
পারুলদের দরজার সামনের উঠান যেখানে হয়তো তাঁর পরদিন শীতের মধ্যে রোদ পোহানোর কথা ছিল –মাহতাব উদ্দিন আহমেদ
মাহতাব উদ্দিন আহমেদ
নোয়াখালির সুবর্ণচরের ঘটনা এখন সবার জানা। নির্বাচনের পর পরই নৌকায় ভোট না দেয়ার কারণে আওয়ামী লীগের ১০-১৫ জন কর্মী মিলে দলগত ধর্ষণ করে চার সন্তানের জননী পারুল বেগমকে। পত্রিকা মারফত খবরটা জেনে পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে ও বুঝতে গত ৩রা জানুয়ারি নৃবিজ্ঞানী নাসরিন সিরাজ ও আমি ঘটনাস্থলে যাই। আমি সেখানে যা যা দেখেছি এবং শুনেছি তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাই। কারণ এই বিবরণ আমাদের সাহায্য করবে পরিস্থিতি বুঝতে। যে হাসপাতালে এখন পারুল বেগমকে রাখা হয়েছে সেখানে গিয়ে আমাদের সাথে পারুল বেগমের স্বামী, সন্তান ও প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হয়। তার পর তাঁর সন্তান ও প্রতিবেশীদেরকে সাথে নিয়ে আমরা যাই পারুল বেগমের সুবর্ণচরে বাড়িতে। আমরা গ্রামবাসী ও প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানতে পারি পারুল বেগম এলাকাতে বেশ সরব কন্ঠ ছিলেন। তবে তিনি বা তার দরিদ্র সিএনজি চালক স্বামী কেউই বিএনপির কর্মী নন। তারা কেবল সমর্থক। শুধু এই জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই নয় বরং বহু আগে থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ও তার লোকজন পারুল বেগমের পেছনে লেগে ছিলেন। কারণ বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের (তাঁদের ভাষায় মেম্বার নির্বাচন) সময় পারুল বেগম রুহুল আমিনের বিপক্ষে কাজ করেছিলেন। তখন থেকেই রুহুল আমিন ও তার দলবলের পারুল বেগমের উপর আক্রোশ। নানাভাবে তারা পারুল বেগমকে উত্যক্ত করতেন। কিন্তু সাহসী নারী পারুল বেগম চলতে ফিরতে রাস্তাঘাটে সেসবের উত্তরও দিতেন।
গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের দিনও পারুল বেগমকে তারা নৌকায় ভোট দিতে চাপাচাপি করে ও হুমকি দেয়। কিন্তু তিনি ধানের শীষে ভোট দিয়ে আসেন। এতে ক্ষিপ্ত হয় তারা। পরে নির্বাচনের পর গভীর রাতে পারুল বেগমরা যখন ঘুমাতে যাচ্ছিলেন তখন প্রথমে তার টিনের ঘরের বাইরের রুমে যেখানে টিন লাগোয়া খাটে তার বড় ছেলে শুয়েছিল সেই টিন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দিয়ে কেটে ফেলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা এবং দরজায় কোপ দিতে থাকে। পারুলের অসুস্থ স্বামী এসময় ভেতরের ঘরে শুয়ে ছিলেন। পারুলরা যখন আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে যে কে তখন তারা উত্তর দেয় যে তারা আইনের লোক। এতে সন্দেহ হলে পারুলরা দরজা না খুলে ভেতর থেকে প্রশ্ন করতে থাকলে এক পর্যায়ে তারা হুমকি দেয় যে দরজা না খোলা হলে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকা হবে। এরপর দরজা খুলতে বাধ্য হলে তারা সবাই একযোগে পারুলদের ঘরে ঢুকে পড়েন। এসময় ঘরের লাইটের আলোয় তারা দেখতে পান যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীরাই, যারা রুহুল আমিনের চ্যালাচামুন্ডা হিসেবে পরিচিত, যারা পারুলকে নিয়মিত উত্যক্ত করতেন তারা বড় বড় মোটা মোটা লাঠি, রামদা, চাপাতি, শাবলসহ ধারালো অস্ত্র হাতে তৈরি হয়ে এসেছে। ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই তারা ঘরের লাইট বাড়ি মেরে ভেঙ্গে ফেলে। এরপর তারা প্রথমে পারুলের ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। এসময় পারুল তাদের গিয়ে বলেন যে তাদের যাবতীয় আক্রোশ তো তার উপরে। তাই তাদের যা করার সেটা যেন তার সাথে করে। তার মেয়েকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। তখন এক পর্যায়ে আক্রমণকারী আওয়ামী লীগের কর্মীরা পারুলের অসুস্থ স্বামী সিরাজুল ইসলামকে তিনি যেখানে শুয়ে ছিলেন সেই খাটের সাথে বেঁধে ফেলে আর পারুলের চার ছেলেমেয়েকে বেঁধে ফেলে আরেক ঘরে। পারুলের স্বামী ও তাঁর সন্তানদের সবারই মুখ বেঁধে ফেলা হয়। এসময় লুঠ করা হয় পারুলদের বহু কষ্টে সঞ্চিত ৪০ হাজার টাকা এবং কিছু স্বর্ণালংকার। এরপর দুই ঘরেই পাহারায় লোক বসিয়ে বাকিরা পারুলকে টেনে হিচড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে তারই উঠানে। এসময় তারা পারুলকে হুমকি দেয় যে যদি পারুল চিৎকার করে তাহলে তার সন্তানদের মেরে ফেলা হবে।

ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেটে ফেলা পারুলদের টিনের ঘরের টিন

এই খাটের হাতলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল পারুলের স্বামী সিরাজুল ইসলামকে

স্বর্ণালংকার ও ৪০ হাজার টাকা লুট করা হয় এখান থেকে
এর পর পারুল বেগমের উপর রাতভর নির্যাতন চলে তাঁর নিজেরই বাড়ির উঠানে। উঠানের পাশে একটি পুকুর ছিল, যেই পুকুরপাড়ে হয়তো পারুল বেগম বসতেন শীতের রোদ পোহাতে। একপর্যায়ে সেই পুকুরপাড়ে কাঁঠালগাছের নিচে চলে এই অকথ্য নির্যাতন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে কেবল দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় নি। কোদালের কিংবা কুঠারের পেছনে যেরকম মোটা লাঠি থাকে সে মোটা লাঠি দিয়ে তাকে ভয়াবহভাবে পিটিয়েছে। এক পর্যায়ে তার এক হাত ভেঙ্গে যায়। শুধু তাই নয় ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যাওয়ার সময় তারা পারুল বেগমের গায়ে মূত্রত্যাগ করে দিয়ে যায়। পরে আমরা হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি তাঁর সারা শরীরে কালশিটে পড়েছে এবং শরীরে ৫২টি কামড়ের দাগ ছিল। এইসব বিবরণ শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল যে আমি কোন স্বাধীন দেশের নয়, আমি একাত্তর সালের পাকবাহিনীর কোন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কাহিনী শুনছি। আপনাদেরও কি তাই মনে হচ্ছে না? পারুল বেগম এখন হাসপাতালে। হয়তো একসময় তিনি শারিরীকভাবে সেরেও উঠবেন। হয়তো জনরোষের চাপে পড়ে এই ঘটনায় জড়িতদের শাস্তিও দেয়া হবে। কিন্তু যে আঘাত তাঁর মনের গভীরে গেঁথে রইবে, যে অপমানের দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে ফিরবে তার ঘরের প্রতিটি কোনায় কোনায়, তাঁর উঠানে, তাঁর রান্নাঘরের সামনে, তাঁর উঠানের গাছগুলোর নিচে, তাঁর পুকুরঘাটে — সেই আঘাত, সেই অপমান তিনি কি করে ভুলবেন? আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, আওয়ামীপন্থী নারীবাদীরা কোন উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে তাঁকে ভোলাবেন? পারবেন কি? কিংবা পারুলের যে সন্তান ধর্ষকেরা চলে যাওয়ার পরে পারুলকে অজ্ঞান, রক্তাক্ত ও উলঙ্গ দেখে লজ্জা পেয়ে আবার ঘরে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়েছিল সেই সন্তানের কাছে আপনারা কোন চেতনার গালগল্প শোনাবেন? কি দিয়ে তাকে ভোলাবেন? পারুল বেগমের কথা বাদই দেই, পারুল বেগমদের পালিত যে কুকুরটিকে ধর্ষকেরা গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিল পারুলকে ধর্ষণ করার আগে সেই কুকুরটির কাছেও কি কোনদিন এই আপনারা মুখ তুলে তাকাতে পারবেন?

ঘটনার নীরব সাক্ষী আরো কতগুলো বোবা গাছ। এরা কি জানতো কোনদিন যে তাদের পদতলেই ঘটবে এমন ভয়াবহ জুলুম?

পারুলদের পালা কুকুর যাকে ঘটনার আগে দিয়ে বেঁধে ফেলেছিল ধর্ষকেরা
আমরা গ্রামের মানুষের কাছ থেকে আরো জানতে পারি যে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা রুহুল আমিন ও তার চ্যালাচামুন্ডারা এমন কাজ যে এই প্রথম করলো তা নয়। এমন কাজ তারা আগেও বহুবার করেছে। গত ১০ বছর ধরে চলছে তাদের অত্যাচার। ধর্ষণ ছাড়াও গাছ কেটে নেয়াসহ তাদের নানবিধ অত্যাচারের কথাও তাঁরা আমাদের জানালেন। গ্রামের মানুষ আমাদের এমনটাও বলেছেন যে রুহুল আমিন গংদের কাজই হচ্ছে ঘরে ঘরে এভাবে মেয়েদের উপর হামলা করা। আমরা মাত্র ঘন্টাখানেকের কথাবার্তাতেই এরকম তিনটি ঘটনার কথা জানতে পারলাম যেখানে মহিলারা নিজেরা এসে এসে আমাদের বলেছেন যে তাদের পরিবারের মেয়েদেরও ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং কোনটারই কোন বিচার হয়নি। শুধু তাই নয়, অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে এদের অত্যাচারে যেসব পরিবারে মেয়েরা বড় হয়েছে সেসব পরিবার সুযোগ থাকলে মেয়েদের এলাকা থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে। কারণ এলাকায় থাকলেই এদের হাতে ধর্ষণের শিকার হতে হবে এ ব্যাপারে তারা প্রায় নিশ্চিত। একজন মহিলা আমাদের জানালেন ধর্ষণের আশংকায় তাঁর মেয়েকে তিনি ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়ার পর যেদিন মেয়ে ঈদের বন্ধে বাড়ি আসে তখন বাজারে গিয়ে কানাঘুষা শুনতে পান যে রুহুল আমিনের লোকেরা ওইদিন রাতে তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা আঁটছে। তখন তিনি আর বিলম্ব না করে সাথে সাথেই মেয়েকে বাসা থেকে বের করে ব্লেড হাতে বের হন এবং মেয়েকে সুবর্ণচর থেকে চৌমুহনীতে নিয়ে এসে ঢাকার গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তারপর বাড়িতে ফিরেন। বাংলাদেশ সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা তো বাংলাদেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে এটা নিয়ে কৃতিত্ব নিতে কোন কার্পন্য করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তো মাদার অব হিউম্যানিটি খেতাবও দিয়ে দেয়া হল। কিন্তু এইভাবে নিজের এলাকা থেকে সুবর্ণচরের মেয়েদের বিতাড়িত হতে বাধ্য হওয়ার সাথে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনার কি খুব বেশি পার্থক্য আছে?
স্থানীয় মানুষ আমাদের কাছে আরও অভিযোগ জানান যে নির্বাচনের দিন রাতে রুহুল আমিন ও তার দলবল ধানের শীষে ভোট দেয়া আরো কতগুলো পরিবারের মেয়েদের উপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু মানুষের পাহারার কারণে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পারুলের স্বামীর সাথে কথা বলে আমরা জানতে পারি যে পুলিশ প্রথমে যে এফআইআর লিখেছিল সেটাতে তিনি মূল হুকুমদাতা রুহুল আমিনসহ মোট ১৩ জনের নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ রুহুল আমিন সহ আরো চারজনের নাম সেটিতে অন্তর্ভুক্ত করেনি। ফলে তিনি সেই এইআইআর প্রত্যাখান করেন। কিন্তু সাহসী পারুল বারবারই মিডিয়ার সামনে রুহুল আমিনের নাম নেন এবং ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে জনরোষ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার করলেও এখন পর্যন্ত এফআইআরে পারুলদের অভিযোগ অনুসারে মূল হুকুমদাতা রুহুল আমিনের নাম নেই। এখন চাপে পড়ে রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে যে সে এই আইনী ফাঁকটাকে কাজে লাগিয়ে বের হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? পারুলকে যারা ধর্ষণ করেছিলেন তারা বেশিরভাগই ইটভাটায় কাজ করে বলে গ্রামের মানুষ আমাদের জানান। রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও মদত ছাড়া এদের কি কখনো এতটা সাহস পাওয়া সম্ভব যে একজনের বাড়িতে গিয়ে তার উঠানে তাকে ধর্ষণ করে আসবে?

FIR এর কপি

এজাহার এর কপি
পারুলদের বাড়িতে স্থানীয়দের সাথে কথা বলার সময়ই কয়েকজন স্থানীয় বৃদ্ধ আমাদের সাথে যোগ দেন। তাঁদের একজন আমাকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দেখান যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিভাবে তাকে প্রহার করেছে তার ছেলের থেকেও বয়সে ছোট আওয়ামী লীগের কর্মীরা। তার লুঙ্গিতে রক্তের দাগও আমাকে তিনি দেখান। তবে সচরাচর যেমনটা হয় এসব ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে মেয়েটাই বেশি বাড়াবাড়ি করেছে এজাতীয় কথাবার্তা বলা – এমন কোন কথা আমরা একজনের মুখ থেকেও শুনিনি। বরং তারা সবাই একই সুরে কথা বলেছেন যে কি পরিমাণ জুলুম করা হয়েছে পারুলের উপর এবং তারা সবাই এর বিচার চান। আমি তখন একপর্যায়ে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করি যে এত এত ক্ষোভ যেখানে জমে আছে, এত বড় জুলুম যেখানে করা হল সেখানে এলাকায় কেন প্রতিবাদ হচ্ছে না? তিনি তখন অস্ফুটে শুধু বললেন যে “প্রতিবাদ…”। বলে থেমে গেলেন। তখন আমি তাঁর যে চোখদুটো দেখলাম সেই চোখের কথা হয়ত আমি কখনোই ভুলব না। কোনায় চিক চিক করা সেই চোখে ছিল এক অসহ্য ব্যাথা, যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সেই চোখে ছিল অসংগঠিত জনগণের তীব্র আকুতি, তীব্র অসহায়ত্ব। সেই চোখ আমাকে মর্মে মর্মে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল এতক্ষণ যে ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা শুনছিলাম তার কথা, ধর্ষকদের প্রবল প্রতাপশালী রাজনৈতিক পরিচয়ের কথা, প্রশাসনের নির্বিকারচিত্ততা-অসংবেদনশীলতার কথা, ধর্ষকদের রক্ষা করার চেষ্টার কথা, এলাকার এ জাতীয় একটা ঘটনারও যে বিচার হয়নি তার কথা। সেই চোখে যারা এই ব্যবস্থার জন্য দায়ী তাদের প্রতি এক তীব্র অভিশাপও আমি দেখেছিলাম। ধর্ষিতার প্রতি প্রশাসনের অসংবেদনশীলতার আরেক নমুনা আমরা পাই পরে যখন পারুলদের বাড়ি থেকে আবার নোয়াখালি জেনারেল হাসপাতালে যাই পারুলকে দেখতে। সেখানে নৃবিজ্ঞানী নাসরিন সিরাজ পারুলের কেবিনে ঢুকে দেখতে পান রুমে দুইটি বেড। একটিতে পারুল চাদর গায়ে শুয়ে আছেন। ঘরে মহিলা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশের বেডে এক পুরুষ পুলিশ হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে তার মোবাইল টিপছেন!
তবে আমরা একটু অবাক হয়েই আবিষ্কার করলাম যে গ্রামের মানুষ আমরা ওখানে যাওয়ার দিন পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের নানান জায়গায় পারুলের ধর্ষণ নিয়ে যতগুলো বিক্ষোভ হয়েছে তার প্রতিটির খবরই তারা রাখেন। মিডিয়া সেসব খবর সবগুলো না দিলেও ফেসবুক মারফত তারা এসব জেনেছেন বলে জানান। শুধু তাই নয়। এসব বিক্ষোভে তারা নিজেরাও বেশ উদ্দীপ্ত বলে মনে হয়েছে। উল্লেখ্য আমরা চলে আসার একদিন পরে সেখানেও বিক্ষোভ হয় বলে আমি জানতে পারি। বছরের প্রথম দিন থেকেই পারুল বেগমের ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক বিক্ষোভ চলছেই। নানাবিধ গ্রুপ থেকে হচ্ছে এই বিক্ষোভ যেটা চলমান থাকা খুবই জরুরী। কিন্তু এই বিক্ষোভ চলমান অবস্থাতেই আওয়ামী বুদ্ধিজীবী মহল থেকে একটি “অরাজনৈতিক” বক্তব্যকে সামনে আনার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। আর তা হল “ধর্ষকের কোন দল নাই”। এক্ষেত্রে আরো যেটা প্রকটভাবে লক্ষনীয়, বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পর ২০০১ সালে যখন পূর্ণিমাকে একই কারণে দলগত ধর্ষণ করে বিএনপির কর্মীরা তখন কিন্তু এদের কাউকেই “ধর্ষকের কোন দল নাই” জাতীয় কথাবার্তা বলতে দেখা যায়নি এবং তখন তারা ব্যাপক মাত্রায় সরব ছিলেন। তাহলে আজকে ২০১৮ সালে এসে যখন একই কাজ আওয়ামী লীগের কর্মীরা করল তখন তাদের প্রায় সকলেই চুপ কেন? তাহলে তাদের কাছে কি আওয়ামী লীগের কর্মীদের দ্বারা ধর্ষণ করা জায়েজ? আর দেশজোড়া ব্যাপক সমালোচনার পর সম্ভবত চাপে পড়ে তাদের মধ্যে গুটিকয় যারা কথা বলেছেন তারাই বা কেন হঠাৎ করে ইনিয়ে বিনিয়ে এই বক্তব্যকে সামনে আনতে চাইছেন যে “ধর্ষকের কোন দল নাই”? একটি মাত্র শব্দেই তাদের এই আচরণের ব্যাখ্যা হয়। আর তা হল অসততা। এই অসততা তারা গত ১০ বছর ধরেই উত্তরোত্তর দেখিয়ে চলেছেন। আর এর মাধ্যমে তারা বুদ্ধিজীবী থেকে পরিণত হয়েছেন আওয়ামীজীবীতে এবং তাদের এই ধর্ষকের কোন দল নাই জাতীয় কথাবার্তার পরে এখন আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে যে ধর্ষণের কোন দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না কারণ “একটি অপরাধকে রাজনৈতিক আবরণ দেয়ার কোন সুযোগ নেই”। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের দায়ভার যদি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপরই বর্তায়, পূর্ণিমাকে ধর্ষণের দায়ভার যেখানে বিএনপির উপরই বর্তাবে, সেখানে আওয়ামী লীগ কর্মীদের দ্বারা ধর্ষণের দায়ভার কেন আওয়ামী লীগ নিবে না? কোন যুক্তিতে?

যে রাস্তা ধরে টানা হচ্ছে উন্নয়নের বিদ্যুতের তার সেই রাস্তা দিয়েই এসেছিল ধর্ষকেরা।
তাই বিচারের দাবীতে বিক্ষোভরত কারো কারো কাছেও আপাতদৃষ্টিতে ধর্ষকের কোন দল নাই কথাটা একটি “শুভবোধসম্পন্ন” ও “অরাজনৈতিক” কথা বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এই কথা প্রচার করার পেছনে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মাথায় যেটা খেলা করছে সেটি হল এক নোংরা রাজনীতি। আর সেই রাজনীতি হল ধর্ষকের দলীয় পরিচয় আড়াল করার রাজনীতি, নিজেদের যাবতীয় দায়ভার অস্বীকার করার রাজনীতি, যে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা এই ধর্ষণকে এভাবে বেপরোয়া করেছে সেই রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার গায়ে আঁচড় লাগতে না দেয়ার রাজনীতি এবং সর্বোপরি, যারা গত ১০ দশ বছর ধরে পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে তাদের দিকে তোলা আঙুলকে অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার রাজনীতি। তাই যারা পারুলের ধর্ষণের বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ করছেন, তাকে নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছেন, তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন তাদের এই নোংরা রাজনীতিটি সম্পর্কে সতর্ক হওয়া জরুরী। সুবর্ণচরের ওই বৃদ্ধের চোখ দুটোতে আমি জুলুমের রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার তীব্র আকুতিটাই দেখেছি। আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই এই আকুতিতে আমরা কে কিভাবে সাড়া দেব তার উত্তর আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে। কিন্তু সাড়া আমাদের দিতেই হবে। পারুল বেগম খুবই সাহসী একজন মহিলা। নয়তো ওই ভয়াবহ নির্যাতনের পর, যার উদ্দেশ্য ছিল তাকে সম্পূর্ণরূপে গুঁড়িয়ে দেয়া, যেখানে তার পরিবারকে ধর্ষকেরা হুমকি দিয়ে গিয়েছিল যে মুখ খুললে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হবে, মেরে ফেলা হবে, সেখানে এত ভয়ের মধ্যেও তিনি মুখ খুলেছেন। সাহসের সাথে সকল ধর্ষকের ব্যক্তিগত ও দলীয় পরিচয় ফাঁস করেছেন। কিন্তু সেই সাহসী পারুল বেগমের মনেও এই প্রশ্ন ঘুরছে – যেটা তিনি নৃবিজ্ঞানী নাসরিন সিরাজকে করেছেন যে “দশ বছর হোক কি বারো বছর হোক ওরা তো এর প্রতিশোধ নেবেই, তখন আমি কি করবো?” পারুল বেগমের এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জনগণ কিভাবে দেই তার উপর শুধু পারুল বেগমই নয়, আমাদের সবার ভবিষ্যতই নির্ভর করছে।
Categories: আন্দোলন বার্তা, যাপিত জীবন, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
Leave a Reply