
গাজীপুরের ঝর্ণা নীটওয়ার লি। কারখানার শ্রমিকরা আজ (২৪সে মার্চ, ২০২০) সকাল দশটায় মালিকের উত্তরার বাসার সামনে অবস্থান নিয়েছে। রাত দশটা পর্যন্ত অবস্থান চলছে। করোনা মহামারীর অজুহাত দেখিয়ে সম্প্রতি ছাটাইকৃত শ্রমিকদের বেতন দিকে অস্বীকার করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। — আলোকচিত্র@মনজুর মঈন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
ফরিদা আখতার
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক কাতরভাবে বিদেশী বায়ারদের উদ্দেশ্যে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, যেন তারা তাদের অর্ডার বাতিল না করে, এবং যা উৎপাদন করা হয়েছে তা যেন তারা নিয়ে নেয়। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস বিস্তারের কারণে বাংলাদেশের ১০৮৯ গার্মেন্টের ১.৪ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে, এর ফলে এই ফ্যাক্টরীগুলোতে ১২ লাখ শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। রুবানা হক তার ভিডিও বার্তায় বারে বারে পুরো গার্মেন্ট সেক্টরের ৪১ লক্ষ শ্রমিকের কাজ হারানো, না খেয়ে থাকা, এমনকি chaos সৃষ্টি হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিলেন।
শ্রমিকদের প্রতি মানবিক হবার কারন দেখিয়ে পোশাক শিল্পপতিদের নিজেদের স্বার্থের কথা বলা নতুন কিছু নয়। তবে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর গার্মেন্ট সেক্টরে তেমন কোন বড় বিপর্যয় হয় নি। তাছাড়া রানা প্লাজার ঘটনা ছিল একান্তই বাংলাদেশ কেন্দ্রিক, বিদেশী বায়াররা তাদের নিজ দেশের ক্রেতাদের দোহাই দিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে এই সুযোগে তাদের নানা শর্ত আরোপ করে বাংলাদেশের পুরা গার্মেন্ট সেক্টরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। লাভ হয়েছে শুধু এই যে গার্মেন্ট কারাখানার শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টা কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয় হয়েছে। অন্যদিকে অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে, শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। বিদেশী ক্রেতা এবং বায়ারদের কাছে বাংলাদেশের শ্রমিকের গুরুত্ব শুধু মাত্র সস্তাশ্রম বলেই, তারা পুড়ে মরলো কি, ভবন ধ্বসে মরলো তাতে তাদের বিশেষ কিছুই আসে যায় না।
করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন। এটা বোশ্বিক মারী বা প্যান্ডেমিক। এই ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, যারা উৎপাদন করবে তারা যেমন আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে তেমনি যারা কিনবে তারাও সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে। এপর্যন্ত যে ১৩৬টি ব্র্যান্ড তাদের অর্ডার বাতিল বা স্থগিত করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে এইচঅ্যান্ডএম, প্রাইমার্ক, এলকট, সিঅ্যান্ডএ, পিপকো, সিএন্ডএ জার্মানি, টম টেইলর, ওয়ালমার্ট, টম টেইল ও জারা। গার্মেন্টের কাপড়, বিশেষ করে ব্রান্ড গার্মেন্ট, প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় পড়ে না। এখন খাদ্য এবং নিত্য ব্যবহার্য্য পণ্য এবং ওষুধ ছাড়া অন্য কেনাকাটা খুব একটা হবে না। আগামি দু’মাস কম পক্ষে কেউ ঘর থেকে বের হবে না, শপিং মলে যাবে না, ফলে গার্মেন্টের শখের কাপড় কেনার ক্রেতা পাওয়া যাবে না। এবং যেসব দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বেশি ঘটছে, সেখান থেকে কাপড় আনা হবে কিনা, এমন সিদ্ধান্তও নেয়া হলে আশ্চর্য হবো না। ফলে রুবানা যতোই আবেদন জানাক, সবারই “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা”র দশা।
রুবানা হকের কথায় মনে হচ্ছে বিদেশের বায়াররা তাদের অর্ডার বহাল রাখলেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন দেয়া, ছু্টি দেয়া ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গার্মেন্ট মালিকরা নিতে পারবেন। কেন? শুনেছি বিভিন্ন শিল্প মালিক সমিতি সহ বিজিএমইএ’ও সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে। তাহলে শ্রমিকের সবেতনে ছুটি দেয়ার বিষয়টি বায়ারদের টাকা দেয়ার ওপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কেন?
এদিকে সরকারও বলছে গার্মেন্টস বন্ধের সিদ্ধান্ত নেবেন মালিকরা, এই কথা বলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। এদিকে শ্রমভবনে শ্রমপ্রতিমন্ত্রী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ও ফ্যাক্টরী মালিকদের সাথে সভা করে বলে দিয়েছেন কোন কারখানা বন্ধ হবে না! ব্যস।
রুবানা হক একাত্তর টেলিভিশনের এক সাক্ষাতকারে বলেছেন পোশাক শ্রমিকদের নেতারাই কারখানা বন্ধের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে শ্রমবিকাশ কেন্দ্র তথ্য নিয়ে জেনেছে যে সেদিনের সভায় পোশাকশ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রায় ২৫টি সংগঠন উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ৯টি সংগঠন পোশাকশিল্প কারখানা সাময়িক বন্ধের পক্ষে মত প্রদান করেছিল। বাকি প্রায় ১৫টি সংগঠন পোশাক শিল্প কারখানা খোলা রাখার পক্ষে মত দেয়। যে সংগঠনগুলি পোশাক শিল্প কারখানা খোলা রাখার পক্ষে মত দেয় তারা বলেছেন, শুধু কারখানা বন্ধ দিলেই হবে না, পোশাকশ্রমিকদের চলতি মাসের মজুরিসহ ছুটি দিতে হবে। অর্থাৎ সবেতনে ছুটির কথাই তারা বলেছেন। সরকার বা পোশাক শিল্পমালিকদের প্রতিনিধিরা কেউই শ্রমিকদের এই দাবী মানছেন না। যেসব শ্রমিক সংগঠন কারখানা খোলা রাখার পক্ষে বলেছেন তারা, বলা বাহুল্য, সরকার দলীয়, শ্রমিক সংগঠনেরই প্রতিনিধি।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে ফেলেছেন যে, দেশে প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ শিল্পকারখানায় শ্রমিকেরা কাজ করে। শুধু গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমিকদের দায়িত্ব নিলে হবে না। দায়িত্ব নিলে সকল শ্রমিকদের দায়িত্ব নিতে হবে। এখন সরকারের পক্ষে এই দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব না। বাহ , একজন শ্রমপ্রতিমন্ত্রীর মতোই কথা বটে! অথচ তিনি একবারও ভেবে দেখেন নি এই শ্রমিকদের ঘামের টাকায় তাঁর মন্ত্রী হওয়া, তাঁর মন্ত্রণালয় চলা সবই হচ্ছে, অথচ এখন তাদের সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষার প্রশ্নে দুনিয়ার অজুহাত তিনি খাড়া করছেন।
শ্রমবিকাশ কেন্দ্র ঢাকার শ্যামলী, মীরপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী, টেকনিকাল থেকে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাছ থেকে কিছু তথ্য নিয়েছে। এখানে গার্মেন্ট শ্রমিকেরা বলছেন, গার্মেন্ট বন্ধ হলে আমরা খাব কি? সরকার বা পোশাক শিল্পমালিকেরা তো বলছে না এই মাসের বেতন নিয়ে তোমরা ছুটিতে যাও। এখনও একদিন গার্মেন্ট কামাই করলে মাসের বেতন বন্ধ। আমাদের বাড়ি ভাড়া আছে, খাওয়া–দাওয়া আছে, ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার জন্য স্কুলের বেতন আছে। স্কুল বন্ধ হইছে কিন্তু স্কুলে বেতন তো ঠিকই দিতে হবে। আমরা এই টাকা পাব কোথায়? গার্মেন্ট শ্রমিকদের কোন প্রকার আশ্বাস দেয়া হচ্ছে না যে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গার্মেন্ট শ্রমিকেরা বড় অংশই বস্তিতে বসবাস করে; একেকটা রুমে ৭ থেকে ৮ জন থাকে। প্রতিটা ঘর পাশাপাশি, লাগালাগি। একটা গোসলখানা এবং একটা পায়খানা ব্যবহার করে প্রায় ২৫–৩০ জন। রান্নার কাজও চলে ওই একটা চুলাতেই। তারা ৯ – ১০ ঘন্টা গার্মেন্টে কাজ করে। সেটা বস্তির থেকে ভাল। তারা বলেন, “সরকার যদি আমাদের এ মাসের বেতন দিয়ে গার্মেন্ট বন্ধ দিতো তাহলো আমরা ঢাকাতে থাকতাম না, দেশে চলে যেতাম”।
রুবানা হক কান্না করছেন এবং ক্রয়াদেশ বাতিল করাকে ‘অমানবিক’ আখ্যা দিয়ে বায়ারদের সমালোচনা করেছেন বলে পত্র–পত্রিকায় খবর এসেছে। তিনি বলেন, “কথা বলার সময় তারা অনেক বড় বড় কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে, সেটার দায়ভার তারা নিচ্ছে না”। অন্তত শ্রমিকদের সামনের তিন মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করার আহবান জানান। তার মানে কি এই যে বিদেশী বায়াররা টাকা না দিলে গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দেবেন না? এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতেও? তাহলে কি তারা বায়ারদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যে শ্রমিকদের ঝুঁকির মধ্যে রেখে দেবেন, বায়ারদের মানবিকতা উথলে ওঠাবার জন্যে?
রুবানা হক, বিজিএমইএ সভাপতি, আপনার দায়িত্ব কি শুধু বায়ারদের কাছে হাত পাতা? নাকি শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া?
ফরিদা আখতার উবিনীগের পরিচালক এবং নয়া কৃষি আন্দোলনের একজন সংগঠক।
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply