মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ একটি খবর : রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ত্রান বাবদ এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তার থেকে ১৬% খরচ করা হবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরনার্থীরা বাঙ্গালী-মুসলিমদের ক্ষতি করছে এরকম মতামত বেশ প্রচার প্রচারণা লাভ করেছে। যার আলামত আমি আমার নিজের গবেষণা কাজে লক্ষ্য করেছি। এ বিষয়ে এর আগে আমি লিখেছিও (দ্রষ্টব্য: প্র. আ. ১০/১১/২০১৭ এবং ৯/৪/২০১৮)। কিন্তু বাঙ্গালী-মুসলিম ছাড়াও তো দেশে নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন রয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? এই যে “স্থানীয় জনগোষ্ঠী” বলে একটি বর্গ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটায় বাঙ্গালী-মুসলিম ছাড়া অপরাপর জাতিগোষ্ঠীকে কি বিবেচনা করা হচ্ছে?
খবরটি যখন টেলিভিশনে দেখছিলাম তখন অসোয়াস্তি নিয়ে খেয়াল করছিলাম সাংবাদিকটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন শুধুমাত্র বাঙ্গালী-মুসলিম জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ের নাগরিকদের। মনে পড়ে গেল ফেব্রুয়ারী মাসে করা ছোট্ট একটি মাঠকর্মের কথা। আমসটারডামের ফ্রি ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের বৃহত্তর একটি গবেষণার অংশ হিসেবে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকদের সাথে আলাপ করা। আমাদের প্রশ্ন ছিল রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আগমনে কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ের মানুষজন?
মাঠকর্মের সময় প্রথমেই আমাকে যে বিষয়টি নাড়া দিয়েছিল সেটা হল প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের খুঁজে পেতে গিয়ে স্থানীয় বাঙ্গালী-মুসলিমদের কাছ থেকে যে আচরণ আমরা পেলাম। “ওরা আছে, কিন্তু দূরে থাকে”, “ওরা আগে ছিল, এখন তো দেখা যায় না”, “ওরা সংখ্যায় খুবই কম (মানে, তাদের সমস্যা অবহেলাযোগ্য)”, “ওরা তো বাংলা পারে না (মানে, তারা নিজেদের সমস্যার কথা নিজেরা বুঝিয়ে বলতে পারে না)” -ইত্যাদি বাঙ্গালী-শ্রেষ্ঠত্ববাদী কথার মুখোমুখি হচ্ছিলাম। এসব কিছু দিয়ে আসলে স্থানীয় বাঙ্গালী মুসলিমরা বাধা তৈরী করছিলো যেন স্থানীয় প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের অভিজ্ঞতা আমাদের মত রিপোর্টারদের কানে না পৌঁছায়।
এবারে আসি প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ের মানুষজনের সাথে সরাসরি কথা বলে কী জানা গেল সে প্রসঙ্গে। কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্পের কাছাকাছি বেশ কিছু তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া রয়েছে। একটি পাড়ায় আলাপ করে জানা গেল তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের বাঙ্গালী-মুসলিম প্রতিবেশীদের এই বিপদের দিনে বিশ্বাস করে না। একজনের উক্তিতে অবিশ্বাসের একটা কারণ বোঝা গেল। তিনি বললেন, “এ এলাকায় যত আবাদী জমি দেখছেন সব এক সময় আমাদের ছিল, সেই বৃটিশ আমল থেকে। বাঙ্গালীরা সব জোর করে দখল করে নিয়েছে। আমরা মাত্র কয়েকটা পরিবার এখানে এখন কোনমতে টিকে আছি”। দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান এরকম বাঙ্গালী-নীপিড়নের ভেতর নতুন রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আগমনে উদ্ভূত টালমাটাল পরিস্থিতিতে এখন তারা ভয়ার্ত যে এবার হয়তো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে হবে।
মানে, বাংলাদেশে বিভিন্ন উছিলায় যখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরী হয় তখন সেই ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে দেশের সমান হিস্যাদার কিন্তু প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ের নাগরিকদের ওপর বাঙ্গালী-মুসলিমদের আক্রমনের যে রেওয়াজ যুগের পর যুগ ধরে চালু রয়েছে সেই আক্রমনের আশংকাই সবাই করছে। নিরাপত্তার জন্য তারা প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখে না, বরং একে বাঙ্গালী-মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণকারী ব্যবস্থা বলে বিবেচনা করে। তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার লোকেরা তাই রোহিঙ্গা শরনার্থীরা আসতে শুরু করলে প্রথম মাস তিনেক রাত জেগে নিজেরা নিজেদের পাহারা দিয়েছেন, দিনের বেলা গ্রাম থেকে কেউ বের হয়নি, শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায়নি, এসএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয়নি। নাফ নদীর ধারে একটি রাখাইন পাড়ার মানুষজনও একই ভয়ে ভীত। একজন বললেন, “বলা তো যায় না কখন কী হয়! আমরা যে সংখ্যালঘু!” যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের চাষ-বাস শরনার্থীরা সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে, দেদারসে আহরণ করছে ক্ষেতের বাঁশ, লাকড়ি, পান কিন্তু ভয়ে কেউ বাধা দিচ্ছে না। পাড়ার কারবারী বললেন, “কিছু বললে যদি কিছু হয়? প্রশাসনে আমাদেরকে দেখার তো কেউ নাই।”
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের কথা দিয়ে শেষ করবো। তাদের আশংকা রোহিঙ্গা শরনার্থীরা মিয়নমারে ফিরে তো যাবেই না বরং শেষ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী হবে। আশংকাটি অমূলক নয়। আমরা নিজেরাই বান্দরবানে এমন একটি গ্রাম পরিদর্শন করেছি যেখানে ১৯৯০’র দশকে আসা কিছু রোহিঙ্গা শরনার্থী বসবাস করছে। এদেরকে স্থানীয়ভাবে ‘বার্মাইয়া’ ডাকা হয়। বান্দরবানে এরকম অনেক গ্রাম আছে বলে আমাদের জানানো হয়। এই দফায় আসা নতুন রোহিঙ্গা শরনার্থীদের কেউ কেউ পুরোনোদের সাথে যোগাযোগ করে পাহাড়ে প্রবেশ করছে এরকম আলামতও আমরা পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে চলে আসে ১৯৮০’র দশকে বাস্তবায়িত বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিহীন অ-উপজাতি স্থায়ীকরণ কর্মসূচি, যেটা পরিকল্পনার পেছনে কাজ করেছে আরেক বাঙ্গালী জাত্যাভিমানী ধারণা যে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক অনাবাদি জমি পড়ে আছে। আমার গবেষণায় আমি পেয়েছি যে এই কর্মসূচির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলতঃ বসানো হয়েছে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পরবর্তী ফলস্বরূপ ১৯৫০-৬০ এর দশকে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা থেকে বিতাড়িত বাঙ্গালী-মুসলমান শরনার্থীদের।
যদিও এবার সরকার রোহিঙ্গা শরনার্থীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করবে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি কিন্তু পাহাড়ীদের আশংকা তাতে কমেনি। তাদের আশংকা যেহেতু রোহিঙ্গারা দেখতে বাঙ্গালীদের মত, তাদের ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মত এবং তারা মুসলিম অতএব পাহাড়ের বাঙ্গালী-মুসলিমদের সাথে রোহিঙ্গাদের সংহতি খুব সহজেই তৈরী হবে এবং সেই সূত্রে তারা পাহাড়ে অভিবাসন করে পাহাড়ীদের ওপর জুলুম করবে। এ আশংকাটাও অমুলক নয় কারণ “উপজাতিরা মগ” এই ধুয়া তুলে এরই মধ্যে বাঙ্গালী মুসলমানরা বেশ কয়েক স্থানে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ের মানুষদের ওপর আক্রমন করেছে।
মোট কথা, বাংলাদেশে যে জাতিগত বিভেদ ও বৈষম্য বিরাজমান এবং প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর ওপর যে প্রবল জাতিগোষ্ঠীর নিপীড়ন চলছে এই সত্য বিবেচনায় না এনে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আগমনের ফলে বাংলাদেশের মানুষের লাভ-ক্ষতি সম্পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব না। “স্থানীয় জনগোষ্ঠী” বর্গটিতে দেশের সকল জাতিগোষ্ঠীকে যুক্ত করাটাই যৌক্তিক। আর বিশেষভাবে আমাদের আমলে নেয়া উচিত যারা প্রান্তিক তাদেরই।
লেখাটি ২৭ জুন ২০১৮, প্রথম আলোতে প্রকাশিত
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply