কল্পনা চাকমা অপহরণ দিবস ২০২০: সহযোদ্ধা সুকেশের মায়ের কথা

রূপন চাকমা

১২ জুন, ১৯৯৬। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠ, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদশী সাক্ষী পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে. ফেরদৌস ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার নুরুল হক এর নেতৃত্বে একদল সেনা ভিডিপি সদস্য কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করেছে। সেইরাতে কল্পনা চাকমার দুই ভাই কোনমতে পালাতে পারলেও কল্পনা চাকমার খোঁজ আজ দুই যুগ পরেও জানা যায়নি। কল্পনা চাকমাকে অপহরণের প্রতিবাদে দেশে বিদেশে ঝড় ওঠে। পাহাড় থেকে সমতল সর্বত্র মানুষ কল্পনা চাকমাকে অপহরণের প্রতিবাদ জানায়।

২৭শে জুন ১৯৯৬। পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশন তিন পার্বত্য জেলায় অর্ধদিবস অবরোধ কর্মসূুচি ঘোষণা করে। দাবি একটাই। কল্পনা চাকমার অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার কর। সেই অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে আরও অনেকের সাথে সেদিন খেদারমারা গ্রামের সুকেশ চাকমা (১৬) সমরবিজয় চাকমা, বঙ্গলতলী গ্রামের মনতোষ চাকমা (২২) এবং রুপন চাকমা (১৬) পথে নামে। কিন্তু কল্পনার খোঁজে বেরিয়ে তাঁরাও গুম হন।

কল্পনার চাকমার সহযোদ্ধা সুকেশের মা বাসন্তী চাকমার (৭৪) সাথে কথা বলেছেন উমে মারমা। বাসন্তী চাকমার সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল ৮ই জুন, ২০১৭।

উমে মারমা: ২৭শে জুন, ১৯৯৬ সাল। ঐ দিনটির কথা বলুন।
বাসন্তী চাকমা: সুকেশ চাকমা, সকলের কাছে আমার ছোট ছেলে  সুকেশ হলেও আমার এবং আমার পরিবারের কাছে সে পিন্টু। ওকে আমরা পিন্টু নামেই ডাকতাম। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। পিন্টু সবার ছোট। তাই আমার কাছে সে ছিল একেবারে নাড়ি ছেড়া ধন। এতবছর ধরে আমার কাছে, আমাদের কাছে পিন্টু নেই অথচ আমি যে এখনও বেঁেচ আছি সেটাই আমার কাছে অবাক লাগে।

আমার স্বামীর নাম হামেশ কুমার চাকমা। আমার শ্বশুরবাড়ী পুজগাং খাগড়াছড়িতে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে আমরা আমাদের নিজের বাড়ি হরেঙাতলী, বঙলতলী ইউনিয়ন মারিশ্যাতে রয়ে গেলাম।

ঠিক কোন সালে আমার পিন্টুর মানে সুকেশ চাকমার জন্ম আমার সঠিক মনে নেই। তবে ১৯৯৬ সালে সেটেলার বাঙালীরা গুম করার বছরে তার বয়স হয়েছিল ১৬ বছর। সেই বছর সে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু এসএসসির রেজাল্ট এর খবর জানতেও পারল না আমার এই ছোট্ট ছেলেটা। তার আগেই তাকে গুম কওে সেটেলার নামক নরপশুরা। তার হারিয়ে যাবার ঘটনার পরেই ম্যাট্রিকের রেজাল্ট বের হলে আমরা জানলাম সে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছে।

বাসন্তী চাকমা

আমার এখনও সেসব দিনের কথা মনে পরে। কল্পনা চাকমাকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে কয়েকদিন আগে সে খবর আমরা সকলেই জানি। সেই থেকে মারিশ্যায় শুরু হয়েছিল একটার পর একটা ঘটনা। আমার তারিখ মনে নাই তবে মনে আছে কল্পনা চাকমার অপহরণের পর মারিশ্যাতে অবরোধ ডেকেছিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ছেলেরা।  সেই তারিখের আগের দিন থেকে আমার ছেলে পিন্টু বলে আসছিল আগামীকাল সে অবরোধ পালন করতে যাবে। আমি অনেকবার আমার ছেলে সুকেশকে বললাম অবরোধ কমসূচীতে সে যেন যোগ দিতে না যায়। সুকেশ বাড়ীর ছোট ছেলে তাছাড়া তার বয়স অনেক কম। তাই নানা ধরণের দুঃশ্চিন্তা হয় তাকে নিয়ে। কিন্তু সে জেদ ধরেছে অবরোধে যাবেই যাবে। অবরোধের দিন ভোরবেলায় সুকেশ তার বন্ধু মনতোষসহ আমাদের বাড়ীতে সকালের ভাত খেয়ে অবরোধে যোগ দিতে বেরিয়ে গেল। তখন কি জানতাম এই যাওয়া তার শেষ যাওয়া। তখন কি জানতাম সেও কল্পনার মতো হারিয়ে যাবে চিরতরে আমাদের ছেড়ে। শুনেছি মনতোষের কোথায় যেন একটা চাকুরী হয়েছিল। কিন্তু সে চাকুরীতে যোগ দেবার আগেই একেবারে হারিয়ে গেল। তাদের লাশও আর পাওয়া গেলনা। সেদিন শুধু আমার ছেলে নয় আমাদের গ্রামের অনেকে অবরোধে যোগ দিতে গিয়েছিল, এমনকি আমার বড় ছেলেও গিয়েছিল, রূপনদের আগেই চলে গিয়েছেল।

সারাদিন আমার চিন্তায় চিন্তায় দিন কেটে গেল। বিকেল হয়ে গেল, কিন্তু আমার পিন্টু আর ফিরেনা। অথচ গ্রামের যারা অবরোধে গেছে তারা প্রায় সকলেই বাড়ি ফিরেছে। এমনকি আমার বড় ছেলেটা সেও বাড়ীতে ফিরেনি তখনও। দুঃশ্চিন্তায় আমার বুক পাথর হয়ে আছে। আমার একটাই চিন্তা ওরা কখন ফিরবে। গ্রামের সবাইতো ফিরেছে। শুধু আমার ছেলেরা ফিরলোনা এখনও। এর আগে একজন না ফিরলে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে নিতাম অমুক কোথায় আছে, কেমন আছে। কিন্তু দুই ভাইই একসাথে না ফেরাতে আমি আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছিনা। এদিকে শুনতে পাচ্ছি অবরোধের সময় কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে। সকাল হয়ে বিকেল আর বিকেল শেষ হয়ে রাত নেমে এলো। তবুও আমার ছেলেদের খবর পেলামনা। কেমন আছে কোথায় আছে তারা। তখনতো এখনকার মতো মোবাইল ছিলনা। এভাবে নানা দু:শ্চিন্তায় সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দিলাম আমরা। কিন্তু এরই ভিতর আমাদের গ্রামে সকলেই প্রায় জেনে গেছে আমার ছেলে পিন্টু/সুকেশকে সেটলার বাঙালীরা গুম করে দিয়েছে, কিন্তু রাতে আমাকে এই খবরটা দেওয়ার মতো সাহস কারও হয়নি। আমার অপেক্ষার আর শেষ হয়না। আমার দুটো ছেলে সেই যে অবরোধে অংশগ্রহণ করতে গেছে এখনও বাড়ি ফিরলোনা।

পরদিন সকালে আমার বাড়ীতে গ্রামের লোকজনের আসা-যাওয়া শুরু হল। তাদের আসা যাওয়া দেখে আমার সন্দেহ হলো কিছু একটা হয়েছে। আমার ছেলে দুটোর কিছু একটা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? আমার ছেলে দুটো কই? তারা কোথায় আছে? অনেক লোকজনের মধ্যে একজন সাহস করে আমাকে বললো যে, আমার ছোট ছেলেসহ আরও তিনজনকে সেটলার বাঙালীরা তুলাবান এলাকা থেকে ধরে নিয়ে গেছে তারপর সম্ভবত মেরে ফেলেছে এবং তাদের লাশ গুম করেছে। এই খবর শুনেই আমি একেবারে বোবা কালা হয়ে গেলাম। সবাই কথা বলছে কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিনা। আমি কি কাঁদছিলাম তখন!! আমার তখন কিছুই মনে পরেনি। শুধু শোঁ শোঁ শব্দ শুনছিলাম।

তারপর আমরা পিন্টু/সুকেশকে সেখানে খুঁজতে গেলাম যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে। সেখানে যদি কোথাও কোন খবর পাওয়া যায়। বা তার লাশ যদি আমরা উদ্ধার করতে পারি, এই আশায়, সেই থমথম পরিস্থিতিতে সেখানে চলে গেলাম। তুলাবানে সেটেলার বাঙালী পাড়ার ভেতরে কয়েক পরিবার চাকমা পরিবার বাস করে তাদের কাছে ঘটনাটা শুনে নিলাম। দূর থেকে ওরা দেখেছে যে সেটেলার বাঙালী কয়েকজন চাকমা ছেলেকে তাড়া করছে আর মারছে। তাদের দূর থেকে দেখা ছাড়া করার কিছুই ছিলনা তখন। এই র্দুঘটনার কথা আমার বড় ছেলে সুগত ঘটনা ঘটার পরপরেই জেনেছে, তাই সে আর বাড়ী ফিরে আসতে পারেনি। আমার সামনে আসার সে সাহস করে উঠতে পারেনি। এই ঘটনার প্রায় একমাস পর আমার বড় ছেলে বাড়ী ফিরে আসে, আমার মুখোমুখি হয়। আমার বড় ছেলে সুগত এখন ইউপিডিএফ-এর আন্দোলনের সাথে জড়িত। জাতির জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েক মাস আগে সেনাবাহিনী তাকে আটক করে অনেক মিথ্যা মামলা দিয়েছে সে এখনও জেলে আছে। আমার ছোট ছেলে সুকেশের এই ভাবে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের পরিবারকে টুকরো টুকরো করে দেয়। এরপর আমার নিজের আমার পরিবারের সকলের সুখ একেবারে নাই হয়ে যায়। আমার চোখে সারাক্ষণ পানি জমে থাকে। এক বুক শূন্যতা নিয়ে আমি এবং আমার পরিবার এখনও বেঁচে আছি।

সেদিনের অবরোধে আমার ছেলে সহ আরও গাবুজ্যে (যুবক) চারটা ছেলে একেবারে হারিয়ে গেল, তাদের লাশও পাওয়া গেলনা। কিন্তু কল্পনা চাকমার হদিস যদি পাওয়া যেতো তাহলে হয়তো আমাদের কষ্টটা একটু কমে যেতো। কল্পনাকেও তার পরিবার ফেরত পেলনা তাকে যে কোথায় নিয়ে গেল তার পরিবার, আমরা জানতে পারলাম না। আমাদের এতো রক্ত এই দেশ নিচ্ছে।

আমার এখনও চোখে ভাসে সেদিন আমার ছেলে সুকেশেরপরনে ছিল জিন্স, জুতা, বাঙালীরা যখন তাড়া করছিল হয়তোবা সে কারণেই সে দৌড়াঁতে পারেনি। আমি একা একা যখন থাকি ভাবি ওরা সেদিকে গেল কেন। অন্য দিকে কি যাওয়া যেতোনা। ওরা কি মাত্র চার জন ছিল! আচ্ছা কিভাবে ওদের মেরে ফেলেছে!! ওদের মেরে ফেলার পর লাশগুলো কোথায় কবর দিয়েছে! আহা যদি জানতে পারতাম ওরা কোথায় কোন জায়গায় লাশগুলো মাটি চাপা দিয়েছে! যদি জানা যেতো!!!

উমে মারমা: আপনি কি ভাবেন যে আপনার ছেলে বেঁচ আছে? যেহেতু ওদের কারোর লাশ পাওয়া যাায়নি !
বাসন্তী চাকমা: না ! আমার মনে হয়না। কারণ সেটেলার বাঙালীরা আর সেনাবাহিনী হচ্ছে অসুর। তাদের কোন দয়া মায়া নেই। আমার মনে হয়না তাদের তারা বাঁিচয়ে রেখেছে।

জানো তবুও আমরা তুলাবানে খবরাখবর নিয়েছি। বাঙালীদের সাথে যোগাযোগ করেছি যদি লাশটাকে ফেরত পাওয়া যায়। এতো রক্ত। একমাস পর বড় ছেলে বাড়ী ফেরার পর আমরা সুকেশের ধর্মকর্ম করে দিলাম। তখন ধরেই নিয়েছি ওরা আর বাড়ি ফিরবেনা।

এরপর থেকে মাঝে মাঝে আমার ভ্রম হয়, সুকেশের ফিরে আসার শব্দ শুনি, ঘরে ফিরলে সে যেভাবে পা ঝাড়তো ঠিক সে শব্দ শুনতে পাই, মশারি টাঙানোর শব্দ, বিছানা পরিস্কার করার শব্দ। মাঝে মাঝে সুকেশের গুন গুন করে গান গাওয়ার শব্দও শুনতে পাই। আমি জানি এসব আমার মনের ভূল, কিন্তু শুনতে পাই। আর আমার চোখে পিন্টুতো সারাক্ষণ লেগে আছে। আমার ছোট ছেলে যে, কি করে ভূলি! এটাযে কী যন্ত্রণা। যার হারাইনি সে জানবেও না বুঝবেও না। ছেলে হারানোর যন্ত্রণা। লাশটা যদি একবার পেতাম!!

উমে মারমা: সুকেশ বড় হয়ে কি হতে চেয়েছিল?
বাসন্তী চাকমা:
সে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। তার জন্ম মারিশ্যায়। কিন্তু বাবার বাড়ী পুজগাং। তাই ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর সে বাবার জন্মভিটে দেখতে যায়। পুজগাং তার বেশ পছন্দ হয়েছিল। ওখান থেকে ফিরে সে ঠিক করেছিল ফেনী পলি টেকনিক্যাল পড়তে যাবে। অনেক লেখাপড়া করবে। আবার ভাবতো সেখানে ভর্তি হতে না পারলে হাজাালং কলেজে পড়বে।

এখনতো আমার মারা যাবার বয়স হয়েছে। একুশ বছর হয়ে গেল আমার পিন্টু নেই। তার লাশ যদি চোখে দেখতাম একটা সান্তনা থাকতো। অন্য ছেলে এখন জেলে। সারাজীবন দুঃখ শূণ্যতায় আমার জীবনটা কেটে গেল। সুখ কিছুই পাওয়া হলো না। আমাদের মৃত্যুর পর আমার নাতনিদের কি হবে সেটা ভেবে ভেবেই দুঃখে হতাশায় মন ভরে যায়। এখন আমার একটাই চিন্তা আমার বড় ছেলে যেন জেল থেকে বের হতে পারে। এভাবেই দুঃখে আমিও একদিন মারা যাবো। সেখানে হয়তো আমার ছেলে সুকেশের সাথে আমার দেখা হবে।



Categories: আন্দোলন বার্তা, প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , , ,

3 replies

Trackbacks

  1. “সেদাম থেলে মরে মার”: শহীদ রূপন চাকমা
  2. “সেদাম থেলে মরে মার”: শহীদ রূপন চাকমা
  3. “সেদাম থেলে মরে মার”: শহীদ রূপন চাকমা

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: