নোয়াব আলী, গুইমারা, খাগড়াছড়ি
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন- Samari Chakma, 2013, Khagrachari
[ বর-পরং সিরিজের এই পর্বের লেখাটি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত একজন পুরাতন বসতি বাঙালির স্মৃতিচারণ। তাঁর মতো আরো কিছু সংখ্যক বাঙালি পরিবার কাপ্তাই বাঁধের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। জনাব নোয়াব আলীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১৩ সালে খাগড়াছড়িতে, আমার আইনজীবী চেম্বার, মাস্টার্স ল’ চেম্বারে। আমি তখন সবেমাত্র আইনজীবী সনদ প্রাপ্ত হয়ে একজন সিনিয়র বিজ্ঞ আইনজীবীর অধীনে কোর্টে কাজ করা শুরু করেছি। একদিন একজন বৃদ্ধ আমাদের চেম্বারে ঢুকলেন ছেলের হাত ধরে। আমার সিনিয়র তাঁর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন জনাব নোয়াব আলী এই পাহাড়ের একজন পুরাতন বসতি বাঙালি ও কাপ্তাই বাঁধের একজন ভিকটিম। এবং একটি মামলার বাদীও তিনি। খাগড়াছড়িতে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জোর জবরদস্তি করে জনাব নোয়াব আলীর বসতভিটার ফাঁকা জায়গায় সেটেলার বাঙালির পরিবারের বসবাসের জন্য বাড়ি করে দেয়, সাথে এই বলে তাঁকে আশ্বাস দেয়া হয় যে, এই ব্যবস্থা একটি সাময়িক ব্যবস্থা। এবং কিছুদিনের মধ্যে সেই সেটেলার বাঙালিদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু অনেক বছর পার হয়ে যাবার পরও সেই সেটেলার বাঙালিরা নোয়াব আলীর জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিল না। বা তাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল না। তাই জনাব নোয়াব আলী তাঁর ভিটা থেকে তাদের উচ্ছেদের জন্য খাগড়াছড়ি কোর্টে একটি উচ্ছেদের মামলা দায়ের করেন।
এই ঘটনাটি শুনার পর আমি তৎক্ষনাৎ তাঁর একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিয়ে আমার ফোনে রেকর্ড করে রেখে দিয়েছিলাম। যখন ২০১৮ সালে আমার বইটি বের করার সময় তাড়াহুড়োতে এই রেকর্ডটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এই সাক্ষাৎকারটি আবার হঠাৎ করে আমার হাতে চলে আসে ২০২০ সালে একটি পেনড্রাইভের মাধ্যমে। এযাবৎ পর্যন্ত আমার সকল সাক্ষাৎকার চাকমা জাতির মানুষের কাছ থেকে নেওয়া। এই সাক্ষাৎকারটিই প্রথম কাপ্তাই বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অন্য জাতির মানুষের কথা। জনাব নোয়াব আলী বেশ কয়েকবছর আগে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। ]
কাপ্তাই বাঁধ এবং আমার কথা:
আমার নাম নোয়াব আলী। আমার বয়স এখন আশি বা নব্বই বছরের কাছাকাছি হতে পারে। কাপ্তাই বাঁধের সময়ে আমাদের বাড়ির ঠিকানা ছিল শিল পৈতাং গ্রাম, ১১৪ নম্বর বালুখালি মৌজা। আমার মায়ের নাম আনোয়ার খাতুন আর বাবার নাম জবেত আলী মাতবর। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সে-সময় শিল পৈতাং গ্রামে আমরা প্রায় ১২০ বাঙালি পরিবার বসবাস করতাম। আমরা ছিলাম চাকমাদের মতো স্থায়ী বাসিন্দা। তাই বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমরা সকলের মতো ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছিলাম।
ফরম পূরণ করে জায়গা পেয়েছি। পাহাড়ি-বাঙালি মিলে আমরা সকলেই যেহেতু কাপ্তাই বাঁধের উদ্বাস্তু প্রজা ছিলাম, তাই সে-সময়ের রাংগামাটির ডিসি আমাদের ফরম দিয়েছিলেন। সেই ফরম পূরণ করার পর আমরা গুইমারাতে জায়গা নিয়েছিলাম। তবে সে-সময় অনেক বাঙালি ছিল যারা শুধু কাজের জন্য আসতো। সেসব বাঙালিরা কোথা থেকে আসতো তা আমার জানা নেই। শুধু জানতাম তারা কাজের জন্য আমাদের এখানে এসেছে।
সে-সময় আমাদের এলাকার হেডম্যান ছিলেন চাকমা রাজার ছোট ভাই বিরুপাক্ষ রায়। আমাদের এলাকার ধীরেন্দ্র মা’ জন(মহাজন) ছিলেন খুব বিখ্যাত মানুষ। কাপ্তাই বাঁধের পরে তাঁরা দিঘীনালায় চলে আসেন। আর মগবান মৌজাতে মা’জন হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন কামিনী দেওয়ান আর বিরাজ মোহন দেওয়ান।
রাংগামাটি শহর থেকে আড়াই মাইল দক্ষিণে ছিল আমাদের গ্রাম। গ্রামের এক কূলে বালুখালি গ্রাম মানে খালের পাড়ের এক কূলে আরেক কূলে ছিল রাংগামাটি শহর। আমাদের গ্রামের পরেই ছিল বিশাল ঝগরা বিল আর শুধু জমি। তারপরে চাকমাদের গ্রাম। তখন চাকমা আর বাঙালিদের মধ্যে সর্ম্পক খুব ভালো ছিল। এখনকার মতো দলাদলি ছিল না। সে-সময়ে চাকমা-বাঙালি একে অপরের উৎসবে আসা যাওয়া করতো। আমরা বাঙালিরা যেমন যেতাম তেমনি তারাও আমাদের ঈদের সময় সেমাই খেতে আসতো। এমনই সর্ম্পক ছিল আমাদের।
মাটি দিয়ে তৈরী আমাদের সেই গুদাম ঘরটি ছিল বেশ বড়। পানি আসার পর সেই বাড়ি এক রাতের মধ্যে ভেঙে পানিতে মিশে গেল একেবারে। বাঁধের পানি যখন গ্রামে ঢুকতে শুরু করলো তখন মাইক দিয়ে ঘোষণা দিচ্ছিল যে পানি আসছে, এবার সব ডুবে যাবে, লোকজন যেন নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। এতো বছর পরে, এই বুড়ো বয়সে আর সাল-তাল মনে নেই! এর আগে মানে গ্রামে পানি আসার আগে আমরা সাপমারা পাহাড়ে একটা নতুন ঘর বানিয়েছিলাম।
পানি আসার মুহূর্তে:
সেই সময়ের অনুভূতির কথা আর কী বলবো! জায়গাজমি সব কাপ্তাই পানিতে হারিয়েছি, এই হারানোর অনুভূতি কী বলা সম্ভব! তবে মনে আছে ঐ সময় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, এই বৃষ্টির মধ্যে মাইকে ঘোষণা চলছে পানি বাড়ার কথা। এই বৃষ্টির মধ্যে দেখি বাঁধের পানি একেবারে আমাদের উঠোনে। তারপর তাড়াহুড়ো করে এক-প্রকার দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে নৌকায় বাড়ির মালপত্র তুললাম। আমরা নৌকায় বাড়ির মালপত্র তুলে রেখে রাত কাটাতে সেই সাপমারা পাহাড়ের বাড়িতে চলে গেলাম। ফজরের নামাজের পর পাহাড় থেকে নিচে নেমে দেখি চারিদিকে শুধু পানি। আমাদের সেই বড় গুদাম বাড়ির কোন চিহ্ন নেই। সব কিছু পানিতে তলিয়ে গেছে।
“পানি এঁত্তে হুড়হুড়ে উদি গিয়ে”। এটা সত্যি যে প্রথম দিকে আমরা কেউ বিশ্বাস করি নি যে কাপ্তাই বাঁধের পানি এভাবে সবকিছু ডুবিয়ে দেবে। কিন্তু কী করবো! পরেতো বিশ্বাস করতেই হয়েছিল! এরপর আমরা নৌকায় তোলা মালপত্র নিয়ে খাগড়াছড়ির গুইমারাতে চলে আসি। এই গুইমারাতে আগে থেকেই আমরা সরকারের কাছ থেকে জায়গা জমি বুঝে নিয়ে বাড়ি করেছিলাম ।
পানি আসার পর সেই পুরাতন জায়গা থেকে আমরা নৌকায় করে প্রথমে মালছড়িতে আসি। তারপর মালছড়ি থেকে জিপ গাড়ি করে গুইমারার নতুন বাড়িতে। সে-সময় সরকার আমাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিলেও কোনো কাগজপত্র আমাদেরকে দেয় নি। এবারে আমাদের গুইমারার ঠিকানা হলো ২০৯ নম্বর বরটিলা মৌজা। এখানে আসার পর হঠাৎ একদিন খবর আসলো কাপ্তাই বাঁধের পানি আবার নেমে গেছে। সরকার বাঁধের পানি নাকি কমিয়ে ফেলেছে। এবং আমাদের জমি আবার ভেসে উঠেছে। এইসব শুনে আমি চলে গেলাম আবার সেই পুরাতন গ্রামে। গিয়েই সে ভেসে উঠা জায়গায় আবার নতুন করে বাড়ি বানালাম। কিন্তু তার ঠিক একবছরের পর আবার বাঁধের পানি এসে ডুবিয়ে দিল আগের মতো। তখন সবাই বললো এই পানি আর কমবে না। এরপর আবার গুইমারাতে ফিরে এলাম এবং আজ অব্দি আছি ।
আমাদের সেখানকার গ্রামে বেশির ভাগ বাঙালি ছিল গরিব। তারা সকলেই চাকমা মা’জনদের বাড়িতে কাজ করে খেতো। আমার দেশের বাড়ি কোথায় আমার তা জানা নেই। আমার দাদার দাদার আমল থেকে আমরা এইখানেই আছি। জীবনে কখনো দেশের বাড়িতে যাই নি।
কাপ্তাই বাঁধের পানি আসার পর আমাদের সেই শ’কুড়ি ঘরের বাঙালিরাা নানান জায়গায় চলে গেছে। অনেকে বান্দরবান চলে গেছে। আর অনেকে খাগড়াছড়ি চলে আসে আমাদের মতো। প্রমোদ দেওয়ানের ছেলে ধলাচান দেওয়ান নামে একজন তখন ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিলেন ।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, Opinion
Leave a Reply