তোমার মন নাই, কুসুম?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অতিথি ব্লগার

নিজের মন নিয়ে কি নারী ভাবেন? প্রতিদিনের খারাপ থাকাটা মেনে নিয়েছেন? কাজে মন দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবছেন? তারা কি জানেন,  “নারীরা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন বেশি, কিন্তু চিকিৎসা পান  পুরুষদের তুলনায় কম? ”(১)

২৪ মে বিশ্ব সিজোফ্রেনিয়া দিবস গেলো। সিজোফ্রেনিয়া সচেতনতা সপ্তাহও গেলো। বর্তমান সময়ের অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতায় বিশ্বব্যাপী রোগটি বাড়ছে। পুরুষের তুলনায় নারীর  নিরাপত্তা বিষয়ক দুশ্চিন্তা বেশি থাকে। তাদেরকে  কীভাবে এরকম পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হবে, এর উপর বাংলায় তেমন কোনো লেখাই পেলাম না!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগজনিত অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া। তাঁরা সম্মানহীন এবং বন্ধুহীন ও আত্মীয়হীন জীবনযাপন করেন। শিক্ষার সুযোগ হারান, চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন, শারীরিক সুস্থতা নষ্ট হয়, চেহারা বিনষ্ট হয়। সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে যায়, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ জীবন বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। স্ট্রোকও ব্রেনের একটি রোগ, সিজোফ্রেনিয়াও ব্রেনের একটি রোগ। অথচ সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের পাগল বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, অপমান করা সহ চিকিৎসা বঞ্চিত রাখা হয় (২)।

এ লেখায় আমি কোনো  উপাত্ত টানবো না।

২০১৭ সাল। একটা  অফিসে জয়েন করেছি। কিছুদিন যাবার পর দেখি, ফোকাস করতে পারছি না। ছাত্রী জীবন থেকেই কোনো রকমের ব্রেক না নিয়ে  ছোট বড় কাজ করছি। নিজের প্রতিষ্ঠানও দাঁড় করিয়েছি। ডেডলাইন আসলে অমানবিক চাপ এবং জীবনযাপনে অনিয়ম নিয়েই কাজ করি। থামতেই জানি না। বিষন্নতাও আসে। সম্পর্কের উঠতি-পড়তি, নেতিবাচক ঘটনার সাথে,সে সব যতটুকু সম্ভব কাটিয়ে উঠতে পারি। অন্তত কোনো গ্লানি রাখি না।

নতুন অফিসের কাজ শুরু করার পর দেখতাম সহজ কাজগুলোও করতে পারছি না। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাজ করছি, শেষ হচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চলে গেলে কিছুদিন ঠিক হয়, কিন্তু আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। একেক সময় মনে হতে থাকে, আমাকে কেউ অনুসরণ করছে। শুরুটা হলো ফেসবুক আইডি হ্যাকড হয়েছে এই সন্দেহে। পারসোনাল হাইজিন মেনে চলতে ইচ্ছে করতো না।

মিলে যাচ্ছে না লক্ষণগুলো? কিন্তু তখনো রোগটা ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে যায় নি। যদি রোগীর কমপক্ষে ৬ মাস সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ থাকে তাহলেই  তার রোগটি আছে বলে ধরা হয়।

আমি ভাবতাম আমি বোধহয় মেলানকোলিক, ক্লান্ত।  

এর মধ্যে ফেসবুকে একটা লেখা ভাইরাল হয়ে গেলো,  ফলোয়ার তৈরি হলো। এই চাপ আমি নিতে পারলাম না।

লেখালেখির জন্য ফেসবুক আইডি রিপোর্টেড হবার পর এক ধরণের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি হলো। ব্যাপারটা সামাজিক- সাংস্কৃতিকভাবে খুবই নেতিবাচক।

সোশ্যাল মিডিয়া আমার জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠলো। কিছু লিখতে গেলেই বিভিন্ন জায়গা থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসতো। কেমন একটা ভারী পরিবেশ। লেখার জন্য নিজেকেই দোষ দিতাম।

এরপর শুরু হলো ইউফেমিজম সহ সাইবার বুলিয়িং। দিনের পর দিন ধরে সেই প্রক্রিয়া চললো ৷ ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া, উদ্দেশ্য প্রণোদিত কমেন্টারি, ইমোশন নিয়ে বিনোদন। কাছের মানুষরাই করতো একজোট হয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাদের মধ্যে একজন আবার নারী, ভিডিও কলে যৌনতা বিষয়ক বাজে কথা বলত!

এক সময় তাদের একজন স্বীকার করে, পরক্ষণেই অস্বীকার করে। তাদের ভুলের ফলাফল আমার উপর চাপিয়ে দেয়।  সত্যি- মিথ্যা -মিথ্যা -সত্যির বনে বনে ঘুরতে থাকে ভূতগ্রস্ত ছায়া।

এই যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব,ভিক্টিমাইজেশন, তা আমার চিন্তা ভাবনাকে, সিদ্ধান্তকে দ্বিধা বিভক্ত করে দেয়, আমার আগের বিষন্নতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

আমার সাইকোসিসের এপিসোড শুরু হয়ে গেলো ব্যক্তিত্ব ও আচরণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

নেতিবাচক মানুষগুলোকে ফিরিয়ে দেয়ার পরেও তাদের কাছে যাই,যোগাযোগ করি। নিজের সিদ্ধান্তে ঠিক থাকতে পারি না।  প্রফেশনাল দায়িত্ব নিতে পারি না। সময়মত কাজ করতে পারি না। ডেডলাইন ধরতে পারি না। রাত দিন নিজেকে প্রতারিত মনে হয়।  একসময় ডেইলি লাইফ বাধাগ্রস্ত হয়ে গেলো। অনেকে আমার কথা ধরতে পারে না।  অনেকে না বুঝেই রাজনীতি করে।

মনের এই ভেঙে যাওয়ার বিষয়টাই বলা হচ্ছে- skhizein বা To split. অনেকে এটাকে স্প্লিট পারসোনালিটি , ডুয়াল পারসোনালিটি বলে ভুল করে। এখানে split মানে আমাদের মনের অনুভূতি (Emotion), চিন্তার ধরণ ( cognition), এবং ব্যবহার বা আচরণের (Behavioural) এই তিনটার মধ্যে যোগাযোগ বা সমন্বয় ভেঙে যাওয়াকে বোঝায়।

এই ভাঙন কিন্তু মানুষের খুব আলগোছে, অবচেতনে  তৈরি হয়, “আপনি বাচ্চাকে বলছেন মিষ্টি নাও, কিন্তু চোখের ইশারায় বলছেন মিষ্টি নিলে অসুবিধা আছে, এই দুরকমের কথা থেকে তৈরি হয়” (৩) ।

সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে না সহজে। যারা আমার সঙ্গে থাকতো এরাও বুঝতে পারে নি।

আমার ব্যাপারে  বেশিরভাগের  ধারণা ছিলো, আমি স্ট্রং,কোনোকিছু আমাকে স্পর্শ করে না। ইচ্ছা করে মানুষের সাথে আমি নিষ্ঠুর আচরণ করি।এইসব আমার বড়লোকি খামখেয়ালি। টাকাপয়সার চিন্তা নেই বলে পাগলামি করে বেড়াই। মুড ডিজঅর্ডারকে ভাবতো সৃষ্টিশীল উর্বর মস্তিষ্কের ভাবনা। একদিনের ঘটনা মনে পড়লো, সারা বাসা শূন্য, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি সুইসাইড করবো। এক সিনিয়রকে সেটা জানালাম। তিনি বললেন,একটা শুক্রবার দেখে সুইসাইড করিস।

বাসায় ছোট বোন চলে আসলো দেখে আর সুইসাইড করা হলো না।

অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। সবাইকে সন্দেহ করছি,শত্রু ভাবছি।

ঢাকা আমার জন্য নরক হয়ে উঠলো। বাসার দায়িত্ব ফেলে আসতেও  পারছি না। শেষে এক আত্মীয়া আমাকে জোর করে ঢাকা থেকে নিয়ে আসলেন। 

হেলথ এন্ড সোসাইটি কোর্সে পড়তাম, বিশ্বের সকল দেশের নারীদের হেলথ সীকিং বিহেভিয়ার (সোজা বাংলায় যে কোনো রোগে  ডাক্তার দেখাতে যাবার প্রবণতা) বেশ খারাপ। সহজে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। উচ্চমূল্যের চিকিৎসা পদ্ধতি নিতে চান না। নিলেও অল্টারনেটিভ ট্রিটমেন্ট সিস্টেমের দিকে যান, হোমিওপ্যাথি,  কবিরাজি, ঝাড় ফুঁক ইত্যাদি।

আমার চিকিৎসাও শুরু হল স্পিরিচুয়াল ট্রিটমেন্ট মেথড দিয়ে। এক নারী জ্বিন আনতেন, তিনি বললেন এগুলো জাদু টোনার প্রভাব, ভালোবাসার তাবিজ সংক্রান্ত সমস্যা। তাকে ভুয়া প্রমাণ করার ফলে তিনি মোটামুটি সবার কাছে বলে দিলেন আমি একজনের সাথে শুয়ে এসেছি, সে আমাকে ছেড়ে গেছে দেখে এই অবস্থা।

আত্মীয়স্বজন আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করতেন, আমার গোপন কোন বিয়ে আছে কি না। মাল্টিপল সেক্স পার্টনার আছে কি না। এসকর্ট নিয়োগ দেয় এমন কোনো গডমাদারের সাথে যুক্ত আছি কি না। এরকম কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম কি না ইত্যাদি।

প্যানিক অ্যাটাকের পর মোটামুটি সবাই ধারণা করলো যে আমার ব্যাপার স্যাপার শুয়ে আসা সংক্রান্ত। কেউ কেউ বলতে আসলেন, বিয়ে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।

অফিস থেকে টারমিনেশন লেটার আসে। এডিটিং  প্যানেলে বসে ওই অবস্থায়ও  অফিসের ফুটেজ দেখছি!

ক্যারিয়ার ফেলে কেন এসেছি এজন্য বাসায় প্রথমে স্থানই দিলো না। প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতো, কবে ফিরে যাব। এসব আমার অসুস্থতা না, কোনো একটা বই লিখছি, সেটারই গল্প মাথায় ঘুরছে। এর চেয়েও খারাপ অবস্থার ভেতর দিয়ে মানুষ গিয়েছে,আমি কেন পারছি না।

আমি হয়তো সিজোফ্রেনিয়ার অন্যান্য রোগীদের মতো বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াইনি, কিন্তু গৃহহীনতার যন্ত্রণা কেমন হতে পারে, ততদিনে জেনে গেছি।

বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন, ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা ফোন দিয়ে তাগাদা দিতেন ফিরে যেতে। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ  কাজের, চাকরির  প্রস্তাব পেলাম, ফিরিয়ে দিলাম।

কিছুদিন অসুস্থ থাকি, আবার স্বাভাবিক হয়ে যাই। কেউ ধরতে পারে না।

বাসা থেকে কোথাও বের হতে দিতে চাইতো না। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ফেলে কী করছি আর আমি অসংলগ্ন উত্তর দেই, বিয়ের প্রস্তাব আসা বন্ধ হয়ে যাবে। বাসায় বন্দি থাকতে থাকতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়লাম।

এরপর লেখালেখি বন্ধ করার জন্য রীতিমতো মানসিক অত্যাচার করা হতো। 

আমার পরিবার কিন্তু মেইল ডমিনেটিং না, এটা খারাপ সময়ের সুযোগ নিয়ে পুরুষ আত্মীয়দের অভিভাবকত্ব করার চেষ্টা, প্রভাব খাটানোর প্রবণতা৷

আমি একটা ছেলে হলে আমার লেখালেখির উপর এই নিষেধাজ্ঞা সেভাবে আসতো না।

সবচেয়ে কষ্ট হতো পিরিয়ড হলে। ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হবে, এটা মাথায় থাকতো না। শীতের দিন লেপ, তোষক সবকিছুতে রক্ত লেগে যেতো। কেউ কাছে আসলে বিরক্ত হতাম। কাপড় ধুতে চাইতাম না। ওই অবস্থায়ই সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকতাম। খাবার সময়ে উঠতাম। সারারাত দুঃস্বপ্নে জেগে থাকতাম।

বিয়ের কথা চলুক,শারীরিক শাস্তি দিলে,আল্লাহকে ডাকলে ঠিক হবে বলে বলে এক বছর এইভাবেই পড়ে রইলাম।

সাইকায়াট্রিস্ট দেখাতে বাসা থেকে ভয় পেতো, বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে আমি বাসা থেকে ছাড়া পেয়ে পাড়া প্রতিবেশীর বাসার গেইটে পানি ঢালতে লাগলাম।

আমার চিকিৎসা শুরু হয় ২০১৯ সালে। প্রথমে ওষুধ শরীরে মানায়নি।  ডাক্তার বদলে বদলে চিকিৎসা নিলাম।   

ইন্টারনেটে যেসব লক্ষণ বলা থাকে, এর সবটাই কিন্তু সবার হয় না। আমার  অডিটরি হ্যালুসিনেশন, অর্থাৎ গায়েবী আওয়াজ শোনা ইত্যাদি কখনো হয় নি। আমি একা একা কথা বলতাম। মনে হতো স্বপ্নের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর  সব খবর আগাম পেয়ে যাচ্ছি।  সারাটা পৃথিবীতে মেটাফোরের ছড়াছড়ি।

ডাক্তার যখন বললেন আমি অসুস্থ, তখনো কেউ মানতে পারলো না। আমার পরিবার প্রথমবারের মতো মানসিক রোগী নিয়ে দৌড়াচ্ছে। কী করবে জানা নেই।

বাবা মা, আত্মীয়স্বজনের ১০০ জনের মধ্যেও যদি কারো সিজোফ্রেনিয়া না থাকে, একজন এর শিকার হতে পারে।

সবাই ভাবতো একবার ওষুধ ধরলে আর ছাড়তে পারবো না। এতো লম্বা ট্রিটমেন্ট কেন? ডাক্তার তার নিজস্ব ব্যবসার জন্য রোগী ধরে রাখছে। অন্যদের ওষুধের কোর্স লম্বা না, তোমারটা শেষ হয় না কেন? কেউ বাসায় আসলে দেখে কড়া ডোজের প্রভাবে মেয়ে ঘুমাচ্ছে, বিয়ে হবে না। ওষুধপত্র খেয়ে এতোই মোটা হয়ে গেলাম যে তখন চিন্তা শুরু হলো, ছেলেরা স্লিম ফিগার পছন্দ করে। বডি শেমিংও যুক্ত হলো আবছা আবছাভাবে। এতো মোটা হয়ে গিয়েছিলাম যে আগের সব জামা ফেলে দিতে হতো, সব পায়জামা ছিঁড়ে যেতো ।

বিভিন্ন মানসিক ডিজঅর্ডারে ইটিং ডিজঅর্ডার বেড়ে যায়। শুরুতে ছিলো খেতে না পারার সমস্যা, পরে ছিলো ওভারইটিং ডিজঅর্ডার। মনে হতো, আমার বাবা মা যদি খাবার যোগাড় করতে না পারতেন,তখন কী করতাম?  দরিদ্র পরিবারের নারীদের মানসিক সমস্যা থাকলে তাদের অবস্থা নিশ্চয়ই খুব ভয়াবহ হবার কথা।

ওষুধে আমি খুব শান্ত থাকতাম। গালিগালাজ করতাম না। রূঢ় আচরণ করতাম না। মত্ত হাতিকে ট্রাংকুয়ালাইজার দিয়ে শান্ত রাখার মতো। সবাই মোটামুটি বেঁচে গেলো।

ওই অবস্থায় আমি এলাকার একটা বিসিএসের কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। যাতে একটা কিছুতে লেগে থাকতে পারি, সোশ্যাল আইসোলেশন থেকে বের হতে পারি।  সুবিধা হলো জীবন সেখানে অনেক ধীর। স্যুডো ইন্টেলেকচুয়াল, সৃজনশীল ধূর্তামি  নাই। পেশাগত ঈর্ষা নাই। এদের জীবনে বড় কোনো পাওয়াও নাই,  সবাই জীবনযুদ্ধ করে যাচ্ছে।

আমি ভেবেছিলাম আর কখনো লিখতে বা অন্যকিছু করতে পারবো না। ডাক্তারই আমাকে তাগাদা দিলেন, কী ব্যাপার , তুমি স্ক্রিপ্ট লিখবা না? আমাকে একটা চরিত্র দিও।

২০২০য়ের বইমেলায় আমার একটা বই প্রকাশিত হয়। মোড়ক উন্মোচনের দিন ডাক্তার  জানান, তিনি এতোদিন সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করছিলেন!

কেউ সহ্য করতে পারবে না, কিংবা স্টিগমা তৈরি হবে ভেবে হয়তো বলেন নি। এমনভাবে চিকিৎসা করেছিলেন যেন আমার গ্যাস্ট্রিক হয়েছিলো…

ডাক্তার জানালেন, যেহেতু আমার জেনেটিক হিস্ট্রি নাই, একটু বেশি বয়সে ধরা পড়েছে এবং রেসপন্স ভালো ছিলো,  আমার ভালো হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিলো। আরো বললেন, পঁচিশ ভাগ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।

যত আগে চিকিৎসকের কাছে যাবেন, সুস্থ হবার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে ৷ হাসপাতালে থাকতে হবে না, বাড়িতে ইনটেনসিভ কেয়ার নেবার প্রয়োজন কমে যাবে। আমার চার বছর সময় লেগেছে, কারণ আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি।  

মনে হতো এই অবস্থা আর কাটবেই না। খুবই অনিশ্চিত এক যাত্রা। বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়া অবিবাহিত  নারীর  জন্যে, সারাজীবন কাজ করতে চাওয়া এক নারীর জন্যে বড় দীর্ঘ যাত্রা। কিন্তু এরও শেষ আছে।  প্রথমে এতোই অসুস্থ ছিলাম যে ডাক্তার বলেছিলেন ওষুধ কাউকে খাইয়ে দিতে হবে। দুয়েক মাস পর থেকে নিজেই পারতাম। ওষুধে থাকা অবস্থায়ই নতুন বই লিখলাম। একটু ভালো হবার পর দেখলাম সব কাজে মনোযোগ দিতে পারছি। ডকুমেন্টারির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছুটে গেলাম। পুরোনো ফুটেজগুলো নিয়ে ছোট কিছু কাজ দাঁড় করার চেষ্টা করলাম।   

একসময় ওষুধ একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হলো।  দেড় বছর ওষুধ চলেছে,  শেষদিন পর্যন্ত ওষুধ খাবার ট্র্যাক রেখেছি।

বাড়ির সবাই মিলে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ওই একটি বিষয়ই আমাকে সুস্থতার দিকে এনেছে। এখন আমাকে সুস্থ, স্বাভাবিক একজন হিসেবেই দেখে।

কিন্তু একটা ঝলমলে, সচল জীবন নিয়েও কেন আমি এই অসুস্থতায় পড়লাম? 

মেয়েদেরকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মানিয়ে নিতে হয় এই অনুশাসনের মধ্যে আমার বড় হয়ে ওঠা। যে কোনো কিছু হলেই আমি নিজেকে দায়ী করতাম।  দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মানুষের অসংগতি দেখেও সহ্য করতাম। কারোর আচরণে কষ্ট পেলেও পুষে রাখতাম। অপরপক্ষ কষ্ট পাবে বলে দূরত্ব তৈরি করতে পারতাম না। ভিক্টিম ব্লেইমিংয়ের  সংস্কৃতির জন্য কারোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইতাম না।

এই যে বিবিধ সামাজিক স্বীকৃতির জন্য ছুটে চলা, সেটা যে সমাজেরই তৈরি,শোষণেরই একটা রূপ, জেনেছি অনেক পরে।

আমি সেলফ কেয়ার করতে পারতাম না। নিজেকে সময়ই দিতাম না। আসলে এই রোগীদের অন্তর্দৃষ্টি থাকে না, এরা বুঝতেই পারে না এরা যে অসুস্থ। এজন্যে অন্যদেরও  উচিত খেয়াল করা তার পাশের মানুষটি কী করছে।

পরিবেশের স্থানান্তর, অভিবাসন ইত্যাদি গৌণ বলে মনে হলেও এক্ষেত্রে  এর প্রভাব আছে।  ২৭ বছর বয়সের মধ্যে  আমাকে বাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে তেরো বার! 

নারীরা পুষ্টির ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। আমিও ছিলাম। অপুষ্টি মানসিক রোগ বাড়িয়ে দেয়।

আমি একা থাকা মানুষ। বাবা মা থেকে দীর্ঘদিন ধরে অনেক দূরে । তাদের সাথে গভীর যোগাযোগ, কথা বলার অভ্যাস কমে যাচ্ছিলো। আমার তীব্র খারাপ সময়েও আমাকে তারা সময় দিতে পারেন নি কারণ তাদের ধারণা ছিলো আমি সব সামলে নিতে পারবোই।

ব্যাক্তি জীবনে ভীষণই স্পিরিচুয়ালিটির দিকে ঝোঁক ছিলো। যেটা আমার অসুস্থতার শেকড় শক্ত করেছে, রিলিজিয়াস সাইকোসিস তৈরি করেছে।সোশ্যাল আইসোলেশনে প্রভাব রেখেছে। একজন সংশয়বাদী মানুষ হয়েও হঠাৎ অতিরিক্ত ধর্মেকর্মে জড়িয়ে পড়ছিলাম। আমার স্বপ্নগুলো খুবই ধর্মসংক্রান্ত হত। নবী মুহাম্মদ (সঃ) যুদ্ধে যাচ্ছেন, ঈসা নবী আমার  গর্ভে, এরকম। পরমাত্মার সাথে মিলিত হতে চাইতাম বলে কাউকে ব্লক করে দিলেও ঈশ্বরের কাছে প্রিয়তর হবার জন্য তাদেরকে আনব্লক করতাম!

অসুস্থাবস্থায় সবচেয়ে বেশি আফসোস করেছি ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলো নিয়ে। বন্ধুত্বের, হৃদ্যতার,  আত্মীয়তার,  ভালোবাসার সম্পর্কগুলো। এই রোগ আমাকে একটা ব্যাপার শিখিয়েছে, যে সম্পর্কগুলো থাকার যোগ্য, তা সবসময়ই থাকবে। আমাকে সে সময় যারা বিনা প্রশ্নে  বিশ্বাস করেছে, এরাই আমাকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসে।  ত্রুটি বিচ্যুতি এবং এ’রকম ভাঙনেরর পরেও এরা  থাকবে। আমাকে গ্রহণ করতে হলে এদের কাউকে উচ্চশিক্ষিত , প্রতিভাবান , অ্যাক্টিভিস্ট হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুস্থ হবার পর দেখেছি প্রতিটি সম্পর্ক ফিরে এসেছে, আগের চেয়েও দারুনভাবে। কেউ কেউ দূরে থেকেও আমার সাথে যাপন করেছে আমার অসুস্থতা।  যেসব সম্পর্ক ভেঙে গেছে,কোনো পক্ষকেই দায়ী করা যায় না। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, গাড়ির ব্রেকফেল হয়ে গেছে,এখন যাকে পিষে মারছে তার দোষ নাই,যে পিষছে,তারও নিয়ন্ত্রণ নাই।

বৈষম্য ও সামাজিক পরাজয়ের মতো প্রতিকূলতাকে থেকে রোধ করার জন্য নারীদের অনুভূতি-নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলি শেখানো খুবই দরকার।  নিজেকে নতুন করে তৈরি করা,নিজের অবস্থাকে গ্রহণ করা এবং ফোকাস করতে শেখানো প্রয়োজন।

আমাকে ফোকাস করার ওষুধ দিতো। কারণ ওষুধ ছাড়া কারো পরামর্শে অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। আমার বেশিরভাগ সমস্যাই ওষুধ খাবার দুই সপ্তাহের মধ্যে চলে গিয়েছিলো। এক বছর পর সাইকোথেরাপি নিয়েছি।  এটা নিয়েও ভয় পেতো সবাই, ভাবতো থেরাপিস্ট মনে দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। সারাজীবন থেরাপি নিতে হবে। আমি পুরুষ থেরাপিস্ট দেখিয়েছিলাম, তার কাজ ছিলো আমাকে নিয়মিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত করা। এ রোগের বড় সমস্যা ঘুম না হওয়া, আমাকে স্লীপ হাইজিন শেখাতো। ব্যায়াম করতে বলতো যাতে হ্যাপি হরমোন নিঃসরণ হয়, মন ভালো থাকে। যেহেতু আমার নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে,আমার  এক বন্ধু যে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও থেরাপিস্ট, প্রতি সপ্তাহে খবর নিয়ে, কথা বলে আমার কগনিটিভ ডিস্টর্শনের (চিন্তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়াটাকে) জায়গাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করেছে, স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে ৷ ওষুধ চালিয়ে যাবার জন্য বারবার জোর দিয়েছে। কারণ এ অনেক দীর্ঘ চিকিৎসা। শেষ করার ধৈর্য সবার থাকে না। অনেকে ওষুধ ছেড়ে দেয়,তাতে রোগটা ফিরে আসে।

থেরাপিস্ট একটা অ্যাক্টিভিটি লগ পূরণ করতে দিতো, কীভাবে দিন কাটাচ্ছি, কী অসুবিধা হচ্ছে লিখতাম। ডাক্তার আমাকে লো ক্যালরি ডায়েট চার্ট দিতো কিন্তু নিউরোট্রান্সমিটারের ওষুধ পাওয়ারফুল বলে আমাকে সমন্বয় করে খেতে হতো। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতাম, ওষুধ আরম্ভ  করার পর রোজ হাঁটতে যেতাম।

সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে জেনে গিয়েছেন এমন নারীদেরকে  কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। নিজের মনের ওঠানামা, পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিতে হবে। ওষুধ তো আসলে রোগটাকে কমায় না, লক্ষণগুলোকে থামিয়ে রাখে । সুস্থ হবার পরেও আবার  লক্ষণ ফিরে আসতে পারে।  প্রয়োজন হলেই চিকিৎসক, থেরাপিস্টের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব একটি সুস্থ ও  নিরাপদ বসবাসের জায়গা নিশ্চিত করা। ইচ্ছাস্বাধীনতা, নিজের আইডিন্টিটি তৈরি , ব্যক্তিজীবন গুছিয়ে নেবার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না।  প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে হবে যেন জরুরি মুহূর্তে সেবা পাওয়া যায়। অনলাইনে কান পেতে রই, মনের বন্ধু ইত্যাদি কাউন্সেলিং এর ক্ষেত্রে  খুব ভালো প্ল্যাটফর্ম। পরিচয় গোপন রেখে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে নিজের সমস্যার কথা বলা যায় এবং দ্রুততম সময়ে চিকিৎসাপদ্ধতি, ডাক্তারের ঠিকানা পাওয়া যায়।

হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না।  প্যানিক অ্যাটাকের পরও আমি অফিসের ডকুমেন্টারি জমা দিতে পেরেছিলাম। হ্যালুসিনেশন চলছে এমন অবস্থায় এলাকার একটা স্কুলেও জয়েন করেছিলাম, ক্লাস নাইনের ইংরেজি বই পড়তে পারতাম না  বলে চাকরি ছেড়ে দিলাম। এখন আমি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে বসতে পারি। আমার বিলিফ সিসটেমকে প্রশ্ন করতে পারি যে কীসের ভিত্তিতে আমি কোনো মানুষ বা ইন্সটিটিউটকে বিশ্বাস করছি। সমস্যাগুলোকে আলাদা করতে পারি। সেগুলো যাতে ফিরে না আসে, সেজন্যে আমার প্রবণতাগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি।

ক্যারিয়ারে একটু পিছিয়ে গিয়েছি, কিন্তু সেটা রোগের জন্যে নয়, আমার মানসিকতার জন্যে। নিরাপত্তার জন্য  জীবনের চেয়ে ক্যারিয়ারকে বড় করে দেখতাম। ডেইলি লাইফ নিয়ন্ত্রণে নেই, সেখানে প্রফেশনাল সম্পর্ক নষ্ট হবার ভয়, ডেডলাইনের ভয় পেতাম। খুব চিন্তা হতো, ক্যারিয়ারের  শুরুতেই এমন ধাক্কা ! আমার থেরাপিস্ট বলেছে, আপনি একটা ব্রেক নিয়েছেন। ছেড়ে দেননি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় ব্যয় করতাম। ফোন, মেসেজ, কমেন্টের উত্তর দেবার জন্য অস্থির থাকতাম। একটা বিরক্তিকর ফোন আসলেও আমাকে ভদ্রতার জন্য তুলতে হতো। এখন আমি স্মার্টফোনের সঙ্গে থাকিই না। ডিজিটাল ওয়েলবিয়িং অ্যাপস ব্যবহার করি,  ফোকাস মোড চালু রাখি, নেতিবাচক যোগাযোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখি। রাত এগারোটার পর ফোনে কোনো কাজ করি না। একসময়  ভাবতাম যে অ্যাপস ব্যবহার করার চেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ জরুরি। কিন্তু  মানুষ সবসময় আপনার সাথে উদার ব্যবহার করবে না,  এই বাস্তবতা মানতে হবে। সবচেয়ে দরকার নিজেকে সন্দেহ না করা। এই বিষয়টি আমাকে অনেকখানি অসুস্থ করে দিয়েছিলো। নিজেকে কারোর কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা আমাদেরকে বাদ দেয়া জরুরি।

মানসিক সমস্যাকে প্রেমের কষ্ট, যৌনতা সংক্রান্ত অবদমন, যৌনজীবনে ব্যর্থতার কারণ ভেবে নেয়া একটা বহুল প্রচলিত বিষয়। সিজোফ্রেনিয়ায় ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যায়। ডোপামিন কেবল যৌনতার সাথে না, খাবার, নতুন কিছু করা, সংগীতের সাথেও সম্পর্কযুক্ত। আমি সংগীতমুখর একজন মানুষ।  আমার বেশিরভাগ সমস্যা ছিলো মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, উদাস হয়ে থাকা। ডোপামিন অধিক নিঃসরণের ফল। ২০১৭ সালে আমি একাধিক নতুন লেখা লিখছিলাম। আমি বাস করতাম ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সালে! তারুণ্যের দেখার চোখ ফিরছিলো। আমার সেই সময়ের লেখায়, গানে একটা টিন এজ টিন এজ ছাপ আছে।  ধীরে ধীরে শৈশবের দিকে যাচ্ছিলাম। সময়টা গুলিয়ে ফেলায় টানা দুই বছর এই নস্টালজিয়া অধ্যায় ছিল। মাথাভর্তি  গল্প, দৃশ্য, লেখা।  থামাতে পারছি না । শেষে ওষুধ দিয়ে ঠিক করতে হল। বর্তমানে ফিরতে পারলাম।

সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের ডিভোর্স এবং ব্যর্থ বিবাহের হার অনেক বেশি। নারীদেরকে প্রায়ই ব্যর্থ মা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডোমেস্টিক এবিউজ এবং ভিক্টিমাইজেশন নারীর জন্য খুব পীড়াদায়ক। এতে রোগটা বেড়ে যায়। এই চাপ থেকেই কেউ নিজের ক্ষতি করে ফেলেন। অনেকে এই রোগীদেরকে আক্রমণাত্মক ভাবলেও দু;খজনক সত্যি হচ্ছে, রোগীরাই আক্রমনের, সহিংসতার , নিপীড়নের শিকার হন! 

জোটবদ্ধ সাইবার বুলিংয়ের জন্য অসুস্থাবস্থায় আমি নিজেকেই দায়ী করতাম, এখন  জানি যে এটা একটা অর্গানাইজড ক্রাইম । আমার সিদ্ধান্ত নেবার জায়গাটা ঠিক থাকলে, বিষণ্ণতা না থাকলে, আমি নিজেকে ভিকটিম হতে দিতাম না।

আমার ড্রাগের, গাঁজার হিস্ট্রি ছিলো না। যারা ড্রাগ নিচ্ছেন বিশেষত হ্যালুসিনেটিং ড্রাগ, গাঁজা নিচ্ছেন, তারা দ্রুত ছেড়ে দিন। আপনারা ছয়গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। 

দীর্ঘদিন অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ খেলে বাচ্চা নিতে অসুবিধা হতে পারে, দামী ওষুধ এ ভয়ে অনেকে ওষুধ বন্ধ করে দেয়।  আপনি অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন। আমার পিরিয়ডে কোন সমস্যা হয় নি । ওষুধগুলোর দামও বেশি  ছিলো না, গড়ে বিশ-পঁচিশ টাকা খরচ হতো রোজ।  ধীরে ধীরে ডোজ কমে আসে, তখন দামও কমে যায়।  কেবল ডাক্তারের ভিজিট উচ্চ হতে পারে, আপনার সুস্থতার চেয়ে এর মূল্য কখনোই বেশি না। এই ব্যাপারে খুব দৃঢ় থাকতেই হবে।  আমারও অপরাধবোধ হতো, নিজেকে বোঝা মনে হতো। বাসায় অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ বাবা মা, নিজের নেই চাকরি । কিন্তু সুস্থ হচ্ছি ভেবে, নারী হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক অপবাদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য দুমাস পর পর দুই তিন হাজার টাকা এ বাবদে খরচ করার মানসিকতা আমি চর্চা করেছি।

অনেকে মনে করে যে সব নারী শক্ত, জীবনে এগিয়ে ছিলো এরাই এরকম বিপর্যয় থেকে উঠতে পারে। বাজে কথা। আমরা প্রত্যেকেই যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আছি। আমি কখনই এতো শক্ত ছিলাম না। রোগ যেমন কাউকে বাছ বিচার করে ধরে না,  সঠিক চিকিৎসা পেলে যে কোনো মানুষ সুস্থ হতে বাধ্য।

অসুস্থাবস্থায় যেসব ভুল করেছেন, যা আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না, সে ব্যাপারে নিজেকে ছাড় দিতে হবে এই ভেবে যে বৈরী পরিস্থিতিতে এ’রকম কাজ আপনি আগে কখনো করেন নি। রোগটাই ব্যক্তিত্বকে বিশৃঙ্খল করে দেয়।

মানুষের যে নেতিবাচক আচরণের জন্য আপনার কষ্ট হবে, তার ব্যাখ্যা করুন। অন্যের প্রতি সহমর্মিতার অভাব থেকে এরা এরকম করে। চিকিৎসায় আপনার ব্রেনের রোগ সুস্থ হয়ে যাবে, কিন্তু এদেরটা স্বভাবজাত, এরা  সামাজিক- সাংস্কৃতিকভাবে অসুস্থ!

আপনি তাদেরকে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে পেরেছিলেন, এটা আপনার যোগ্যতা। ইন্টারনেটে সিজোফ্রেনিয়া সার্চ দিলে একটা অদ্ভূত ও হাস্যকর প্রশ্ন আসে, ক্যান সিজোফ্রেনিক পিপল লাভ? সেসময় আমার সকল অনুভূতির মধ্যে সবচেয়ে তীব্র ছিলো ভালোবাসা। বরং আমার আফসোস ছিলো কেন আরও ভালোবাসতে পারলাম না। আমি আমার নিপীড়কদেরকেও ভালোবাসতে পেরেছি।  ভালোবেসে শান্তি পেয়েছি। এখনো এদের প্রিয়বিয়োগে আমার খারাপ লাগে।

এই বিপর্যয়ের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, নিজেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাওয়া, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়া। আসলে এই লড়াইটা কিন্তু মোটেও একার না। এটা সমষ্টিগত। একটা সিজোফ্রেনিয়ার রোগী বাসায় রাখা ও যত্ন করা এবং তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ধরে রাখা, তার ক্যারিয়ার, বিয়ে নিয়ে আড়াই-তিন বছর ধরে সামাজিক জবাবদিহি করা, অতোটাও সহজ না।

প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও এখন আমি এই অবস্থাকে সাদরে গ্রহণ করেছি। এখন আমার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস নেই। আমি বাঁচি একজন সাধারণ মানুষের মতো, যে কোনো এক সময় একটা অসুস্থতার ভেতর দিয়ে গেছে ৷ যেহেতু আমাকে গড় আয়ুর চেয়ে ১৫-২০ বছর কম বাঁচতে হবে, এই বেঁচে থাকাটা যেন অর্থপূর্ণ হয়, এখন সেই চেষ্টাই করি।  ভালো লেখার, দুর্দান্ত সৃজনশীল কাজ করার চেয়ে ভালো থাকাটা অনেক বেশি সুন্দর!

নারীদেরকে আমি একটাই অনুরোধ করতে চাই। আমাদের জীবনটা এমনিতেই বন্ধুর। আপনার মানসিক যন্ত্রণা পুষে রেখে সেটাকে আরো সমস্যাসঙ্কুল করে দেবার কোনো অর্থ হয় না।  সমস্যা আমরা কতটুকু এড়িয়ে চলছি তা দিয়ে আমরা কতখানি শক্তিশালী সেটা প্রমাণ করে না। বরং আমাদের ক্ষতগুলোই মূল্যবান এবং সৎ। এরাই আমাদের ঘাতসহ ও সুন্দর করে তোলে।

আপনার পথচলা মসৃণ হোক। শুভকামনা।

তথ্যসূত্র:

১। মুসলিমা জাহান, নারীর মানসিক স্বাস্থ্যও অবহেলিত, প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭

২। ডা. মো. তাজুল ইসলাম। অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

৩। ডা;  আজিজুল ইসলাম, লিংকঃ https://youtu.be/QcTAW5wkz6o

পেইন্টিং:

ইন্টারনেট থেকে নেয়া

১. আয়নায় নিজেকে দেখা, স্টেনহোপ আলেক্সানডার ফোর্বেস ১৯১৪

২. জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া,আলবার্ট অবলেট ১৮৮৩

ব্লগার: গবেষক, লেখক, চলচ্চিত্রকার।



Categories: যাপিত জীবন

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: