আনমনা প্রিয়দর্শিনী
ভয় ভীষণ বাস্তব, ঠিক তেমনি আশাও। মৃত্যু আর ক্ষুধার ভয় যখন সর্বগ্রাসী তখন আশারবাণী অনেক বেশী অন্তঃস্বারশূন্য ভাষণ বা ভেজাল তুকতাক মন্ত্রের মতো – শব্দ আছে, কিন্তু অর্থ নেই। তবুও আমরা হাল না ছাড়ি, আশাহীন এই আকালের দেশে শেষ আশাটির জন্য হলেও বুক বাধি । শেষ ঝড়টিতে উড়ে যাবার আগ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরি স্বপ্ন-সম্ভাবনার খুঁটিগুলোকে, হোক না তা যতই নড়বড়ে । এখনই সময় ভিন্ন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার; অসৎ, বেলাজ, খুনি ক্ষমতা-কাঠামোকে উপড়ে ফেলার। এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। প্রতিটি যন্ত্রণা, প্রতিটি ভয়কে শক্তি আর সংহতিতে পাল্টে ফেলার, নতুন আশায় নতুন এক বাস্তবতার গল্প বোনার।
মহামারীতে ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘জৈবিক’ বলে কিছু নেই । একটা ভাইরাস ও মহামারী হিসেবে কোভিড -১৯ এর জীবিত দেহের দরকার পড়ে ঠিকই, কিন্তু দেহ থেকে দেহে বিস্তারের যে পথ সে বেছে নেয় তা কোন জৈবিক নিয়মের বাতলে দেয়া পথ নয়। বরং আমাদের সমাজ ও পৃথিবীতে বিদ্যমান অসমতা, অসহায়ত্ব, বিভাজনকে পুঁজি করেই মহামারী তার ডাল-পালা ছড়ায় । বরাবরই তাই কিছু সমাজ, কিছু সম্প্রদায়, কিছু দল, কিছু ব্যক্তি এই মহামারীর কবলে মরে, আর বেঁচে যায় দুনিয়ার তাবৎ সুবিধাভোগী বাসিন্দারা। শুধু বিজ্ঞান, কয়েক হাজার ভেন্টিলেটর, আর লাখ খানেক পিপিই- এর সাধ্য কি এই অসম অসুখের বিরুদ্ধে লড়ে । মহামারীর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটা তাই কখনই বিজ্ঞানী, স্বাস্থ কর্মী, আর গদিতে বসা নেতাদের একার নয়। এ যুদ্ধে আমরা সবাই শরীক, কিন্তু যুদ্ধটা ভীষণ অসম । এই অসমতা আর বিভাজনের দেয়ালগুলোকে গুঁড়িয়ে দেবার সম্ভাবনার ওপরই নির্ভর করবে আমাদের জয় ।
ধোঁয়া ওঠা চায়ের এক কাপ নেশায় চুমুক দিতে দিতে দিন পার করা অনেক উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের কাছে এ কথাগুলো মনে হতে পারে খুব বেশী বেমানান। দিন রাত নামি দামী তারকা বা প্রতাপশালী রাজনীতিবিদদের করোনায় আক্রান্ত হবার খবর দেখে আমাদের মনে বিশ্বাস জাগতেই পারে যে এইবার বুঝি বোরিস আর বস্তির ঘরে ধুকতে থাকা দিন মজুর বছিরের মধ্যে আর কোন পার্থক্য রইল না। আমাদের এই আত্মতৃপ্তি দায়ক আয়েশি চিন্তার খোঁড়াক জোগাতে ম্যাডোনা দুধ-গোলাপের পাপড়ি বেছান স্নানপাত্রে বসে করোনার কালে ধনী-গরিবের এক হয়ে যাবার গল্প শোনায়। কিন্তু বাস্তবতা হল এই অসম অসুখের গল্পে কোথাও সাম্যের ছিটে ফোঁটাও নেই। এটা সত্যি যে অদেখা এই ভাইরাসের কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রতাপশীল, সবচেয়ে ধনী দেশগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্যি হলো পৃথিবীর সবচাইতে প্রান্তিক মানুষগুলোকেই গুনতে হচ্ছে লাশের বড় বড় সংখ্যা আর সইতে হচ্ছে ক্ষুধার অনবরত জ্বালা। আমেরিকার শিকাগোতে যেখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০% হচ্ছে কালো মানুষ সেখানে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া মোট রুগীর ৭২% হচ্ছে তাঁরা। নিউ ইয়র্কে এযাবৎ কালে বাংলাদেশী আমেরিকান মৃত্যুর সংখ্যাটা দুইশ ছাড়িয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরে মোট আক্রান্তের ৪০% রুগীই হচ্ছে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকেরা। সেনিটাইজারে ধোয়া আমাদের ‘সুশীল’ মন হয়তো ‘কাওলা’ আর ‘বাঙ্গাল’দের ‘অশিক্ষা,’ ‘অসভ্যতা,’ ‘কমনসেন্সের’ ঘাটতি আর সোস্যাল মিডিয়াতে ঘুরপাক খাওয়া গুজব-তামাশার মাঝে এই মানুষগুলোর সংক্রামণের কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার, সপ্তাহ শেষে হাতে গোনা কিছু ডলার পাওয়ার, আর ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকার বাস্তবতাই এই মানুষগুলোকে আক্রান্ত করছে সবচেয়ে বেশী। প্রান্তিকের মার খাওয়া বা মরে যাওয়ার এই ছবিটা পুরো বিশ্বেই কম বেশী এক-ই রকম । পৃথিবী জুড়ে নেতারা করোনাকে ঢাল বানিয়ে তাদের ক্ষমতার তলোয়ারে শান দিয়ে যাচ্ছে। বহু সরকার তাদের জনগণের ওপর বাড়াচ্ছে অযথা নজরদারি, খাদ্য-আশ্রয়হীন মানুষকে জিম্মি করছে কঠোর লকডাউনের শাসনে, কেড়ে নিচ্ছে মুক্তিকামী মানুষের বাক স্বাধীনতা। মহামারী উসকে দিচ্ছে বর্ণবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণা। পশ্চিমা বর্ণবাদের হাত ধরে যখন বহু মুসলিম এই মহামারীকে দেখছে “চীনের ওপর আল্লাহর দেয়া গজব” হিসেবে, ভারত সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে তাবলীগ জামাতকে বানাচ্ছে বলির পাঁঠা। করোনার বিস্তার নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে লকডাউনের যে কৌশল আমরা নিচ্ছি, সেই একই ব্যবস্থা সারা পৃথিবী ব্যাপী লাখ লাখ নারীকে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ও শিশুকে চাইল্ড অ্যাবইউজের হুমকিতে ফেলছে। বাংলাদেশে বেশীর ভাগ মানুষ কোভিড-১৯ এর রুগী হবার যোগ্যতাটাও হারাচ্ছেন। হাসপাতালের ‘হাজার হাজার’ শয্যায় শোয়ার সুযোগ পাবার আগেই অনেকেই নিজের ফুসফুসের কাছে হার মেনে চির শয্যায় চোখ বুজছেন। এদেরই কেউ কেউ ঠাঁই পাচ্ছেন ৪-১০ জনের জন্য তৈরিকৃত মৃত্যু তালিকায়, অন্যরা রয়ে যাচ্ছেন ‘করোনা -উপসর্গ,’ ‘ঠান্ডা,’ ‘জ্বর-কাশি,’ ‘নিউমোনিয়া’ অথবা কোনো অজ্ঞাত রোগে মরা লাশেদের দলে। যারা বেঁচে আছেন তাঁদের অনেকেরই যুদ্ধটা শুধু করোনার সাথে নয়। চাকরি হারানোর ভয়ে শত মাইল পায়ে হেটে পার হয়ে আসা কারখানা ফেরত লাখ লাখ শ্রমিক নিজেকে আবিষ্কার করছে চাকরী হারানোদের ভিড়ে। শীর্ণ হাত উঁচু করে শ্রমিকদের পূর্ণ মজুরী চাবার দাবি নিজ গৃহে “স্বেছা নির্বাসন” এ যাওয়া কিছু মানুষদের চোখে বড্ড “আন-হাইজেনিক” ঠেকছে। যখন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিত্তশীল ও মধ্যবিত্ত ফেসবুকে “Stay at Home” স্লোগানের ঝড় তুলছে, তখন দেশের কোটি, কোটি শ্রমজীবী মানুষের চাকরি হারানো ও অভুক্ত মরার ভয়ের কাছে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, হাত ধোয়া এমনকি খোদ করোনা ভাইরাসও বড্ড বেশী অর্থহীন হয়ে পড়ছে। গল্পগুলো তাই অসমতার, অসহায়ত্বের।
তবে মহামারী শুধু মৃত্যু আর হাহাকার-ই বয়ে আনছে না। এর উপাখ্যানের ভাঁজে ভাঁজে জন্ম নিচ্ছে পরিবর্তনের নতুন নতুন সম্ভাবনা। তার-ই টুকরো টুকরো গল্প ছড়িয়ে আছে আমাদের চেনা সমাজের অলি-গলিতে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানা সামর্থ্যের মানুষ বিদ্যানন্দের মতো আরও ছোট বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করছে যাতে করে তারা দেশের অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারে। নিজ আশ্রয়ের আরাম ও নিরাপত্তাটুকুকে পেছনে ফেলে হাজার হাজার ছাত্র গনপরিবহনকে জীবাণুমুক্ত করছে, ফসলের দাম না পাওয়া দরিদ্র কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে শাক-সব্জি, আক্রান্ত বা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা পরিবারে পৌঁছে দিচ্ছে খাদ্য, ওষুধসহ প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় দ্রব্য। যখন বাস্তবসম্মত জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) অভাবে দেশে ডাক্তারদের মরতে হচ্ছে, তখন কিছু সংগঠন নিজ উদ্দ্যোগে লাখ লাখ পিপিই তৈরীর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিছু তরুণ তৈরী করছে “মুক্তি -২০” এর মতো কম খরচে পিপিই জীবাণুমুক্ত করার স্টেরিলাইজেসন চেম্বার। আক্রান্ত রুগীদের জীবন বাঁচাতে স্থানীয় নির্মাতারা তৈরী করছে ভেন্টিলেটর। ডাক্তারদের গগলসের বিকল্প হিসেবে “ফেস-শিল্ড” বানাচ্ছে বাংলাদেশ চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির কিছু তরুণ ডাক্তার। কোভিড-১৯ টেস্ট করার জন্য দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক ইউনিভার্সিটি তাদের ল্যাবারোটারি খুলে দেবার কথা বলছে। এই মরার কালে মধ্যবিত্ত মানুষকে কিছুটা হলেও উজ্জীবিত করতে শিল্পীরা বাঁধছেন গান। তরুণ প্রতিবেশীরা বাজার করে দিচ্ছেন তাদের এলাকার বয়োজেষ্ঠদের জন্য। শিক্ষকরা শুধু নতুন নতুন শিক্ষা পদ্ধতি-ই প্রয়োগ করছেন না, বরং মানসিক দিক থেকে নাজুক ও বিষন্নতায় ভোগা ছাত্রদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সরাইখানা বিনামূল্যে বিলি করছে খাদ্য। যখন পুরো বিশ্বে মৃত ব্যেক্তির অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার রীতি-রূপ পাল্টে গেছে, প্রিয় বাবার গালে শেষ বারের মতো আদর মেখে দিতে, অথবা ভালোবাসার সঙ্গীনিকে শেষ ছোঁয়া ছুঁইয়ে দিতে পারছে না শোকে ও ভয়ে পাথর হয়ে যাওয়া মানুষগুলো, তখন জাত-ধর্মের তোয়াক্কা না করেই বুক চিতিয়ে মৃতব্যক্তিকে শ্মশানে পৌঁছে দিতে, আর দাফনের সব দায় কাঁধে নিতে কিছু হুজর, আর মাদ্রাসার ছাত্র এগিয়ে আসছে। এমনকি ‘ভিক্ষুকও’ তার সর্বস্ব্য তুলে দিচ্ছে অন্য কোন সর্বহারা মানুষের হাতে। অভুক্ত মানুষের রাস্তা বন্ধের প্রতিবাদও পাল্টে গেছে সামাজিক দুরত্বের নিয়ম মেনে। এরকম হাজারটা না বলা গল্পরা মিশে আছে হতাশা আর যন্ত্রণার গা ঘেঁষে।
কিন্তু জীবন বাঁচানোর এসব প্রচেষ্টা একা এই বিশাল যুদ্ধটা জয় করতে পারবে না। এখনও আরও অনেক কিছু করা বাকি। সরকারী ও বেসরকারি প্রতিস্থানগুলোর উচিৎ এ সব উদ্যোগী মানুষ ও সংগঠনের পাশে দাঁড়ানো যাতে করে তারা তাদের সামাজিক সেবা চালিয়ে যেতে পারে। গুল-গল্প বলার দিন এখন শেষ। এক চেতনার ঘুম পাড়ানী গান শুনিয়ে আর ডিজিটাল বাংলাদেশের অবিরাম রেকর্ড বাজিয়ে জনগণকে আগ্রুম-বাগ্রুম বোঝানোর চেষ্টা করোনা কালে আর কাজে আসবে না। সরকারকে এখন আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। অর্থনৈতিক ভাবে ধনী ও জনসংখ্যা কম এমন রাষ্ট্রের নেয়া পলিসি বাংলাদেশের মত জনবহুল ও দিন এনে দিন খায় মানুষের দেশে অন্ধভাবে প্রয়োগ করলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশী। প্রান্তিক মানুষকে খাদ্য ও আয়ের নিশ্চয়তা না দিয়ে, শুধু কঠোরভাবে লক ডাউন প্রয়োগ করলে কোভিড-১৯ এর চাইতে ক্ষুধার যন্ত্রণায় বেশী মানুষ মারা পরবে। দেশ ব্যাপী লক ডাউনকে সফল করতে চাকরীচ্যুত, আয়হীন, দরিদ্র মানুষের দোরে দোরে সাহায্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে দেশের এন. জি. ও. গুলো সরকারকে সাহায্য করতে পারে। ইতিমধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ গভার্নেন্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), কিভাবে এই মহামারীকে ফলপ্রসূ উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা করে কার্যকর পলিসি প্রণয়নের জন্য উপযোগী দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। ব্র্যাক এডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ-এর গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশে চরম দরিদ্রতা ৬০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষ অভুক্ত আছেন। বিআইজিডি-পিপিআরসি পরিচালিত সাম্প্রতিক এক যৌথ তড়িৎ জরীপে দেখা গেছে যে শহুরে ও প্রত্যন্ত অঞ্ছলের বস্তিবাসীদের আয় গড়ে ৭০% পর্যন্ত কমেছে, খাদ্য খাতে ব্যয় ২৬% পর্যন্ত কমেছে এবং ১২ই এপ্রিলের হিসেব অনুযায়ী গবেষণায় অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলো বাইরের কোন রকম সাহায্য ছাড়া বড় জোর আর দুই সপ্তাহের মতো চলতে পারবে। ঘড়ির কাটা খুব দ্রুতই ঘুরে যাচ্ছে। হিসেবে অনুযায়ী ২৬ এপ্রিলের পর থেকে এই মানুষগুলোকে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। দেশের বেশীরভাগ দরিদ্র মানুষের চিত্রটা হয়তো এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। সরকারের বিভিন্ন পরিষদগুলোর তাই উচিৎ সরকারী হিসেবে-নিকেশের পাশাপাশি এইসব গবেষণা তথ্যকে কাজে লাগিয়ে দেশের অনাহারী মানুষদের কাছে দ্রুত ও কার্যকর উপায়ে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেয়া। চুরি-ডাকাতি এদেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু “ত্রাণ” নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা আর বেশিদিন আধপেটা মানুষেরা বরদাস্ত করবে না। আমরা দেখছি যে এই করোনা কালেও খুনীদের দুই-তিন দিনের মাথায় ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো সরকার চাইলে দোষীদের খুব দ্রুত সাজা প্রদান করা সম্ভব। ঠিক একই ভাবে প্রশাসনের উচিত “ত্রাণ” চুরির সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গকে ধরা পড়ার দুই দিনের মধ্যে সাজা প্রদানের সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া। এ বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয় যে মানুষকে খাদ্য ও জীবিকার নিশ্চয়তা দেবার মধ্যে দিয়েই তাদেরকে সবচেয়ে ফলপ্রসূভাবে ঘরে রাখা সম্ভব।পাশাপাশি লক ডাউনকে বাস্তব সম্মত করতে সরকারকে স্থানীয় নেতা, ওয়ার্ড কমিশনার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এলাকাভিত্তিক সেবা প্রদান কার্যক্রমের সাথে আরও দক্ষভাবে যুক্ত করতে হবে। এই এলাকা ভিত্তিক প্রশাসন এলাকার দিন মজুর, পরিবহন কর্মী, সব্জি ও মাছ-মুরগী বিক্রেতা, মুদি ও ওষুধের দোকানের মালিকদের নিয়ে একটি মোবাইল টিম গঠন করতে ও হট-লাইনের ব্যবস্থা স্থাপন করতে পারেন। যখন-ই এলাকার কোনো বাসিন্দাদের কোনো কিছু প্রয়োজন পড়বে তখন-ই এই টিমের সদস্যরা ন্যায্য মূল্যের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় সেবা নিয়ে এলাকাবাসীর দোরে পৌঁছে যাবে। এর মূল উদ্দেশ্য হবে কঠোর ভাবে জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা নয়, বরং সংগঠিত ও সুবিন্যস্তভাবে মানুষের চলাচলকে পরিচালিত করা। আবার এলাকার দরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরী করে সেই মানুষদের কাছে সরকার ও ব্যেক্তিগত উদ্যোগের সাহায্য পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রেও এই টিম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লক ডাউনের মত হোম কোয়ারেন্টাইন কৌশলও আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এটা বোঝা কঠিন কিছু নয় যে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা দেশের বেশীরভাগ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যারা বস্তি, বা ছোট একটা ঘরে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বাস করেন এবং রান্নাঘর বা শৌচাগার আরো ডজন খানেক প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে ব্যবহার করেন। হোম কোয়ারেন্টাইন বরং ভিআইপিদের জন্যই কার্যকর করা হোক যাদের আর সকল সুবিধার মত নিজ গৃহে পৃথক থাকার মত আয়েশি সুবিধাও রয়েছে। দেশে যদি সত্যিকার অর্থেই কোয়ারেন্টাইনের জন্য প্রায় ২৫-৩০ হাজারের মত শয্যা থেকে থাকে তাহলে দেশের ৬ হাজারের মতো আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঠিক কোন যুক্তিতে বাসায় বসিয়ে রাখা হয়েছে তা ঠিক স্পষ্ট নয়। সরকারের উচিৎ আরও বেশী সংখ্যক কোয়ারেন্টাইন প্রতিস্থানের ব্যবস্থা করা এবং বিদ্যমান প্রতিস্থানগুলোর কার্যক্রম শুরু করা। স্থানীয় অবকাঠামো, যেমন স্কুল/বিশ্ববিদ্যালয়, দুর্যোগ আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি টেস্টের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করা যাদের নেশা তাদের বিজ্ঞান নিয়ে রাজনীতি করাটাও স্বাভাবিক। ডাঃ জাফরউল্লাহর তত্ত্বাবধানে বিজন কুমার শীল ও তার টীমের তৈরি করা কিট ব্যবহার করার অনুমোদন দেয়া নিয়ে পিং পং বল খেলা থেকে বিরত থাকাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যত দূর বুঝি আমাদের স্বীকৃতির আশায় ওনারা এই কিট বানায়নি। আপনার, আমার, সরকারের গোস্যা বা হিংসা বা অবহেলায় ব্যাক্তি জাফরউল্লাহদের কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের আসে যায়। এমনিতেই এরা ভাঁড়ামি, কুটনামী, চামবাজী, ঠকবাজী দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আরও নাটক দেখানো এই মানুষগুলোর পেটে সইবে না। শুধু শারীরিক সুস্থতা নয় দেশের মানুষের মানসিক সুস্থতার প্রতিও নজর দেয়া জরুরী। কারন মহামারী সবসময়ই নানা আপদ-বিপদের পাশাপাশি মানসিক বিপর্যয়কেও ছড়িয়ে দিতে থাকে এর বিস্তারের পুরোটা পথ জুড়ে। এ কারণেই ভাইরাস, দরিদ্রতা, আর কর্মহীনতা সারা দেশে ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে দেশে কৃষক, শ্রমিক, এমন কি শিশু আত্মহত্যার হারও বেড়ে গেছে অনেক। এটি কেবল শুরু। দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া না হলে আত্মহত্যার মিছিল নামবে সারা দেশ জুড়ে।
সর্বপোরি সরকারের বোঝা জরুরী যে কোন রকমের স্বচ্ছ ও যথাযথ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছাড়া শুধু মাত্র বিশাল অংকের আর্থিক প্রণোদনা দেশের মানুষ ও অর্থনীতি কোনোটাকেই বাঁচাতে পারবে না। একথা বোঝা খুব কষ্টকর নয় যে কেন দেশের ধনী পোশাকশিল্প মালিকদের মাত্র ২% সুদে এবং ভারীশিল্প মালিকদের ৪% সুদে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে, যেখানে কৃষকদের দেয়া হয়েছে ৫% সুদে। তারপরও শত শত কারখানা লাখ লাখ শ্রমিক ছাঁটাই করছে, বেতনের দাবীতে করোনার ভয় অগ্রাহ্য করে শ্রমিকেরা মাঠে নামছে জীবন বাঁচানোর দাবী নিয়ে। এসব শ্রমিক সরকার, আপনার,আমার ভিক্ষার দাবীদার না। আর তাই সরকারের প্রণোদনা না, বরং কড়া নিয়ম ও কঠিন শাসন মালিককে বাধ্য করুক শ্রমিককে তার ন্যায্য মজুরী দিতে। একই কথা কৃষকদের ক্ষেত্রেও খাটে। যেখানে দেশের উত্তরাঞ্চলের বোরো চাষীদের ফসল ক্ষেত-শ্রমিকের অভাবে বৃষ্টির পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সেখানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পর্যাপ্ত বাজার ব্যবস্থার অভাবে কৃষকের ফলন মাঠেই পঁচে মিশে যাচ্ছে । এই কৃষকেরা বহুদিন ধরেই ঋণের বোঝা টেনে বেড়াচ্ছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে, কোনো ভিক্ষা বা প্রণোদনার ক্ষমতা নেই এই মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার।
মহামারী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে যে এই মরার কালে আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন কঠোর লক ডাউন বা প্রণোদোনা নয়, বরং শ্রেণী, ধর্ম, দল নির্বিশেষে একে অপরের জন্য ও দেশের জন্য একসাথে কাজ করার। এই যুদ্ধটা জয়ের জন্য তাই দেশের প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী সেক্টর, প্রতিটি মেধাবী শক্তি, ও প্রতিটি সাহসী পদক্ষেপকে সকল রকমের বিভাজনের ঊর্ধ্বে গিয়ে এক হতে হবে। পরিবর্তনের সম্ভাবনাগুলো এই এক হবার ইচ্ছে ও চেষ্টার হাত ধরে এখনো অপেক্ষায় আছে। আমাদের সামনে এখন পথ বাছাইয়ের পালা। আমরা আমাদের মধ্যেকার বেলাজ অসমতা, নোংরা ঘৃণা, ও মরা চিন্তাগুলোকে পশ্রয় দিয়ে যেতে পারি, অথবা আমরা বুকের সবটুকু ভালোবাসাকে নিংড়ে দিতে পারি দেশের আনাচে কানাচের জানা-অজানা প্রতিটি মানুষের জন্য। আমরা স্বার্থপরের মত ফিরে যেতে পারি পুরানো নীতিহীন, অসৎ, দাঙ্গাবাজ জগতের অ”স্বাভাবিক” জীবনে। অথবা আমরা স্বপ্নবাজের মতো স্বপ্ন দেখতে পারি নতুন এক স্বাভাবিকতার, নতুন এক সময়ের, নতুন এক বিশ্বের, যেখানে হয়তো আবারো কোন মহামারী হানা দেবে, কিন্তু সেই পৃথিবীতে আমরা আরও বেশী প্রস্তুত থাকবো, আরও বেশী ঐক্যবদ্ধ থাকবো নতুন সেই মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।
আনমনা প্রিয়দর্শিনী পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ এবং প্রভাষক লেকচারার, বিআইজিডি, ব্রাক ইউনিভার্সিটি।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply