কাপ্তাই বাঁধ । এবং আমাদের যাযাবরের জীবন!

সাধন কুমার চাকমা, দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি

সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন: সমারী চাকমা, মার্চ’ ২০১৮

[ নোটঃ এই সাক্ষাৎকারটি আমার কাছে অনেক কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কারণগুলো হচ্ছে-

১. দেশ ছাড়তে বাধ্য হবার আগে এটি ছিল আমার নিজের নেয়া শেষ সাক্ষাৎকার ।

২. এই সাক্ষাৎকারটি বর-পরং বিষয়ক অন্য সাক্ষাৎকারের চাইতে একেবারে আলাদা । এবং

৩. এই সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে আমি আমার মায়ের দিকের পূর্ব পুরুষদের কথা তাঁদের গৌরবোজ্জল জীবনের কথা আবিস্কার করেছি, শুনেছি এবং জেনেছি । সে-সব আমার কখনো জানা হয় নি । তিনি আমার মায়ের মা, মানে নানুর বাবার সরাসরি ছাত্র ছিলেন । তিনি যখন আমার মায়ের দিকের আমার পিজু ‘র ( গ্রেট গ্রান্ডফাদার) কথা বলছিলেন তখন কিন্তু তিনি জানতেন না আমি তাদেরই উত্তরসুরি । আমার কাছে এটি ছিল খুবই আনন্দের আর গর্বের ।

জিদু সাধন কুমার চাকমার জন্ম ১৯৩৬ খ্রী. তিনি মৃত্যু বরণ করেন ১২/১২/২০১৮ খ্রী. খাগড়াছড়ির খবংপয্যার ছেলের বাড়িতে । আমার দুঃখ তিনি এই লেখাটি দেখে যেতে পারলেন না । তাঁর স্মৃতি এবং শক্তিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এই লেখাটির মাধ্যমে।  Samari Chakma, 25/07/2021 ]

অনেক দিন আগের কথা:

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ হবার অনেক আগে আমাদের পরিবারের প্রথম বসতি ছিল সাবেক্ষং এলাকায় । এই সাবেক্ষঙে প্রয়োজনীয় পরিমানে চাষবাসের জমি না থাকার কারণে আমার আজু বুত্তেং চাকমা কাজলং এলাকায় এসে নতুন করে বসতি গড়েন । পরে এখানেও প্রয়োজন মত চাষবাসের জমি না পাওয়াতে আজু এরপর চলে আসেন কাজলঙের আরেক জায়গা ভুয়োছড়ি গ্রামে ।

সেই পুরাতন ভুয়োছড়ির গ্রামে আমার মা ডুমুরী চাকমা (কালাইয়া মা) এবং আমার বাবা ইন্দ্রধন চাকমার সংসারে আমার জন্ম হয় । আমার মা-বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সাধন কুমার চাকমা । আমার বাবার বাবা এবং মায়ের নাম (আজু এবং নানুর) নাম যথাক্রমে বুত্তেং চাকমা এবং জানগী চাকমা । আমার মা-বাবা দুজনেই ছিলেন বুং গোজার আগুন পুন গোষ্ঠির বংশধরের মানুষ । আমাদের ভুয়োছড়ি গ্রামটির অবস্থান ছিল মারিশ্যার হাকপুজ্যে গ্রাম এবং বুরবো গোজার গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় । যেটি এখন তিনটিলা মৌজার বঙলতলী ইউনিয়নের অর্ন্তভুক্ত । এরপরে কাপ্তাই বাঁধের পানিতে এই গ্রামটি ডুবে যাবার পর আমাদের নতুন ঠিকানা হলো তখনকার মেগেনি’র বর্তমানে দিঘীনালার বাবুছড়া গ্রামে । আমার মনে আছে সেসময় আমার বয়স ছিল কুড়ির কাছাকাছি । তার মানে আমার বয়স এখন প্রায় আশির কাছাকাছি ।

আমি ছিলাম বাবা-মার একমাত্র ছেলে তাই বোধহয় পড়াশুনাটাও বেশী দূর করা হয়ে উঠে নি । আমাদের বাড়ি ছিল বাঁশের তৈরী সোজা বেড়া দেয়া আলকঘর মানে মাটি থেকে একটু  উচুঁতে তোলা বাড়ি ।  আমাদের গ্রামের  কাছেই  ছিল ঘন জংগল । গ্রামের ভিতরে একটি ছোট ছড়া ছিল, যার নাম ছিল ভুয়োছড়ি ছড়া । এই ছড়ার নামেই আমাদের গ্রামটির নামকরণ হয় ভুয়োছড়ি আদাম। সেসময়  নলকূপ বলে কিছুই ছিল না। সেই ভুয়োছড়ি ছড়াতেই কুয়ো বানিয়ে সেই কুয়ার পানি আমরা ব্যবহার করতাম । তখন রাংগামাটি যেতে হতো পানি পথ দিয়ে । তাই কাজলং থেকে রাংগামাটিতে যেতে বড় বড় নৌকা আমরা ব্যবহার করতাম । তবে সেসময়েও নৌকার মাঝিরা ছিল সকলেই বাঙালি। আমাদের গ্রাম থেকে রাংগামাটি পৌঁছাতে লেগে যেতো একদিন একরাত ।

কাপ্তাই বাঁধের পানি আসার আগেই বাঘেইছড়ি, কাজলং নিবাসী বংশা গোজার মেয়ে শুভ দিনী চাকমার সাথে আমার বিয়ে হয় । আমার বয়স তখন মাত্র সতের বছর । আসলে খুব অল্প বয়সে আমি বিয়ে করেছি । পড়াশুনাও তেমন একটা করা হয়নি মাত্র ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়েছিলাম তখনকার সময়ে হাকপজ্যে দোর স্কুলে । সেসময়ে সব জায়গায় স্কুল ছিল না বললেই চলে । আমাদের এলাকায় সে-সময় মাত্র এই স্কুলটি ছিল। এই হাকপজ্যে গ্রামটি ছিল হাম্বে গোজার বংশধর মানুষদের । প্রায় ১০০ পরিবার বাস করা সেই গ্রামটি ছিল অনেক বড় গ্রাম । আমাদের গ্রামেও প্রায় ৬০/৭০ পরিবারের বসতি ছিল ।

তো এই গ্রামকে ঘিরেই ছিল আমার জগত সংসার । আমার জন্ম, বেড়ে উঠা, আমার বিয়ে এবং আমাদের বড় মেয়ে শান্তি প্রভা চাকমার জন্মও হয় এই গ্রামে । এরপরেতো আমাদের গ্রামটি বাঁধের পানিতে ডুবে গেলে আমরা মেগেনিতে চলে আসি । এই মেগেনিতে আমাদের বাকি সন্তানদের জন্ম হয় । আমাদের ৫ কন্যা, শান্তি প্রভা, স্বপ্না প্রভা, কেয়া চাকমা, হিতৈষী চাকমা, আশা চাকমা এবং একমাত্র ছেলে সুপ্রকাশ চাকমা ।

আমাদের চাকমা জাতির ইতিহাস অনুসারে দেখা যায় যে বুং গোজা তিন ভাগে বিভক্ত । দাঙর বুং গোজা, মাজ্যেং বুং গোজা এবং চিগন বুং গোজা । ছোট বেলায় মা-বাবা থেকে শুনেছি আমাদের এই বুং গোজা আগুন পুন গুত্তির নামকরণের ইতিহাস । আর এই আগুন পুন গুত্তির নাম করণের পিছনে নাকি একটা মিথ আছে । তাঁরা বলতেন, আমাদের পূর্ব পুরুষগণ খুব কর্মঠ ছিলেন । তাই তাঁদের সাথে আগুন জ্বালানো অবস্থায় একটা বেনা সবসময় কোমরের পিছন দিকে গুজানো থাকতো । কোন একদিন নাকি সেই বেনার আগুন থেকে এক ব্যক্তির পরণের কাপড়ে আগুন লেগে যায় । এরপরেই এই মানুষের বংশধরদের নাম হয় ‘আগুন পুন গুত্তি’ ।

আমাদের গ্রাম ভুয়োছড়ি এবং হাকপজ্যে গ্রামের কথা:

এক: সময় যতোই চলে যাচ্ছে ততই আমার সেই ফেলে আসা গ্রাম এবং হাকপজ্যে গ্রাম এলাকা আরো বেশী করে মনে পড়ছে । পুরোনো সেই দিন, আমাদের সেই বাড়ি, গ্রাম, গ্রামের মানুষজন, পাহাড়, জঙ্গল, ‍ভুয়োছড়ি ছড়া, স্কুল, হাকপজ্যে গ্রাম কতকিছু মনের ভিতর গেঁথে আছে এখনো ।

কাজলং নদীর পাড় থেকে সামান্যতম দুরত্বে এক লম্বা লাঙেল[1] এর উপর অবস্থিত ছিল ভুয়োছড়ি নামে সেই ডুবে যাওয়া আমাদের গ্রামটি । নদীর পাড়ে হলেও বর্ষা কালে কখনো পানিতে ডুবে যেতো না । নদী আর গ্রামের মধ্যবর্তী জায়গাটি ছিল চাষবাস করার জায়গা । সে সময় আমাদের গ্রামে বছরে অন্তত একবার মেলা বসতো । মেলাতে যাত্রা পালা এবং গানের অনুষ্ঠান হতো । এক একটি দল ২০/২৫ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা পালায় অংশ নিতো ।

আমার মনে পড়ে মেলায় দুম বা ব্যান্ড পার্টি আনা হতো সেই রাংগামাটি শহর থেকে । আর দুম পার্টির সদস্যরা ছিলেন সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বির মানুষ । মনে আছে কোন এক বছর মেলাতে অরুন শান্তি-বরুন শান্তি নামে একটি চাকমা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল । দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে এই মেলা দেখতে লোকজন এসেছিল । কী সব আনন্দের দিন ছিল আমাদের তখন । তখন রেডিওর কথা শুনলেও টেলিভিশনের কথা শুনি নি । রেডিও কি তা চোখে দেখেছি যখন কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতি পূরণ হিসেবে টাকা পাওয়ার পর আমাদের গ্রামের একজন রেডিও কিনে এনেছিল । আমরা প্রায় গ্রামের সকলেই সেই রেডিও দেখার জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিলাম সেটা আমার স্পষ্ট মনে আছে( হাসি )। চোখ বুঝলে আজো দেখতে পাই নারিকেল গাছের বাগান, আম, জাম গাছের বাগান আর কলা বাগান । শান্ত, নিরিবিলি পাখির শব্দে মুখরিত সেই গ্রাম । সে-সময়ের জীবন এখনকার মতো ব্যস্ততার জীবন ছিল না । আরাম আয়েশের আতঙ্ক মুক্ত জীবন ছিল সে সময় । আমাদের সময়ে ঘিলা খেলা আর নাদেং খেলা ছিল জনপ্রিয় খেলা । মেয়েরাও কিন্তু ঘিলা খেলা খেলতে খুব পছন্দ করতো ।

আমাদের গ্রামের সবার ছিল ’গুজ্যা ভুই’[2] । সেই জমিতে ধান রোপন করার সময়ে কামলা হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিরা আসতো । তারা সেই জমিতে ধান ছিটিয়ে দিয়ে আবার নিজ দেশে চলে যেতো । ধান পাকা শুরুর সময়ে আবার এসে ধান কেটে মাড়িয়ে দিয়ে একেবারে বাড়ির গোলাতে ধান তুলে দিয়ে চলে যেতো । তখন এক কানি জমিতে ধান রোপা থেকে শুরু করে একেবারে গোলায় তুলে দেওয়া পর্যন্ত আমাদের তাদেরকে পারিশ্রমিক হিসেবে দিতে হতো ৫০০ টাকা করে । তখন আমরা বছরে প্রায় ৪/৫০০ ধান গোলায় তুলতে পারতাম ।

 এছাড়াও আমাদের পাউন্দি মানে সবজি চাষের জমি ছিল প্রায় সাত/আট কানির সমান ।

দুই: সে সময় হাকপজ্যে গ্রাম ছিল সে এলাকার সবচেয়ে সবদিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী । স্কুল ছিল, হিয়ং মানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল । মনে আছে সে বৌদ্ধ মন্দিরে একজন বড়ুয়া ভান্তে থাকতেন । তখনকার দিনে এখনকার মতো একসংগে ৫ জন ভান্তে পাওয়া ছিল অকল্পনীয় । তখন শুধু আমরা বুদ্ধকেই পূজা করতাম । এই সময়ের মতো সংঘ দান, অষ্ট-পরিস্কার দান বলে কিছুই ছিল না। তবে আরেকটা দান ছিল পুগলিক দান[3] ।’ এই দান একজন ভান্তেকে নিয়েই করা যেতো । এখন অবশ্য এই দানের কথা কেউ জানে বলে মনে হয় না ।

আগেই বলেছি আমাদের এলাকায় মাত্র হাকপজ্যে গ্রামে একটা প্রাইমারী স্কুল ছিল । ৩/৪ টার গ্রামের বাচ্চারা আমরা সেই স্কুলে পড়াশুনা করতাম ।  আমার এখনো চোখে ভাসে, আমাদের হাকপজ্যে স্কুলের শিক্ষক চেলা মাস্টার স্যারের চেহারা । তিনি ছিলেন লম্বা, ফর্সা এবং সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী । তাঁর কাছেই আমার শিক্ষার শুরু । তাই তাঁর অবয়বকে কেন জানি আজো দেখতে পাই । চেলা মাস্টার স্যারের পরিবারকে সে এলাকায় সবাই একনামে চিনতো তখন । তাঁর ছোট ভাই হচ্ছেন বিখ্যাত কল্পতরু চাকমা । কল্পতরু চাকমা সেসময় নামকরা একজন ’কালিগর[4]’ ছিলেন । তাঁর মতো খুব ’কালিগর’ তখন একজনও ছিল না । হাতির দাঁত এবং হাড় দিয়ে এমনকি অন্য যেকোন জিনিষ দিয়ে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা নানা ধরনের জিনিস বানাতে পারতেন । চাকমা মেয়েদের হাতের বাঙুরি খুব ভাল বানাতে পারতেন । আমার মনে আছে সে সময় সেই বাঙুরি বিক্রি হতো ৮/১০ টাকা করে । শুধু কি বাঙুরি ! কানের ফুল, নাক ফুল, আংটি এমন কি নকল টাকাও বানাতে পারতেন ।

তাঁর বানানো সেই নকল টাকা ছিল একদম হুবহু আসল টাকার মতন । পার্থক্য ছিল শুধু একটাই আসল টাকাতে যে একটা শব্দ থাকতো সেটা নকল টাকাতে ছিল না । আমার এখনো মনে পড়ে সে-সময় এরকম বানানো জিনিষ পত্র নিয়ে সরকারি উদ্যেগে একটি প্রর্দশনী হয়েছিল । সেই প্রর্দশনীতে কল্পতরু চাকমার বানানো বন্দুক, নকল টাকা এবং তাঁর এক ছেলে মিস্যা বাপ বানানো তাজমহল প্রর্দশিত হয়েছিল । আরেক ছেলের বানানো জিনিষও ছিল কিন্তু এখন আর আমার তা মনে নেই । এবং সেই ছেলের বানানো জিনিষটিই সেই প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। এই প্রদর্শনীর পর কল্পতরু চাকমার পরিবার সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছিলেন হাতি দাঁত নিয়ে কাজ করার । শুধু তাই নয়, তাদের পরিবার ছিল নামকরা শিকারী পরিবার ।

বরকল গোদা: আমাদের হিল চাদিগাঙে কারেন্ট উৎপাদনের জন্য পানির উপর বাঁধ হবে সেটা লোক-মুখ থেকে শুনেছিলাম । তারপরেই আমরা দেখলাম তখনকার পাকিস্তান সরকার বরকলে চিলকধাকে বাঁধের জন্য কাজ করা শুরু করে দিয়েছে । আরো শুনেছিলাম বাঁধের পানিতে ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে সরকারের এমন শর্ত ছিল যে ক্ষতি পূরণ পাওয়ার পর পরই তাদের জায়গা ছেড়ে  চলে যেতে হবে । কিন্তু পরে বরকলের এই চিলকধাকে আর বাঁধটি হয় নি । চিলকধাকে বাঁধের অসসমাপ্ত কাজটি আমি নিজের চোখে দেখে এসেছিলাম । বাঁধ দেয়ার জন্য বিশাল বিশাল গর্ত করা হয়েছিল । আমরা সেই গর্তে নেমে আধা মাইলের মতো হেঁটে দেখে এসেছিলাম বড় বড় গর্ত গুলো । এই বাঁধটি কেন বন্ধ করে দিয়েছিল সেটার সঠিক কারন আমাদের জানা না থাকলেও বাজারে প্রচলিত অনেক গুজব আমরা শুনেছি । যেমন- বরকলের বাঁধ নির্মাণ হলে এই বাঁধের পানি ভারতের দেমাগ্রী পার হয়ে অনেক দূর এলাকা নাকি ডুবিয়ে দিতো ।  তাই ভারত সরকারের আপত্তিতে এই কাজটি এখানেই বন্ধ হয়ে যায় । আরেকটা গুজব ছিল এমন, যেটি ছিল অলৌকিক । গর্ত করার সময় নাকি শ্রমিকরা একটি হীরে পেয়েছিল, পরে সেই হীরেটি আবার গর্তে পড়ে গেলে আর কাজ করা সম্ভব হয় নি (হাসি)। পরে এই বরকলের বাঁধটি কাপ্তায়ে নিয়ে যাওয়া হয় । যে বাঁধটির নাম কাপ্তাই বাঁধ ।

কাপ্তায়ে বাঁধ নির্মাণ: বরকল থেকে কাপ্তাই বরগাঙ নদীতে বাঁধ নির্মাণ সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলো । আমি একবার অনেকের সাথে দলবেঁধে সেই বাঁধ ‍নির্মাণ দেখতে গিয়েছিলাম । সে এক এলাহি কারবার । না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন । বড় বড় ট্রাক্টর দিয়ে পাহাড় কাটার পর সে মাটি নদীতে ফেলা হচ্ছে এরপর কাটা মাটির ভরাট যাতে শক্ত হয় তাই চার পাঁচটি হাতি দিয়ে সেই ভরাট করা মাটি চাপ দেয়া হচ্ছে । সেখানে কাজ করা শ্রমিকরাও ছিল প্রায় সবাই বাঙালি আর পাঠান । কাপ্তায়ে তখনও পর্যন্ত অনেক চাকমার বসতি ছিল । পরে শুনেছি বাঁধের পরে অনেক চাকমা সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যায় ।

তো বাঁধ নির্মাণ শুরু হবার সাথে সাথে পানি কতদূর আসবে, কতদূর উপরে উঠবে সে-সবের মাপ-ঝোক শুরু হলো এবং এলাকায় এলাকায় গাছ কাটিং আরম্ভ হলো । তবে কাপ্তাই বাঁধের ফলে এতদূর পানি আসবে, সে কথা আমাদের বুড়ো-বুড়িরা বিশ্বাস করতেন না । বলতো এতো বড় বরগাং কেমন করে বেঁধে রাখবে । একদিন সরকারের লোকেরা আমাদের উঠোনে এসে একটি পিলার দিয়ে লেভেল দিয়ে বলল বাঁধের পানি এতদূর পর্যন্ত আসবে । এই পিলার দেখার পরও বাবা তাদের কথা একটুও বিশ্বাস করেন নি (হাসি) । 

তারপর একদিন রির্জাভ ফরেস্টের এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের বড় এবং লম্বা  গাছ  গুলো কাটা আরম্ভ হলো । এই কাজের ধারাবাহিক ভাবে যাদের রেজিস্ট্রি ভুক্ত জমি আছে তারা কাগজপত্র দেখিয়ে জমির এবং বাগানের ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেল । কিন্তু সেই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে কি ডুবে যাওয়া সবকিছুর ক্ষতির পূরণ হয় ! হয় না। যে সব ব্যক্তির বাগানের বা গাছের মালিকানার কাগজপত্র ছিল তারাই তাদের বাগানের বড় বড় কাটা গাছের দামের ক্ষতিপূরণ পেলো  ৩/৪/৫ টাকা করে । আর যাদের কোন বৈধ কাগজপত্র ছিল না তারা কোন ক্ষতি পূরণ পেলো না । কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ ছাড়াই তাদের থেকে জায়গা কেড়ে নিল সরকার । এতো বছরের গড়া বাগান একেবারে খালি হাতে সরকারের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো । এসবের বিরুদ্ধে বলার বা দেখার তখন কেউ ছিল না । ছিল না আমাদের চাকমা রাজা । রাজা যেহেতু নেই তাই তার প্রজার নেতারাও কোথাও নেই । সব হারাদের সম্বল ছিল শুধু একবুক র্দীঘশ্বাস আর চোখের পানি । সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়ার সাথে উচ্ছেদের নোটিশও দিয়ে দিল আমাদের । এটা সত্য যে সে-সময়ের ক্ষতিপূরণ সমান হারে কেউ পায় নি । যেমন তিন নং লংগদু, রাংগামাটি মৌজার মানুষেরা পেয়েছে এক কানি ৬০০ টাকা করে । আর আমাদের দিয়েছে ৫০০ টাকা করে । এই অবিশ্বাসের মাঝেই আমরা ফরম  পূরণ করলাম । কোথায় নতুন বসতি করতে চাই তার ফরম ।

এভাবে একদিন কাপ্তাই বাঁধের গেট বাঁধার সময় চলে আসে । এইবার জায়গা ছাড়ার পালা ।

বাঁধের পানিতে ডুবে যাবার সময়ের স্মৃতি:

কাপ্তাই বাঁধের পানিতে আমাদের গ্রাম ডুবে যাবে এই কথাটি বাবা বিশ্বাস করে নি । তখনই এই ’অবিশ্বাস’ বিশ্বাসে পরিনত হলো যখন কাপ্তাই বাঁধের পানি সত্যি সত্যি আমাদের বাড়ির দোর গোড়ায় হাজির হলো । আমাদের গ্রাম, জমি, বাড়ি, সবকিছু পানিতে ডুবে যাবার সেই দৃশ্য আজো দেখতে পাই । সেই সব দিনের কথা এখনো আমার কাছে স্পষ্ট মনে আছে । এতটুকু ফিকে হয় নি ।

যদিও সবাই বলে ‘স্মৃতি’ সময়ের সাথে সাথে চলে যায় । সে সময়ের পানিতে ডুবতে থাকা বাড়ি, গ্রাম যখন ফেলে আসছি আমাদের তখনকার অনুভূতি গুলো আজকে এই সময়ে এসে বলে বুঝানো কঠিন । যার জীবনে ঘটে সে জীবন দিয়ে বুঝে, কি হারাতে চলছে! এই মুহূর্তেও আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না আমার মনে বা বাকি সবার মনের সেই সময়কার অবস্থা । এই গ্রামের সাথে এই বাড়ির সাথে আমার সর্ম্পকতো সেই ছোটবেলা থেকেই । আমি এখানে বড় হয়েছি, বিয়েও করেছি এখানে । আমার প্রথম সন্তানের জন্মও এখানে ।  আমাদের জমি জমা, বাগান বাগিচা সবতো এই গ্রামেই । এত বছরের পরিশ্রমের ফল এইভাবে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে হচ্ছে অচেনা অজানা জায়গায়, স্বাভাবিক ভাবে মনতো কাদঁবেই । এটাতো সত্য, আবার কবে আমরা এইরকম বাগান বাগিচা করতে পারবো, আমাদের এখানে যে স্বাভাবিক জীবন ছিল আবার কবে আমরা এই জীবন পাবো বা আদৌ পাবো কিনা এসব দুঃশ্চিন্তাতো ছিলই । এইসব ভাবনা দুঃখ, কান্না সব সাথে করে বাধ্য হয়ে চলে আসতে হলো । আসলে আমাদের তখন কিছুই করার ছিল না ।

মনে আছে সপ্তাহ খানেক ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছিল তখন ।  সময়টা  বৈশাখ না জ্যেষ্ঠ মাস ঠিক মনে নেই । এই বৃষ্টির পানিতে ধীরে ধীরে কাজলং নদীর পানি বাড়তে শুরু করে । পানি বাড়ার সাথে সাথে স্রোতস্বিনী কাজলং নদীটাকে আর নদী লাগছিল না, মনে হচ্ছিল কাজলং নদী একটা বিশাল ডোবা । এবং  গ্রাম থেকে নদীতে পড়া নালা আর ছোট ছোট নদীর পানির স্রোত হঠাৎ করে যেনো বন্ধ হয়ে গেলো । ছোট বড় কোন নদীর পানিতে আর স্রোত নেই ।  সব ছড়া আর নদী গুলোকে মনে হচ্ছিল এক একটা ছোট বড় ডোবা। এদিকে কাজলং নদীর পানি ফুলে ফেঁপে উপরে উঠছেই তো উঠছে । এবং এই ফুলে ফেঁপে উঠা পানিতে  ভাসছিল বড় বড় সব গাছ ।  আবার সে সব গাছের সাথে ভাসছিল বড় বড় গাং ইজা [5]। এদিকে আমরা প্রতিদিন সারাদিনের পর রাতে ঘুমাতে যাবার ঠিক আগে আঙুলে মেপে দেখতাম পানি কতদূর বেড়েছে এবং উঠেছে ।  দেখা যেতো সারাদিনে পানি বেড়েছে আট আঙুলের সমান । এসব দেখে আমার বাবা এইবার সত্যি সত্যি বিশ্বাস করলেন এই পানিতে আমাদের সবকিছু  ডুববে ।  আমরা আর এখানে থাকতে পারবো না ।

এরপর বাবা বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । আমাদের তখন নিজেদের দুটো নৌকা ছিল । আমাদের বাড়িতে যে তিনটি খাট ছিল সেসব ভেঙ্গে নৌকায় তোলা হলো অন্যান্য জিনিষপত্রের সাথে । একদিন পানি একেবারে ঘরের দরজার সামনে চলে এলো । এইবার ঠিক ঘরের দরজার সামনে নৌকা এনে আমাদের কিছু জিনিষপত্র উঠিয়ে নিজেদের বাড়ি ছাড়লাম নতুন জায়গার সন্ধানে (র্দীঘশ্বাস) ।

এদিকে গ্রামে যাঁরা আগে-ভাগে বিশ্বাস করেছিলেন যে কাপ্তাই বাঁধের পানি সব ডুবিয়ে দেবে তাঁরা কিন্তু বেশ আগেই কাজলং, দুরছড়ি, রুপকারী, সিজক দোর এবং হাগারাছড়ি চলে গিয়েছিলেন । সম্ভবত আমরাই মনে হয় সবার শেষে গ্রাম ছেড়েছি ।

যদিও আমরা ফরমে লিখেছিলাম আমরা মারিশ্যা যেতে চাই ।  কিন্তু আমাদের সেখানে যাওয়া হয় নি ।  আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম লংগদুতেই থাকবো । তবে সমতলে না একটু  পাহাড়ের উপরে আমরা আমাদের নতুন বাড়ি বানাবো । তো পাহাড়ের উপরে বাড়ি করার জন্য সব  ঠিকঠাক করে গাছ, বাঁশ, শন সব জোগাড় করে যখন বাড়ি বানানো শুরু করবো ঠিক সেই মুর্হুতে আবার সরকারের লোকজন এসে আমাদের পাহাড় দেখে বললো না এখানে ঘর করা যাবে না । সরকার এইবার আমাদের এই পাহাড় পছন্দ করেছে লংগদু থানা স্থাপনের জন্য । এবং একপ্রকার জোর করেই লংগদু থানা স্থাপন করার জন্য আমাদের সেই পাহাড় সরকার কেড়ে নিলো আমাদের থেকে । বাধ্য হয়ে সরকারের কাছে সেই পাহাড়, বাড়ি করার জন্য আনা সরঞ্জাম সবকিছু সেখানে রেখে আমরা চলে এলাম কাজলং । এবং পরে কাজলং থানা বাজার’ হলো আমাদের জায়গার উপরেইতো ।

কাজলং এসে অফিসে কাগজপত্র ঠিক করতে গেলে তখনকার সেকশন অফিসার বললো, ভাই তোমরা এই কাজলঙে থেকে কি করবে? তোমার সময়ে এখানে আর ভালো কৃষি জমি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই । এই বড় বড় গর্তের জমি দিয়ে কি করবে তুমি? তুমি বরং ফরমটা নিয়ে আসো, এখানে না থেকে মেগেনি[6]তে চলে যাও । ফরমে লেখা আছে ১ একর, সেটা আমি ৫ একর বানিয়ে দিচ্ছি । আমি তখন সেকশন অফিসারের প্রস্তাব শুনে খুব ভালো করে ভেবে দেখলাম সত্যি তো! আমি ভালো করে চিন্তা করে অফিসারের কথায় রাজী হয়ে গেলাম এবার আমাদের নতুন ঠিকান মেগেনি কূল । এবং আর দেরী না করে বড় বড় নৌকায় করে মেগেনি কূলের দিকে রওয়ানা দিলাম । সে নৌকার ভাড়া দিতে হয়েছিল ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে ।  মেগেনি দোর আসতে আমাদের প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছিল । কারণ আমাদের নৌকা গুলো ছিল  অনেক বড় আর অন্যদিকে নদীর পানির গভীরতা ছিল কম । তাই বড় বড় নৌকা দিয়ে এই নদী পথের যাত্রায় অনেক সমস্যা হয়েছিল । এই এক সপ্তাহ নৌকা যাত্রার সময় মাঝে মধ্যে নদীর পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করতাম । আর বাকি সময়টা নৌকার মধ্যে বসে থেকে অপেক্ষা করতাম কখন নতুন জায়গায় পৌঁছাবো । পানি আসার সময় আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল। আমরা তাকে কাল্লোঙে[7]র ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে গেছি।

প্রকৃতির অগ্রিম বার্তা:

এই কথা বলা দরকার যে আমরা সকলেই ছিলাম প্রকৃতি র্নিভর । একদিকে বাঁধ বাধা হচ্ছিল আরেকদিকে প্রকৃতি নানা ভাবে আমাদের অমংগলের সংকেত পাঠানো আরম্ভ করেছিল । আসলে প্রকৃতির হঠাৎ অন্যরকম আচরণকে আমরা সবসময় ধরে নিই এইসব অমংগলের চিহ্ন। সে-সময়ের এরকম কয়েকটি ঘটনার কথা বলি-

ঘটনা এক: আমার বোনের স্বামীর তখন একটা পালিত মুরগী ছিল । সেই মুরগী হঠাৎ করে প্রতিদিন সকাল বিকেল বাড়ির কার্নিশে উঠে শুধু একনাগারে ডাকা আরম্ভ করলো । সাধারনত মুরগী এইভাবে কখনো ডাকে না । তো মুরগীর এই ডাকা দেখে আমরা গৃহস্থরা ধরে নিলাম কিছু একটা ঘটনা ঘটতে চলছে । না হলে কেন মুরগী এইভাবে ডেকে যাবে!

ঘটনা দুই: শুধু ঘরের পালিত মুরগী না, বনের অনেক মোরগ-মুরগীরা জংগল ছেড়ে আমাদের গ্রামে ঢুকে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে দিয়েছিল । সচরাচর জংগলে থাকা মুরগীরা গ্রামে ঢুকে না ।

তাছাড় গভীর রাতে টিয়া পাখির দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যেতো তাড়স্বরে ডাকতে ডাকতে ।

ঘটনা তিন: একদিন ভোর বেলায় গ্রামে সবাই ঘুম থেকে জেগে দেখলাম জংগলের দুটো হনুমান আমাদের গ্রামে এসে বসে আছে ।

পশু-পাখিদের এরকম আচরণ দেখে আমাদের গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বীরা বলতে লাগলো এসবই হচ্ছে কুমংগলের লক্ষণ। আমাদের জন্য কু-বার্তা পাঠাচ্ছে প্রকৃতি । এরপর পরেই তো কাপ্তাই বাঁধের পানিতে সব ডুবে গেল । আর আমরা জীবনের সবকিছু হারিয়ে সারাজীবনের মতো যাযাবর হয়ে গেলাম ।

ক্ষতিপূরণ:

কাপ্তাই বাঁধের পানিতে আমাদের প্রায় ১৪/১৫ একর জায়গা পানিতে ডুবে গেছে । কিন্তু সেসব জায়গার ক্ষতিপূরণ পেয়েছি অনেক কম । আমার মনে আছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাত্র তখন ৯ হাজার টাকা পেয়েছিলাম আমরা । কিন্তু এটাতো সত্যি টাকা দিয়ে কি সবকিছুর ‘ক্ষতির পূরণ’ হয়! হয় না । আমাদেরও হয় নি । সবকিছুতো পানিতেই ডুবে গেল শুধু স্মৃতিগুলো রয়ে গেলো!

-রাজার কোন ভূমিকার কথা আপনার মনে পড়ে?

আমাদের চাকমা রাজা বাঁধ নিয়ে বা সে-সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের কোন বার্তা দিয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না । আমাদের কাছে রাজা মানেইতো অন্যরকম । কিন্তু রাজার ভূমিকা কি তা আমি জানি না । তবে মনে আছে আমার বয়সকালে প্রত্যেক বছর রাজ-পূণ্যাতে যেতাম । রাজ পূণ্যাহ মানেই তো মেলা । তিন চার দিন ধরে জমজমাট মেলা বসতো । কি থাকতো না সে মেলায়- হরেক রকম দোকান পাট, যাত্রাপালা । কুমিল্লা, ব্রাক্ষনবাড়িয়া থেকে যাত্রা দল ভাড়া করে এই পূণ্যাতে আনা হতো । রাত এগারটার দিকে যাত্রা পালা শুরু হয়ে শেষ হতো সকালে । এইসবই তো এখন স্মৃতির অংশ মাত্র ।

মেগেনিতে নতুন জীবন:

মেগেনিতে এসে জায়গা কিনে বাড়ি করলাম আমরা । এই নতুন জায়গায় এসে এক বছরের মতো চাষবাসও করলাম । এখানে বলে রাখা ভাল যে আমরা ডুবে যাওয়া গ্রাম ছেড়ে এই মেগোনিতে চলে এলেও আমাদের কাছের অনেক আত্মীয়-স্বজন লংগদু এবং তার আশপাশে জায়গায় রয়ে গিয়েছিল । কিন্তু এক কি দেড় বছর পর সেসব আত্মীয় স্বজন সবাই আবার মেগোনিতে আমাদের কাছে চলে এলো । এবং এসেই বললো এই দেশে আর থাকা যাবে না । 

  • তাদের কেন মনে হলো যে আর এই দেশে থাকা যাবে না?

বাঙালিদের জ্বালায় । তোমাদের হয়তো জানা নেই তখন মাত্র হিলে বাঙালিদের ঢুকা শুরু হয়েছিল । এবং সেই তখন থেকে বাঙালিরা আমাদের মেয়েদের দিকে কু-দৃষ্টি দিতে শুরু করে দেয় । তাদের এই কু-দৃষ্টি দেখে আমার আত্মীয়-স্বজনদের মনে তখনই ভয় ঢুকে গিয়েছেল এই বাঙালিরা একদিন আমাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে । এই ভয় থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নিলো ভারতে চলে যাওয়ার ।’

তারপর যা হয় ওদের ভয় আমাদের মাঝেও সংক্রামক হয়ে ঢুকে গেলো । ওদের দেখাদেখি আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম একসাথে দেশান্তরী হবার, ভারতে চলে যাবার । আসলে এখন বুঝতে পারি দেশান্তরী হবার জন্য শুধু যে এই ভয়টা দায়ী তা কিন্তু নয় । বাড়ি ডুবে যাওয়া, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে এভাবে ক্রমান্বয়ে জায়গা বদল করতে বাধ্য হওয়া, ঠিকমত জায়গা না পাওয়া সব মিলিয়ে আমাদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল তখন । মনে হয়েছিল এই দেশ আর আমাদের দেশ না ।

তারপর দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত:

সে-সময় আমাদের কে নিয়ে গেছে বা কার নেতৃত্বে ভারতে চলে গিয়েছিলাম তা আর এখন মনে নেই । তবে মেগোনি থেকে ভারতে যাওয়ার রাস্তা তখন অনেকের চেনা ছিল । আমার মনে আছে আমরা মোট ৬০ পরিবার একসাথে গিয়েছিলাম । যারা আমাদের গাইড করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে আমরা টাকা দিয়েছিলাম । তবে তাদেরকে বলেছিলাম আগে আমাদের ভারতে পৌঁছে দিয়ে আসো তারপর তোমাদের টাকা দেবো । তখনও কিন্তু আমার বাবা মা বেঁচে ছিলেন ।

সেই গাইডরা আমাদেরকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মোন-গাঙের মনু ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে গেল । মনু ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি সেখানে আমাদের মতো অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে । সে-সময় ত্রিপুরার চাকমা নেতা বাবু স্নেহ কুমার দেওয়ান, বাবু কামিনী দেওয়ান, বাবু ঘনশ্যাম দেওয়ান এবং বাবু ইন্দ্র মনি দারোগা আমাদের দেখতে মনু ক্যাম্পে আসলেন । এখানে বলা ভাল আমাদের এই গ্রুপটির মতো আরো অনেকে মিজোরামের দিকে না গিয়ে অন্য সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন ।

আসলে মানুষ তখন নিজের সুবিধা মতো যে যেভাবে পারে, যে যেদিকে পারে সেভাবেই দেশ ছেড়েছে । যেমন কাজলঙের মানুষ গেছে মিজোরামের দেমাগ্রী হয়ে । আর আমরা মেগেনি কূলের মানুষরা ভারতে ঢুকেছি ত্রিপুরার বর্ডার দিয়ে । তো সেখানে পৌঁছে আমাদের মনু ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে আমরা আমাদের নাম লিখালাম ।

  • ভারতে পৌঁছাতে কতদিন লেগেছিল আপনাদের?

মেগেনি থেকে হাঁটা পথে মনে হয় প্রায় ৭ থেকে ৮ দিন লেগেছিল আমাদের । বাড়িতে আমার তখন ৭/৮ টি মহিষ ছিল । সেই মহিষ গুলোকেও আমরা সাথে করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলাম ।

মনু ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর আমরা পড়লাম এবার মহা-বিপদে । সেখানে গিয়ে শুনলাম ভারত সরকার আমাদের নিয়ে যাবে কুচবিহারে । এদিকে বাবু স্নেহ কুমার দেওয়ান, বাবু ঘনশ্যাম দেওয়ান, বাবু ইন্দ্রমুনি দারোগা আমাদেরকে বললেন দেখো বাপ-ভেই লক তোমরা এখানে এসেছো খুব ভালো । কিন্তু ভারত সরকার তোমাদের এখন নিয়ে যেতে চাইছে বিহারে । কিন্তু বিহারে যদি তোমরা যাও সেখানে একজনও তোমরা বাঁচতে পারবে না ।

  • কেন তাঁদের এমন মনে হলো?

জানি না । তবে আমরা অন্যদের থেকে সেই বিহার নিয়ে নানা গল্প শুনেছি । যেমন- বিহারের বড় বড় গাছ গুলো নাকি রাতে দেবেদা[8] হয়ে মানুষ খেয়ে ফেলে । আর নাকি এক প্রকার জোঁক আছে যে জোঁক গুলো মাথা থেকে পা পর্যন্ত ধরলে সে মানুষটা মারা যায় (হাসি) । এটাকে নাকি সেখানকার লোকেরা বলে রাক্ষুসে জোঁক । 

এইসব শুনে আমরাতো মহা বিপদে পড়ে গেলাম । সরকার চাইছে বিহারে নিতে আর স্নেহ বাবুরা চাইছে নেফাতে নিতে । তাঁরা আমাদের বললেন আমরা তোমাদের নেফাতে নিয়ে যেতে চাই । শুধু একটা কাজ করতে হবে এখান থেকে তোমাদের হেঁটে কুমার ঘাট পর্যন্ত যেতে হবে । সেখানে পৌঁছাতে পারলে তোমরা ট্রেনে করে নেফায় যেতে পারবে । তবে সবাইকে নিজ খরচে যেতে হবে ।

এদিকে মনু ক্যাম্পে কম হলেও ৫/৬ হাজারের মানুষ আমরা জড়ো হয়েছি । এবং সবাই চাকমা । সেই মনু ক্যাম্প থেকে পরিবারের জনসংখ্যা অনুযায়ী আমরা সরকার থেকে রেশনের টাকা পেতাম । যেমন এক পরিবারে যদি ৭ থেকে ১১ জন থাকে তাহলে তারা পাবে সপ্তাহে মাত্র ৮ টাকা, ৭ জন থেকে কম হলে পাবে ৬ থেকে ৫ টাকা । তখন চালের দাম ছিল অনেক কম । তাই সরকার টাকাই দিতো । লম্বা লম্বা করে তিন/চারটি বাড়ি করে ক্যাম্প করে দিয়েছে আমাদের থাকার জন্য । এই ক্যাম্পে আমরা এক হাত জায়গায় দুই জন করে গাদাগাদি করে ঘুমাতাম ।

সেই সময়ে ঘটে যাওয়া কত ঘটনার স্মৃতি মনেতে আসে যায় । অনেক স্মৃতির ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে আবার অনেক স্মৃতি সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে । রেশনের টাকা পাবার পর বাজারে গিয়ে চাল কিনতে চাইলে পরিবারের সংখ্যার হিসেব দিতে হতো । সরকার রেশন কন্ট্রোল করছে তাই এই নিয়ম ছিল সবার জন্য । তবে একটা বিষয় ছিল আমরা চাল ৯ আনা করে কিনতে পারলেও সেখানকার অধিবাসীদের ১২ আনা করে কিনতে হতো ।

যাই হোক, বিহার আর নেফায় যাওয়া নিয়ে ক্যাম্পের লোকজন দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল । যাদের হাতে টাকা আছে তারা যেতে চাইছে বিহার আর আমাদের মতো যাদের হাতে টাকা নাই তারা যেতে চাইছি নেফা । আমাদের নেফা যাওয়ার পক্ষে আছেন সেখানকার নেতা বাবু স্নেহ কুমার দেওয়ানরা । এই গোলমেলে পরিস্থিতিতে তাঁরা মানে চাকমা লীডাররা ঠিক করলেন আমাদেরকে গাড়ী করে কুমারঘাট নিয়ে যাবেন । কিন্তু গাড়ি ভাড়ার টাকাটা আমাদেরকে দিতে হবে । তাঁরা বললেন যেহেতু তারা কোন কোম্পানি নয় তাই আমাদের গাড়ি ভাড়ার টাকা তাদের কাছে নেই । এই টানাপোড়েনের মধ্যে তাদের নেফা যাওয়ার প্রস্তাবে আমরা রাজী হলাম । নেফা যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা প্রথম কুমারঘাট পর্যন্ত হেঁটে যাবো, এইভাবে সব ঠিকঠাক হলো । এইবার নেফা যাওয়ার পালা!

কিন্তু আমাদের এই গোপন পরিকল্পনা সরকারের কানে চলে গেলো । এবার সরকার ঠিক করলো যে যারা বিহার যেতে চাইছে না তাদের রেশন বন্ধ করে দিবে । আর যারা বিহার যাবে বলে সম্মতি দিয়েছে তাদের জন্য রেশনের টাকা বরাদ্দ থাকবে । এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর কাকতালীয়ভাবে একটা ঘটনা ঘটলো । সরকারকে না জানিয়ে যেদিন আমরা কুমারঘাট যাবো বলে ঠিক করেছিলাম ঠিক সেদিন রাতেই বিহারে নেয়ার জন্য সরকার ক্যাম্পে ট্রাক নিয়ে আসলো এবং আমাদেরকে একপ্রকার জোর জবরদস্তি করে ট্রাকে তুলার চেষ্টা করতে লাগলো । এই হট্টগোলের মধ্যে তখন দেখা গেল যে, যারা বিহার যাবে বলে রাজি ছিল তারা গেল নেফার পথে আর যারা নেফা যাবে বলে ঠিক করেছিল তারা চলে গেল বিহারে (হাসি)। দেখা গেল এক পরিবারের মধ্যে স্ত্রী গেল নেফাতে আর জামাই গেল বিহারে । কারন কারোর কোন অগ্রিম প্রস্তুতি ছিল না এইভাবে বিহার আর নেফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার ।

এইভাবে রাতের অন্ধকারে এক পরিবারের লোকজনকে আবার আলাদা হতে হলো একে অপরের কাছ থেকে । আমি জানি না এরপরে তাদের আবার দেখা হয়েছে কিনা ।

অবশ্য তার একটু আগে আমরা যখন জানতে পেরেছিলাম যে সরকার ট্রাক নিয়ে আসছে আমাদের বিহারে নেওয়ার জন্য তখন তাঁরা আমাদেরকে বলেছিল”তোমাদের যখন ট্রাকে উঠানোর জন্য জোর করবে তখন তোমরা তাদেরকে ঠেলে বের হয়ে হাঁটতে থাকবে । তাদেরকে ভয় পেলে চলবে না । পুলিশ হয়তো তোমাদের আটকানোর চেষ্টা করবে কিন্তু তোমরা থামবে না ।” তাদের কথা মত আমরা মনু ক্যাম্প থেকে বের হয়ে সেই রাতেই কুমারঘাটের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেছিলাম ।

আর যারা ট্রাকে উঠতে বাধ্য হয়েছিল তাদেরকে সেই রাত্রেই মোনছড়া ক্যাম্পে নিয়ে গেল তারপর সেখান থেকে বিহার । আমি পরে শুনেছি বিহারে অনেক পরিবার গিয়েছে । তবে আমি সঠিক সংখ্যা জানি না । সেই রাতে ১০ থেকে ১২ বড় বড় ট্রাক এসেছিল । আমার ধারনা এইসব হিসেব ভারত সরকারের কাছে থাকবে ।

সেদিন রাতে মনুক্যাম্প ছাড়ার পর আমরা টানা ২৫ মাইল হেঁটে সকাল বেলা দশ/এগারটার দিকে কুমারঘাটে পৌঁছলাম । আমাদের সাথে ছোট ছোট বাচ্চা ছিল, বুড়ো-বুড়ি ছিল । এর আগেই বলেছি আমি মেগেনি থেকে আমার সাথে মহিষ নিয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু এইবার আমি সেই মহিষ গুলোকে মনুতে আমার ভাগ্নে আর ভাইয়ের ছেলেদের নিকট রেখে আসতে বাধ্য হলাম । ওরা বললো সেই মহিষগুলো তারা বিক্রি করে দেবে । আমার আসলে তখন কিছুই করার ছিল না । আমার সাধের মহিষ গুলো তাদের কাছে রেখে এলাম নেফায় যাবো বলে ।

এদিকে কুমারঘাটে পৌঁছানোর পর দেখলাম এখানে আমাদের থাকার জন্য কোন আপাতঃ ব্যবস্থা নেই । তবে আমাদেরকে রাখা হলো কুমারঘাটের গ্রামের স্থানীয় চাকমাদের বাড়িতে ও দোকানে । পরে শুনেছি বাবু স্নেহ কুমার চাকমা ও তাঁর দল সেখানে স্থানীয়দের কাছে গিয়ে বলেছেন ’পাকিস্তান থেকে আমাদের চাকমারা আসতেছে, আমাদেরকে একটু সাহায্য করতে হবে। তাদেরকে কিছুদিনের জন্য এখানে রাখতে এবং খাওয়াতে হবে।’ তাঁদের এই অনুরোধের কারনে স্থানীয় চাকমারা নিজেরা টাকা পয়সা তুলে আমাদের দুই দিন খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করলেন । সংখ্যায় আমরা কম ছিলাম না, ৪০০ থেকে ৫০০ জনের কাছাকাছি হতে পারে । এতজন মানুষকে দুইদিন ধরে সেখানকার স্থানীয় চাকমারা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন । দু’দিন পর বাবু স্নেহ কুমার দেওয়ানরা মিটিং করে এসে আমাদের বললেন, তোমাদের এখানে আর থাকা হবে না ।

  • এরপর আপনারা কি করলেন?

সেটা আরেক কাহিনী। তাঁরা আমাদের বললেন এখান থেকে নাকি পেজাত্তল যেতে হবে। পেজাত্তল কুমারঘাট থেকে পচিঁশ মাইল দূর । সেখান থেকে করিমগঞ্জ না কোথায় জানি নিয়ে যাবে আমাদের । তবে পেজাত্তল যেতে হবে হেঁটে হেঁটে । আবার নতুন করে পচিঁশ মাইল হাঁটতে হবে শুনে আমি এবং আমার সাথে যাওয়া বাকি তিন পরিবার খুব হতাশ হয়ে গেলাম । এবং এইবার সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়ে গেলাম । এমনিতে মাত্র ২/৩ দিন আগে একরাত্রেই পঁচিশ মাইল হেঁটে আমরা সকলে খুব ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম । আবার হাঁটা! তাছাড়া তাঁদের কথা বার্তায়, পরিকল্পনায় কোন ঠিক-ঠিকানা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না । প্রথমে বলেছিল ২৫ মাইল হাঁটলে হবে কিন্তু এখন বলছে আবার ২৫ মাইল । তাই সেই মুহূর্তে তাঁদের উপর বিশ্বাস রাখতে আমরা পারছিলাম না ।

আমি এবং আরো তিন পরিবার মিলে ঠিক করলাম আমরা আর কোথাও যাবো না । এইবার সোজা দেশে ফেরত চলে যাবো । তবে সেখানে থাকা বাকি পরিবারগুলো তাঁদের কথামত চলে গেল পেজাত্তলের দিকে ।

আবার দেশে ফেরার পালা:

দেশে ফেরত আসাও কিন্তু সহজ ছিল না । দেশে ফিরে আসার পর হয়তো সরকার আমাদের ধরে জেলে দিতে পারে । তবু আমরা সেই মুহূর্তে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম । কারন সেখানে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম কোনকিছুর ঠিক-ঠিকানা নেই । কোথায় নিয়ে যাবে, কে নিয়ে যাবে, আমাদের নিয়ে কি করবে বা কি করতে চায় এসব তাঁরা নিজেরাও জানে না । যদিও তাঁরা সকলেই নেফা নেফা করছিল কিন্তু সেই নেফা কোথায়, কোন জায়গায়, কতদূর সে-সবও তাঁদের জানা আছে বলে আমার মনে হয় নি ।

এইবার কুমারঘাট থেকে দেশের উদ্দেশ্যে আমরা রওয়ানা দিলাম । আমরা আবার মনুতে ফিরে আসলাম । যেখান থেকে কুমারঘাট গিয়েছিলাম সেখানে সপ্তাহ খানেক জিরিয়ে তারপর সেখানকার স্থানীয় লোকজনের সাহায্য নিয়ে ছওমনু হয়ে আমরা চার পরিবার মেগেনি নদী দিয়ে আবার আমাদের নিজেদের দেশে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকলাম (হাসি) ।

সেটা ১৯৬৪ সালের সময়ের কথা । নিজের দেশ ত্যাগ করে আবার ফেরত আসা!  আসলে ফেরত আসা বললে ভুল হবে । সেখানে কোন কূল কিনারা দেখতে না পেয়ে  ফেরত আসতে বাধ্য হওয়া বলা যায় (দীর্ঘশ্বাস সহ হাসি)।

সেসময় মেগেনির নাড়েই ছড়িতে একটি সরকারি ক্যাম্প ছিল । ক্যাম্প মানে সরকারের বাহিনীর ক্যাম্প । তো আমরা যখন মেগেনি নদী দিয়ে দেশে ঢুকছি তখন আমাদের আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো । ওখানে বসে শুনলাম ক্যাম্পের অফিসার ওয়ারলেসে কথা বলছে ঢাকার সাথে । তারা জানতে চাইছে আমাদেরকে তারা এখন কি করবে? তখন ঢাকা থেকে বলা হলো আমাদের যেন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় ।

আমাদের সাথে থাকা মহিষগুলোকে হেঁটে হেঁটে আনার দায়িত্ব নিয়ে তারা আমাদের চার পরিবারের লোকজনকে বাঁশের চালিতে উঠালো মেগেনি থানায় আনার জন্য । আমাদের সাথে ছিল সেই ক্যাম্পের কয়েকজন (ইপিআর না কি নাম বাহিনীর) সদস্য । তখন মেগেনি থানার দায়িত্বে ছিল যামিনী দারোগা নামে একজন বড় দারোগা । তিনি আমাদের এই অবস্থায় দেখে বললেন, সরকার এসব কি করে! আমি এদেরকে নিয়ে এখন কি করবো? তখন তিনি কাগজে কিছু একটা লিখে আমাদের দস্তখত নিয়ে বললেন, যাও, সবাই নিজ নিজ জায়গাতে চলে যাও ।

সাথে আবার আমাদের কুড়ি সের করে গম রেশন হিসেবে দিলেন । এই কুড়ি সের গম হাতে নিয়ে আমরা এবার নিজেদের কিছুদিন আগে ছেড়ে যাওয়া জায়গায় চলে আসলাম । এবং বাকি তিন পরিবার মানে আমার জেঠাতো ভাইরাও তারা আবার লংগদুতে ফেরত চলে গেল । এরপর আমি আমার শ্বশুর এর জায়গা বাবুছড়াতে বাড়ি-ঘর বানিয়ে স্থায়ী হয়ে গেলাম । আমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে সে-সময় আমার শ্বশুররা ভারতে আমাদের সাথে চলে যায় নি । কিন্তু আমার জন্য তখন একটি দুঃখের খবর অপেক্ষা করে আছে । মেগেনিতে ফিরে আসার পরপরই আমি জানতে পারলাম আমি চলে যাবার পর সরকার আমার নামীয় তিন একর জমি চাষবাসের জন্য অন্যদের দিয়ে দিয়েছে ।

ভারতে আমরা মনে হয় মাত্র তিন মাস ছিলাম । তার মধ্যে মাত্র এক সপ্তাহ কুমারঘাটে ছিলাম আর বাকি সময়টা কেটেছে রাস্তায় হাঁটার মধ্যে দিয়ে এবং মনু ক্যাম্পে । তো দেশে ফিরে আমার এই তিন একর জমি বেহাত হওয়া থেকে বাঁচাতে রামগড়ের সরকারি অফিসে ধর্না দেওয়া শুরু হলো আমার । তখনতো সব অফিসিয়াল কাজ হতো রামগড় থেকে । এবং সেই সময়ে মেগেনি থেকে রামগড় যাওয়া সহজ ছিল না । আমার এই তিন একর জমি উদ্ধার করতে আমার একেবারে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । অনেক কষ্ট করার পর অবশেষে সরকার আমার তিন একর জমি আমার কাছে ফেরত দিয়ে দিল ।

আগে বলেছিলাম আমাদের পরিবারের একটি বন্দুক ছিল, যেটি আমরা সাথে করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেশে ফেরার সময় সেই বন্দুকটা আর আমরা ফেরত আনতে পারি নি । আর এই বন্দুক নিয়ে আমরা আবার আরেকটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম ।

এরই মধ্যে যামিনী দারোগা বদলী হয়ে গেলেন, এবার থানায় আসলো একজন নতুন বাঙালি দারোগা । সে দারোগা এসেই আমাদের বিরুদ্ধে বন্দুক পাচার মামলা দিয়ে দিল । সে বন্দুক পাচার মামলায় আমাদের গ্রেফতার করার জন্য সে দারোগা একেবারে আমাদের বাবুছড়া বাড়িতে এসে একদিন হাজির হলো । এই বন্দুক পাচার মামলাটি ছিল অ-জামিন যোগ্য মামলা । তো সেদিন কোনমতে গ্রেফতার হওয়া থেকে বেঁচে গেলেও সেই বাঙালি দারোগা একটা তারিখ দিয়ে বলে গেল, এই তারিখে রামগড়ের কোর্টে গিয়ে তোমাদের জামিন নিতে হবে ।

তো কি করা । তার কথা মতো সেই তারিখে জামিনদার সহ আমরা, বাবা সহ রামগড় কোর্টে গিয়ে জামিন নিলাম । এইভাবে পাঁচবার কি ছয়বার কোর্টে হাজিরা দেওয়ার পর তখনকার টিএনও বললেন, বন্দুকটাতো আপনার বাবার নামে । আমি চাইলে আপনার বাবাকে ছয় মাসের জেল-হাজত বাস করাতে পারি । কিন্তু আপনার বাবা বুড়ো মানুষ তাই ৫০০ টাকা জরিমানা ধার্য্য করলাম । তিনি আবার আমাদের জীজ্ঞেস করলেন আমরা তৎক্ষনাৎ ৩০০ টাকা দিতে পারবো কি না! যদি দিতে পারি তাহলে মামলাটি তখনিই তিনি শেষ করে দিবেন । এবং মামলা থেকে আমাদের অব্যাহতি দিয়ে দিবেন ।

সেসময় ৩০০ টাকা মানে অনেক টাকা । আমাদের হাতে এতো টাকা তখন সেই মুহূর্তে ছিল না । তারপরও আমরা খুঁজে টুঁজে ১০০/১৫০ টাকা যোগাড় করলাম । তখন দারোগা বললেন জামিনের দরকাস্ত লিখে কোর্টে জমা দিতে । দরখাস্তের সাথে ১০০ টাকা দিয়ে জামিনের র্প্রাথনা করলে র্কোট আমাদের আরো পঁচিশ দিন সময় দিলেন বাকি ২৫০ টাকা জমা দেবার জন্য । এবং সেদিনই  মামলাটি শেষ হয়ে যাবে ।  আমরা রামগড় থেকে বাড়ি ফিরে এলাম । আবার পঁচিশ দিন বাদে বাকি টাকা যোগাড় করে আমরা রামগড় গিয়ে কোর্টে জমা দেওয়ার এই বন্দুক পাচার মামলা থেকে বাবা আমি মুক্তি পেলাম । এই ঘটনাটি এখন আমি খুব সহজ করে বলছি । তখন কিন্তু এই ঘটনাটি আমাদের জীবনে নরক হয়ে এসেছিল । তাছাড়া রামগড় আর মেগেনির দূরত্ব ছিল অনেক । এবং সবটাই ছিল হাঁটা পথ । কাজে বুঝতে পারছো সেই মামলা নিয়ে আমরা কিরকম বিপদে পড়েছিলাম ।

আসলে আমরা যখন দেশ ছাড়ছিলাম তখন সবাই যার যার বন্দুক সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিল । তো আমরাও নিয়ে গিয়েছিলাম । ভারতে গিয়েই সেই বন্দুক ক্যাম্পে জমা দিতে হয়েছিল । তাই ফেরত আনা সম্ভব হয় নি ।

যাই হোক এইভাবে আবার এখানে আমাদের জীবন শুরু হলো । আমরা পরে এখানে বসে শুনেছি বিহারে যাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সরকার খুব চেষ্টা করেছিল সেখানে রাখার । এমনকি পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল যাতে তারা সেখান থেকে পালাতে না পারে । কিন্তু মাত্র এক মাস পরেই সরকার আবার তাদেরকে সেখান থেকে ফেরত নিয়ে আসে । এবং তাদেরকে নেফাতে নিয়ে যায় । অবশ্য এই কাহিনী আমরা পরে মানুষের মুখে শুনেছি ।

শেষ বয়সের ভাবনা:

আজ জীবনের শেষ দিকে এসে আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের সেই সময়ের দুঃশ্চিন্তা আজ সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে । হিল চাদিগাঙের সবকিছু এখন বাঙালিদের দখলে । আমাদের সেই সমৃদ্ধ মেরুং এখন আর পাহাড়িদের দখলে নেই। মেরুং এখন পুরোটাই বাঙালির দখলে । এবং এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার হিলের সব পাহাড় অচিরেই বাঙালিদের দখলে চলে যাবে । এটি মনে পড়লেই আমার শুধু কান্না পাই ।

পানিতে ডুবে যাবার পর আমি কয়েকবার সেই পুরোনো গ্রামে গিয়েছিলাম । গিয়ে দেখি সেখানে এখন কোন চাকমার বসতি আর নেই। সেটেলার বাঙালিরা এখন সেখানে বসতি গড়েছে । কাপ্তাই বাঁধের পানি কমে গলে আমাদের ডুবে যাওয়া সেই ধান্য জমি গুলো এখনো ভেসে উঠে । আর সেসব জমি এখন বাঙালিরা দখলে নিয়ে চাষ-বাস করে খায় । এসব দেখলে এবং ভাবলে আমার এখনো বুক পুড়ে যায় কষ্টে,দুঃখে, অপমানে ।

আমার জেঠাতো ভায়ের ছেলে সত্যবান চাকমা এখন অরুনাচলে বসবাস করছে । সেখানে তারা এখন অনেক সুখে আছে । যদিও এখনো তারা ভারতের নাগরিকত্ব পায় নি । তবুও সেখানে এখানকার মতো দলাদলি, মারামারি অন্য কিছু নেই । আমার সেই ভাই সত্যবানের ছেলে একবার এখানে দেশে বেড়াতে এসেছিল।

মেগেনি থেকে ভারতে চলে যাবার সময়ের কথা, স্মৃতির কথা মনে পড়লে সবকিছু আজো কল্পনার মতো লাগে । আমরা বর-পরঙে ৬০ পরিবার একসাথে গিয়েছিলাম । আর মাত্র ৩ পরিবার দেশে ফেরত এসেছিলাম । যাবার পথের কষ্টের কথা আর কি বলবো!  আমাদের এই ৬০ পরিবারের দলের অনেক ছোট ছোট বাচ্চা হাঁটার সময় রোগে অসুখে ভুগে মারা গিয়েছিল । অনেক গর্ভবতি মা রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে বাধ্য হয়েছে । হাঁটতে হাঁটতে মনে হতো এই রাস্তা কখন ফুরাবে । কখন পৌঁছাবো ভারতে । ভারত এত দূর কেন! হাঁটার এই কষ্টকর সময়ের অনেক স্মৃতির মধ্যে একটি স্মৃতি আজো আমার চোখে ভাসে । সেটা হচ্ছে হাঁটার সময় রাস্তায় অনেক বড় মাট্যা দুর (মাটিতে থাকা কচ্চপ) দেখা পেয়েছিলাম । যেটি প্রায় ৪ হাত সমান লম্বা ছিল । আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন আমাদের হিল ট্রাক্টস ছিল ঘন অরণ্যে ভরা এক জায়গা ।

১৯৬৪ সালের আগে থেকেই আমাদের হিল চাদিগাঙে ধীরে ধীরে বাঙালিরা ঢুকতে শুরু করে দেয় । এই ঢুকতে থাকা বাঙালিদেরকে নিয়েও আমাদের ভয় শুরু হয় তখন থেকেই । তারপর বাঁধ বাধা শুরু হলো । আমাদের সেই ভয়টা এবার বড় আকারে রূপ নেয়া শুরু করে । আমার মনে আছে বিকেল বেলায় গ্রামের সবাই আমাদের বাড়িতে গল্প করতে আসতেন । সবার তখন বাঁধের পানির গল্প বাদে অন্য যে গল্প করতেন তা হচ্ছে নতুন বাঙালির বসতির গল্প । সবাই তখন বলতেন মনে হয় আর এখানে থাকা যাবে না । বাঙালিরা যেভাবে আসা শুরু করেছে । আর নিজেদের বাঁচাতে চাইলে আমাদের ভারতে চলে যেতে হবে । এভাবেই এক অনিশ্চিয়তার মধ্য দিয়ে আমি আমরা আমাদের সময় পার করে গেলাম । আমি শুধু অন্ধকার দেখি আমার এই নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে!

এখন মনে হয়, তখন যদি একেবারে বর-পরঙে গিয়ে স্থায়ী হতে পারতাম তাহলে হয়তো ভালো হতো । তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমানের এই কঠিন পরিস্থিতি দেখতে হতো না, ট্রমার মধ্যে শেষ বয়সটা কাটাতে হতো না।


[1] পাহাড়ের শিরোপিঠ বা পাহাড়ের পৃষ্ঠ

[2] পানিতে ডুবে থাকা জমি।

[3] আগে এখনকার মতো ৫ জন ভান্তে পাওয়া সহজ ছিল না । তাই একজন ভান্তেকে সামনে রেখে খুব কম খরচে যে দান করা হতো সেটাই পুগলিক দান। এখন অবশ্য এই পুগলিক দানের কথা তেমন শোনা যায় না ।

[4] কল্পতরু চাকমা ছিলেন চাকমা জাতির একজন বিখ্যাত কারুশিল্পী।

[5] নদীর বড় বড় চিংড়ি মাছ ।

[6] মেগেনি মেইনি  দিঘীনালা । বর্তমান দিঘীনালার নাম ছিল তখন মেগেনি/মেগেনি কূল । মেগেনি কূল মানে বর্তমানের বৃহত্তর দিঘীনালা এলাকাকে বুঝায় । এখনো পাহাড়িরা বিশেষ করে চাকমা জাতির মানুষেরা দিঘীনালাকে মেগেনি কূল বলে থাকেন ।

[7] পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা জিনিষপত্র বহণের কাজে এটি ব্যবহার করে থাকে।

[8] খারাপ দেবতা।



Categories: Opinion

Tags: , , , , , , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: