আবদুল্লাহ মাহফুজ, ফুলবাড়ী থেকে ফিরে:
সময় তখন শনিবার সন্ধ্যা। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার নিমতলার মোড়ে দেয়ালে দেয়ালে ফুলবাড়ী দিবস পালনের পোস্টার। এই পোস্টারে প্রতিবাদী এক নারীর মুখাবয়ব রয়েছে। ২০০৬ সালে ফুলবাড়ী আন্দোলনে যে ছবিটি দেশ বিদেশে সবার কাছে প্রকাশ হয় আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে।
জানা গেলো , এই নারীর নাম গোলবানু। তার বাসা নিমতলার কাছেই। আমরা তার বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম। নিমতলার মোড় থেকে একটি গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম গোল বানুর বাড়িতে। ইটের গাঁথুনির উপর টিনসেড ছোট একটি বাসায় থাকেন এই নারী। এশিয়া এনার্জির উন্মোক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ। প্রেরণার নাম।
কেমন আছেন সেই গোল বানু? জানতে চাইলে জানালেন, গত কয়েক দিন জ্বর। ভাত খেতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে মানসিক ও শারীরিকভাবে দূর্বল হননি। তিনি মানসিকভাবে সব সময় তেজী থাকেন সে কথাও জানিয়ে দিলেন কথায় আড্ডায়। ঘরে কম আলোর একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। আলোর স্বল্পতা আর এই নারীর মুখে শোনা সেই সব উত্তাল দিনের গল্পতে এক অন্য রকম পরিবেশ সৃষ্টি হয় তার সেই ছোট্ট ঘরটি।
গোল বানুর মুখে সেই গল্পের বর্ণনা শোনার আগে একটু পেছনে ফিরে জানা যাক সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক ফুলবাড়ী আন্দোলনের ইতিহাস।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সাথে গোলবানু
তখন বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায়। তারা বহুজাতিক কোম্পানী এশিয়া এনার্জির সাথে ফুলবাড়ী এলাকায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের চুক্তি করে। যা পরিবেশ জীবন যাত্রা ও দেশের জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেছেন দেশের স্বাধীন গবেষক, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এবং স্থানীয় মানুষ। এর প্রেক্ষিতেই তারা এই চুক্তি বাতিলের দাবিতে গড়ে তোলে আন্দোলন। তেল গ্যাস বিদ্যুত বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে শুরু হওয়া ওই আন্দোলন ২০০৬ সালের আগস্টে এসে উত্তাল রুপ ধারণ করে।
সে বছর ২৬ আগস্ট জাতীয় কমিটির ঘোষিত এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ীর কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিকে ঘিরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআর এর গুলিতে সেদিন প্রাণ হারায় তিন তরুণ। আহত হয় অনেক মানুষ। কিন্তু প্রতিরোধ প্রতিবাদে উত্তাল থাকে ফুলবাড়ীর জনপদ। যে পথে পথে আজও ফুলবাড়ীর সেই রক্তাক্ত ইতিহাস প্রেরণা হয়ে আছে।
সেই আন্দোলনে জাতীয় ভাবেই পরিচিত হয়ে ওঠা এক মুখ ছিলো গোলবানু। যার ছবি দিয়ে এবারও ফুলবাড়ী দিবস উৎযাপনের প্রতিবাদী পোস্টার করা হয়েছে।
সেই গোল বানুর মুখ থেকেই শোনা যাক ওই দিনের কিছু ঘটনা, সেই সব দিনের স্মৃতির বাক্স খুলে গোল বানু জানালেন, ২৬ আগস্ট যে সংঘর্ষ হয় তখনো তিনি মাঠে যাননি। তিনি বলেন, ”আন্দোলনে পুরা এলাকা গরম। আমরা দেখছি দাড়াইয়া সব। তখনো আমরা নামি নাই। পরে তো শুনলাম ব্রিজের পরে গুলি হলো। লাশ পরলো। তারপর যে কি হলো…। রাতেও বিডিআর হানা দিছে বাড়ি বাড়ি। ওই দিন রাতে আমরা কিছু খাই নাই। পুরুষ পোলারা গ্রাম ছাড়া। পরের দিন ২৭ আগস্ট আমি দোকানে গেছি। দেখি দোকান পাট বন্ধ। সারাদিন না খাওয়া মানুষ আমরা। আবার দোকান সব বন্ধ। জিগাইলাম বন্ধ করছেন কেন? কইলো কারফিউ দিছে। আর সইতে পারলাম না।”
নিজ বাসায় গোলবানু
তিনি বলেন, ”তখন বাসায় আইসা বটি আর ঝাটা নিয়া বের হইছি। …খাইতে দিবি না। আমাগো কামাই খাস আর আমাগো মারস। দেখি আজ কি হয়। আমি ঝাটা আর বটি হাতে বিডিআরকে ধাওয়া দিছি ব্রিজের দিকে। বিডিআর আর পুলিশ হাসতে হাসতে সরে গেছে। ভবছে পাগল আমি। কিন্তু আমি যাই নাই। পরে সব মহিলারা নামছে রাস্তায়। আমরা কইছি কোন কারফিউ মানি না। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গলাম। আয় দেখি কে আছোস…। এর পর তো আমরা সব রাস্তায়। মিছিল করছি। বিডিআর এর ভয়ে রাতে আশে পাশের গ্রামে যারা আড়ালে ছিলো রাতে তারাও আইলো…।”
কথায় কথায় জানা গেলো সেদিনের গোলবানুদের সেই প্রতিরোধে আবার সাহস ফিরে আসে সবার মাঝে। গড়ে ওঠে শক্ত প্রতিরোধ। উত্তাল ফুলবাড়ী তখন হয়ে ওঠে সারা দেশের মানুষের মনযোগের কেন্দ্র বিন্দু। ‘আন্দোলনের রাজধানী ফুলবাড়ী ফুলবাড়ী’ হিসেবেও অনেক স্লোগান দিতে শুরু করে। প্রতিরোধের মুখে তৎকালীন সরকার বাধ্য হয়ে গুটিয়ে নেয় এশিয়া এনার্জির অফিস। প্রত্যাহার করে নেয় পুলিশ বিডিআর সদস্যদের। ৬ দফা চুক্তি করে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিয়ে। যদিও সেই চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। তাই এখনো আন্দোলন করে যেতে হচ্ছে গোলবানুদের। আন্দোলনকারীদের মতো তারও আফসোস ও ক্ষোভ কাজ করছে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াতে।
গোলবানু বলেন, ”ওর কয়েকদিন পর নেত্রী (তৎকালীন বিরোদী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা) আইলো। সান্তাহারে সভা কইরা কইয়া গেলো, আমি যদি ক্ষমতায় যাই তো আমি ছয় দফা বাস্তবায়ন করে দিবো। ফুলবাড়ীর মানুষ শান্তিতে থাকবেন…। আমরা বললাম যাক… দোয়া দিয়ে দিলাম। ক্ষমতাও গেলো কিন্তু ১১ বছর হয়ে গেলো কোন খবর নাই।”
পরিবারের সাথে গোলবানু
একটু থেমে কিছুক্ষণ পর গোলবানু তেজী স্বরে বললেন, “আমরা বাঁচি থাকতে এই চুক্তি পারবি না করতে। কি মনে করছে আমরা মরি যাবো? আমরা যদি একটা মানুষ মরি যাই আমাদের ছাওয়াল পাওয়াল ৩টা বড় হবে। মায়ের ইতিহাস ধরে কি থাকবে না?”
গোলবানু কথায় কথায় অনেক ক্ষোভই ঝাড়লেন। আস্তে আস্তে সেখানে জড়ো হওয়া তার প্রতিবেশিরাও তার কণ্ঠস্বরকেই তখন অনুসরন করলেন। তারাও একই কথা বললেন।
কথায় কথায় গোলবানুর পরিবারের খবর জানা গেলো। সামনে তার মেয়ের বিয়ে। তার ৩ ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়েই সংসার।
গোলবানু জানালেন এই ফুলবাড়ীই তার সংসার। তার বেড়ে ওঠা। জন্মস্থান। তার পৈত্রিক বাড়ি ছিলো ভারতে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় তার বাবার পরিবার বাংলাদেশে চলে আসে। ফুলবাড়ীই তাদের ঠিকানা।
গল্প কথায় সময় পার হয়ে যায়। আন্দোলনের অগ্নি মুখের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আমরা ফিরে আসলাম ওই পথ ধরে আবার। সুরু গলি ধরে ফেরার পথে দেয়ালে দেয়ালে টানানো পোস্টারে গোলবানুর ছবিটির অর্থ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমাদের কাছে। সেই পোস্টারে লেখা- ‘ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই’।
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply