সমারী চাকমা, ২ জানুয়ারি ২০২১
যে জীবন যখন ছিল সুখ আর শান্তিরঃ
আমার নাম সুরেন্দ্র চাকমা। আমাদের গ্রামের নাম কেঙ্গল ছড়ি,জেলা রাংগামাটি। আমার বাবার নাম গুণ রঞ্জন চাকমা এবং মায়ের নাম বিনাতা চাকমা। আমাদের পরিবারের সাত ভাই বোনের মধ্যে আমি মেজো জন। আমার বয়স এখন প্রায় ৭২ বছরের মত হতে পারে, যেহেতু কাপ্তাই বাঁধের পানি আসার সময় আমার বয়স ছিল দশ বা বারো। আমার সেই সময়ের ঘটনা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। এখনো চোখে ভাসে সেই সময়ের অনেক ঘটনাবলী। বিশেষ করে কাপ্তাই বাঁধের পানি যখন আসছিল আর একে একে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো আমাদের আবাদী জমিগুলো। আমার চোখের সামনেই তো আমাদের জমিগুলো বাঁধের পানিতে একে একে তলিয়ে গেল। এতো বছর পরেও সেই স্মৃতি মনে পড়লে মন কেমন করে উঠে। মন আপনা আপনি খারাপ হয়ে যায়। সেই সময়ের আরো অনেক ঘটনা আজো আমার মনে শক্ত করে দুঃখের স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
সেই সময় কাপ্তাই বাঁধের পানিতে সব কিছু ডুবে যাবার পর অনেক পরিবার দেশ ছেড়েছিল। শুধু তারা দেশ ছেড়েছিল তা না, তাদের সাথে যাদের বাড়ি ঘর ডুবে যায়নি এমন লোকজনও দেশ ছেড়েছিল, এই দেশ ছেড়ে যাওয়াকে আমরা বলি “বর-পরং”। এটা আসলে আমাদের চাকমাদের জীবনে এক বড় বিপদের সময়। এই রকম বর-পরং যাওয়া, মানুষজন শূন্য এক গ্রামে আমরা গিয়েছিলাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। সেখানে গিয়ে দেখলাম বাড়ি ঘর সব ঠিকঠাক আছে কিন্তু কোন মানুষের চিহ্ন নেই। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। শুধু বাতাসের শব্দ আর কুকুরে ডাক। কয়েকটা কুকুর ডাকছে আর এদিক সেদিক ঘুরছে। আমিতো তখন ছোট, সেই গ্রামে গিয়ে এই দৃশ্য দেখার পর আমার বেশ ভয় লেগেছিল সেটা আমার এখনো মনে আছে। বর-পরং যাওয়া মানুষ শূন্য সেই গ্রামের দৃশ্য আজো আমার স্মৃতিতে দুঃখের আর অসহায়ের স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। সেই স্মৃতি ভোলা কঠিন।
কাপ্তাই বাঁধ হবার আগে আমাদের বাড়ি ছিল সমতলের জমিতে, যে জমিতে আমরা পাগুন্দি ক্ষেত (সবজি চাষ করার জমি) করতাম। চাষবাদের সুবিধার্তে আজু আর বাবা সেখানে বাড়ি করেছিলেন। কিন্তু বাঁধ বানানোর সময় পানিতে ডুবে যাবার ভয়ে বাবা সেই পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে সমতল থেকে একটু উঁচু মুড়োতে (পাহাড়ে) বাড়ি বানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে সময় আমাদের মত গ্রামের অনেকেই মুড়োর উপর বাড়ি করতে বাধ্য হয়েছিলেন বাঁধের পানি থেকে বাঁচার জন্য।
আমাদের গ্রামে তখন সম্ভবত ২০/৩০ পরিবারের বসতি ছিল। আর এই গ্রামের বেশীরভাগ ছিল ইয়ো হোজা, চান্দি গোষ্ঠির বংশধরের মানুষ। আমাদের পরিবারও এই ইয়ো হোজা, চান্দি গোষ্ঠির অংশ। এই গ্রামের কার্বারী ছিলেন রুনু চন্দ্র চাকমা। তিনি আমার আপন জিদু বা জ্য়াঠা ছিলেন। তাঁর ছেলে মেজর কীর্তি রঞ্জন চাকমা। সে এখন আমেরিকায় বসবাস করছে। শান্ত নিরিবিলি সুখী গ্রাম বলতে যা বোঝায় তাই ছিল আমাদের গ্রাম। আমার যতটুকু মনে পড়ে তখন সেই গ্রামের লোকজন সবাই স্বাবলম্বী ছিল, খাওয়া পরার জন্য কাউকে কারোর কাছে হাত পাততে হতোনা।
আমাদের গ্রামে স্কুল ছিলনা কিন্তু গ্রামের সকলে মিলে এক বছরের জন্য মাস্টার রেখে দিতেন গ্রামের বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য। আমার মনে আছে সে মাস্টারকে মাসিক ৩০ টাকা করে দেয়া হত, বেতন হিসাবে। তখন কিন্তু ত্রিশ টাকা অনেক টাকা (হাসি)। আর আমরা আমাদের গ্রাম থেকে দেড়/দুই মাইল দূরে আমাদের পাশের গ্রাম বেত ছড়ি প্রাইমারী স্কুলে পড়তে যেতাম। আমি বেশী পড়তে পারিনি। মাত্র ক্লাশ ফোর পযর্ন্ত পড়েছি। আমাদের সাথে মেয়েরাও ইচ্ছে করলে পড়তে পারতো। আমার এক বোন যে এখন খাগড়াছড়ি থাকে সেও পড়াশোনা করেছে কিন্তু অন্য বোনরা করেনি।
কাপ্তাই বাঁধের পানিঃ
তখনতো পাকিস্তান আমল। এমন শান্ত নিরিবিলি গ্রামে একদিন খবর পৌঁছালো কাপ্তাইতে বর-গাং এর পানি ধরে রাখার জন্য একটা গোদা (বাঁধ) হবে আর সেই ধরে রাখা পানি নাকি আমাদের গ্রাম, জায়গা, জমি সব ডুবিয়ে দেবে। এই কথা কেউ বিশ্বাস করলো আর কেউ করলো না। এই খবরের পর গ্রামে শুধু একটাই কথা, গোদা/বাঁধ এবং পানি। খাওয়ার সময়,বেড়ানোর সময় এই এক আলোচনা সবার – কোথায় যাবো, কি হবে, দিন চলবে কেমন করে? সত্যি সত্যি কি পানি আসবে আর সব ডুবে যাবে ? বাড়িতেও সেই একই আলোচনা। আমি তখন বয়সে ছোট কিন্তু বাবা মা‘দের অসহায় আর চিন্তিত মুখ দেখে সব বুঝতে পারি। বড়দের এই দুঃশ্চিন্তা আমার এবং আমার বন্ধুদের মধ্যেও প্রভাব ফেলে ।
একদিন আমার জিদু/ জ্য়াঠা বাবু কার্বারী রুনু চন্দ্র চাকমা গ্রামের সকলকে নিয়ে মিটিং ডাকলেন এই বাঁধের পানি বিষয়ে। বড়দের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা কয়েকজন সমবয়সী বন্ধু মিলে মিটিং শুনতে গেলাম। কার্বারী জিদু বললেন – “সরকার একটা বাঁধ বানাচ্ছে বর-গাং এর উপর পানি ধরে রাখার জন্য। সেই ধরে রাখা পানি আমাদের গ্রাম পযর্ন্ত আসবে। এখনো জানিনা কতটুকু আসবে। কিন্তু যতটুকু শুনেছি আমাদের গ্রাম, জায়গা-জমি সব ডুবিয়ে নিয়ে যাবে। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে কে,কোথায় যাবে। যে কেউ আলাদা বা একসাথে নতুন বাড়ি বা গ্রাম গড়ে তুলতে পারবে। সবাইকে এক জায়গায় নতুন বসতি গড়ে তুলতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই। যে যেভাবে পারে সেভাবে করতে পারো।”
এই মিটিং এর পর সবাই এক প্রকার বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো যে সত্যি সত্যি বাঁধ হচ্ছে আর সেই পানি আমাদের জায়গা জমি ডুবিয়ে দেবে। সবাই খুব মন খারাপ করলো এবং দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলো – এরপর তারা কোথায় যাবে? কি খাবে? কেমন করে সামনের দিনগুলো চলবে? বাড়ি বানানোর জায়গা বা চাষবাস করার জমিও বা কোথায় পাবে? আমাদের বাড়িতেও সেই একই আলোচনা। একদিন কার্বারী জিদু বাবাকে ডেকে বললেন খাগড়াছড়ি ফেনী কূল এলাকা ঘুরে আসতে। যদি সেখানকার সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে আমরা সেখানে জায়গা কিনে নতুন বসতি গড়ে তুলবো। তবে এও সিদ্ধান্ত নিলেন এখানেও আমাদের দুই পরিবারের বাড়ি থাকবে, নিরাপত্তার জন্য। যদি ফেনী কূলে ভবিষ্যতে থাকা সম্ভব না হয় তাহলে এখানেই তো ফিরতে হবে। এরই মধ্যে বাবা এই পুরাতন বাড়ি ভেঙ্গে একটু পাহাড়ের উপরে নতুন বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাতে পানি আসার আগেই আমরা সেই একটু উচুঁতে তোলা বাড়িতে চলে যেতে পারি। ফেনী কূল এলাকা তখন নাকি খুব সমৃদ্ধশালী ছিল। তাই সেখানে থাকা বাঙালী বসতিদের ভয়ের কারণে কার্বারী জিদু আর বাবারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এখানেও বাড়ি করার। পরে অবশ্য বাবাদের সেই চিন্তা সত্যি হয়েছিল, যারা সেখানে চলে গিয়েছিলেন তারা কয়েক বছরের মধ্যে আবার ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেখানকার বাঙালীদের জ্বালায় টিকে থাকতে না পেরে পুরনো জায়গায় তারা ফেরত এসেছিলেন।
পানির লেভেল এবং গাছ কাটিংঃ
একদিন আমাদের গ্রামে সরকারের লোক এলো ”পানি লেভেলিং” করার জন্য। ”পানি লেভেলিং” হচ্ছে কাপ্তাই বাঁধের পানি কতো দূর আসবে আর তা কতো উচ্চতায় হবে সেটা পরিমাপ করে নির্ধারণ করা। পানির মাপজোক করা শেষ করে তারা জায়গায় জায়গায় লেভেলিং/দাগ দিয়েছিল এবং এলাকার মানুষদের সে সব বিষয়ে সচেতন করা শুরু করেছিল। সরকারের লোক হিসাবে যারা ছিল তারা প্রায় সকলে ছিল বাঙালী। সেই কর্মচারীরা চার কোণা পাকা পিলার নিয়ে আমাদের গ্রামে এসে পাকা পিলারের একটা অংশ মাটির নীচে শক্ত করে পুঁতে আরেকটা অংশ প্রায় দুই ফুটের সমান উচ্চতা মাটির উপরে রেখে সেখানে লাল কালির দাগ দিয়ে বললো এতদুর পানি আসবে এবং এতো উচ্চতা সমান পানি হবে। আমাদের বাড়ির উঠোন পযর্ন্ত দাগ দেয়া হয়েছিল। আর জিদু কার্বারী ঘরের ভিটাতেও দাগ দেয়া হয়েছিল। আমরা ছোটরা দল বেঁধে এবং বড়রাও তাদের এই ”লেভেলিং” দেয়ার কাজ দেখতে লাগলাম।
এই পিলার বসানো আর দাগ দেয়া দেখে তখন গ্রামের লোকেরা নতুন করে বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে সত্যি সত্যি পানি আসবে এবং তাদের সবকিছু ডুবিয়ে নিয়ে যাবে। কী অসহায় হয়ে গিয়েছিল তাদের মুখ! বাবা দাদারা সহ বাকি সবাই মুখ কালো করে ভাবতে লাগলেন কিভাবে বাকি জীবনটা কাটবে। জীবন চালানোর জন্য সব জমি যদি পানিতে ডুবে যায় তাহলে কি খাবে? কেমন করে চলবে আমাদের? তাদের এই অসহায় ভরা মুখ দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। তাইতো এবার আমাদের কি হবে!
এর পরে পরেই আরেকদল “গাছ কাটিং” করতে আমাদের গ্রামে হাজির হলো। যতদূর পর্যন্ত পানি লেভেলের দাগ দেয়া হয়েছে সে সব জায়গায় থাকা বড় বড় গাছ গুলো চিহ্নিত করে কাটা শুরু হলো। এই দৃশ্যও ছিল দেখার মতো। আমরা ছোটরা আবার দলবেঁধে দেখতে গেলাম। এইবার শুধু চারিদিকে কাটা বড় বড় গাছ।
বাঁধের পানিঃ
এরপর কোন একদিন কোন এক সময় আমাদের গ্রামের নদীর পানি হঠাৎ করে বাড়তে আরম্ভ করলো। এরপর আমাদের সেই নদীর পানি উছলে পড়ে আমাদের জায়গা জমি ডুবিয়ে নিতে শুরু করে। আমরা সকলে সেই পানি আর সেই পানিতে আমাদের জায়গা জমি ডুবে যাওয়া দৃশ্য দেখতে লাগলাম কেউ একাকি দাঁড়িয়ে, কেউবা দল বেঁধে। অদ্ভুত সেই দৃশ্য। সেই কষ্টের স্মৃতি এখনো চোখে লেগে আছে। সকালে যে জায়গা পানিতে ডুবেনি সেটা বিকেল না হতেই পানির নীচে তলিয়ে গেল। পানি আসছে আর সবকিছু ডুবিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা দলে দলে সেই করুণ দৃশ্য দাঁড়িয়ে, বসে দেখছি (দীর্ঘশ্বাস)। আমাদের কিছুই করার ছিলনা শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া। আমার মনে আছে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কথা হতো এইভাবে – আজ এতদূর ডুবিয়ে নিয়ে গেল কাল অতদূর অমুকদের জমি ডুবে যাবে। হয়তো এক সপ্তাহ লাগবেনা আমাদের গ্রামের সকল জমি পানিতে ডুবে যাবে। দেখতে দেখতে বাঁধের পানিতে আমাদের বাড়ির চৌদ্দ হানি, কার্বারী জিদুর দশ হানি, আমাদের আরেক জিদুর দশ থেকে চৌদ্দ হানি চোখের সামনে ডুবে গেল। সকলের চোখের সামনে ডুবে গেল। শুধু পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কোনায় থাকা জমি ডুবেনি। বাঁধের পানি ততদূর পর্যন্ত যায়নি।
সেই ডুবে যাওয়া জমি এখন আমরা বছরে একবার চাষ করার সুযোগ পাই যখন শীতকালে পানি কমে গিয়ে সেই ডুবে যাওয়া জমি জেগে উঠে। শীতকালে পানি কমে গেলে আমরা ধান বপন করি আর পানি আসার আগে তাড়াহুড়ো করে পাকা ধান (মাঝে মাঝে আধা পাকা ধান) কেটে ঘরে তুলে নিই। আমাদের এই ডুবে যাওয়া সব জমি গুলো ছিল দিহুন্ডু বা দুইবার চাষ যোগ্য জমি।
মনে আছে প্রথম বছরে বাঁধের পানি এসেছিল অনেক বেশী। এই পানির ভয়ে আমরা পাহাড়ের উপরে ঘর তুলেছিলাম। পরে অবশ্য দেখা গেল যতদূর পানি আসবে বলে দাগ দেয়া হয়েছিল ততদূর পর্যন্ত পানি আর আসেনি। আমাদের পুরনো বাড়ির উঠান পর্যন্ত পানি এসেছিল। অবশ্য পানি আসার আগেই আমরা পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বাড়ি তৈরী করে সেখানে চলে গিয়েছিলাম। আর প্রথম দুই/তিন বছরে যতটুকু পানি এসেছিল পরে তাও আর আসেনি। এখন পানি আমাদের সেই পুরনো বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকে।
জায়গা জমির ক্ষতিপূরণঃ
বাবা এবং জিদুরা সকলেই ডুবে যাওয়া জমির ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। সেটা কত তা আমি জানিনা। তবে মনে আছে বাবা সেই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে এক জোড়া মহিষ কিনেছিলেন। গ্রামের সকলে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে এখন বুঝি জমি হারানোর দাম সেই একজোড়া মহিষ দিয়ে কি পূরণ হয়! আমাদেরও হয়নি। আমাদের কত স্মৃতি কত আশা ছিল সেই পুরনো জায়গা ঘিরে।
ঘটনা বহুল সময়ঃ
সেই সময়ে শুধু কিন্তু পানি আসার ঘটনাটা মনে রাখার মতো ছিলনা! তখন আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে আমাদের জীবনে যাতে আমরা প্রায় সকলে একপ্রকার আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন ছিল কেন এইসব ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটছে? নাকি প্রকৃতি কোন কিছু আগে থেকে জানান দিচ্ছে? অথবা এইসব কি না দেখা সেই অপ-দেবতাদের কাজ! এমন দুটো ঘটনার কথা না বললেই নয়।
ঘটনা এক- তখনো কাপ্তাই বাঁধের পানি আসেনি। মাত্র আসবে আসবে করছে। সম্ভবত ১৯৫৯ সালের কথা সেটা। ইংরেজির মাসের নাম মনে নেই। তবে বাংলার মাসের নাম মনে আছে। বাংলা মাস কার্তিক মাসের কোন এক জ্যোৎস্নার রাত, আকাশও ছিল খুব পরিষ্কার, ঝড়েরও কোন লক্ষণ ছিলনা কিন্তু সন্ধ্যার পর পরই, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে প্রচন্ড বাতাস শুরু হয়ে গেল। শুধু শোঁ শোঁ শব্দ করা প্রচন্ড বাতাস। এই বাতাসে মাঝ রাত্রে আমাদের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেল। পরে বাড়ি ভেঙ্গে পড়ল। সারারাত বাতাস বয়ে যাবার পর সকালে বাতাস থেমে গেলে আমরা ভেঙ্গে পড়া বাড়ির বাইরে বের হয়ে দেখলাম গ্রামের অনেক বাড়ি ভেঙ্গে গেছে। বড়রা বলাবলি করছিল এই রকম ঝড়-বৃষ্টিহীন বাতাস তারা জীবনে কখনো দেখেনি। এই বাতাস সম্ভবত দেবতাদের দ্বারা সৃষ্ট। চাকমা ভাষায় “দেউ চল্লে।”
ঘটনা দুইঃ ‘দেউ চলার’ ঘটনা আমার মনে ভীষণ দাগ কেটে দিয়েছিল। এরপর পানি এসে আমাদের জীবন উলোট-পালোট করে গেল। গ্রামের অনেক মানুষ অন্য জায়গা বসতি করতে চলে গেছে। কিন্তু আমরা আমাদের গ্রাম ছাড়িনি। শুধু জায়গা পরির্বতন করেছি মাত্র। এমন সময়ে একদিন আরেকটা ঘটনা ঘটলো। একদিন সকালে দেখা গেলো সারা গ্রাম জুড়ে রং বেরং এর প্রজাপতি উড়ছে। লাল, হলুদ, কালো, সাদা এমনই অনেক রঙের প্রজাপতি উড়ছে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম এই প্রজাপতি ওড়ার দৃশ্য। বিকেল হতেই এই প্রজাপতিগুলো আবার চলে গেল। কোথায় গেল তা কেউ দেখলোনা। শুধু নাই হয়ে গেলো। এই ঘটনার কারণে গ্রামের মানুষরা আবার আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়লো। এইবার আবার কি হতে যাচ্ছে!! কেউ কোনদিন তাদের জীবনে এইরকম দৃশ্য দেখেনি।
ঘটনা তিনঃ আসলে কাপ্তাই বাঁধের পানি আসার আগে প্রকৃতি এক প্রকার জানান দিয়েছিল যে একটা বড় ধরনের বিপদ আসছে। পানি আসার আগে ”বিরেজ”(এক ধরনের পাখি-বাংলায় সম্ভবত ভীমরুপ বলা হয়) সারা রাত দিন করুণ স্বরে ডাক দিতো। ডাকতে ডাকতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যেতো। কিন্তু বিরেজদের দেখা যেতোনা, শুধু তাদের কান্নার শব্দ শোনা যেতো। আর কুকুরের ডাক তো ছিলই। সব মিলিয়ে পরিবশেটা ছিল অমঙ্গলের।
আগেতো বলেছি আমাদের পাশের গ্রামের অনেকে বর-পরং এ চলে গিয়েছে। আমরা একবার সেই মানুষ বিহীণ গ্রামও দেখে এসেছি। ভয়ংকর ছিল সেই অভিজ্ঞতা। পরে শুনেছি বর-পরং যাবার সময় অনেক পরিবার একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেকে মারা পড়েছিলেন যাবার পথে। শোনা কথা, শুধু মানুষ যায়নি দেবতারাও তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল বর-পরং যাবার পথে। এই নিয়ে কত গল্প কত কথা।
বিজু উৎসবের স্মৃতিঃ
আমাদের সময়ের বিজুর দিন গুলো ছিল আনন্দের। এই সময়ের মতো কোন আতংক ছিল না। আমরা তখন বাংলা মাস দিয়ে বিজুর দিন হিসেব করতাম। ফাগুন আভা/ফাগুনের বাতাস মানেই তো বিজু আসা। ফুল বিজুর দিন হতেই আমরা বিশেষ করে মায়েরা ছড়াতে গিয়ে গঙ্গা মা’র উদ্দেশ্যে বাতি দিতেন তিন দিন ধরে। আর ফুল তুলে ভোর বেলায় সূর্য ওঠার সময় আমরা সবাই ফুল দিতাম ছড়াতে। ফুল বিজুর দিন ভোর বেলায় আমরা ছড়াতে, নদীতে স্নান করতে যেতাম। এই স্নান করাকে বড়রা বলতো ‘বিজু গুলো হানা’। এখনতো বাচ্চারা ”বিজু গুলো” কি সেটা জানে না।
তারপর মূল বিজুর দিন সকাল বেলায় আমরা যারা ছোট তারা নিজেদের বাড়ির কিছু ধান নিয়ে গ্রামে বেরিয়ে পড়তাম অন্য বাড়িতে থাকা মুরগী হাঁসদের ”আধার/ খাদ্য” দেবার জন্য। এটি ছিল একটা উৎসবের মতন। দল বেঁধে হাঁস-মুরগীদের ”আধার” দিতে যাওয়ার সময় কী যে আনন্দ ছিল তখন। অবশ্য আগে নিজেদের বাড়ির হাঁস-মুরগীদের ”আধার/ খাদ্য” মানে ধান বা চাল দিয়েই তবে অন্য বাড়িতে যেতাম। এটাই ছিল নিয়ম। চেষ্টা করতাম যেন গ্রামের সকল বাড়ির হাঁস মুরগী আমার বাড়ির ”আধার/ খাদ্য” থেকে বাদ না যায়। এই করতে করতে বেলা বেড়ে যেতো। যে বাড়িতে আগে পাজন তোন/পাচন তরকারী রান্না হয়ে যেতো সেই বাড়ির মুরুব্বীরা আমাদের ডেকে বলতেন বিজু হয়ে গেছে, বিজু খেয়ে যাও। চল্লিশ/এক চল্লিশ পদের তরকারী আর শুকনো পোয়া মাছ, শুটকী দিয়ে এই পাজন রান্না হতো। তার সাথে নানা ধরনের পিঠা আর মিষ্টি সিরাপ। কোন কোন বাড়িতে বড়া পিঠা, সান্নে পিঠার সাথে বিনি ভাত থাকতো সাথে আমাদের মতো ছোটদের জন্য জোগারাও (এক ধরনের মদ, যা শুধু মাত্র বিজু উৎসবের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী করা হয়) বরাদ্দ থাকতো (হাসি)। অথবা কোন কোন বাড়িতে আমরা ‘মদ’ খেতে চাই কিনা জিজ্ঞাসা করতো। মদ হচ্ছে বড়দের জন্য। আসলে বিজু মানে হচ্ছে সব কিছু থেকে মুক্তি।
আর গজ্যা পুজ্যা দিন ছিল বড়দের পায়ে ধরে প্রণাম করে আর্শিবাদ নেয়ার দিন। ছোট বেলায় দেখেছি আমার মা এই দিনে ”মা লক্ষীকে” পূজা দিতেন। আর গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বীদের দুপুরের ভাত খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করতেন। অনেক গ্রামে এই বিজু উপলক্ষে ”দলী” ফেলতো মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক মঞ্চস্থ হতো। সে ছিল এক দেখার মতো।
আমাদের সময়ে গ্রামে কোন বৌদ্ধ মন্দির মানে হিয়ং ছিল না বললেই চলে। শুধু জানতাম আমরা জাতিতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি। কিন্তু ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কোন বুদ্ধ মূর্তি বা বুদ্ধ ছবি আমি দেখিনি। মাকে এবং অন্যান্যদের দেখতাম অসুখ বিসুখে বা এমনিতে মা গঙ্গাকে পূজা দিতে, মা লক্ষীকে পূজা দিতে। এখন প্রায় সব গ্রামে গ্রামে হিয়ং দেখা যায়। এটাও অনেক পরিবর্তনের লক্ষণ।
সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান: সিডনী ।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে
Leave a Reply