
“যদি মরতে হয় না খেয়ে করোনা দিয়ে কি করবো?” “যাবো না যবো না বেতন ছাড়া যাবো না”। ১৩ই এপ্রিল সাভার আশুলিয়াসহ বিভিন্ন কারখানার গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতনের জন্য রাজপথে, কারখানার গেটের সামনে স্লোগান দিয়েছে । রাকিব অ্যাপারেলস, সাভার; ১৩ এপ্রিল, ২০২০। ─ ছবি: সংগৃহীত।
নাফিসা তানজীম
সারা বিশ্বব্যাপী গার্মেন্ট শিল্প করোনা মহামারীর কারণে বিশাল সংকটে পড়েছে। প্রথম বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো তাদের শোরুমগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। শোরুমগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের করেছে ছাঁটাই। যে ব্র্যান্ডগুলো রানা প্লানা ধ্বসের পরে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এগিয়ে এসেছিল, এখন সেই একই ব্র্যান্ডগুলো তাদের অর্ডার একের পর এক স্থগিত বা বাতিল করে দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে যে এই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্ট রফতানি -৬.৫৭% থেকে -১৭.০৬% হ্রাস পাবে। ইউতে রফতানি কমবে -৩.৬৭% থেকে -১২.৩৮% (জাস্ট স্টাইল, ২ এপ্রিল ২০২০)। এই রপ্তানি ঘাটতির প্রভাব ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মত বা তার চেয়েও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এই পরিস্থিতিতে যৌক্তিক কারণে বিজিএমইএ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বিজিএমইএর ওয়েবসাইট অনুযায়ী এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ১১২৭টি ফ্যাক্টরির ৩.১৩ বিলিয়ন অর্ডার বাতিল অথবা স্থগিত করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়বে প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার গার্মেন্ট শ্রমিকের ওপরে। মার্চ মাসের ২৩ তারিখে একটি ইউটিউব ভিডিওতে বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট রুবানা হক রিটেইলারদের বিবেকের কাছে আবেদন জানান। তিনি ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য একসাথে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন।
ব্যবসা বনাম টিকে থাকার সংগ্রাম
গত কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে বিজিএমইএ বারবার গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের বিষয়টি সামনে তুলে ধরছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাথে একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে রুবানা হক বলেন, “ওদের (ব্র্যান্ডদের) জন্য এটি একটি ব্যবসায়িক প্রশ্ন….আমাদের জন্য এটা ৪১ লাখ শ্রমিকের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।“ ব্যবসা এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের প্রশ্নটি অবশ্য এতখানি সোজাসাপ্টা নয়। ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকান রিটেইলররা তাদের শোরুমের শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে এখন হিমশিম খাচ্ছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রচুর শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে। কিছু শ্রমিক তাদের সরকারের কাছ থেকে সীমিত সুযোগ-সুবিধা পেলেও সামনে বিশ্বব্যাপী যে মন্দা আসছে, সেই মন্দা সামাল দেয়ার জন্য এই সীমিত সহায়তা কিছুই না। অনেক শ্রমিক এখন তাদের ইউনিয়নের সাথে মিলে হরতাল-অবরোধ-প্রতিবাদ সমাবেশ করছে যাতে করে বড় রিটেইলারগুলো তাদের শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী পূরণ করতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিকরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে খুব সুন্দর করে শ্রমিকের বেঁচে থাকার দাবীর মোড়কে ঢেকে-সাজিয়ে উপস্থাপন করছেন। হ্যাঁ, কারখানাগুলো ক্ষতির কারণে বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকরা তাদের চাকরি হারাবে। চাকরি না থাকলে শ্রমিক এবং তাদের পরিবারগুলোর পক্ষে টিকে থাকাই একটি কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাই কারখানাগুলোর টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু শ্রমিকের টিকে থাকার জন্য কারখানাগুলোর টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তার আলোচনায় যেন মালিকপক্ষের মুনাফা লাভ এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি ঢাকা পড়ে না যায়, সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখা দরকার।
দুর্যোগকালীন পুঁজিবাদঃ বিতর্ক নাকি ঐক্য?
সম্প্রতি “করোনা ও পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা” শীর্ষক অনুষ্ঠানে খালেদ মুহিউদ্দীনের মুখোমুখি হন বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট রুবানা হক। বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেয়ার পরিবর্তে রুবানা হক কেন বিশ্ব খাদ্য সংস্থার কাছে গার্মেন্ট শ্রমিকের খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য যোগাযোগ করেছেন বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে রুবানা হক বলেন, “এই সময়ে কিন্তু আপনারা যদি সারাক্ষণ খালি কন্ট্রোভার্সি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে খুব মুশকিল। আমি এই অনুষ্ঠানের প্রথম থেকেই দেখছি সবচাইতে খোঁচা দিয়ে কথা বলার জায়গাগুলোয় বলছেন। খালেদ, এই সময়ে আমাদের একসাথে থাকতে হবে। এই সময়ে এটা জরুরি না…”।
কানাডিয়ান সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট নেওমি ক্লাইন “ডিজ্যাস্টার ক্যাপিটালিজম” বা “দুর্যোগকালীন পুঁজিবাদ” নামক খুব চমৎকার একটি ধারণার বলেছেন। ক্লাইনের মতে দুর্যোগের সময় সরকার বা কর্পোরেশানের মত ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি অবস্থা সামাল দেয়ার নামে এমন চরমমাত্রার পুঁজিবাদী উদ্যোগ নিতে পারে, যেসব উদ্যোগ হয়তো স্বাভাবিক সময়ে চিন্তারও বাইরে থাকে। জরুরি পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে দুর্যোগকালীন সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান যতটা পারা যায়, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যবস্থা নেয়। দুর্যোগকালীন পুঁজিবাদ এখন বিশ্বব্যাপী পোশাকের পুরো সাপ্লাই চেইন জুড়ে এমন সব কাজ-কর্ম করছে, যা স্বাভাবিক সময়ে করা অনেক কঠিন। আমেরিকা-ইউরোপের মত জায়গায় ব্র্যান্ডগুলো তাদের শোরুমের বেশিরভাগ শ্রমিককে ছাঁটাই করে দিচ্ছে। তারা গণহারে তৃতীয় বিশ্বের সাপ্লায়ারদের অর্ডারগুলো স্থগিত বা বাতিল করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যেখানে করোনা মহামারীতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের অন্ন-সংস্থানের কোন নিশ্চয়তা নেই, সেখানে গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদেরকে মজুরি দেয়ার কারণ দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে খুবই অল্প সুদে ঋণ পাচ্ছে। লক্ষ্য করুন, শ্রমিকদেরকে সবেতন ছুটি দেওয়ার কথা কিন্তু মালিকপক্ষ বা সরকারের কেউ উচ্চারণও করছে না। শ্রমিকরা কিন্তু প্রণোদনার অর্থ সরাসরি পাবে না। এটা মালিকপক্ষ হয়ে তাদের কাছে আসতে হবে। শ্রমিকের ঘরে এই মূহূর্তে খাবার নেই। সরকারি ঋণের সুবিধা মালিকপক্ষ হয়ে শ্রমিকের কাছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে কবে পৌঁছবে এবং আদৌ পৌঁছবে কিনা, আমরা কিন্তু তা এখনও জানিনা।
তাই দুর্যোগের সময়ে এক হয়ে কাজ করাটা যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি দুর্যোগকালীন পুঁজিবাদকে প্রশ্ন করাটাও খুব জরুরি। এই বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তাকে “কন্ট্রোভার্সি” তৈরি করছে বলে থামিয়ে দিতে চাওয়াটা কোন কাজের কথা নয়। করোনা ভাইরাসের এই মহামারী আমাদের পুরো সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গলদগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। মুনাফার লোভে তৃতীয় বিশ্বে বিভিন্ন দেশ এবং আমাদের দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলো একজন আরেকজনের সাথে সস্তা শ্রমের যোগান দেয়ার যে প্রতিযোগিতায় মেতেছে, তার ফলাফল শ্রমিকের ওপরে যে কত ভয়াবহভাবে পড়তে পারে, করোনা ভাইরাস মহামারী সেটি আমাদের সবার সামনে তুলে ধরেছে। মাত্র এক মাস রপ্তানি বন্ধ থাকলে কেন পুরো গামের্ন্ট শিল্প প্রায় ধবসে পড়বার অবস্থা হবে? পুরো শিল্পের অবস্থা এত নাজুক কেন? যে বিজিএমইএ দেড় বছর আগেও গার্মেন্ট শ্রমিকের বেতন বাড়ানোর বিরুদ্ধে চরম অবস্থান নিয়েছিল – যারা শ্রমিকদের দাবী করা ১৬০০০ টাকা দিতেতো চায়ইনি, বরং ৫৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরিকে মাত্র ৬০৬৩ টাকা করবার প্রস্তাব দিয়ে শেষ পর্যন্ত ৮০০০ টাকাতে রাজি হয়েছিল – সেই একই বিজিএমইএ আজকে শ্রমিকের অধিকার, তাদের অন্ন-সংস্থানের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে এত উচ্চকিত কেন?
হ্যাঁ, আমরা জানি গার্মেন্ট কারখানা চালানো কোন সহজ কাজ নয়। সস্তা পণ্য সরবরাহের বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। এর সাথে যোগ হয় বায়ারদের অযৌক্তিক চাপ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পরিবহন অব্যবস্থাপনা, বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীল বাণিজ্যের প্রবণতা বৃদ্ধি, অটোমেশান – এইসব কিছু গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের কাজ খুব কঠিন করে দিয়েছে। এইসব বড় বড় সমস্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারখানার মালিকদের নেই। তারা যে জিনিসটি শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেটি হল শ্রমিকের মজুরি। আর তাই আমরা দেখি যেকোন দুর্যোগে যে জিনিসটি সবার আগে হুমকির সম্মুখীন হয়, সেটি হচ্ছে শ্রমিকের মজুরি।
রুবানা হক নিউ ইয়র্ক টাইমের ইন্টারভিউতে বলেছেন, ““ওদের (ব্র্যান্ডদের) জন্য এটি একটি ব্যবসায়িক প্রশ্ন….আমাদের জন্য এটা ৪১ লাখ শ্রমিকের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।“ এই “আমরা” কারা? কারখানার মালিক এবং শ্রমিককে কিন্তু কোনভাবেই এক কাতারে ফেলা সম্ভব নয়। দুর্যোগ যত বড়ই হোক না কেন, কারখানার মালিকদের না খেয়ে মরে যাওয়ার অবস্থা হয়নি। তাদের ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থেকে বা কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও পোহাতে হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের আংশিক কাভারেজ
নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, ফোর্বস, ফরচুন, এনপিআর, আল-জাজিরার মত বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলো অর্ডার স্থগিত বা বাতিল করার কারণে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প এবং শ্রমিকেরা কীভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে, আর অনেক সমালোচনা করছে। এইসময়ে ব্র্যান্ডগুলোর ওপরে চাপ প্রয়োগ করার জন্য এই কাভারেজের বিকল্প নেই। কিন্তু খুব কম বিদেশী মিডিয়াই গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাছে তাদের অভিজ্ঞতার কথা সরাসরি জানতে চেয়েছে। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারখানার মালিকদের বা বিজিএমইএর কাছে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেন তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে কারখানা বন্ধের কথা বা শ্রমিকদের সবেতন ছুটি দেওয়ার কথা উচ্চারণও করেননি অথবা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কেন কারখানা বন্ধের জন্য নিজেদের মধ্যে কোন ধরণের সমন্বয় করেনি, সেই প্রশ্নগুলো পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে একেবারেই আসেনি। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং কারখানাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে শত শত শ্রমিক চাকরি হারানোর ভয়ে মাইলের পর মেইল হেঁটে কাজে যোগ দিতে শহরে এসেছে। এটি নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো স্টোরি করার প্রয়োজন বোধ করেনি। দেশে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণসমাবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গার্মেন্ট কারখানাগুলো শ্রমিকদের সবেতন ছুটি দিয়ে বন্ধ করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মধ্য এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণী বাড়িতে বসে “সামাজিক দূরত্ব” চর্চা করে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই কারখানায় যথাযথ ভালো মানের মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, হাত ধোয়া, মেশিন নিয়মিত বিরতিতে স্যানিটাইজ করা, বা নিরাপদে টয়লেট ব্যবহার করার মত স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার মত অবস্থা নেই। পশ্চিমা গণমাধ্যম এইসব বিষয়ে পুরোপুরি নীরব।
বেঁচে থাকার সংগ্রামের অর্থনৈতিকায়ন এবং বিতর্ক চালিয়ে যাবার প্রয়োজনীয়তা
মিশেল মার্ফির “জীবনের অর্থনৈতিকায়ন”-এর তত্ত্বটি দিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প ও শ্রমিকের বর্তমান অবস্থাটি খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জীবন যেখানে অর্থনীতির সূচকে বাঁধা, সেখানে জাতীয় অর্থনীতি এবং মালিকপক্ষকে রক্ষা করা শ্রমিকদের জীবন রক্ষার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতির সূচক এখানে নির্ধারণ কে বাড়িতে বসে “সামাজিক দূরত্ব” চর্চা করে নিরাপদ থাকবে এবং কার জীবন কাজে যোগ দিয়ে হুমকির সম্মুখীন হবে।
গার্মেন্ট শ্রমিকের জীবিকা একদিকে যেমন হুমকির মুখোমুখি, আরেকদিকে তাদের বাড়িতে এবং কাজের জায়গায় করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধের ব্যবস্থাও ভীষণরকম নাজুক। বিজিএমইএ গার্মেন্ট শ্রমিকের জীবিকার ব্যাপারটি বারবার স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরছে কিন্তু শ্রমিকের স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। শুধু একটি করে মাস্ক দিলেই ফ্যাক্টরির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। শুধু মাস্ক দিয়ে আর হাত ধুয়ে যদি করোনা সংক্রমণ ঠেকানো যেতো, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের মত দেশগুলোতে করোনার পাও পড়তোনা।
আন্তর্জাতিক বায়ারদের উদ্দেশ্যে দেয়া একটি বক্তব্যে রুবানা হক বলেছেন, “আমরা শ্রমিকের কল্যাণের জন্য অঙ্গীকার না করলে চার লাখ শ্রমিক না খেয়ে থাকবে।“ শ্রমিকের জীবিকা, মজুরি ও অন্নসংস্থানের ব্যাপারে বিজিএমইএর এতখানি দরদ তাদের ঐতিহাসিক ট্র্যাক রেকর্ডের সাথে একেবারেই যায় না। এটি কি তবে বিজিএমইএর মৌসুমী, সুবিধাবাদী অবস্থান?
বিজিএমইএ আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে অত্যন্ত কৌশলীভাবে বারবার বায়ারদের ওপরে চাপ প্রয়োগ করার জন্য পরোক্ষ আবেদন জানাচ্ছে। হ্যাঁ, বায়ারদের ওপরে চাপ প্রয়োগ করার অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ওপরে চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে বিজিএমইএর এত অনীহা কেন? খালেদ মুহীউদ্দিনের সাথে সাক্ষাতকারে রুবানা হক বলেছেন যে বাংলাদেশ সরকার জার্মান সরকার নয়। হ্যাঁ, তা অবশ্যই নয়। কিন্তু সরকার আর বিজিএমইএর মধ্যেকার সুসম্পর্কের ব্যাপারটি কি উপেক্ষা করা যায়? বিজিএমইএর নেতাদের জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনে দাঁড়ানোর এবং জয়ী হওয়ার অনেক অনেক উদাহরণ আছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের দশ শতাংশ সদস্য গার্মেন্ট কারখানার মালিক এবং বাকি সদস্যদের একটা বড় অংশের গার্মেন্ট শিল্পের সাথে বিভিন্নধরণের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। বিজিএমইএ যে সরকারের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হবে এবং সরকারের ওপরে যথাযথ চাপ প্রয়োগ করতে চাইবে না, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধবসের পর থেকে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স বাস্তবায়নের পেছনে বিদেশী ব্র্যান্ড, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রম অধিকার রক্ষার সংস্থাসমূহ এবং বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলো বিপুল অংকের অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করেছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় টিয়ারের কারখানাগুলোর বিল্ডিং ও অগ্নিনিরোধক সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে ভালো কিছু কাজ করেছে। কিন্তু অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মত টপ-ডাউন আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো শুধু বিল্ডিং ও অগ্নিসুরক্ষার ওপরে তাদের সব শক্তি ব্যয় করেছে এবং দেশের প্রচুর প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শক্তি ব্যয় করতে বাধ্য করেছে। তারা শ্রমিকের জীবন, জীবিকা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, শ্রম আইন পরিমার্জন ও বাস্তবায়ন – এসব বিষয়ক কোন উদ্যোগকেই সমর্থন করেনি। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শ্রমিকের “নিরাপত্তা” নিশ্চিত করার বিশাল উদ্যোগের পরও করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আমাদের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, জীবিকা ও জীবনের নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন।
করোনাভাইরাসের এই সংকটে আমাদের অলীক “ঐক্যের” পেছনে না ছুটে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার এবং কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের দূর্যোগ মোকাবেলা ব্যবস্থা এত নাজুক কেন যে কিছুদিনের ব্যাঘাত ঘটলেই পুরো শিল্প ধবসে পড়ার অবস্থা হয়? শ্রমিকদের জন্য সবেতন ছুটি, বেকারত্ব বীমা এবং দুর্যোগকালীন রিলিফ ফান্ডের কেন্দ্রীয় কোন ব্যবস্থা কেন নেই? ৪২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঠিক কীভাবে শ্রমিকের হাতে পৌঁছাবে? এই প্রণোদনা সঠিকসময়ে এবং ন্যায্যভাবে শ্রমিকের কাছে পৌঁছবে কি? একইসাথে আমাদের মনে রাখতে হবে যে শুধু গার্মেন্ট শিল্প কেন্দ্রিক নীতি ও সমাধান আমাদেরকে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দেবে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি, লাগামছাড়া বেসরকারীকরণ, সস্তা শ্রমের ওপরে জাতীয় অর্থনীতির মাত্রারিতিক্ত নির্ভরশীলতা, সংকুচিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, আর এনজিও, কর্পোরেশন ও ব্যক্তিগত দান-খয়রাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে একটি দেশের জন্য দক্ষ, গণতান্ত্রিক সরকারের এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুত্বের কথা ভুলে যাওয়া – এই বড় বড় সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে না পারলে গার্মেন্ট শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী, যুগোপযোগী ও টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে।
নাফিসা তানজীম যুক্তরাষ্ট্রের লেযলি ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজ এবং উইমেন, জেন্ডার, অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটি স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক।
এই লেখাটির ইংরেজি ভাষ্য, COVID 19:: the appropriation of garments workers survival নিউ এইজ-এ এপ্রিল ১৪, ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
Ahmed, Ilias. 2020. “With Job on Line, Hundreds of Bangladesh Workers Walk over 100 Km to RMG Factories.” Bdnews24.Com, April 4, 2020. https://m.bdnews24.com/amp/en/detail/bangladesh/1742663?fbclid=IwAR2K5TkJGYtV0iMsAZLjfGPdcssALHLduXJF07OUadN_0FaR5eadWz8X4cI.
Akhter, Taslima. 2020. “Risk of Social Isolation and Greater Health Crisis.” New Age | The Most Popular Outspoken English Daily in Bangladesh, April 6, 2020. https://www.newagebd.net/article/103868/risk-of-social-isolation-and-greater-health-crisis.
Atik, Faysal, and Obaidur Masum. 2020. “Stung by Criticism, BGMEA Urges Owners to Shut Factories. It’s Too Late.” Bdnews24.Com, April 4, 2020. https://m.bdnews24.com/en/detail/business/1742988?fbclid=IwAR2qi3kISwRjbBlSYOJ0G_epBWcULMOQIJkGu9S7kPfZBjNW4hbrRO18l5M.
“BGMEA.” Bangladesh Garment Manufacturers and Exporters Association (BGMEA): Towards a Sustainable Garment Industry. Accessed April 7, 2020. https://www.bgmea.com.bd/.
Brand BGMEA. March 23, 2020. “Appeal to International Buyers.” YouTube. Accessed April 6, 2020. https://www.youtube.com/watch?v=LmhbW9DO4os.
DW খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায় [DW Khaled Muhiuddin wants to know]. 2020. “করোনা ও পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা (Corona and the Five Thousand Crore Stimulus Package).” April 3, 2020. https://www.youtube.com/watch?v=YqbNY4aCkdo.
Lu, Sheng. 2020. “COVID-19 – The Worst-Case Scenarios for Apparel Sourcing.” Just-Style: Apparel Sourcing Strategy. April 2, 2020. https://www.just-style.com/analysis/covid-19-the-worst-case-scenarios-for-apparel-sourcing_id138428.aspx.
Murphy, Michelle. 2017. The Economization of Life. Durham: Duke University Press.
Paton, Elizabeth. 2020. “‘Our Situation Is Apocalyptic’: Bangladesh Garment Workers Face Ruin.” New York Times, March 31, 2020. https://www.nytimes.com/2020/03/31/fashion/coronavirus-bangladesh.html.
Prothom Alo. 2020. “পোশাক কারখানা বন্ধের দাবি [Demand to close garment factories].” Prothom Alo, March 21, 2020. https://www.prothomalo.com/economy/article/1646142.
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply