- আশা চাকমা, মা’জন পাড়া, খাগারাছড়ি, ডুবুরীদের নাতনি/কন্যা
“এই পর্বের ‘ডুবুরি’ হচ্ছেন বরনমুখি চাকমা ও চপ্পলাল চাকমা। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ বা কথা হয়নি। ‘আমার কাপ্তাই বাঁধ: বর-পরং, ডুবুরিদের আত্মকথন’ বইটি প্রকাশ হওয়ার পর তাঁদের নাতনি/কন্যা আশা চাকমা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে যে সে তার নানু (বাবার মা) ও বাবার জীবন ‘কাহিনি’ শোনাতে চায়।কীভাবে কাপ্তাই বাঁধের পানি তাঁর নানু ও তাঁর নাবালক ছেলেকে প্রায় চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলÑ সেই ‘জীবন কাহিনি’! বাঁধের পানির কারণে আশা চাকমার নানু একদিন নিজেকে খুঁজে পেলেনআরেক দেশে, ভারতে; আর তাঁর ১০/১২ বছরের পিতৃহীন নাবালক ছেলে রয়ে গেছে একা তাঁদের বাড়িতে।বর-পরঙে আসার আগে তিনি ছেলেকে বলার সুযোগ পাননি যে তাঁকে জোর করে বর-পরঙে নিয়ে যাচ্ছে তাঁর বাবা-মা। তিনি বাধ্য হচ্ছেন ছেলেকে ছেড়ে যেতে। তারপর প্রায় ৪০ বছরের মতো তাঁদের দেখা হওয়া দূরে থাক, সামান্যতম যোগাযোগও ছিল না। আশার বাবা চপ্পলাল চাকমা শুনেছেন, তাঁর মা ও ভাই-বোন থাকে অরুণাচলে। তিনিও কখনও ভাবেননি, তাঁদের সঙ্গে আবার তাঁর দেখা হবে। কিন্তু একদিন নাটকীয়ভাবে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটে এবং সেই দূরদেশে মা-ছেলের পুনর্মিলনঘটে। আবার এই দেখা হওয়ার ৪/৫ বছরের মাথায় মা ও ছেলের মৃত্যু হয় একই বছরে, ভিন্ন ভিন্ন দেশে! কাপ্তাই বাঁধ সংক্রান্ত তাঁদের পরিবারের জীবনের এই ‘কাহিনি’ শোনার পর সত্যিকার অর্থে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি থমকে গিয়েছিলাম। কারণ, আশা চাকমার পরিবার তো আমার বৃহৎ পরিবারের অংশ। আশার বাবা আমার বাবার মামাতো বোনের স্বামী। কিন্তু তাঁর জীবনের এই লুকায়িত মন-কাঁদানো কাহিনিআশা না বলা পর্যন্ত আমরা কেউ জানতাম না।
এই পর্বের ‘ডুবুরি’ বরনমুখি ও তাঁর ছেলের কথা বলছেন ডুবুরিদের নাতনি/কন্যা আশা চাকমা, মা’জনপাড়া খাগাড়াছড়ি।”
কাপ্তাই বাঁধ ও পানি এবং আমার নানু ও বাবা
আমার নাম আশা চাকমা। আমার বাবা ও মায়ের নাম যথাক্রমে চপ্পলাল চাকমা ও মনিকা চাকমা। বাবার বাড়ি সূত্রে আমাদের বাড়ি কাজলং নদীর পাড়ের মারিশ্যার রূপকারী গ্রামে। আমার নানুর নাম বরনমুখি চাকমা। আর আজুর নাম অমিয় কুমার চাকমা। আমি আজ আমার নানু বরনমুখি চাকমা ও বাবা চপ্পলাল চাকমার জীবনের ঘটনা বলব। কাপ্তাই বাঁধের পানি আমাদের পরিবারের জীবনে কী বিপর্যয় এনেছিল, সেটার কাহিনি। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ হওয়ার আগে ধনপাদা গ্রামে বাবা ও তাঁর ভাই জন্মেছিলেন। বাবার সূত্র ধরে আমরা তিয়ে গোজার মানুষ। তারপর কাপ্তাই বাঁধ হলো এবং সেই বাঁধের পানিতে বাবাদের সেই পুরোনো ধনপাদা গ্রাম অন্য অনেক গ্রামের মতো তলিয়ে যায়। তারপর আজু এবং নানু বাবা ও কাকাকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে আবার সংসার শুরু করেন বর্তমান রূপকারী গ্রামে।
বাবারা ছিলেন দুই ভাই ও এক বোন। কাকার নাম দয়ালাল চাকমা আর পেজেমার নাম মনে নেই। পেজেমার জন্ম এই রূপকারীতেই। বাবা, কাকা ও পেজেমা খুব ছোট থাকতেই তাঁদের বাবা মানে আমার আজু মারা যান। তখন নানুর বয়সও খুব বেশি হয়নি। কিন্তু নানু আজু মারা যাওয়ার পরও স্বামীর ভিটেরূপকারীতে রয়ে গিয়েছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি, তখন নানু অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতেন। নাবালক তিন ছেলেমেয়েকে আগলে রেখে সংসার চালানো সহজ কাজ ছিল না। তবুও নাকি নানু ছেলেমেয়েকে ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা কখনও ভাবেননি।
কিন্তু কাপ্তাই বাঁধের পানি নানু ও বাবার জীবনকে নির্মমভাবে বদলে দেয়। এই পানি মা ও এক নাবালক ছেলেকে প্রায় চিরতরে ছাড়াছাড়ি করে দেয়। মায়ের এভাবে হারিয়ে যাওয়া বাবার মনের ওপর প্রচন্ড চাপ পড়েছিল। বাবা নানুর সঙ্গে দেখা না হওয়ার আগ পর্যন্ত ভাবতেন, তাঁর মা তাঁকে একা ফেলে রেখে বর-পরঙে চলে গিয়েছিল। তাই বাবাপ্রায় সারাজীবন ‘মা-মা’ হাহাকারে কাটিয়েছেন।
আজু মারা যাওয়ার পরও কিন্তু নানু তাঁদের নতুন ভিটেতে রয়ে গিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে।তাই বাবা তাঁর মায়ের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পর একেবারে অনাথ হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক বছর পর্যন্ত বাবা তাঁর মা ও ভাই-বোনরা কোথায়, কেমন আছেÑ সেটা জানতে পারেননি। অনেক বছর পরে বাবা লোকমুখে শুনেছেন, মা নিজের ভাইদের সঙ্গে বর-পরঙে চলে গিয়েছেন। মা তাঁকে একা ফেলে বর-পরঙে চলে গিয়েছেন, এ নিয়ে বাবার মনের ভেতরের গভীর বেদনার কথা জিজ্ঞেস করারও কেউ ছিল না।
তারপর বাবার বিয়ে হয়ে গেল আমার মায়ের সঙ্গে। আমরা তিন ভাই ও এক বোন। আমি যখন বড় হলাম, তখন বাবা আমাকে তাঁর এই গভীর বেদনার কিছু কথা মাঝে মধ্যে শোনাতেন। ছোটবেলায় বাবা আমাদের বলতেন, তাঁর মা ও ভাই-বোন ভারতের অরুণাচলে থাকেন। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, কেন তাঁরা সেখানে আর আমরাই বা কেন এখানে! সেই ছোটবেলায় ‘বর-পরং’ কীÑ তা বুঝতাম না! তবে বড় হওয়ার পর বাবার সেই বেদনা একটু একটু উপলব্ধি করতে পেরেছি বলে হয়তো তোমার বর-পরং বইটির কথা শুনে তোমাকে বলতে এসেছি।
আমার মনে আছে, বাবা আমাদের ঠিক এভাবে বলতেন, তখন ছিল বর-পরং যাওয়ার সময়। কাপ্তাই বাঁধের পানি অনেক গ্রাম ডুবিয়ে দিয়েছিল। প্রায় সকলেই জায়গা-জমি হারিয়ে নিঃস্ব। এই পানি সে সময়ে মানুষের জীবন হঠাৎ করে বদলে দিয়েছিল। বাবারাও নতুন গ্রামে আসতে বাধ্য হলেন। ঠিক এরকম সময়ে ১৯৬০ সালের পর কোনো একদিন নানু তাঁর বড় ছেলে, মানে বাবাকে বাড়িতে রেখে কাজলং নদীর ঐপারে তাঁর বাবার বাড়িতে ভাইদের কাছে বেড়াতে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন কাকা ও পেজেমাকে। কিন্তু নানুর বাবার বাড়ির লোকেরা তখন বর-পরং যাচ্ছিল, যেটা হয়তো নানু জানতেন না।
নানু সেই যে বাবাকে বাড়িতে ফেলে নিজ বাবার বাড়ি গেলেন, আর ফিরলেন না। আমার ছোট্ট বাবা জানতেও পারলেন না, তাঁর মা আর দুই ভাই-বোন তাঁকে ফেলে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বাবার সেসময়ের অনুভ‚তির কথা আমি হয়তো কল্পনাও করতে পারি না। তো, বাবা এরপর মা, ভাই-বোন হারিয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেন। বাবা অনেক কষ্টকর সংগ্রাম করে তাঁর কাকার কাছে মানুষ হলেন। নানুরা চলে যাওয়ার পর দীর্ঘ সময় তাঁরা কোথায় আছেন, বাবা জানতেও পারেননি। বড় হওয়ার পর শুধু লোকমুখে শুনতেন, তাঁর মা আর ভাই-বোনরা বর-পরঙে গিয়েছেন। এবং তাঁরা এখন অরুণাচলে আছেন। এটুকু ‘শোনা কথা’ ছিল তাঁর সম্বল। অরুণাচল দেশ থেকে কতদূর, সেটা তো বাবা কল্পনাও করতে পারতেন না। শুধু জানতেন, সেটা ভারতে। নানুদের এভাবে হারিয়ে বাবা ছোটবেলা পার হয়ে বড়বেলায় পা দিলেন। মা-বাবাহীন বড় হওয়া অনেক কষ্টের, সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারি।
একসময় বাবার সঙ্গে আমার মায়ের বিয়ে হয়ে গেলে বাবা চলে আসেন মা’জনপাড়া, খাগাড়াছড়িতে; আমার মায়ের গ্রামে। আমাদের চার ভাই-বোনের জন্ম এখানে। আমরা মাঝেমধ্যে বাবার বাড়ি মারিশ্যাতে বেড়াতে যেতাম বাবার কাকাতো ভাই-বোনদের বাড়িতে।
এটাই ছিল আমাদের বাবার বাড়ি যাওয়া।
১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে হঠাৎ করে অরুণাচল থেকে নানুর সংবাদ নিয়ে নাটকীয়ভাবে বাবার নামে একটা চিঠি আসে। আমার এখন মনে হয়, বাবার জীবনটাই ছিল পুরোটাই ‘অকল্পনীয়’ বা ‘নাটকের’ চেয়ে নাটকীয়তায় ভরা। সে সময়টাও ছিল আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের এক উল্লেখযোগ্য সময়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিতে যে লড়াই, সেই লড়াই অবসান হতে চলছে। পাহাড়ের দুঃখী মানুষ, আমরা ভাবছি, এবার আমাদের কপাল ফিরবে। আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পেয়েছি।
এই চুক্তির ফলে ভারত-বাংলাদেশের চাকমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে হঠাৎ করে আবার যোগাযোগ শুরু হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যাঁরা এতদিন একেঅপরের সঙ্গে যোগাযোগ বা দেখা করতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে এখন যোগাযোগ বা দেখা হচ্ছে। বর-পরঙে যাঁরা ১৯৬০ সালে বা পরবর্তী সময়ে গিয়েছেন, তাঁরাও আসছেন নিজেদের ‘দেজ’ দেখতে। তখনকার পার্বত্য চট্টগ্রামের আবহাওয়া ছিল ঠিক যুদ্ধে জয়ের মতো। এবং সেই মুহূর্তেই আমার বাবার কাছে ‘এক জাদুর চিঠি’ আসে তাঁর মায়ের সংবাদ নিয়ে। বাবার ভাই দয়ালাল চাকমা তাঁদের মায়ের সংবাদ দিয়ে অরুণাচল থেকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বাবার কাছে। আমার সঙ্গে বাবার আত্মিক বন্ধন ছিল আমার ভাইদের চেয়ে বেশি। বাবা তাঁর অনেককিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। তো, বাবা সেই চিঠি পেয়ে আমাকে দেখালেন, কাঁদলেন এবং স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন, এবার মায়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হবেই। আমি সেই ঐতিহাসিক চিঠিটি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই ছোট্ট চিঠিতে কী লেখা ছিল।
বাবার ছোট ভাই দয়ালাল চাকমা বাবাকে লিখেছিলেন
‘পূজনীয় দাদা, আমার নাম দয়ালাল চাকমা। আমি তোমার ছোট ভাই হই। আমরা এখন অরুণাচল থাকি। আমাদের মা এখনো বেঁচে আছে। মা তোমাকে সেখানে নিজের ইচ্ছেতে ফেলে আসেনি। মা বাধ্য হয়েছিল তোমাকে ফেলে আসতে। মা এখনো প্রতিদিন তোমার কথা বলে, তোমাকে স্বপ্নে দেখে! মা বলে, তোমাকে না দেখা ছাড়া সে মরতেও পারবে না। টাকা-পয়সার কথা ভেবো না। তুমি এই চিঠি পাওয়ার পর আমাকে খবর দিলে আমি তোমাকে নিতে আসব। মা এবং আমরা তোমাকে দেখতে চাই।’
আর বাবা তাঁর ভাইয়ের এই চিঠি পাওয়ার পর পাগলের মতো হয়ে গেলেন। কাঁদলেন আর পাগলের মতো তাঁর মাকে দেখতে অরুণাচল যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু আমাদের মতো পরিবারের পক্ষে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়াটা কোনোমতেই সহজ ব্যাপার ছিল না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল টাকা। এদিকে, আমাদের তখন খুব টানাটানির সংসার। নানা ভাবনায়, স্বপ্নে ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সাল শেষ হয়ে গেল। ২০০০ সাল এলো। আর বাবার তাঁর মাকে দেখার স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল। এভাবে সময় গড়িয়ে ২০০৩ সাল চলে এলো। তারপর আমার কাকা দয়ালাল চাকমা কোনো একদিন হঠাৎ করে একেবারে দেশের সীমান্তে চলে এলেন বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ, নানু অপেক্ষা করছেন তাঁর বড় ছেলেকে দেখবেন বলে! না হলে যে তিনি মরতেও পারছেন না! তখন তাঁদের মনের অবস্থাটা বেশি বুঝতে না পারলেও এখন আমি বুঝি বাবা, নানু ও কাকার সেসময়ের মানসিক ‘অবস্থার’ কথা! বাবাকে মানসিক অস্থিরতা পেয়ে বসেছিল তখন।
আমার কাকা সেটেলার বাঙালিদের ভয়ে দেশে আমাদের বাড়িতে আসেননি। তাঁরা শুনেছেন, এই দেশের বাঙালিরা খুব খারাপ। তাই বাঙালিদের ভয়ে তিনি আর এ দেশে আসার সাহস করলেন না। তাই তিনি মাটিরাঙ্গার সীমান্তের ফেনীক‚লে কোনো এক জায়গায় বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকলেন। সেখান থেকে একজনকে পাঠালেন বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এবার শত প্রতিবন্ধকতা পায়ে ঠেলে বাবা নিজের মাকে দেখতে অরুণাচল যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। নিজের নিরাপত্তার জন্য মন্দিরে গিয়ে শ্রমণ হয়ে রংকাপড় নিলেন। টাকা-পয়সার জন্য কাজলঙের রূপকারীতে আমাদের যে সামান্য জমি ছিল, সেটা তিন বছরের জন্য বন্ধকী দিলেন। তারপর সেই টাকা নিয়ে প্রায় ৪০ বছর পর নিজের মাকে এবং বাকি দুই ভাই-বোনকে দেখার জন্য ‘অন্য দেশে’ যাত্রা করলেন।
বাবা সেখানে গিয়ে তিন মাসের বেশি সময় ছিলেন। আর আমরা এখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কবে বাবা ফিরবেন আর আমরা তাঁদের দেখা হওয়ার গল্প শুনব। বাবা যাওয়ার সময় শ্রমণ হিসেবে গিয়েছিলেন, যাতে পথে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয়। কারণ, বাবার তো পাসপোর্ট ছিল না। প্রায় তিন মাস পর বাবা ফিরে এলেন আমাদের কাছে। তখন আমরা তাঁর এত বছর পর নিজের মা ও ভাইবোনকে দেখার গল্প শুনলাম।
বাবা যখন কাকার সঙ্গে অরুণাচলের চাকমাদের এলাকায় পৌঁছালেন, তখন রাস্তায় নাকি অনেকেই জিজ্ঞেস করছিলেনÑ বাবা কেন জায়গা থেকে এসেছেন। সেই গ্রামটা ছিল তিয়ে গোজাদের গ্রাম। আসলে অরুণাচলে গিয়ে প্রায় সকলেই নিজেদের গ্রামের লোকদের সঙ্গে বা নিজের গোত্রের সঙ্গে বসতি করেছিলেন। যখন সবাই তিয়ে গোজার কথা সুরে (প্রত্যেক গোত্রের কথা বলার একটা ভঙ্গি আছে) কথা বলছিলেন, তখন নাকি বাবার মনে হয়েছিলÑ আহা এটা তো পূরণ যুগের মতো! সবাই নিজেদের লোক!
বাবা কাকাদের গ্রামে সরাসরি কাকার বাড়িতে না গিয়ে সেখানকার স্থানীয় কিয়ঙে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। আর কাকাকে বললেন, নানুকে যেন সরাসরি তাঁর আসার কথা না জানায়। কিন্তু নানুকে যেন কিয়ঙে পাঠিয়ে দেয়। সেই কথামতো কাকাও বাড়িতে গিয়ে নানুকে বলেননি যে তাঁর বড় ছেলে এত বছর পর অরুণাচল এসেছে তাঁদের দেখতে। শুধু বললেন, কিয়ঙে ‘দেজ’ থেকে একজন শ্রমণ এসেছে। তাকে সিয়ং দিতে কিয়ঙে যেতে হবে। কাকার কথামতো নানু সিয়ং নিয়ে কিয়ঙে গেলেন। বাবা বলেছিলেন, ‘এত বছর পরেও আমি মাকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলাম।’ কিন্তু বাবা নানুকে প্রথমেই নিজের পরিচয় দেননি। তারপর নানু বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেজে’ তার বাড়ি কোথায়? আবার নাকি নিজের মনেই নানু গড়গড় করে বলছিলেন, ‘দেশে বড় ছেলেকে আমি ফেলে এসেছি। এখন সে কেমন আছে, আমি জানি না। তার জন্য আমার বুকটা এখনো পোড়ায়। জানি না, আমার বড় ছেলের সঙ্গে এই জনমে আর দেখা হবে কিনা?’ তখন বাবা নানুর সঙ্গে মজা করার জন্য বললেন, দেশ থেকে আমাদের সঙ্গে আরও একজন এসেছে। সে হয়তো তোমার ছেলে হতে পারে। সেই কথা শোনামাত্র নানু এক চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় সে? কোথায় রেখে এলে তাকে? কোন জায়গায়? আমাকে এক্ষুনি তার কাছে নিয়ে চলো।’ নানুর এ রকম [সিরিয়াস] অবস্থা দেখে এবার বাবা বললেন, ‘মা, আমিই তোমার ছেলে!’ নানু যখনই শুনলেন বাবা তাঁর ছেলে, তারপর তিনি চিৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। মা-ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন ৪০ বছর পর, আরেক দেশে।
কিয়ঙে মা-ছেলের এই মিলন দেখে সেখানে উপস্থিত সবাই নাকি চোখের পানি ফেলেছিলেন। তারপর প্রায় তিনমাস সেখানে থাকার পর বাবা ফিরলেন নিজের দেশে। দেশে ফিরেই বাবা নিজের মেজ ছেলে দাক্কো দাদাকে (পুলক চাকমা) সেখানে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক কী কারণে দাক্কোদাকে পাঠানো যায়নি, আমার আর তা মনে নেই। এখন ভাবি, তখন দাক্কোদাকে যদি সেখানে পাঠানো যেত, তাহলে আজো হয়তো তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতেন। এই তো, দাক্কোদা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য ইউপিডিএফের সদস্য হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে গেলেন। এবং সেখানেই মারা গেলেন। আমরা জানতেও পারলাম না, কোনো তদন্তও হলো না কেন জেলে দাক্কোদা মারা গেলেন!
বাবার সঙ্গে তাঁর মা ও ভাইয়ের সেটাই ছিল বর-পরঙের পর প্রথম আর শেষ দেখা। বলতে ভুলে গেছি, বাবার তো একজন ছোট বোন ছিল, যে বর-পরঙে যাওয়ার সময় নানুর সঙ্গে গিয়েছিল। বাবার সেই ছোট বোনটি সেখানে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। বর-পরঙে যখন কাকা আর পেজেমা গিয়েছিল, তখন তাঁদের বয়স ছিল যথাক্রমে হয়তো সাত ও চার বছর হবে।
তারপর সময় চলে যায়। অরুণাচল থেকে ফেরার পর বাবার মন সারাক্ষণ মায়ের জন্য উতলা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের আর্থিক অবস্থার কারণে আরেকবার যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া তখনকার সময়ে এরকম ফেসবুক, মোবাইল ফোন ছিল না। তখন শুধু চিঠির ওপর ভরসা করে আমাদের দিন চলত। আমার সঙ্গে বাবা প্রায় নানুকে নিয়ে কথা বলতেন। ২০০৫ সালের কোনো একসময়ের কথা। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। একদিন বাবা হঠাৎ করে এসে আমাকে বললেন, ‘আশা, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তোমার নানু মারা গেছে। আমার কেমন জানি লাগছে।’ বাবার এই কেমন জানি লাগাটা কয়েকদিন পরে সত্যি হয়ে জানাতে আমাদের কাছে কাকার একটা চিঠি এলো অরুণাচল থেকে।
কাকার চিঠি পেয়ে আমরা জানলাম, নানু মারা গিয়েছেন মাস খানেক আগে। আমি আজো মনে মনে ভাবি, বাবার এই কেমন বোধ হওয়াটি মা ও ছেলের আত্মিক যোগাযোগের কারণে। এবং এখনো সেই স্মৃতি মনে পড়লে আমিও আনমনা হয়ে যাই। বাবার জন্য মন কেমন করে। আমাদের সঙ্গে তো নানুর কখনো দেখা হয়নি।
নানু মারা যাওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর বাবা কি মনে মনে বদলে গিয়েছিলেন? আমি জানি না। তখন তো এতসব বুঝতাম না। এইসময় হলে হয়তো বাবাকে আরও বেশি করে বুঝতে চেষ্টা করতাম। বাবার সেই সময়ের অনুভ‚তি নিয়ে আরও হয়তো বেশি করে ভাবতাম। হয়তো বাবা তাঁর মায়ের মৃত্যু মনে মনে মেনে নিতে পারেননি। তাই সে বছরই ২০০৫ সালে নানুর মৃত্যুর কয়েকমাস পর বাবাও হঠাৎ করে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। এখন হয়তো মা-ছেলে সেখানে আরেক জগতে একসঙ্গে আছেন। কাপ্তাই বাঁধের পানি আমাদের মতো হাজার হাজার পরিবারকে বদলে দিয়েছে সবদিক দিয়ে।
এখন নানারকম প্রযুক্তির সুবিধার কারণে অরুণাচলে থাকা কাকার সঙ্গে প্রায়ই আমার যোগাযোগ হয়। এই তো সেদিনও কথা বললাম। আমাদের এখনো দেখা হয়নি। কাকা প্রায় আমাকে বলেন একবার অরুণাচল ঘুরে আসতে। আমি জানি না, এ জীবনে আমাদের মানে কাকার আর আমার মুখোমুখি দেখা হবে কিনা! কাপ্তাই বাঁধের পানি এভাবে কত পরিবারের সর্বনাশ হয়ে এসেছিল, সেটা ভুক্তভোগী যাঁরা, তাঁরা বোঝেন ও জানেন।
আহা আমাদের কাপ্তাই লেক!
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, Opinion
Leave a Reply