“এই জুলুমবাজ সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসীর কাছে বিচার দিলাম”

পুলিশি হামলার প্রেক্ষিতে তাজরীন ও এ ওয়ান বিডি লিঃ এর শ্রমিকদের যৌথ সংবাদ সম্মেলন

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক জুলহাসনাইন বাবু, লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এ ওয়ান বিডি লিঃ এর শ্রমিক আশরাফ আলী, বক্তব্য রাখেন তাজরীন গার্মেন্টের আহত শ্রমিক জরিনা বেগম, গার্মেন্টস টিউউসি এর সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সবুজ, গার্মেন্ট শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক শামীম ইমামসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

এই জুলুমবাজ সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসীর কাছে বিচার দিলাম-

এ ওয়ান বিডি লিঃ ও তাজরীনের আহত শ্রমিকবৃন্দ

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, 

আপনারা জানেন আমরা তাজরীন ও এ ওয়ান (বিডি) লিঃ এর শ্রমিকেরা করোনাকালীন সময়ে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা ও বিপদে পড়ে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করে আসছিলাম।

তাজরীনের শ্রমিকরা তিন দফা দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে খেয়ে না খেয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে অবস্থান ধর্মঘট পালন করে আসছি এই বিগত ৮০ দিন ধরে। এই তিন দফা দাবী হল: ) শ্রম আইনের ক্ষতিপূরণের ধারা সংশোধন সাপেক্ষে সকল আহত শ্রমিকদের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ প্রদান, ) সকল আহত শ্রমিকদের সম্মানজনক বাস্তবসম্মত পুনর্বাসন, ) সকল আহত শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

অন্যদিকে এ ওয়ানের শ্রমিকরা গত ১১ মাস ধরে ঢাকা, আশুলিয়া ইপিজেড এ আন্দোলন করে আসছিলাম। এ ওয়ানের শ্রমিকদের দাবিও স্পষ্ট- অবিলম্বে ১১ মাসের বকেয়া বেতন ভাতা ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করতে হবে; কারখানা বন্ধ করা হলে ইপিজেড আইন ২০১৯ অনুযায়ী সকল পাওনা পরিশোধ করতে হবে। গত ১১ মাসে আমাদের মালিকপক্ষ ও বেপজা অন্তত ২২ বার আমাদের পাওনা পরিশোধ করার আশ্বাস দিলেও আমাদের পাওনার পরিশোধে কোন অগ্রগতিই হয়নি। উল্টো পাওনা পরিশোধের কথা বলে বেপজায় ডেকে নিয়ে দুই দফা আমাদের পেটানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ ডিসেম্বর থেকে আমরাও বাধ্য হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টানা অবস্থান করে আসছিলাম।

আমরা তাজরীনের শ্রমিকরা বিগত ৮০ দিন ধরে আমাদের তিন দফা দাবিকে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের নজরে আনার জন্য এমন কোন কাজ বাকি নেই যা আমরা করি নাই। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে আসছিলাম। এর মধ্যে বিগত ৮০ দিনে আমরা গুনে গুনে তিন বার স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শ্রম প্রতিমন্ত্রী এবং বিজিএমইএর কাছে। আমরা মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছেও এক দফা স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলাম।

অন্যদিকে এ ওয়ানের শ্রমিকরা ঢাকা ইপিজেড এর জিএম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, নির্বাহী চেয়ারম্যান বেপজা, ইতালীর রাষ্ট্রদূত, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ১১ মাসে ২ দফায় আশুলিয়া প্রেসক্লাবে ৮ দিন এবং ২ দফায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ৮ দিন অবস্থান করি।

কিন্তু আমরা সহ আপনারা সবাই দেখলেন এদেশের সরকার শ্রমিকদের মানুষই মনে করেনা। এমনকি মাননীয় শ্রমপ্রতিমন্ত্রীর সাথে আমাদের তাজরীনের শ্রমিকদের যখন দেখা হয় তখন তিনি আমাদের বলেছিলেন বিজিএমইএর কাছ থেকে আমাদের তাজরীনের শ্রমিক পরিচয়ের প্রত্যয়ন পত্র প্রাপ্তি সাপেক্ষে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে এককালীন কিছু অনুদান আমাদের দেয়া যেতে পারে। শুধু তাই নয় ইতিমধ্যে পত্রিকার খবর মারফত আমরা জানতে পারি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরও আমাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য ইতিবাচক প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল। কিন্তু বিজিএমইএর কাছ থেকে প্রত্যয়ন পত্র আদায় করার কোন আন্তরিক উদ্যোগ সরকার নেয় নি। আমাদের নিয়ে সরকার এবং বিজিএমইএ সহ সংশ্লিষ্ট সকলে ক্যারামবোর্ড এর গুটি বানিয়ে খেলছে।

অন্যদিকে আমাদের এ ওয়ানের শ্রমিকদের বেপজা এবং ঢাকা ব্যাংক আইনি জটিলতার ফেলে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বেপজা কারখানাকে ২য় দফায় টার্মিনেট করেছে ২৯ আগস্ট ২০২০ এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। কিন্তু কারখানা বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্যাংক। আমরা কাজ করেছি, কাজের মজুরি চাই। আইনি জটিলতা দেখিয়ে আমাদের বিপদে ফেলা চলবে না। ১১ মাস ধরে শ্রমিকরা অনাহারে থাকতে পারেনা। অবিলম্বে মধ্যবর্তী পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থতা করতে হবে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,

আপনারা দেখলেন আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কিভাবে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হল। পুরুষ পুলিশ দিয়ে আমাদের নারী শ্রমিকদের বেদমভাবে পেটানো হল। পুরুষ পুলিশ আমাদের নারী শ্রমিকদের গায়ে হাত দিল। পিটিয়ে রক্তাক্ত করল। তাদের বুকে হাত দিল, গায়ের জামাকাপড় ছিড়ে দিল, বুকের ওড়না কেড়ে নিল, পুলিশের হামলা থেকে এমনকি বয়স্ক শ্রমিক ও ছোট্ট শিশুও রেহাই পায়নি। সেই সাথে চলেছে অকথ্য গালিগালাজ। পুলিশ সমানে আমাদের “বেশ্যা, খানকি মাগী” এসব বলে গালি দিয়েছে। জ্বী সাংবাদিক বন্ধুগণ! আমরা চাই আপনারা এই গালিগুলো ছাপুন। যে সরকার বিজিএমইএ  এবং চোর, বড়লোকদের পাহারাদারদের  ভূমিকায় অবতীর্ণ তার পুলিশের দেয়া এই গালিগুলো আপনারা ছাপুন।

পুলিশের বর্বর হামলায় শুধু আমাদের তাজরীনের আন্দোলনরত আহত শ্রমিকদের মধ্যেই মোট ১৮ জনকে আহত অবস্থায় মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। অন্যদিকে এ ওয়ানের শ্রমিকদের মধ্যে পুলিশি হামলায় আহত হয়েছেন ২৫ জন। আমাদের পাশে সংহতি জানাতে উপস্থিত থাকা ছাত্র ভাইদেরও পুলিশ পিটিয়েছে। তারা আমাদের উপর হামলার ভিডিও করছিলেন দেখে তাদের মোবাইল কেড়ে নেয় পুলিশ। বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর নেতা ইকবাল কবিরসহ আরো একজনের মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়। একইভাবে স্রেফ হামলার ভিডিও করার কারণে পুলিশ ওই সময় আমাদের সাথে উপস্থিত  গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজকে পুলিশ আটক করে প্রিজন ভ্যানে তুলে আটকে রাখে। পরে ভোর ৬টার দিকে তাকে ছাড়া হলেও ছাড়ার আগে তিনি আমাদের উপর হামলার যে ছবি-ভিডিওগুলো তুলেছিলেন সেগুলো জোরপূর্বক মুছে দেয়।

পুলিশ আমাদের গত পরশু বলেছিল দেশের পরিস্থিতি নাকি ভাল না, এজন্য অরাজকতার ঠেকাতে আমাদের জোর করে উঠিয়ে দেয়া হবে। আমরা দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন করতে চাই, এই যে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের আজ আট বছর পরেও আমাদের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ দেয়া হল না এর চেয়ে বড় অরাজকতা আর কি হতে পারে? আমরা এ ওয়ানের ১১০০ শ্রমিক ১১ মাস ধরে বেতন পাইনা, এর চেয়ে বড় অরাজকতা কি হতে পারে? আর ভোররাতে যখন আমরা ঘুমন্ত অবস্থায় তখন আমাদের উপর অতর্কিতে এই বর্বর হামলা করে সবচেয়ে বড় অরাজকতার রাজত্ব তো পুলিশ তথা সরকারই কায়েম করল।  

এভাবে আমাদের বর্বরোচিতভাবে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেয়ার ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নাই। আমরা আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তীব্র ঘৃনা জানাই। আমরা থুতু দেই এই সরকারের মুখে। আমরা এই জুলুমবাজ সরকারকে, যে সরকার শ্রমিকদের দাবিকে পাত্তাই দেয় না, যে সরকার শ্রমিকদের মানুষই মনে করে না সেই সরকারকে অভিশাপ দেই। এই জালিমরা ধ্বংস হবে। কোন একদিন এই দেশের মাটিতে শ্রমিকদের সাথে করা সকল জুলুমের বিচার হবে। আমরা তাজরীন ও এ ওয়ান গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক ভাইবোনদের উপর সরকারের চালানো এই ভয়াবহ জুলুমের বিরুদ্ধে আপনাদের কাছে বিচার দিলাম।  

সেই সাথে আমরা এও বলতে চাই সরকার আমাদের মৃত মনে করলেও আমরা মরি নাই। তাজরীন ও এ ওয়ানের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে আসছি না। ইতিহাস সাক্ষী শ্রমিকেরই বিজয় হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনে প্রিয় দেশবাসী আপনারা আমাদের পাশে থেকে সরকারকে বাধ্য করবেন আমাদের দাবি মেনে নিতে আপনাদের কাছে এই আবেদন আমরা রেখে গেলাম। 

আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই আমাদের বিজয়ী করবে

বার্তাপ্রেরক,

তাজরীনের আহত শ্রমিকদের পক্ষে,
জরিনা বেগম

এ ওয়ান বিডি লিমিটেডের শ্রমিকদের পক্ষে
আশরাফ আলী



Categories: আন্দোলন বার্তা

Tags: , , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: