আনু মুহাম্মদ
এবিষয়টি আমাদের পরিষ্কার থাকা দরকার যে, ধর্ষণ মানে ক্ষমতার দাপট, ক্ষমতার ঔদ্ধত্ব। তার সাথে আছে নারীর প্রতি ভয়ংকর অসম্মান, নারীর শরীর আর জীবনের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তারের রাজনীতি আর সংস্কৃতি; শিশু ছেলেমেয়ে, অন্য লিঙ্গের মানুষও এর আক্রমণের বাইরে নাই। ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন মানে তাই সবরকম জুলুমের বিরুদ্ধে, প্রাণ প্রকৃতি মানুষ বিনাশী ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই; অমানুষের দাপটের বিপরীতে সকল মানুষের জন্য নিরাপদ জগত তৈরির লড়াই।
ক্ষমতার বিভিন্ন কেন্দ্র, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী, আইন আদালত তথা রাষ্ট্রক্ষমতা কীভাবে ধর্ষণকারীদের তৈরি করে, মদদ দেয়, ব্যবহার করে, রক্ষা করে, তার অসংখ্য উদাহরণ সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সেজন্য পাহাড়ে সমতলে বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিটি প্রতিবাদে অসংখ্য নিপীড়িত মানুষের, বিশেষত নারী আর তার স্বজন পুরুষের, দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার আর ক্রোধ আছে। কতোজন খুন হয়েছে, কতোজনের জীবন বিভীষিকায় ভরে গেছে তার কোনো হিসাব নাই। বস্তুত ধর্ষকদের আশ্রয় প্রশ্রয় পৃষ্ঠপোষকতা ক্ষমতাবানদের অস্তিত্বের অংশ। তাদের রক্ষা করে ক্ষমতাবানরা নিজেদের মুখ ও মুখোশ রক্ষা করতে চায়।
সারাদেশে যখন ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে বিস্তৃত হচ্ছে সেসময় ২২ বছর আগে ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ বিরোধী ঐতিহাসিক আন্দোলন যে দুর্বৃত্তদের মুখোশ উন্মোচিত করেছিল তাদের পাক পবিত্র বানানোর চেষ্টা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি, একটি গুজবের আত্মকাহিনী’ শিরোনামে একটি রচনা ফেসবুকে প্রচার করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, যা গত ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত হয়েছে। যে আন্দোলন সারাদেশের মানুষকে সরব করেছে, পরম্পরায় শক্তি যুগিয়েছে, তাকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় মিথ্যাচার ও কুৎসায় ভরা এই রচনা। লেখার মূল বক্তব্য হলো- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেসময় আসলে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। ঘটলেও তাতে ছাত্রলীগের কারও সম্পৃক্ততা ছিল না। তখন যে ঐতিহাসিক ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা ‘আনু মুহাম্মদ, রেহনুমা আহমেদ, মানস চৌধুরী’ দের ‘ষড়যন্ত্রের’ ফল।
প্রকৃতপক্ষে সেই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের যৌন হয়রানিতে ত্যক্তবিরক্ত ছাত্রীরা যখন ধর্ষণের খবর পেয়ে ফুঁসে উঠেন তখন। ১৯-২০ আগস্ট ১৯৯৮ প্রধানত ছাত্রীদের বিশাল মিছিল থেকে সেই আন্দোলনের ব্যাপকতা তৈরি হয়। অভিযুক্ত নেতাদের মধ্যে এক নম্বর নাম ছিল জসিমুদ্দিন মানিক। ২০২০ সালে খোকন সেই মানিককে নির্দোষ প্রমাণ করতেই কলম ধরেছেন। মানিককে পরিচিত করাতে গিয়ে খোকন লিখেছেন, ‘মানিক ছিল ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী। দেখতে সুদর্শন এবং পারিবারিকভাবেই পয়সাওয়ালা। ১৯৯৩-৯৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর সালাম বরকত হল ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।..১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসে আধিপত্য বজায় রাখতে ছাত্রলীগে যোগ দেন। পয়সাওয়ালা হবার কারণে ছাত্রলীগের একটি অংশ তাকে প্রশ্রয় দেয়। তবে ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের দুঃসময়ের অধিকাংশরাই ছিল মানিকের বিরুদ্ধে। দলের জন্য সর্বনাশা এই খেলাটা এই দুঃসময়ের কর্মীরাই ক্ষোভে করেছেন, কিছু বাম ছাত্রসংগঠনের সাথে আঁতাত করে।’
খোকনের লেখায় তাই কয়েকটা বিষয় প্রধান হয়ে উঠেছে- এক. মানিক ছাত্রদল থেকে আসা বা অনুপ্রবেশকারী। তবে তার কোনো অপরাধ নেই। তাকে ফাঁসানোর জন্য ‘ছাত্রলীগের ত্যাগী দু:সময়ের কর্মীরা’ তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাল দেয়। তার মানে খোকনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, অনুপ্রবেশকারী নয়, মূল অপরাধী ‘দু:সময়ের ত্যাগী ছাত্রলীগ কর্মীরা’! তবে আবার খোকন বলেছেন, ‘ওই সময়ে জাহাঙ্গীরনগরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।’ আরও যোগ করেন যে, ‘ওই ধর্ষণের ঘটনার সাথে মানিক তথা ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ঘটনা কারা ঘটিয়েছিল তা ঐসময়ের সবাই জানতো।’ কারা তারা? জানা নাম বলতে খোকনের অসুবিধা কী?
সেই আন্দোলনে বিরাট সংখ্যায় ছাত্রীরা প্রতিদিন হলে, ক্যাম্পাসে মিছিল, সভা সমাবেশ করছিলেন। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বাম ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন পাঠচক্রসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাদের সর্বত্র মোকাবিলা করতে হতো ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীকে। মিছিলের পেছনে-পাশে, সমাবেশের গা ঘেঁষে, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, ভয় দেখানো, হুমকি চলতো অবিরাম। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে গুজব, উড়ো চিঠি, কুৎসা রটনা এগুলোও চলেছে অবিরাম। এই ভয়ের মধ্যেও দিনে রাতে মেয়েদের সমাবেশ মিছিল হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক হিসেবে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো আমরা নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছি। আমরা তাই নিপীড়িতদের পক্ষে লিখেছি, কথা বলেছি। এক পর্যায়ে এই আন্দোলনের তাগিদেই ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছি।
ছাত্রলীগ নেতা আনন্দ খুন নিয়ে মামলা ও দলাদলির কথা এনেছেন খোকন। আনন্দের কথা এলে আমি এখনও বেদনা বোধ করি। আনন্দ ছিলো আমার প্রিয় ছাত্র। আমার কোর্সে ওকে আমি পেয়েছে খুবই মনোযোগী একজন শিক্ষার্থী হিসেবে। কোর্সের মাঠ গবেষণার কাজেও ওকে দেখেছি খুবই আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে। সব সরকারের আমলেই হলে হলে সরকারি ছাত্র সংগঠনের দাপট ভয়ংকর। মফস্বল থেকে আসা বা দুর্বল ছেলেদের টিকে থাকতে হলে তাতে যোগদান করা অনিবার্য হয়ে যায়। আমার কোর্স শেষ, তাই আমি জানতাম না, সেই আনন্দ বদলে গেছে, সন্ত্রাসী জগতে ঢুকে একপর্যায়ে নেতা, আর তার কিছুদিনের মধ্যে ছাত্রলীগেরই আরেক গ্রুপের সাথে সংঘাতে নিহত। কীভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়, শিকার হয় তার দৃষ্টান্ত এদেশে আনন্দের মতো আরও অনেকেই। এদেরকে ফাঁদে ফেলে, ব্যবহার করে করে, শিক্ষার্থী থেকে সন্ত্রাসীতে পরিণত করে ক্ষমতাবান নেতারা। এরা খুন করে, খুন হয়, পঙ্গু হয়, নিজেরা রক্তারক্তি করে, পাগল হয়, দেশান্তরী হয়। আর নেতাদের ক্ষমতা আর সম্পদ ফুলতে থাকে।
যাইহোক, ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের বর্তমান জোয়ারের মুখে ‘ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড’ বিধান রেখে সরকার এই আন্দোলনে সমাপ্তি টানতে চেষ্টা করছে। আইনে মৃত্যুদন্ড রাখা সহজ কিন্তু তাতে অপরাধী কতোটা ভীত বা সংযত হবে তা নির্ভর করে তার আশ্রয় প্রশ্রয় কোথায় তার ওপর। যেমন খুনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড, কিন্তু কতো খুন বিচারহীনতায় তার হিসাব কে করবে? ক্রসফায়ার, হেফাজতে খুন তো বটেই গত এক বছরে ধর্ষণের পর খুনের কয়টার বিচার হয়েছে? উদাহরণ মেলা, ত্বকী হত্যাকান্ডের সকল প্রমাণ প্রস্তুত হবার পরও তা আটকে আছে অদৃশ্য-দৃশ্যমান ইশারায়, বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডে ফাঁসির আদেশ যাদের দেওয়া হয়েছিলো তাদের প্রায় সবাই পলাতক, জোবায়ের হত্যাকান্ডে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত অধিকাংশ আদালত থেকেই পালিয়েছে। শুধু তাই নয়, ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তির শাস্তিও মওকুফ হতে পারে যদি তার সঙ্গে ক্ষমতার আশির্বাদ থাকে।
মূল সমস্যা এখানেই। ক্ষমতাবানদের মধ্যে যদি এই প্রবণতা প্রধান হয়, ‘আমরা যা খুশি তাই করতে পারি, করাতে পারি’, যদি কোনো জবাবদিহি না থাকে, মতপ্রকাশ প্রতিবাদ প্রতিরোধ যদি সারাক্ষণ হুমকি হামলা আইন গুম খুন দিয়ে দমন করা চলতে থাকে তাহলে সকল পর্যায়ে ক্ষমতার ঔদ্ধত্ব সীমাহীন পর্যায়ে চলে যায়। আর যাদেরকে নেতারা ব্যবহার করতে থাকে; ভোট ডাকাতি, খুন-দখল-চাঁদাবাজীতে নিয়োগ করে, তাদেরও নিজস্ব এজেন্ডা তৈরি হয়। ‘যা খুশি তাই করতে পারি’ ভাবের শক্তিতে তাদের দুর্বৃত্ত তৎপরতার শিকার হয় নারী, শিশু, ক্ষমতাহীন মানুষ।
এরকম পরিস্থিতিতে ভরসা তৈরি হয় মানুষের যৌথ সামষ্টিক তৎপরতায়। তাই ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অঞ্চলসহ সারা দেশ জুড়ে ধর্ষণ যৌন নিপীড়ন ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষের যে প্রতিবাদ প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে সেটাই সবার জন্য নিরাপদ বাংলাদেশের পথ।
লেখক: শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্য়ালয়। ঢাকা।
Categories: আন্দোলন বার্তা, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
Leave a Reply