নভেম্বর মাস। সন্ধ্যায় দুই বান্ধবী মিলে হাঁটতে বেরিয়েছি আগারগাঁওয়ের সরকারি দপ্তর এলাকার নিরিবিলি প্রশস্ত রাস্তায়। একটা মোড়ের একটা ছাপড়া চায়ের দোকান পেরুচ্ছিলাম যখন, কে যেন ডেকে উঠলো – “রোহিঙ্গা”। শুনে দু’জনেই বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম। সন্ধ্যায় নিরিবিলি এলাকায় হাঁটতে বেরিয়ে পুরুষের কন্ঠে “যাবি নাকি?” এমনটা শুনেছি বেশ কয়েকবার। যার সম্ভাব্য একটা অর্থ ঐ ব্যক্তি গণপরিসরে হাঁটাচলারত নারীকে “বেশ্যা” ডেকে জনস্বমক্ষে লজ্জায় ফেলতে চাইছে। কিন্তু, এভাবে রোহিঙ্গা ডাক আগে তো শুনিনি!
জানুয়ারী মাস। মংলায় নদী পার হবো বলে নৌ-ঘাটে ভীড়ের মধ্যে এগুচ্ছি। সফরসঙ্গী সকলেরই পীঠে ব্যাগ। কানের কাছে কে যেন ডেকে উঠলো- “রোহিঙ্গা”। এবার ঠিক করলাম মানুষের সাথে আলাপ করতে শুরু করবো। কী মানে এর? এভাবে রোহিঙ্গা ডাকার? যে নৌকায় উঠেছিলাম তার মাঝিকেই জিজ্ঞেস করলাম। প্রথমে মাঝি নিজেই লজ্জা পেয়ে “আপনাদের কেউ কিছু বলে নাই”, “আমি তো বলি নাই” – ইত্যাদি বলে প্রশ্ন এড়াতে চাইলেন। পরে যখন তাঁকে আশ^স্ত করলাম যে রোহিঙ্গা ডাকায় আমি মনে কষ্ট পাইনি, স্রেফ ডাকটার অর্থ বুঝতে চাইছি তখন তিনি ব্যাখ্যা করলেন : মংলায় ইপিজেড আছে তাই প্রায় সময়ই এখানে বিদেশীরা আসে। তাদের পিঠে থাকে ব্যাগ আর তারা দল বেঁধে হাঁটে, ঠিক যেমন টিভিতে রোহিঙ্গাদের দেখাচ্ছে তেমনভাবে। তাই এই নৌ-ঘাটে ব্যাগ সহ বিদেশী বা বহিরাগত দেখলে তাকে নিয়ে “মজা” করে রোহিঙ্গা ডাকা হয়।
ফেব্রুয়ারী মাস। ঢাকার শ্যামলী। সাইকেল চালিয়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে একটা সংকীর্ণ মোড়ে ঢুকেছি। মোড়ের ছাপড়া রেস্তোঁরাটা থেকে উড়ে এলো রোহিঙ্গা ডাক। এবার সাহস করে তখনই থামলাম। এগিয়ে গেলাম ডালপুরি ভাজারত দোকানদারের দিকে, চোখের রোদ চশমাটা খুলে, হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “রোহিঙ্গা বলে ডেকেছেন কেন?” এবারে যে ব্যাখ্যাটা পেলাম সেটা হল, একজন খেটে খাওয়া মানুষ আরেকজন খেটেখাওয়া মানুষকে যখন রসিকতার মাধ্যমে সমালোচনা করতে চায় যে সে ধনী মানুষের চালচলন নকল করে “ফুটানি” করছে তখন সে রোহিঙ্গা ডাকটা ব্যবহার করে। যেমন, ডালপুরী দোকানদার চশমা পরেছে তাই তাকে পাশের চায়ের দোকানদার রোহিঙ্গা ডেকে বসলো। যারা খেয়াল করেছেন মনে করতে পারবেন নিশ্চয়ই যে, চশমা বা রোদ-চশমা পরাটা বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই প্রয়োজনের চেয়ে ঢং-এর সাথে সম্পর্কিত করে দেখা হয়।
এভাবে দিনে দিনে আমার অভিজ্ঞতা বাড়ে। ঢাকায়, ঢাকার বাইরে চলতে-ফিরতে গেলেই রোহিঙ্গা ডাক কানে আসে। আজকাল ডাকটা যেন কানে সয়ে গেছে। আমার সামাজিক চক্রে কয়েকজন সাংবাদিক ও নৃবিজ্ঞানী বন্ধুদের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারি যে তারাও রাস্তাঘাটে রোহিঙ্গা ডাকাডাকিটা খেয়াল করেছে। মনে হচ্ছে যেন মর্যাদাহানি সূচক শব্দভান্ডারে নতুন এক পদ হিসেবে বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছে এ’টি। তবে সবাই এটা এক অর্থে ব্যবহার করছে না। শেষ আরেকটি ঘটনা বলি। ঘটনাটি ঘটে মার্চ মাসের শেষের দিকে, মিরপুর থেকে জিগাতলা মুখী এক টেম্পোর ভেতরে। মোহাম্মদপুর বাস স্টপেজ এলাকায় টেম্পোর চালকের পাশের সিট খালি হলে টেম্পোর মধ্যবয়সী হেল্পার টেম্পোর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুন যাত্রীকে সেখানে গিয়ে বসতে বললেন এ’ভাবে: “এই রোহিঙ্গা, সামনে গিয়ে বয়”। যাত্রীটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অফিসগামী বা কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়গামী তরুন বলে মনে হলো না, মনে হল নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। চিকন শরীরে আঁটোসাঁটো পোষাকে সে বেশ এ কালের কেতা দুরস্ত আর দশটা শহুরে তরুনের মতই। কানে ইয়ারফোন গুঁজে, মোবাইল ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে চলাফেরা তার। হেল্পারের রোহিঙ্গা ডাক তার কানে সয়ে গেছে অথবা শুনতে তার বয়েই গেছে এরকম একটা ফুরফুরে ভঙ্গিতে সে টেম্পোর সামনের আসনে গিয়ে বসে। আপাতঃ নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়ানো তরুনটিকে কোন জায়গা থেকে গণপরিবহন-শ্রমিকটির জনসমক্ষে হেয় করতে ইচ্ছে হল?
হেল্পারকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, ওকে আপনি রোহিঙ্গা ডাকলেন কেন?” হেল্পার ভাই কিছু উত্তর করার আগেই আমার পাশে বসে থাকা এক নারী-যাত্রী উত্তর করলেন, “ও তো এ’টা মজা করে বলেছে। রোহিঙ্গাদের তো ভাষা দিয়েই চেনা যায়। তাদের ভাষা আমাদের ভাষা একদম আলাদা”। “কিন্তু, এটা কেমন মজা! কিছু মানুষ নিজের দেশে সংখ্যালঘু জাত বলে অত্যাচারের শিকার হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ’রকম বিপদগ্রস্ত জাতের নাম নিয়ে রসিকতা!” – আপত্তি করলাম আমি।
ছবি: কুতুপালং ১ নং শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারীরা। অক্টেবর ২০১৭
আমাকে স্বান্তনা দেয়ার ভঙ্গীতে তিনি বললেন, “বাংলাদেশের মানুষ তো এরকমই। কিছুই বুঝেনা। না বুঝে কথা বলে।” কিন্তু আমি মানতে নারাজ যে বাংলাদেশের মানুষ অবুঝ। কী বুঝ থেকে এখানকার মানুষ ইদানিং একে অপরকে রোহিঙ্গা ডাকছে এই প্রশ্ন আবার তুলি। এবারে উত্তর করেন আমার মুখোমুখি বসে থাকা আরেক নারী-যাত্রী। তাঁর ব্যাখ্যা: চট্টগ্রামের মানুষ যেমন চট্টগ্রামের বাইরে থেকে আসা মানুষদের বোইঙ্গা বলে রোহিঙ্গা বা রোইঙ্গারও প্রায় সেরকমই একটা অর্থ। যারা বাইরে থেকে এসেছে, যারা এখানকার স্থানীয় নয় তাদেরকে বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন, ঢাকার মানুষরা ঢাকার বাইরে থেকে আসা মানুষদের রোইঙ্গা বলে। এমনকি ঢাকার ভেতরে এক এলাকার মানুষ আরেক এলাকার মানুষকে রোইঙ্গা বলে। ইদানিং বিষয়টা এমন পর্যায়ে পৌঁচেছে যে রাস্তায় এক কোম্পানীর বাসের হেল্পার আরেক কোম্পানীর বাসের হেল্পারকে রোইঙ্গা ডাকে। টেম্পোর প্রায় সব যাত্রী যখন এই ব্যাখ্যায় প্রায় একমত এবং দু’একটা বাড়তি মন্তব্য যোগ করছেন তখনও কিন্তু হেল্পার ভাই উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। ভাবখানা যে উত্তরটা আমাদের মেলে নাই। আলাপের একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে চার-পাঁচ বছর আগে হরহামেশা শোনা যেত সেরকম আরেকটি মর্যাদাহানিকর পদের উল্লেখ করেন একজন। আর সেটি হল মফিজ। পদটি দিয়ে বোঝানো হত যারা মফস্বল থেকে শহরে এসেছে এবং যারা শহরের আপাতঃ দ্রুত গতি-প্রকৃতির সাথে তাল মেলাতে না পেরে ঠোক্কর খাচ্ছেন। তাহলে কি রোহিঙ্গা কথাটি মফিজ কথাটির জায়গা দখল করে নিয়েছে? এবার হেল্পার ভাই একমত হলেন, বললেন, “হ, হ। রোহিঙ্গা মানে মফিজ”।
*লেখাটির একটি রূপ দৈনিক প্রথম আলোতে ৯ এপ্রিল ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply