সামান্তা শারমিন*
এ দৃশ্য অপরিচিত নয়, অপ্রত্যাশিতও নয়। দিনের পর দিন দশ বারো জন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ বলে বলে যখন মুখে ফ্য়ানা তুলে ফেলেছিল, সংখ্যায় কম বলে সেই কথার গুরুত্ব দেয়নি এই জনগণই।
ছাত্রলীগের এমন অবস্থার শুরু বেশ কয়েক বছর ধরেই। মেট্রোরেল প্রকল্পের রুট পরিবর্তনের দাবিতে সংহতি সমাবেশ ছিল ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি। ঐদিন পালটা সমাবেশ ডাকে ছাত্রলীগ। তবে তারা ছাত্রলীগ নামে ডাকেনি অবশ্য। তারাও সাধারণ শিক্ষার্থী নামধারী ছিল। তাতে কিছু আসে যায়নি কারণ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ঘৃণাভরে সবাই চিনে রাখে। আর সেদিন ছাত্রলীগের সবাইকেই দেখা যাচ্ছিল। সেই সমাবেশের ব্যানারে কি লেখা ছিল মনে করিয়ে দেই- ‘যুক্তিতে মুক্তি মেলেনা’।

পরে জেনেছিলাম এই হাস্যকর ব্যানার দেখে অনেক শিক্ষার্থী (হলে থাকতে গিয়ে বাধ্যতামূলক ছাত্রলীগ অংশ) আস্তে আস্তে ভেগে গিয়েছিল। এটা ছিল ছাত্রলীগের নতুন ট্রায়াল যেটা একদম কাজে দেয়নি। অবশ্য সে সময় নির্বাচন কাছে ছিলনা এটাও সত্য। আমরা যারা আন্দোলনের মধ্যে ছিলাম তারা ধীরে ধীরে ছাত্রলীগ,পুলিশের এইসমস্ত ট্রায়াল এন্ড এরর দেখতে থাকি। পালটা কর্মসূচী ডাকার ভান করে ভন্ডুল করে দেয়ার এই প্রক্রিয়া আরো একবার আমরা দেখতে পেয়েছিলাম সুন্দরবন রক্ষার সাইকেল মিছিলে। সেদিন অনেকটা কাজ করেই গিয়েছিল কিন্তু শেষতক রক্ষা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে ছাত্রলীগকে খুবই দিশেহারা,বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি আমরা। দমন বিষয়ে অবশ্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন প্রশাসনিক ও মানসিকভাবে প্রশাসনিক শিক্ষকগণ।

প্রক্টরনামা ১ঃ ২০১২ সালে ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চকে শাসাচ্ছেন প্রক্টরদ্বয়
২০১২ সালে সংগঠিত হয়ে ওঠা ‘শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’এর ডাকসু আন্দোলনে আমাদের প্রাক্তন প্রক্টর ও সহকারি প্রক্টরগণ ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনীর দুয়েকজনকে নিয়েই কার্য সমাধা করতে পারতেন। অসংখ্য ছবি, সংবাদ আছে যাতে দেখা যায় প্রো প্রক্টর রবিউল ইসলাম গালাগালি করতে করতে ব্যানার কেড়ে নিচ্ছেন। আক্রমন করতে এরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত এবং আক্রমনকে জায়েজ করতেও এদের জুড়ি মেলা ভার । মূলত এই পার্টিজান শিক্ষকদের কাছেই কোটা আন্দোলনে হামলাকারী ছাত্রলীগ ঋণী। ছাত্রলীগ এই শিক্ষকদের ছত্রছায়াতেই হামলা করেছে। আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা আসতেন কম তাই প্রতিরোধ গড়ে তোলাও সম্ভব হতো না। কেন কম আসতেন সে আলাপও জরুরি তবে এ প্রবন্ধে নয়।

প্রক্টরনামা ২ঃ চর্বিসমৃদ্ধ শিক্ষকদের ভার সামলাতে না পেরে ক্যান্টিনের পাতলা ডাল খাওয়া আমাদের পড়ে যাওয়া।
শিক্ষকদের মারামারির আরো কিছু ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৭ সালের ২২ মে আর ২৯ জুলাই যথাক্রমে সিনেট ও ভিসি প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আসলে একমাত্র শিক্ষার্থীদের নির্বাচন বাদে প্রত্যেকটি নির্বাচন যথাসময়েই হত। নির্বাচনের দুইদিনই নির্বাচন অগনতান্ত্রিক বলে শিক্ষার্থীরা নিজের দাবি জানাতে যায়। দুইবারই শিক্ষকগণ তাদের অতি পরিচিত স্পেশালিটি প্রদর্শন করেন।

প্রক্টরনামা ৩ঃ শিক্ষকদের বিশেষ গলা ধাক্কা প্রদর্শণ
তবে ২৯ জুলাই ব্যাপারটা আরো ঘোট পাকায় যখন জানা গেলো হামলাকারী শিক্ষকদের মধ্যে বহিষ্কৃত, যৌন নিপীড়নকারী এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি প্রত্যাশী বহিরাগত শিক্ষকরা ছিলেন। উক্ত বহিরাগত শিক্ষক দ্রুতই চাকরি পাবেন বলে মুখ ফস্কে মিডিয়ায় জানিয়ে দেন প্রাক্তন প্রক্টর আমজাদ হোসেন। এর কিছুদিন পরে আমরা জানতে পারি আমাদের প্রক্টর পদ অলঙ্কৃত করেছেন নতুন সেনাপতি। এত ডিটেইল জানাটা কাজে লাগে যখন আমরা দেখি কোটা সংস্কার আন্দোলনে ৩০ জুলাই বা ২ জুলাই ছাত্রলীগের কারা কারা মারধরের সাথে যুক্ত। ক্যাডার মেহেদি হাসান সানী, সোহানুর রহমান সোহানদের নাম আমাদের অপরিচিত নয়। এবছরের গত ১৫ জানুয়ারি সাত কলেজ অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে অনেক শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামে। ক্যাম্পাসের পরিচিত, হলগুলোর বড় ছাত্রলীগ নেতারাই ফেসবুক পোস্টে সমর্থন জানিয়ে আন্দোলন অরগানাইজ করেন। ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থী লেখাটা এক্ষেত্রে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা সত্য ছিল। মূলত তিন ধরণের ছাত্র ছিল মিছিলে।
১.ছাত্রলীগ নেতা বা নেতা হতে চাওয়া কর্মী।
২. হলে থাকতে হবে বলে ছাত্রলীগ করে এমন একটা বড় অংশ।
আর ৩.আসলেই বাসা টু ক্লাস করা অতিসাধারণ শিক্ষার্থী।
এর মধ্যে শেষ দুই অংশ আসলেই সাত কলেজ অধিভুক্তি খুবই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ১৫ তারিখ ভিসি অফিস ঘেরাও করলে ছাত্রলীগ খুব চাপ বোধ করে। আন্দাজ করি ভিসি অফিস থেকেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সাধবরণ সম্পাদককে ডেকে আনানো হয়। নেতারা খুব ভয় দেখান এই বলে যে, ভিসি বাবার মত, তিনি কিছু বললে তা অমান্য করা উচিত নয়। এই কথায়ই কাজ হওয়ার কথা কিন্তু বাসা টু ক্লাস করা শিক্ষার্থীরাই রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে খুব সাহসী হয়ে উঠে। তারা বলে দাবি মানা না হলে তারা বাসায় যাবে না। এরপরই তাদের অভিজ্ঞতার বাইরের এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের জবানবন্দিতে শুনি, সভাপতিকে দেখে অনেক ছাত্রই ভয়ে ‘মানুষ’ হয়ে যায়। আন্দোলনের সমন্বয়ককে মারধর করে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়।

২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ঘিরে আছে ্আন্দোলনকারীদের
বাকি ছেলেদেরকে একজন একজন করে আস্তে আস্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিঃশব্দে। হলের মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই পন্থা এবং একটু আগে পাশে বসে স্লোগান দেয়া ছেলেটাকেই দেখা যায় জিদ ধরে বসে থাকা মেয়েদের ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে। মানসিক ও ছবি দেখে বুঝা না যাওয়ার মত শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একে একে সবাই চলে যায়। আমি কল্পনা করতে পারিনা ছবিতে দেখা শেষ তিনজন মেয়েকে কি পরিমাণ বাজে স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। উপরে যে দুইজনের নাম বললাম,তাদের নাম সেই ঘটনায় পত্রিকায় এসেছিল, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নামে লিখিত অভিযোগ করা আছে। শিক্ষকদের কাছ থেকে আসলেই ছাত্ররা মন দিয়ে শিখছে।
১৫ তারিখের নিপীড়নের ঘটনা কয়েকজন ফেসবুকে বিস্তারিত লেখে। আন্দোলনের বক্তব্য ও প্রক্রিয়ার সাথে পুরোপুরি একমত না হওয়া সত্ত্বেও ডাকসু নির্বাচন,রুট বদলাও ইত্যাদি দাবির পক্ষের আন্দোলনকারীরা এটা মেনে নিতে পারছিলাম না যে ঢাকা শহরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়ন হবে তাও আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রদের দ্বারা। তাই নিপীড়িতদের সঙ্গে নিয়েই বিচার চাইতে সমাবেশ, ঘেরাও আর ২৩ তারিখ দ্বিতীয় বারের মত ভিসি অফিস ঘেরাও কর্মসূচী নেয়া হয়।

২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারিঃ ছাত্রলীগের প্রথম দিকের আক্রমণ
এর মধ্যে ১৫ তারিখের নিপীড়িত ছাত্রীরা হুমকি ধামকিতে ভয়ার্ত বিধায় নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দের সঙ্গ ত্যাগ করেন এবং ২৩ তারিখ বন্ধু, শুভাকাঙ্খিহীন অবস্থায় বিচার প্রত্যাশী ২০০ জন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের সর্বশেষ স্ট্র্যাটেজি বর্বর মারধরের শিকার হন।

ছবিতে ছাত্রীদের মবরধর করছে এই শায়লাকেই এর কয়দিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে পাঠানো হয়। বোধকরি পুরষ্কারস্বরূপ ।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় ২০১৫ সালের পরে ছাত্রলীগের আন্দোলন বানচাল প্রক্রিয়ার বিবর্তন এবং আমার মতে এই শিক্ষা এসেছে আমাদের প্রক্টর ও অন্যান্য শিক্ষকদের কাছ থেকে। তবে নির্বাচনের বছর একটা বড় ফ্যাক্ট এবং সেটা লুকানোর কোন ইচ্ছা সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের নেই। ইন্ডিপেন্ডেন্টের একটি টকশোতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি একথা বলেই দিয়েছেন।
এর মধ্যে আরও কত কিছু হল, হাফিজ গণরুমের অত্যাচারে মারা গেলো, সিদ্দিকুর আর রফিকের চোখ অন্ধ হয়ে গেলো, তরুণ আত্মহত্যা করল, ৮ এপ্রিল পুলিশ ছাত্রলীগ উভয় মিলে ক্যাম্পাসে নারকীয় অবস্থার অবতারণা করল, ৯- ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দফায় দফায় হামলা, হুমকি, গুমের চেষ্টা করা হল। এরপর এল ক্রসফায়ার। আবার হামলা, গ্রেফতার। এতকিছু অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যেত যদি অন্তত ক্যাম্পাসটাকে সুরক্ষিত করা যেত। সরকারি লোকজন এটা জানে যে ক্যাম্পাসটা একটা দুর্গ। তাই তারা এরমধ্যে দিয়েই রুট নিবে, আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে মিথ্যা ছড়াবে আর হলের গণরুমকে প্রশাসনের হাতে দেবে না। আর আমাদের শিক্ষার্থীরাও এগুলো দিনের পর দিন মেনে নিয়েছেন। আজকের ঘটনাগুলো সোজা বাংলায় সে সবেরই ফসল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুব খারাপ একথা ২০১২ সাল থেকে শুনছি, বলছি। ঢাবির অধ্যাদেশ, নিয়মকানুন, বার্ষিক বিবরণী জাতীয় ডকুমেন্টসে কোথাও জবাবদিহিতা করতে বাধ্য এমন কারো পদ উল্লেখ নাই। অর্থাৎ, এই ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ভঙ্গ,নিপীড়ন এমনকি একাডেমিকালি অন্যায্য কাজের জবাব দেয়ার জন্য ছাত্রদের কাছে বাধ্য কেউ না। হাজার হাজার তদন্ত কমিটি রিপোর্ট না বের করেও দিব্যি থাকতে পারে।
আসলে দিনের শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় ৯৭ বছর ধরে জণগণের করের টাকায় গড়ে তোলা বলেই শিক্ষার্থীরা সব কিছুর হিসাব চেয়েছে, জবাব চেয়েছে তাই সহ্য করেনি তারা। নানান ফন্দি ফিকির করে নস্যাত করেছে। কিন্তু কোটা আন্দোলন তো সরকারী স্বার্থ রক্ষার, ভোট রক্ষার ব্যাপার। আর এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সাড়াও ব্যাপক। তাই পূর্বোল্লেখিত ঘটনাগুলোর পরিক্রমায় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দক্ষ,পাকাপোক্ত ছাত্রলীগকে ত্রাতারূপে দেখা যাবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগতভাবে আমার আফসোসের বিষয় হল আগের আন্দোলনগুলোতে বিশেষ করে ডাকসু আন্দোলনে যদি এই মুহূর্তের আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রী সমাজ সক্রিয় থাকতেন তাহলে অন্তত নিজের ক্যাম্পাসে, হলে সুরক্ষিত থাকতেন। কিন্ত তা না হওয়ায় আজ ক্ষমতার বিষে উন্মাদ এক হায়েনা আর তার বাচ্চাদের খাদ্যে পরিণত হয়েছেন আপনি, আপনারা।
* অতিথি ব্লগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্য়লয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্রী
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply