ক্যান উই ফাইট রেপ কালচার উইথ ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট ?

ফেব্রুয়ারি ২, ২০২১

সায়দিয়া গুলরুখ: আজ সারাদিন এই নিউজটাই মাথায় গেঁথে আছে? “শহীদ মিনারের কাছে কিশোরীর বিবস্ত্র লাশ’ গ্রেপ্তার ১

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: আমি দেখিনি খবরটা, এখন মাথা শূন্য হয়ে গেল।

সায়দিয়া গুলরুখ: “Failing to rape, man kills teen: Victim’s friends tell cops; forensic expert finds marks of strangulation

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: ফেইলিং টু রেপ বলছে কেন?

সায়দিয়া গুলরুখ: আল্লাহ জানে?

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: নিউজের ভেতরে লেখা মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। ময়নাতদন্ত না হলে নাকি বলতে পারবে না!

সায়দিয়া গুলরুখ: তাই ভেবেছিলাম আজকে মর্গে যাই একবার। মর্গের কর্মরত যারা আছেন তারা হয়ত কিছুটা ধারণা দিতে পারত।

আমার আজকাল দেশের জন্য আত্মত্যাগের এই গানগুলো নতুন করে সাজাতে ইচ্ছা করে…

আমার বোনের রক্তে রাঙানো ’২১-এর ফেব্রুয়ারী                                                      
কেউ কি রাখিবে মনে?
কেবা গাইবে,
“আমি কি ভুলিতে পারি?”

ভুলে যাওয়ার এই জমানায় 
নভেরার যত্নে গড়া
শহীদ বেদির মাটি কাঁদবে
উন্নয়নের ধুলোয় সিক্ত
কাঁঠাল গাছটি
রাখবে মনে
জাগবে বসুন্ধরা
ঘুমাবে মিম

ভুলে যাওয়ার এই জমানায়
স্বাধীন দেশ
শহীদ বেদি
ধর্ষকের উল্লাস
আমার বোনের রক্তে রাঙানো ’২১-এর ফেব্রুয়ারী
কেউ কি রাখিবে মনে?
কেবা গাইবে,
“আমি কি ভুলিতে পারি?”

চারিদিকে যত চেতনার বিক্রি-বাটা
আমার বোনের রক্তে রাঙানো ২১’-এর ফেব্রুয়ারী
কেউ কি রাখিবে মনে?
কেবা গাইবে,
“আমি কি ভুলিতে পারি?”

আনমনা প্রিয়দশীনি: ইস কি সুন্দর কঠিন সত্যি কথা। 

সায়দিয়া গুলরুখ: আমাকে একটা ছবি এঁকে দেন না, এই নিউজটার প্রেক্ষাপটে আপনার যেমন ইচ্ছা। একটা ই-কার্ড বানাবো।

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: ছবি ইমেইল করেছি, পেয়েছেন?

সায়দিয়া গুলরুখ: ছবি পেয়েছি। আপনার রঙের ব্যবহার, আমার অমর একুশের গানের জমিনে শব্দ বসানোর চেষ্টা নিয়ে ভাবছি। ভাবছি, শহীদ বেদিতে ধর্ষণের চেষ্টা, তারপরে হত্যা, সে কারণে যে অনেকে, এমনকি আমিও নাড়া খেলাম, তার কারণ কি আমাদের কোনো স্যাক্রেড প্রত্যাশা ছিল ফ্রম দ্য শহীদ বেদি, এখানেই তো রাতে বেশ্যারা খদ্দের  নেয়। ঘরহীন মানুষেরা নাকি নেশা করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বয়ানে ভর করে লেখা এবং ছবি ধর্ষণের প্রতিরোধ হিসেবে কতটা কার্যকর?

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: এই যে পবিত্র বা জাতীয় স্পেসের ধারণা, কিংবা আমার আপনার নাড়া খাওয়া, জাত গেল বলে আহাজারী সেগুলো আদতে কিছু ধর্ষণকে জায়েজ করে তোলে, আর কিছু ধর্ষণ হয়ে পড়ে কম অপরাধের বিষয়। যেই মাত্র ধাক্কা খাচ্ছি এই ভেবে যে বেদিতে ধর্ষণ বিশাল পাপ…সেই মাত্র লাকিংমে কিংবা অর্নার ধর্ষণ কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে। স্থানের রাজনীতির সাথে ধর্ষণের রাজনীতিকে যুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ।

ফেব্রুয়ারি ১৬

সায়দিয়া গুলরুখ: দুটো প্রতিবাদের সাথে সংহতি জানিয়ে একটা প্রশ্ন করি। ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে ৩১শে জানুয়ারি রাতে। পরদিন ১লা ফেব্রুয়ারি প্রীতিলতা ব্রিগেড শহীদ মিনারে একটি মানব বন্ধন করেন। এই মানববন্ধনের ব্যানারে লেখা ছিল, ”স্বাধীনতা তুমি শহীদ মিনারে পড়ে থাকা আমার বোনের লাশ।”

আলোকচিত্র: বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা

দ্বিতীয় প্রতিবাদটি আরও দুইদিন পরের। ৩রা ফেব্রুয়ারি। আমাদেরই এক বন্ধু সহযোদ্ধা শহীদ মিনারের এমাথা-ওমাথা বিশাল ব্যানারে ”স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এখানে কিশোরী ধর্ষণ ও খুন হয়” লিখে টাঙিয়ে দিয়ে আসল। দুটো প্রতিবাদই আমার ক্ষোভকে ধারণ করেছিল। কিন্তু ঘটনাটির সাথে সময় যত দূরত্ব তৈরি করছে ততই ভাবছি — ”স্বাধীন রাষ্ট্রে এমন হওয়ার কথা ছিল না” — এই জায়গা থেকে অবাক ও ক্ষুব্ধ হওয়াটার একটা মুশকিল আছে।

আলোকচিত্র: সংগৃহীত

স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের কল্পনায়তো নারী বা জেন্ডার-বাইনারির বাইরের কোনও মানুষের জায়গা ছিল না। বাঙালী জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাতো খুব জেন্ডারড। আমরা ভুলে যাচ্ছি ‘৭১ বিজয়ের মধ্যে দিয়ে একটি পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রই গঠিত হয়েছিল, হয়েছে। এই দেশের বীরাঙ্গনাদের অভিজ্ঞতাতো তাই বলে। সার্বভৌম ভূখন্ড অর্জন আর নারীর স্বাধীনতা বা লিঙ্গীয় বৈষম্যের অবসানতো এক কথা নয়। তাহলে আমরা কেনও ভাবছি ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট দিয়ে ধর্ষণের সংস্কৃতিকে আঘাত করা যাবে? ক্যান উই ফাইট রেপ কালচার উইথ ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট ?

ফেব্রুয়ারী ১৭

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: খুবই কাজের প্রশ্ন। এখানে আমার দুটো ভিন্ন কিন্তু কানেকটেড উত্তর আছে। একটাতে আমি আপনার দ্বিধা থেকে দূরে সরে যাই, আরেকটাতে আপনার পজিশনকে পাকাপোক্ত করি। প্রথমত, কথা বলি আপনার কবিতা আর আমার ছবি নিয়ে।
“আমার বোনের রক্তে রাঙানো ২১’-এর ফেব্রুয়ারী
কেউ কি রাখিবে মনে?
কেবা গাইবে,
“আমি কি ভুলিতে পারি?”
এই কবিতা পড়ে কিন্তু আমার মনে হয়নি যে আপনি ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট দিয়ে ধর্ষণের বিচার বসাচ্ছেন। বরং আমার মনে হয়েছে এখানে একটা বিস্মৃতির কথা আছে  … দিনের পর দিন চেতনা বিক্রি করে, পুরুষ শহীদদের নিয়ে ধান্দাবাজী করে, উন্নয়নের পুরুষ পুরুষ গল্প শুনিয়ে আমরা আড়াল করেছি, করছি নোংরা গল্প গুলো, হেরে যাবার গল্প গুলো, আমার, আপনার মতো কোটি কোটি মা, বোন,  স্ত্রী, সন্তান, মেয়ে, নারীদের গল্পগুলো। আপনার কবিতা জানান দেয় যে জাতীয় ইতিহাসে, প্রতিদিনকার জাতীয় গল্পে আমরা নেই। জাতীয় এই বিস্মৃতিকে ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট-এর বাইরে গিয়ে তো বুঝতে পারবেন না। আমার ছবিটাও তাই। ছবিটা কি বলে আপনার কাছে? আমিও ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট দিয়ে ধর্ষণের সংস্কৃতিকে বোঝার বা যাচাই করার পক্ষে সমস্যা দেখি। তবে কেন এই ছবি? কেন এই শহীদ মিনার? ছবিতে শহীদ মিনারটাকে চেনা যায়, মানে যেমন ভাবে আমাদের চেনানো হয়? ভোরের আলোতে যেই ঝকঝকে মিনার দেখেন, সেই মিনার, তার গরাদ, পেছনে লাল টুকটুকে সূর্য তো এই অন্ধকারের মিনারে নেই। এই মিনারের ছবি আমরা দুই চোখ বুজে যেই মিনারকে ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করি সেই অন্ধকারের মিনার  … এখানে একজনের ধর্ষণের কোনো গল্প নাই, আছে বছরের পর বছর হাজার হাজার নারীকে, শিশুকে, কিশোরীকে উলঙ্গ করার গল্প, এই রাতের মিনার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় নারীরা কতোটা মৃত, বিস্মৃত।

সায়দিয়া গুলরুখ: শুধু নারী নয়, যে কোনো বয়সের পুরুষ এবং ‘হিজড়া’রাও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, প্রতিরোধও করেছেন। ২০১৯ সালে গাজীপুরের এক যুবক, পেশায় ব্যাবসায়ী, চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে পাড়ার গুন্ডারা ধর্ষণ করে সেটার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়। যুবকটি পরে আত্মহত্যা করেন । এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা তখন পর পর নিউজ হয়েছিল। সরি, আপনি বিস্মৃতির রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছিলেন ।

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: খুব ভালো হলো যে আপনি আরেকটি বিস্মৃতি তুলে ধরলেন। এই যে ধর্ষণকে আমরা একচেটিয়া নারীর অভিজ্ঞতা হিসেবেই বুঝি এটাও তো বিস্মৃতি। অথচ হিজড়া, এবং যেকোনো বয়সী পুরুষদের ধর্ষণের অভিজ্ঞতাতো কম কিছু নয়। কি আপ্রাণ চেষ্টা আমাদের এসব শরীর ছেঁড়ার গল্পগুলোকে জাতীয়তাবাদী গল্প থেকে আড়াল করার। অথচ হরদম নেংটা করা হচ্ছে সবাইকে।

মিনারটাও নেংটা  আমাদেরই মতো। এই জঞ্জালে ভরা নোংরা মিনারকে বুঝতে হলে ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট কিভাবে একটা স্যাক্রেড মিনার, সৌধ দাঁড় করায় আমাদের সামনে, আর হাপিস করে নেংটা মিনারটাকে সেটা বোঝা লাগবে। সোজা কথায় ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্টের চোখ দিয়ে নয় কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই বিশাল বিস্মৃতির রাজনীতি বোঝা জরুরি।

সায়দিয়া গুলরুখ: আপনি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে ঢোকার আগে আমি একটু নোকতা দেই এখানে।  এই শহীদ মিনার আর তার জাতীয়তাবাদী ইতিহাসতো বিস্মৃতির জমিনেই লেখা। স্বাধীন বাংলাদেশ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখলো ভাস্কর নভেরা আহমেদের নাম মুছে দিয়ে, যিনি এই মিনারের রূপকার। বিস্মৃতির চর্চা জাতির ইমেজ নির্মাণ ও রক্ষার অন্যতম পূর্বশর্ত। শহীদ মিনারে ধর্ষণের চেষ্টা ভুলে না গেলে এর মহিমা উদযাপন করা যাবে না, তনু ধর্ষণ ও হত্যা ভুলে না গেলে সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমের গল্পে ভাটা পড়বে।

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: একদম ঠিক কথা বলেছেন। এই যে শহীদ মিনারে বা মিনার এলাকায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্ট টগবগ করছে তা নিয়ে দ্বিতীয় উত্তরটা দেই। ওই দুই স্লোগানে আমিও নাড়া খেয়েছিলাম। ফেসবুকে শেয়ারও করেছিলাম। আপনার সাথে সেদিনের কথা বলার পর এই স্লোগানের মুশকিলগুলো সামনে আসলো। ভেবে দেখলাম আমাদের প্রতিবাদের ভাষাও কিন্তু ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্টে নারীর উধাও হওয়াটাকেই  বৈধতা দেয় ঠিক যেমনটা আপনি বললেন। ”স্বাধীনতা তুমি শহীদ মিনারে পড়ে থাকা আমার বোনের লাশ।” কোন বোন এ? শুধু সেই কিশোরী মেয়ে যার লাশটা মিনারের কাছে পড়ে ছিল, যার লাশ আর আড়াল করা গেলো না? বাকি যাদের লাশ দেশ জুড়ে পরে আছে, বা যারা লাশ হলো না, কিন্তু ধর্ষিত হলো তাদের জন্য এই “স্বাধীনতা তুমি” স্লোগান না। এই স্লোগান স্পেশ্যাল খাতির করে সেই নারীর লাশদের যারা জাতীয় স্যাক্রেড স্পেসে পড়ে থাকে। কিংবা “স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এখানে কিশোরী ধর্ষণ ও খুন হয়” — এই স্লোগান এতো বছর ধরে যে এতো ধর্ষণ, খুন, গুম হলো সেগুলোর হিসাব রাখতে চায় না। এই স্লোগান পঞ্চাশ বছর পর যেই ধর্ষণটা আর লুকানো গেলো না, খুনটা আর ধামা চাপা দেয়া গেলো না সেটারে নিয়ে কান্না করে। এখানেও দেখেন বিস্মৃতিকে বৈধতা দেয়া। এই দুই স্লোগান আর আপনার কবিতা, আমার ছবির মধ্যে আমি বিস্তর পার্থক্য দেখতে পারি।আমাদের তুলিতে, কবিতায় বিস্মৃতির পেছনের গল্পটাকে তুলে ধরা হয়েছে। আর স্লোগানে বিস্মৃতিটাকেই পাকা পোক্ত করা হয়েছে। ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্ট দিয়ে ধর্ষণের বিচার চাওয়ার সমস্যা স্পষ্ট হয় এই স্লোগানে। 

সায়দিয়া গুলরুখ: ধর্ষণের স্থান-কাল-পাত্রভেদে পাবলিক প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হয়, এক্ষেত্রে  প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ক্যাটালিস্ট হিসেবে ধর্ষণের স্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো । 

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: হুমম। এইটা আসলে একটা ক্লাসিক সমস্যা। আপনি ভাবছেন ওই প্রতিবাদ গুলো বোঝাতে চাচ্ছে যে “স্বাধীন রাষ্ট্রে এমন হওয়ার কথা ছিল না” । হতে পারে  … কিন্তু তাহলে ধরেন যখন অর্না ধর্ষিত হলো বা অন্য কেও, তখন কি এমন ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করেছেন? আমার মনে হয় সমস্যাটা আরেকটু অন্যরকম। আমরা আমাদের জাতীয় পিতৃতান্ত্রিক পরিচয় দাঁড় করাই কিছু বিমূর্ত, একপেশে, কানামাছি সত্য, কানামাছি মিথ্যা টাইপ গল্প দিয়ে। সেই গল্পের চেহারা দেই মিনার, সৌধ তৈরী করে। দেশ উচ্ছন্নে যাক, রাতের অন্ধকারে নোংরা, আবর্জনা, নেশার বড়ি, ইনজেকশনে সয়লাব হোক কিংবা ধর্ষক বা খদ্দেরের স্পার্মে ভিজে যাক এই সব পবিত্র স্থান, সারা বছর এদেরই গা ঘেঁষে বেঁচে থাকুক উদ্বাস্তু গৃহহীন মানুষেরা  … আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। আমরা নেশার আড্ডা, কড়া দারিদ্রতা, রগরগে দেহ ব্যবসা আড় চোখে দেখি, চুপ থাকি। কিন্তু স্যাক্রেড দিনে, স্যাক্রেড মাসে এদের ধবধবে পরিষ্কার থাকা চাই। ৩১ জানুয়ারীর ধরা পড়ে যাওয়া ধর্ষণ স্যাক্রেড স্পেস এর যে ফকফকা মিথ সেই মিথের গালে কষে থাপ্পড় মারে। এই শেষ মুহূর্তের ধর্ষণ মিনারটাকে পরিষ্কার হবার সময় দেয় না। রাত পোহালেই মহান ফেব্রুয়ারী আসে। গেঞ্জামের শুরু তখনই। এই নির্দিষ্ট ধর্ষণ যে ‘স্বাভাবিক’ ধর্ষণ না, হরদম ঘটনা না সেটা বোঝানো আমাদের নিজেদের লজ্জা ঢাকার জন্য খুব জরুরি হয়ে পড়ে। আমাদের বাঙালি, মধ্যবিত্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহন করা মন প্রতিবাদী হয়ে জানান দিতে চায় যে “এই ধর্ষণ স্বাধীনতা বিরোধী ধর্ষণ,” “কিংবা ৫০ বছর পর হয় এমন একটা ধর্ষণ।”  

সায়দিয়া গুলরুখ: আপনি নিশ্চয়ই  বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় আঘাতকারী  ধর্ষণ বলছেন, তাই না? যে ধর্ষণটা শহীদ মিনার থেকে দূরে কামরাঙ্গীরচর বা সাভারে ঘটে, বা দেশের নানা প্রান্তের অর্ডিনারি স্পেসে ঘটে, সেগুলো একইভাবে চেতনায় আঘাত করে না।

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: একদম তাই।এই ধর্ষণ, চেতনায় আঘাত লাগা ধর্ষণ। একে না পারে জাতি অগ্রাহ্য করতে, না গিলতে। সমাধান হিসেবে জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্ট দিয়ে এর বিচার বসায়। তো প্রশ্ন হলো ভিন্ন কি করা যেতে পারে? রাষ্ট্র, এর স্থান, এর চেতনা যে ভীষণ পুরুষালী সেটা বোঝানোর নতুন ভাষা, তরিকা খোঁজা যেতে পারে ।জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্টকে  ভিন্নভাবে রিক্লেইম করা যায় না? স্যাক্রেড স্পেসের মিথ ভেঙে দেয়া যায় না? স্থানের রাজনীতিটাকে ধর্ষণের রাজনীতির সাথে যুক্ত করা যায় না? ধরেন একটা স্লোগান উঠলো — “স্বাধীনতা তুমি সেই শুরু থেকেই শহরে, মিনারে, খোঁয়াড়ে, মাঠেতে পড়ে থাকা আমার বোনের লাশ।”

কিংবা, ধরেন

“এ মিনার ভাষা শহীদের মিনার, এ মিনার ধর্ষিতার, ‘বেশ্যার’ বধ্যভূমি”

এই স্লোগানগুলো কিন্তু মেনে নেয় যে রাষ্ট্র ও তার স্বাধীনতার সাথে নারীর স্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেই, যেমনটা আপনি বললেন। এই স্লোগান কোনো নারীর লাশকে, কোনো নারীর বঞ্চনাকে মুছে ফেলে না, আবার একই সাথে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় মিনার কিভাবে খোঁয়াড় থেকে ভিন্ন নয়, সে তার স্যাক্রেডনেস হারিয়ে ফেলেছে জন্ম থেকেই।জাতীয়তাবাদী একপেশে, নারীকে বাদ দেবার সেন্টিমেন্টকে যদি ইনক্লুসিভ, জেন্ডার সেনসিটিভ কোনো সেন্টিমেন্ট দিয়ে ধোলাই দেয়া যায় তাইলে মন্দ কি? 

সায়দিয়া গুলরুখ: আমি ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্টকে রিক্লেম করতে চাই না, জাতিরাষ্ট্রের কল্পিত সীমানায় আমার দমবন্ধ লাগে কিন্তু আপনার স্লোগানগুলো আমার খুব পছন্দ হইসে, বিশেষ করে এই কথাগুলো, “স্বাধীনতা তুমি সেই শুরু থেকেই শহরে, মিনারে, খোঁয়াড়ে, মাঠেতে পড়ে থাকা আমার বোনের লাশ।” এই স্লোগান নিয়ে আমি দাঁড়াতে চাই। আসেন, এই দফা আলাপে ফুল স্টপ এখানে দেই।

ফেব্রুয়ারী ১

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: ইস তীরে এসে তরী ডুবালাম। আলাপে তো ফুলস্টপ মারা গেলো না। “জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্টকে ভিন্নভাবে রিক্লেইম” করার কথা লেখার পর থেকেই মনটা খচখচ করছিলো। হয়তো জাতীয়তাবাদী গল্পের উল্টো কোনো গল্প বানানোর কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আপনিই ঠিক। জাতীয়তাবাদ, সেটা সোজা হোক, উল্টা হোক সবসময়-ই কোনো না কোনো পক্ষকে বাদ দেবেই, সেই গল্পে কেউ না কেউ বিস্মৃত হবেই। তাই জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্টের যেকোনো ভার্সনই অকেজো। তারে আমিও বাদ দিলাম। তার চাইতে জাত, ধর্ম, শ্রেণী, লিঙ্গ, ভিন্ন যৌনতা, পবিত্র-অপবিত্র স্থান, কাল, পাত্র সকলকে ধারণ করতে পারে এমন ইনক্লুসিভ সেন্টিমেন্ট, ভাষা, প্রতিবাদ দাঁড় করাই চলেন। এইবেলা সত্যি সত্যি ফুল স্টপ দেই। টাটা ।



Categories: কথোপকথন, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ

Tags: , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: