
সুকুমার রায় রচিত হ য ব র ল গল্পে উদোর ভাই বুধো
সম্প্রতি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়াকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পরিসরে শরনার্থী বিরোধী বেশ কিছু মতামত অতি জোরালোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। এই লেখাটিতে আমি সেই মতামতগুলোর অন্তর্নিহিত মানুষের চাওয়া ও আতংক বিশ্লেষণ করবো। ১৯ অক্টোবর ৬ জনের একটি দলের সাথে আমি কক্সবাজার ও কুতুপালং এলাকা পরিদর্শন করি। এই বিশ্লেষণে সেই যৌথ মাঠকর্ম থেকে পাওয়া তথ্যও যুক্ত করা হয়েছে।
কক্সবাজারে ১০ লাখের মত বহিরাগত প্রবেশের ফলে স্থানীয় কাঁচামাল ও শ্রম বাজারে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরী হচ্ছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নিয়ে আলাপ করলেও শাক-সবজির দাম বেড়ে গেছে বা দিনমজুরদের মজুরি কমে গেছে এরকম একটা মতামত পাওয়া যাচ্ছে এবং এর জন্য একতরফা ভাবে শরনার্থীর ঢলকে দোষী করা হচ্ছে। কুতুপালংয়ে মাঠকর্ম করে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারে দরদামের যে একটা তারতম্য ঘটেছে সেটা আমরাও লক্ষ্য করেছি কিন্তু এর জন্য দায়ী কে সেটা বুঝতে আমাদের বাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে এই সরল বিশ্বাস থেকে সরে আসতে হবে। তখন আমরা দেখতে পাবো যে বাজারে চাহিদা, সরবরাহ, দাম এগুলো নির্ধারনের পেছনে কলকব্জা নাড়ে নানান ধাপের ক্ষমতাধর প্রভাবশালী মহল। এদের কাছে যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাম্পার ফলন সব পরিস্থিতিতেই টাকা-পয়সার লাভ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর সবচাইতে অবহেলার পাত্র হচ্ছে বিপদগ্রস্থ মানুষ। এবং এরা স্থানীয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাজার ভারসাম্যহীন করে রেখেছে বাজার ব্যবস্থার জন্মলগ্ন থেকেই। কক্সবাজারেও সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। কিন্তু কুচক্রি মহলের তৈরী করা স্থানীয় নতুন বিপদে বিরক্ত ও দিশেহারা হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আরেক মানুষ, বিপদগ্রস্থ বহিরাগত রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে। এমন না যে বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরীর এই কুচক্রি মহলকে স্থানীয়রা চেনে না বা জানে না বা কেউ কেউ সেই বাজারের কর্তা বা কর্মী নয়। কিন্তু স্থানীয় বাজারের প্রবহমান টানাটানিতে অস্থির স্থানীয়রা তাদের হক বহিরাগতরা লোপাট করে নিচ্ছে এই মতামতটিই দিচ্ছেন।
অথচ, কক্সবাজার জেলা শহরের ও কুতুপালংয়ের স্থানীয় লোকজন ও কুতুপালংয়ের দুটো রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে বসবাসকারীদের সাথে আলাপ করে জানা যায় স্থানীয় বাজারে বহিরাগত রোহিঙ্গারা বেশ বড় অংকের কাঁচা টাকা আমদানি করেছে। যেমন, বহিরাগত রোহিঙ্গাদের যে নৌকাগুলো বেয়ে নিয়ে এসেছে সেগুলো আসলে বাংলাদেশী স্থানীয় বাঙ্গালীদের। প্রতি মাথা বাবদ রোহিঙ্গারা এই নৌকাগুলোতে পরিশোধ করেছেন এক লক্ষ বার্মিজ টিঁয়া (রোহিঙ্গাদের ভাষায় মিয়ানমারের মুদ্রার নাম)। বাংলাদেশে ঢুকতে সীমান্তরক্ষীদের দিতে হয়েছে মাথা প্রতি এক লক্ষ টিঁয়া। বাংলাদেশে এসে থাকার জন্য ছাপড়া প্রতি শুধু জমির দাম দিতে হয়েছে মাসিক ২০০ টাকা হারে। স্বর্ণ এক ভরি গেছে ৩৫ হাজার ও একটা গরুর দর গেছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। মায়ানমারের মুদ্রা টাকায় পরিবর্তিত করতে গিয়ে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবসায়ীরাও বেশ লাভবান হয়েছে। এক লক্ষ টিঁয়া ৮ থেকে ১০ হাজার বাংলাদেশী টাকায় কিনেছেন তারা। এছাড়া এখনও প্রতিদিন স্থানীয়রা এসে স্থানীয় বাজার দরের চেয়ে স্বস্তায় রিলিফে দেয়া নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বহিরাগত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন।
এই যে রোহিঙ্গাদের মায়ানমার থেকে শরনার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসা উপলক্ষে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কক্সবাজার এলাকাতে এতো টাকা-পয়সার লেনদেন তাতে যে স্থানীয়রা যে লাভবান হয়েছে এ কথাগুলো সাধারণত অনুলেক্ষিত থাকছে। এর কারণ হয়তো এই যে এই লেনদেন বিবেচিত হয় অবৈধ হিসেবে। কিন্তু এই লেনদেন যে ঘটেছে এবং এই লেনদেনে মূলত লাভবান হয়েছে স্থানীয়রাই সেটা মিথ্যা নয়। তবে এটা ঠিক যে সেই লাভের ভাগ স্থানীয় সকলে সমানভাবে পায়নি। এখন দেখা যাচ্ছে আমদানী হওয়া টাকা যে স্থানীয়ভাবে সকলে ভাগ পায়নি বা কিছু কুচক্রি মহল সেটার সিংহভাগ আত্মসাৎ করেছে সে নিয়ে অনেকে ক্ষুব্ধ কিন্তু এই ক্ষোভ প্রকাশের সময় লোকে বিরোধিতার পক্ষ হিসেবে রাখছেন রোহিঙ্গা শরনার্থীদের।
এবারে আসি বৈধ লেনদেনে। জানা যায় যে শরনার্থীদের আগমনের কারণে ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, কেয়ার, অক্সফ্যাম, এ্যাকশান এইড, সেইভ দ্য চিলড্রেনের মত বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের দেশীয় মূল কার্যালয়ের অস্থায়ী সেল বসিয়েছে উখিয়ায়। এর ফলে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে কক্সবাজরের পর্যটন শিল্প। স্থানীয় এক হোটেলের মালিক আমাদের জানান যে আগামী এক বছরের জন্য কক্সবাজারের সব ভালো হোটেলগুলো এরা ভাড়া করে নিয়েছে। ফলে হোটেল ব্যাবসায় অফ-সিজন বলে এখন আর কিছু থাকলো না। কিন্তু রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রসঙ্গ টেনে আনার সাথে সাথে রুটিনের মত তিনিও বলে বসলেন : “ওরা দেশের জন্য বোঝা”। এমনকি পর্যটন শহরের ভাঙ্গা রাস্তা, আবর্জনা ভর্তি নর্দমা, স্থানীয় মেয়েদের তথাকথিত বেহায়াপনা বৃদ্ধি এই সব নিয়ে অতিষ্ঠ ভাব প্রকাশেও স্থানীয় অনেকে শরনার্থীদের দায়ী করেন: “ওরা আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে, মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে”।
শরনার্থীদের সেবা দান একটা নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হিসেবে স্থানীয়ভাবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে শিক্ষিত-বেকারের সংখ্যা এতো বেশী যে সকলকে সংস্থান করতে পারেনি এই ক্ষেত্রটি। স্থানীয়দের মধ্যে যারা এই নতুন কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের আগে থেকেই বিরাজমান বেকারত্ব নিয়ে আকাশচুম্বী ক্ষোভ ও অষন্তোষ প্রকাশ করতে শরনার্থীদের উপস্থিতি যেন এখন নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।
সব দেখে শুনে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাঁড়ে বলে পুরোনো প্রবাদটি মনে পড়ে যায়। একটা বহিরাগতের দল সামনে থাকলে স্থানীয়দের চলমান সংকটের দায় চাপাতে তাৎক্ষনিকভাবে বহিরাগতকেই যে লোকে দেখতে পাচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও যেন সেই লক্ষণটিই দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আলাপ করতে গেলেই বাংলাদেশের অনেকে ভীষন রকমের কঠোর গলায় বলতে থাকেন – “রোহিঙ্গারা তো বাংলাদেশের না, বহিরাগত”। একবার এক সম্মেলনে মিয়ানমারের কয়েকজন উন্নয়ন কর্মীর সাথে কথা বলতে গিয়েও শুনেছি “রোহিঙ্গারা তো বাংলাদেশের, আমাদের না”। এই কথাগুলো শুনলে মনে হয় কোন্ মানুষ কোন্ দেশের স্থানীয় আর কে বহিরাগত সেটা যেন চিরকালই নির্ধারিত ছিল। এবং তথাকথিত জায়গার মানুষ তার নিজের জায়গাতে অনড় থাকলে বিদ্যমান নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সম্পদ নিয়ে টানাটানি আপনাআপনি সমাধান হয়ে যাবে। বাংলাকে ঘিরে স্থানীয় ও বহিরাগত এই শ্রেণীগুলো নির্ধারণকারী রাষ্ট্রীয় সীমারেখা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সেই বৃটিশ আমল থেকে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতি হয়েছে। এখন সেই ঐতিহাসিক ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে তথাকথিত বহিরাগতদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় সীমানাকে রক্ষা করতে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলাও আইন সম্মত। অনেক সাধারণ মানুষের কাছে মানুষের জীবন ও গতিশীলতার চেয়ে রাষ্ট্রীয় সীমানা আর তার ফলে তৈরী শ্রেণীগুলো রক্ষা হয়ে পড়েছে বেশী জরুরী। বিপদগ্রস্থ মানুষের প্রতি সহানুভূতি বোধ করতেও এগুলো যেন বাধা দিচ্ছে।
*লেখাটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ ১০ নভেম্বর ২০১৭-তে দৈনিক প্রথমআলেতে প্রকাশিত হয়।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply