নির্যাতিত হবার খবর। অর্থাৎ এই মেয়েটির নির্যাতনের খবরটি পেশ করে উনি গৃহকর্মীরা কতখানি খারাপ চরিত্রের (‘দহরম মহরম’+শিশু সুপ্রীতিকে যৌন নির্যাতন) সেটা তুলে ধরছেন, এবং শিরোনামে ওই ইঙ্গিত, যে গৃহকর্মী গৃহকর্তাকে বাগিয়ে নিতে চায়। আবারো মনে করিয়ে দেই, প্রেক্ষিতটা হলো ডিম্ পোড়ানোর ‘অপরাধে’ একটা বাচ্চা মেয়েকে গৃহকর্ত্রী শারীরিক আক্রমন করেছে, ভয়ানক নির্যাতন করেছে। সেই নির্যাতনের কী প্রেক্ষিত তুলেছেন সুপ্রীতি? লেখার গোড়াতে নির্যাতনকারী নারীর সম্ভাব্য extenuating circumstance সম্পর্কে বকর বকর করে। যে হয়তো মহিলা নিজে নির্যাতিত। যে হয়তো মহিলা অন্তঃসত্ত্বা বলে খিটখিটে হয়ে আছেন।

১৪/১৫ বছরের লক্ষ্মীর বেলায় এসব extenuating circumstance ভাবতে কিন্তু সুপ্রীতি ধর এক লাইনও খরচ করেননি।

এইখানেই, আবারো, আমাদের নারীবাদের ব্যর্থতা। মধ্যবিত্ত নারীবাদী তার শ্রেণী পরিচয় কিছুতেই ভুলতে পারে না, অতিক্রম করতে পারে না। Patriarchal bargain বলে একটা বিষয় আছে: এ তাই। পুরুষতন্ত্র তাকেও ব্যবহার করছে, গৃহকর্মীকেও ব্যবহার করছে, কিন্ত তাকে গৃহকর্ত্রী হিসেবে সামান্য পুরস্কৃত করছে, সেই সামান্য সম্মান, সামান্য পুরস্কার বজায় রাখতে কামড়াকামড়ি না করলেই নয়। এবং যতদিন এই ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ (এই শব্দগুলো মন্তব্যকারীরা বারবার ব্যবহার করেছেন) থেকে বাংলাদেশী তথাকথিত নারীবাদীরা বের হতে না পারবেন, ততদিন এইসব নারীবাদ-ফারিবাদ সব ফজুল বিষয়, এই ফেসুবকেই সেটাকে আলগোছে আটকে রাখা যায়।
——
পুনশ্চ: এইটুক যোগ করি: উইমেন চ্যাপ্টার-এর বইনেরা, বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী আমি আর আপনি না–মোটামুটি শিক্ষিত, মোটামুটি অর্থবান, মোটামুটি ‘ভদ্রলোক’ না। বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী হলো যাদের আপনি ‘ওরা’ বলে ডাকছেন, সেই কাতারের। বাংলাদেশের সিংহভাগ নারীর ইস্যু যতদিন আপনার আর আমার নারীবাদের ইস্যু বলে হৃদয়ে এবং কাজে টানতে না পারবেন, ততদিনে এই নারীবাদ দিয়ে পুরুষতন্ত্রের বাল ছিঁড়া ক্যান, নাড়াইবারও পারবেন না।

 



Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags:

1 reply

Trackbacks

  1. ক্ষমতান্ধ নারীবাদ: প্রসঙ্গ দেশের প্রথম নারী-উপাচার্য  |

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: