করোনা, মধ্যবিত্ত সমাজ আর আমাদের “কাজের মেয়ে”রা


শারমিন জাহান (৪০) একজন গৃহকর্ত্রী (ডানে বসা), থাকেন মোহাম্মদপুরে। রানিয়া বেগম (২৫) গৃহপরিচারিকা হিসেবে এই পরিবারের সাথে কাজ করছেন গত ১৫ বছর ধরে, এভাবেই তিনি তার পরিবারের খাওয়া-পড়া নিশ্চিত করেছেন। আলোকচিত্রটি জান্নাতুল মাওয়ার “সান্নিধ্যে দূরত্ব (close distance)” গল্পের একটি ছবি।

নাফিসা তানজীম

করোনার সময়ে অনেক ওয়েবিনার হয়েছে, পত্রপত্রিকায় লেখালিখি হয়েছে শহুরে মধ্যবিত্ত কর্মজীবী নারীর ওপরে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়া নিয়ে। “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করা মধ্যবিত্ত কর্মজীবী নারীর জন্য সহজ কথা নয়। করোনার সময়ে পুরুষেরা কীভাবে আরাম করে ঘর থেকে অফিস করছে, কিন্তু মেয়েদের বাচ্চার অনলাইন পড়াশোনা দেখা, ঘরের তাবত কাজ আর অফিসের কাজ অনলাইনে সামলে উঠতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আমরা অনেক দেখেছি।

এই আলোচনা-সমালোচনায় কি কিছু একটা মিসিং হচ্ছে?

বাংলাদেশের ছেলেদের ছোটবেলা থেকে এত বাজেভাবে সোশালাইজ করা হয় যে বেশিরভাগ ছেলেই ঘরের কাজ শেখে না। তাদের ছোটবেলায় শেখানো হয় না যে ঘরের কাজ শুধু মেয়েদের কাজ না। বড় হয়ে অনেক সেন্সিবল ছেলে ঘরের কাজের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ছোট থেকে না শেখা বা অনভ্যাসের কারণে তাদের অনেকেই ঠিকমতো ঘরের কাজগুলো গুছিয়ে করে উঠতে পারে না। কিন্তু ঘরকে তো চলতে হবে ঠিকমতো। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীকেও ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে। ঘরের কাজ করবে তাহলে কে? আমাদের শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের ঘরে ঘরে তৈরি হয়েছে বিশাল ভ্যাকুয়াম। এই ভ্যাকুয়াম কে পূরণ করছে?

হ্যাঁ, আজকে আমি আমাদের “কাজের মেয়ে” আর “বুয়া”দের কথা বলতে এসেছি। করোনার সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্মজীবী মেয়েদের মাথায় হাত পড়েছে কারণ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে গৃহকর্মীকে বিদায় দিতে হয়েছে। বাসায় অকর্মণ্য ব্যাটাছেলে থাকার পরও সংসারের সিস্টেম এতদিন মোটামুটি সুন্দরভাবে চলে যেত গৃহকর্মী ছিল বলে। গৃহকর্মী না থাকায় কর্মজীবী মধ্যবিত্ত নারীর কাজের চাপ বেড়ে একাকার অবস্থা। কতগুলো নারীবাদী ওয়েবিনার, পত্রিকার মতামত গৃহকর্মীর এই ব্যাপারটা একটু গভীরে গিয়ে দেখেছে?

আজকাল আমরা অনেকে ভাষার ব্যবহারে সচেতন হয়ে গৃহকর্মীদের আর “কাজের মেয়ে” বা “বুয়া” বলতে চাই না। “খালা,” “আপু,” “হেল্পিং হ্যান্ড” এইসব শব্দ ব্যবহার করি। ভালো। মননে বদল হওয়া ভালো। কিন্তু আসলেও আমাদের মনন ঠিক কতখানি বদল হয়েছে?

কাজের মেয়ে নিয়ে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই। এই ‘ছোটলোকের জাত’টার সমস্যা। এরা ভালো ব্যবহারের মূল্য বোঝে না। এদের সাথে সুখ-দুখের আলাপ করলে, ভালো ব্যবহার করলে

এরা মাথায় উঠে বসে থাকে। এরা চোর। এরা কাজ ফাঁকি দেয়। এরা ছুটি নিয়ে আর ফেরত আসে না। অনেক দান-খয়রাত, সাহায্য-সহযোগিতা করলেও এরা তার মূল্য দিতে জানে না। এরা ব্যক্তিগত বাউন্ডারি বোঝে না। নিষেধ করলেও এরা সোফায়-ডাইনিং টেবিলে-বিছানায় বসে। এদের সিন্ডিকেট ভয়ংকর। একজনে ছাঁটাই করলে আর নতুন করে কাজের মানুষ পাওয়া যায় না।

হুম, কাজের মানুষরা ছোটলোক আর খুব খারাপ জাত বুঝলাম। আমরা মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা ঠিক কতটুকু মহান?

গৃহকর্মীদের বেতনের কথা একটু চিন্তা করি। ঢাকা শহরে একজন “ঠিকা বুয়া” কত টাকা পান? এলাকাভেদে আটশ থেকে এক হাজার টাকার আশেপাশে। বাঁধা মানুষ রাখতে গেলে হয়তো ছয় থেকে দশ হাজার টাকার মতো পড়বে। আমরা অনেকেই মনে করি এরা অনেক টাকা পাচ্ছে। তারপর এরা আর কী চাইতে পারে?

বাংলাদেশ আমেরিকা না। আমেরিকারও অনেকরকম সমস্যা আছে। দুই দেশের তুলনা হয় না। কিন্তু তাও একটু আমেরিকার উদাহরণ টানি। নিজের দেশের বাইরে গিয়ে অন্য দেশে কিছুদিন থাকলে নিজের এবং অন্য দেশের – দুই জায়গারই অসংগতিগুলো মানুষের চোখে ধরা পড়তে থাকে। যে জিনিসগুলোকে আমরা “নরমাল” বলে ধরে নেই, সেই জিনিসগুলো যে ঠিক নরমাল না, সেটা মানুষ বুঝতে পারে।

আমেরিকায় অনেক জায়গায় গৃহকর্মীদের ব্যাপারগুলো কিছুটা রেগুলেটেড। প্রতিটা স্টেটে মিনিমাম স্যালারি ঠিক করা আছে। তার নিচে বেতন দেয়ার নিয়ম নাই (তারপরও অনেক হেরফের হয়। যেমন যাদের আমেরিকায় থাকার বৈধ কাগজ নেই, তাদের খুব কম বেতনে কাজে নেয় অনেকে… তবে সেটা অন্যদিনের আলোচনা)। আমেরিকায় শুধু প্রচণ্ড বড়লোক হলেই বাসায় বাঁধা মানুষ রাখা সম্ভব।

সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে বেতন পান, বাঁধা মানুষ রাখতে গেলে তাঁর পুরো বেতনের অর্ধেক বা অন্তত তিন ভাগের একভাগ চলে যাবে বাঁধা মানুষের বেতনে। যারা “ঠিকা” মানুষ রাখে, তারা হয়তো দুই-এক সপ্তাহে একবার করে লোক ডাকে ঘর-দোর পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য। প্রতিদিনের রান্না আর গাড়ি চালানোর কাজ মোটামুটি নিজেদেরই করতে হয়। বাংলাদেশের মতো মধ্যবিত্ত প্রতিটি ঘরে ঘরে সেখানে কাজের মানুষ নেই।

এই পরিস্থিতি কম-বেশি বেশিরভাগ “উন্নত” দেশগুলোতে একইরকম। “উন্নয়নশীল” দেশগুলোতে তাহলে কি মধ্যবিত্তরা এত ভালো অবস্থায় আছে যে এখানে ঘরে ঘরে কাজের মানুষ? না। আমেরিকার মধ্যবিত্তদের চেয়ে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা মনে হয় ভালো নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের সুবিধা হলো এখানে আছে ভয়াবহ রকমের একটি অসহায় নিম্নবিত্ত শ্রেণি এবং নিম্নবিত্ত নারী। এই মেয়েদের অনেকের গ্রামে নদীতে ঘর ভেঙে গেছে। কারো পরিবার চাষ-বাস করে আর সংসারের খরচ চালাতে পারছে না। পেটের দায়ে এরা শহরে আসছে। এসে হয়তো গার্মেন্টসে কাজ নিচ্ছে। অথবা বাসাবাড়িতে কামলা দিচ্ছে পানির দামে।

পানির দামে কেন বললাম? আমাদের কয়জন নিজেদের স্যালারির অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ বাসার বাঁধা কাজের মানুষকে দেয়ার চিন্তা করবে – যেটা আমেরিকার মতো দেশে করতে হয় বলে বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত মানুষ যতটা পারা যায় নিজেদের কাজ নিজেরাই করার চেষ্টা করে? এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যরাও পুরুষত্বকে সেলফে তুলে রেখে ঘরের কাজে হাত লাগানোর চেষ্টা করে। অনেকে হয়তো এটা শুনে হা-হা করে উঠবেন। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের উপাত্ত দেখাবেন। গার্মেন্টসের ন্যূনতম মজুরি এখন ৮ হাজার টাকা। সেখানে বাঁধা কাজের মানুষের ৬ হাজার টাকা বেতন তো ঠিকই আছে। না, আসলে ঠিক নাই। গবেষক, মানবাধিকার কর্মীরা হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে গার্মেন্টসের কর্মীদের ঢাকা শহরে খেয়ে-পরে মানুষের মতো বাঁচতে হলে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা দরকার হয়। গার্মেন্টসের মালিকরা দিতে রাজি হয় নাই। মালিকেরা মনে করেছে গার্মেন্টসের মেয়েরা কীটের মতো বাঁচলেই যথেষ্ট। ৮ হাজার টাকা গার্মেন্টসের শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ট না। অনেকে সরকারি চাকরির বেসিক স্যালারির কথা বলবেন। কিন্তু সরকারি চাকরির সাথে কতরকম বেনিফিট আসে সেটা চিন্তা করে দেখেন। সুলভে বাসা, চিকিৎসা ভাতা, পেনশন, প্রচণ্ড রকমের সোশ্যাল প্রেস্টিজ – এর কোন জিনিসটা গৃহকর্মীরা পায়? অনেকে হয়তো বলবেন বেতন তো সবারই কম – বাসায় যে টিউশনি করে আর যে অফিসের পিওনের কাজ করে সবাই কম বেতন পায়। হ্যাঁ, কিন্তু সবাই এক্সপ্লয়েটেড বলে সিস্টেমিক এক্সপ্লয়েটেশানকে নরমালাইজ করার কোনো কারণ নেই। আমাদের বুঝতে হবে আমাদের ইনফরমাল সেক্টরের সমস্যাগুলো কোথায়, কীভাবে তারা “আনস্কিল্ড” এবং “ফেমিনাইজড” জবগুলোকে এক্সপ্লয়েট করে এবং কেমন করে এই সেক্টরগুলোকে লেবার ল আর ইউনিয়নের আওতায় আনা যায়।

সাবরিনা হক (২২) একজন গৃহকর্ত্রী (বামে বসা), থাকেন ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমন্ডিতে। ময়না (১৮) একজন গৃহকর্মী, পরিবার খাওয়া-পড়া নিশ্চিত করার তাগিদে গত পাঁচ বছর ধরে ঢাকায় আছেন। আলোকচিত্রটি জান্নাতুল মাওয়ার “সান্নিধ্যে দূরত্ব (close distance)” গল্পের একটি ছবি।

আর পুরো চিত্রটিতে গৃহকর্মীদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ। বাসার ড্রাইভার আর গৃহকর্মীর বেতনটা তুলনা করে দেখেন। ড্রাইভারের স্ট্যান্ডার্ড বেতন ঢাকা শহরে এখন প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। বাঁধা বা ঠিকা মানুষের মোট মাসিক বেতন কত? মোট কর্মঘণ্টা যদি হিসাব করেন, একজন গৃহকর্মী সম্ভবত ড্রাইভারের সমান বা তার চেয়েও বেশি কাজ করেন। তাহলে গৃহকর্মীর বেতন এত কম কেন? কেউ কেউ বলবেন ,ড্রাইভিং-এ তো স্কিল লাগে। গাড়ি চালানো শিখতে হয়। লাইসেন্স নিতে হয়। ঘরের কাজে তো এমন স্কিলের দরকার হয় না। মায়ের পেট থেকে পড়েই কেউ রান্না করা শেখে না। ঘরের কাজ করা শেখে না। বাংলাদেশের দামড়া ব্যাটাছেলেগুলো তো সারাজীবনেও ঘরের কাজগুলো শিখে উঠতে পারে না। ঘরের কাজে স্কিল লাগে না? আমি পনেরো-বিশ ঘন্টা ড্রাইভিং প্র্যাকটিস করে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছি এবং ভালোমতো ড্রাইভিং শিখে উঠতে আমার বছরখানেক লেগেছে। কিন্তু আমি বারো বছর ধরে রান্না করে এখনও আমার মায়ের স্কিল লেভেলে রান্না করতে পারি না। গৃহকর্মীর স্কিল ড্রাইভারের স্কিলের চেয়ে কোনো অংশে কম না। কিন্তু সে নারী, তার স্কিল কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিখতে হয় না, তার স্কিলের সার্টিফিকেট দেয়ার কেউ নেই। তাই তাকে তার কাজের জন্য কম মজুরি দেয়াটা আমাদের সমাজে জায়েজ।

এত কম বেতনে যাকে আমরা এক্সপ্লয়েট করবো, তার কাছ থেকে আমরা যদি টপ লেভেল প্রফেশনালিজম, বাউন্ডারি, প্রাইভেসি ইত্যাদি ইত্যাদি আশা করি – তা তো হবে না। তার সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, জবের কোনো ফর্মাল কন্ট্রাক্ট নেই, মুখের কথায় তার চাকরি চলে যায়, নির্দিষ্ট ছুটি নেই, কাজের মধ্যে ব্রেকের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, অসুখ হলে চাকরির কন্ট্রাক্টের অংশ হিসেবে বেফিনিটের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিটা জিনিস তাকে ধরে ধরে আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিটা এমপ্লয়ারের সাথে নেগশিয়েট করে নিতে হয়। এখন দেশের জাতীয় লেবার ল যদি তাদের প্রটেকশান না দেয়, তাদের জন্য যদি কার্যকর শ্রম সংগঠনের ব্যবস্থা না থাকে, ফরমাল ন্যূনতম বেতনভাতার ব্যবস্থা না থাকে, তখন তার জায়গা গৃহকর্মীদের “সিন্ডিকেট”ই নেবে। গৃহকর্মীদের সিন্ডিকেট নিয়ে হাহাকার করে মাথা কুটে মরলেও কিছু হবে না। তাদেরতো নিজেদের রক্ষা করবার জন্য কিছু না কিছু করতে হবে!

কোনো কোনো এমপ্লয়ার হয়তো অনেক উদার। তারা গৃহকর্মীদের চেয়ার-টেবিলে বসতে দেন। বেতনের ওপরেও বাড়তি টাকা দেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেন। কিন্তু এদের তো আপনার উদারতার ওপরে নির্ভর করার কথা না। এরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে। দেশের লেবার ল-এর এদের সুরক্ষা দেবার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে তো আমরা ধর্ষণ আর বড় বড় অপরাধের ল বানিয়েই খালাশ। ল কাজে লাগানোর কোনো নাম নাই। আর গৃহকর্মীদের জন্য তো কোন ল-ই নাই। করোনার পর সরকার থেকে ৩১টা ডিরেক্টিভ দেয়া হয়েছিলো খেটে খাওয়া মানুষদের রক্ষা জন্য। সেখানে কৃষক, দিন-মজুর, ভ্যানচালক, রিকশাওয়ালা, পরিবহণ শ্রমিকদের কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত কর্মজীবী নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুইটা দল – গৃহকর্মী আর গার্মেন্ট শ্রমিকদের নাম-গন্ধও ছিল না। গার্মেন্টসের মেয়েরা তাও তাদের তৈরি করা পোশাক বিদেশে যায় বলে কিছুটা ভিজিবিলিটি পায়। গৃহকর্মীদের কাজতো আর বিদেশে রপ্তানি হয় না। তাই তাদের নিয়ে কারো তেমন মাথা ব্যথাও নাই। ওহ হ্যাঁ, তারা যখন সৌদি আরবে গিয়ে রেপড হয়ে ফিরে আসে, তখন আমাদের জাতীয় মান-সম্মান নিয়ে হাহাকার পড়ে যায়। কিন্তু দেশের ভেতরে বাসাবাড়িতে সেক্সুয়ালি হ্যারাস হলে, নির্যাতনের শিকার হলে তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নাই।

আমরা মধ্যবিত্তরা গ্রাম থেকে আসা গরিব মেয়েদের ভয়ংকর কম দামে কাজের মানুষ হিসেবে ব্যবহার করে দিনের পর দিন শোষণ করার একটা সিস্টেম তৈরি করে রেখেছি। দেশের মধ্যবিত্ত নারী এবং তাদের পরিবারের অকর্মণ্য ব্যাটাছেলেরা মিলে দরিদ্র শ্রেণিকে, দরিদ্র নারীকে শোষণ করে আজকে প্রফেশনাল উইমেন হয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারছে, নারীর ক্ষমতায়ন করতে পারছে। মধ্যবিত্ত নারীর যাকিছু “প্রফেশনাল” অর্জন, তার জন্য দিনের পর দিন মূল্য দিয়ে গিয়েছে নিম্নবিত্ত গৃহকর্মীরা।

কিন্তু দরিদ্র নারীর শ্রম করোনার কারণে এক্সপ্লয়েট করা যাচ্ছে না। তাই পুরো এক্সপ্লয়টেশানের সিস্টেম ধ্বসে গেছে। কয়টা মধ্যবিত্ত নারীর করোনার সময়ের কষ্ট নিয়ে হাহাকার করা ওয়েবিনার এই দরিদ্র গৃহকর্মী নারীকে শোষণ ব্যাপারটা অন্তত রিকগনাইজ করেছে? শত শত গৃহকর্মী যে কাজ চলে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে, তার ওপরে ঠিক কতগুলো ওয়েবিনার আর পত্রিকার মতামত বের হয়েছে?

একজন নারীবাদী হিসেবেই আমি বলবো আমাদের বাংলাদেশের মূলধারার ফেমিনিজমের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এলিটিস্ট, মধ্যবিত্ত ডমিনেটেড, বিদেশি ফান্ডনির্ভর, শহুরে ফেমিনিজম। আমরা যারা নিজেদের প্রগ্রেসিভ, লিবারেল, নারীবাদী, মানবতাবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি বলে দাবি করি, তাদেরও রক্ত-মজ্জায় শ্রেণিবিদ্বেষ এমন করে মিশে আছে যে গৃহকর্মীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমাদের কর্মকাণ্ড যে কতখানি ডিগ্রেডিং এবং ডিহিউম্যানাইজিং – এটা আমাদের মাথাতেও আসে না। আমরা অনেকে হয়তো পলিটিক্যালি কারেক্ট হয়ে কাজের বুয়াকে আজকাল বলি “হেল্পিং হ্যান্ড”। কিন্তু নিজেদের পরিবারে একদম ছোটবেলা থেকে গৃহকর্মীদের সাথে যেসব সমস্যাজনক লেবার প্র্যাক্টিস হতে দেখেছি, সেগুলোর মূলোৎপাটন করার সাধ্য আমাদের আদৌ হবে কি?

***********************************************************************************************

“সান্নিধ্যে দূরত্ব (close distance)” ছবিগল্প প্রসঙ্গে: আলোকচিত্রীর কথা: ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, গৃহ কর্মীরা পূর্ব বঙ্গের গ্রামীণ সমাজের অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন গৃহস্থালীগুলোতে পেটে-ভাতে কাজ করত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে মজুরি শ্রমের ধারণা ও অনুশীলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তার সাথে সাথে অর্থের বিনিময়ে গৃহশ্রম, গৃহ পরিচারিকার ধারণাও পাকাপোক্তভাবে আমাদের সামাজে জায়গা করে নেয়। কালের পরিক্রমায় আমাদের দেশ দুইবার স্বাধীন হয়েছে (১৯৪৭, ১৯৭১), কিন্তু কোনও আমলেই সরকার এই গৃহকর্মীদের জন্য নুন্যতম মজুরীর কথা ভাবেনি, তাদের কোনও সাপ্তাহিক ছুটি নেই, বাঁধা ধরা কর্মদিবস নেই, বিশেষ করে যারা “বান্ধা” হিসেবে কাজ করেন। এই বিষয়ে পাবলিক পরিসরে তেমন কোনও আলাপ-আলোচনাও নেই। এই নারীরা মধ্যবিত্ত সংসারে বিছানা গুছায়, রান্না করে, ঘর ঝাড়ু দেয়, সোফা ঝারপোছ করে কিন্তু এই সোফা বা বিছানায় তাদের বসার নজির নাই। এটাই অলিখিত নিয়ম।

আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া শহুরে মধ্যবিত্ত গৃহকর্ত্রীদের কাছে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্মীর সাথে একই সোফায় বসে পোট্রেট তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই কাজের মধ্য দিয়ে শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়িতে যে স্থানিক নিষেধাজ্ঞা (spatial taboo), প্রকারন্তরে শ্রেণীগত নিষেধাজ্ঞা (class taboo) আছে তা লঙ্ঘন করতে চেয়েছেন। গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্মীর একই গৃহী পরিসরে বিচরণ, কিন্তু এই দুই শ্রেণীর নারীর আর্থ-সামাজিক জীবন ও মতাদর্শিক মূল্যায়নে রয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। জান্নাতুল মাওয়া তার এই কাজের মাধ্যমে এই নারীদের মধ্যে, যারা একই সোফায় বসার অধিকার রাখে না, তাদের মধ্যে সংহতি, সৌহার্দ্য, সান্নিধ্য তৈরির সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন। সেই অসমতা যাকে আমরা স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছি। “সান্নিধ্যে দূরত্ব (close distance)” শীর্ষক এই সিরিজে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তারাও এই বিভেদের চৌকাঠ পার হতে আগ্রহী।

আলোকচিত্রে পরিবেশিত এই সান্নিধ্য ক্ষণস্থায়ী, একটা ছবি তোলার প্রক্রিয়ায় ঐতিহাসিক শ্রেণীবৈষম্য বিলীন হবে না, কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনে আলোকচিত্রের শক্তিমত্তায় জান্নাতুল মাওয়ার আছে গভীর আস্থা। মাওয়া এই ভেবে আশস্ত বোধ করেন যে এই সিরিজের  আলোকচিত্রগুলো গৃহী পরিসরের বিরাজমান সামাজিক, ঐতিহাসিক বৈষম্যের এই অগ্রহণযোগ্য চর্চা নিয়ে পুনর্ভাবনার সুযোগ তৈরী করবে।

নাফিসা তানজীম যুক্তরাষ্ট্রের লেযলি ইউনিভার্সিটির জেন্ডার, রেস অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটি স্টাডিজ এবং গ্লোবাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক। তার ওয়েবসাইট https://ntanjeem.org/. লেখাটি “মেয়ে” নেটওয়ার্কের ফেসবুক পেইজে প্রথম প্রকাশিত হয় – https://www.facebook.com/meyenetwork/posts/3028734560564590

জান্নাতুল মাওয়া একজন আলোকচিত্রী, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষক। সান্নিধ্যে দূরত্ব সিরিজটি নিয়ে মাওয়া ২০১৩ -১৪ সালে কাজ করেছেন। এই সিরিজের অন্য ছবিগুলো জন্য দেখুন, Close distance by Jannatul Mawa



Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: