পঞ্চবিহারী চাকমা
আলিকদম, বান্দরবান
শৈশবের কথা :
আমার নাম পঞ্চবিহারী চাকমা। আমার জন্ম ১৯৪৩ সালের তৎকালীন বেতছড়ি গ্রাম, জুরোছড়ি, রাংগামাটি জেলায়। এই গ্রামেই আমার শৈশব, যৌবন কেটেছে। আমার পিতা-সুরত মনি চাকমা এবং মা-কজবি চাকমা। বাবার বাবা, আজুর নাম হচ্ছে নমঞ্জয় চাকমা তবে বেবে মানে নানুর নাম আর স্মরণে নেই। আমার জন্মসাল দিয়ে হিসেব করলে আমার বয়স এখন প্রায় ৭৮ বছর। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট। আমার বড় দুই ভাইবোন যথাক্রমে বনবিহারী চাকমা এবং হীরালতা চাকমা দুইজনেই গত’ হয়েছেন। আমার এই দুই ভাইবোনও ছিল এই কাপ্তাই বাঁধের উদ্ভাস্তু। মানে আমাদের পুরো পরিবার কাপ্তাই বাঁধের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর একটি পরিবার। আমার স্ত্রীর নাম বিনন্ধমুখী চাকমা, তাঁর বাবার নাম-পঞ্চরাম চাকমা, গ্রাম-উয্যাংছড়ি, বরকল, রাংগামাটি। ১৯৬২ সালে আমাদের বিয়ে হয়।
কাপ্তাই বাঁধের আগের সময়টা ছিল আমাদেরই সময়, অন্যরকম সময়। এখন হয়তো বলে বুঝানো যাবে না। আমাদের সবকিছু ছিল। সুখ ছিল, শান্তি ছিল, জায়গা-জমি সব ছিল। তাই ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁেধর আগের সময়ের কথা মনে হলে এখনো মন-প্রাণ কেঁদে উঠে। তারপর একে একে কতকিছু মনে পড়ে যায়! চোখের সামনে স্মৃতিগুলো হাজির হয়। প্রাণ কী-রকম ছটফট করে! বুঝাবো কেমন করে!
স্মৃতিতে ছোটবেলার সময়
শৈশব কালটা সবার কাছে আনন্দের মজার সময়। আমার কাছেও তেমনি। ছোটবেলায় কত বন্ধু কত সাথী ছিল। আমরা একসাথে ঘিলে খেলা, ফোর খেলা, গুদু খেলা এবং নাদেং খেলা খেলেছি। সেসব কি ভূলা যায় বলো! একসাথে স্কুলে গিয়েছি। আমাদের গ্রামে তখন একটি প্রাইমারী স্কুল ছিল। নাম সুবলং হাগারাছড়ি মডেল ইংলিশ স্কুল। এই স্কুলটি আমাদের গ্রাম থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে ছিল।
বাঁধ নির্মাণের সময় আমি তখন রাংগামাটির শাহা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীতে পড়তাম। আমার সহপাঠি ছিল শাক্য সিংহ চাকমা, পরিমল চাকমা, প্রমোদ রঞ্জন চাকমা, মহেন্দ্র চাকমা। আরো অনেক ছিল। শুধু এই সহপাঠিদের নাম এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। কদম্বরানী চাকমা এবং রোহিনী চাকমা নামে দুইজন ছাত্রীর নাম আমার স্মৃতিতে এখনো গেঁথে আছে। তাঁরা আমার এক বছরের জুনিয়র ছিলেন।
বাঁধের পানিতে ডুবে যাবার আগে আমাদের বেতছড়ি গ্রামে প্রায় পঞ্চাশ পরিবারের মতো বসতি ছিল। তন্মধ্যে তিন/চার পরিবারের বাড়িঘর ছিল টিনের ছাউনি দিয়ে করা। মানে এখন বুঝতে পারি সেসব পরিবারের আর্র্থিক অবস্থা আমাদের পরিবারের চাইতে অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল বলা যায়। আমাদের গ্রামের লোকেরা নিত্য-নৈমত্তিক জিনিসপত্র কেনা-বেচার জন্য প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটা পথের দূরত্বে সুবলং বাজারে আসতো।
আমার মনে পড়ছে তখন আমাদের বাড়িতে একজন বাঙালি থাকতেন। নাম হামিদ আলম। তাঁর বাড়ি ছিল সাতকানিয়া, চিটাগাঙে। এই হামিদ আলম আমাদের বাড়ির জমিগুলো চাষবাষ করে দিতেন। আরেকজন ছিলেন আমাদের গরু চড়ানোর জন্য। তাঁর নাম হচ্ছে লক্ষীচরণ চাকমা। আমাদের এলাকার মৌজার হেডম্যান ছিলেন সুবলচন্দ্র চাকমা। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে অর্পনাচরন চাকমা মৌজার হেডম্যান হন।
অতঃপর কাপ্তাই বাঁধ এবং বাঁধের পানি
আমাদের গ্রামের অবস্থান ছিল সমতল এলাকায়। তাই আমাদের বাড়ি-ঘরও ছিল সমতলে। সেজন্য আমাদের প্রচুর পরিমানে জায়গা-জমি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর কোন অভাব ছিল না। তাই সারাবছর আমাদের ভাত কাপড়ের জন্য ভাবতে হতো না। তাছাড়া সেসময়ে মানুষের জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ আর সরল। গ্রামের লোকেরা ছিল পরস্পরের আত্মীয়। গ্রামের লোকেরা পরস্পরের সাথে আনন্দর্পূণ সর্ম্পক বজায় রেখে চলতো। এখনকার মতো জায়গা-জমি নিয়ে ঝগড়া বা মনমালিন্য হবার কোন সুযোগ ছিল না তখন।
আমার মনে আছে প্রথম যখন আমরা শুনলাম কাপ্তাই বাঁধের পানি আসবে তখন গ্রামের মানুষ খুব কমদামে তাদের গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস-মুরগী যা যা আছে সব বিক্রি করে দিয়েছিল খুব কম দামে। কারন মানুষের জীবন বাঁচানো তখন প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তাই বাবাও আমাদের যা যা ছিল খুব কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য হলো। চিটাগাং থেকে বাঙালিরা এসেছিল এইসব কিনতে। আর বিক্রেতেরা ছিল সবাই চাকমা।
তারপর একদিন গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করলো তারপর গ্রামের লোকজন জীবন বাঁচাতে নিজেদের পরিবার নিয়ে যে যেভাবে পারে সেই সেভাবে গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো একটু আশ্রয় পেতে বা বেঁচে থাকার জন্য। আর আমরা চলে এলাম মাতামুহুরীতে। আসলে তখনকার সময়কে তো এভাবে বলে বোঝানো যাবে না। হঠাৎ করে সবার জীবনে দূর্বিষহ, কষ্টকর দিন চলে আসলো সবাই আসলে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে পানিতে নিজের বসতভিটা, চাষবাষের জমি ডুবে যাচ্ছে এরচেয়ে কষ্ট আর একজীবনে কি হতে পারে বলো! আমাদের বাড়ি ডুবে গিয়েছিল মাঘ ফাল্গুন মাসে মানে জানুয়ারীর দিকে সম্ভবতঃ। তখন শীতকাল ছিল। চোখের সামনেই পানি হু-হু করে পানি আসতে লাগলো তারপর গ্রামটাই ডুবে গেল। সেই দৃশ্য আজো চোখে ভাসে আমার।
চাকমা রাজার বাড়িও পানিতে তলিয়ে গেলো। তারপর আমাদের গ্রামের অনেকেই গ্রামের পাশের অনেক উঁচু পাহাড়ে ঘর বানালো। যাঁরা এতদিন সমতল জমিতে চাষবাষে অভ্যস্ত ছিল তারা এবার পাহাড়ে চাষ করার বা জুম করা শিখতে লাগলো। যেন নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করা। কাউকে বোঝাতে বা বলতে না পারা সেসব কষ্টকর দিন আমাদের। এই বয়সে এসে আমাদের অতীতের সেই সুখের দিন এবং কাপ্তাই বাঁধের পানিতে ডুবে যাবার সময়ের কথা মনে পড়লে এখনো চোখের জল আটকাতে পারি না।
এবং আমাদের বর-পরং- মাতামুহুরী, বান্দরবান
তো আমরা সরকারীভাবে ঠিক করলাম মাতামুহুরীতে যাবো। আরো অনেক মানুষ ঠিক করলো এদিকে আসার। একদিন আমরা চট্টগ্রাম হয়ে গাড়িতে করে চকরিয়া গেলাম। সেখান থেকে মানে চকরিয়া থেকে নদী পথে বান্দরবানে এই এখন আলীকদমে পৌঁছলাম।
আবার অনেকেই বান্দরবান সদর হয়ে, টংকাবতী ইউনিয়ন হয়ে উত্তর হাঙ্গর ও দক্ষিণ হাঙ্গর পাড়ি দিয়ে প্রায় সপ্তাহ ধরে পায়ে হেঁটে রাংগামাটি হতে এইখানে মানে আলীকদমে পৌঁছেন। আমার যতদূর মনে আছে ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে ধারাবাহিক ভাবে ১৯৬৩ সালের দ্বিতীয় ধাপে এবং পরে ১৯৬৪ সালের তৃতীয় ধাপে কাপ্তাই বাঁধের সব হারানো লোকজন এখানে আসেন।
আমাদরে পরবিার ও আত্মীয়-স্বজন ১৯৬৪ সালে এই মাতামহুরী এলাকায় চলে আসি এবং অদ্যাবধি আলীকদম উপজলোয় বসবাস করছি। তখনো এই এলাকায় বহু চাকমা জাতির লোকজনের বসবাস ছিল। তাঁরা অনেক আগে থেকেই এখানে ছিলেন। মানে আমরা আসার আগে থেকে। ১৯৮৪/৮৫ সালে ¤্রাে জাতির সংগ্রামরে সময় অনকে চাকমা জাতির লোকজন জীবন বাঁচানোর জন্য রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জলো ও উপজলোয় চলে যান। আবার ¤্রাে জাতির সংগ্রাম শষে হলে অনকেইে আবার আলীকদম ফরিে আসনে। তবে তাঁদের অনেকেই আর ফিরে এই এলাকায় ফিরে আসেননি। আবার অনেকে বান্দরবান র্পাবত্য জলোর থানছি উপজলো ও লামা উপজলোয় বসতি স্থাপন করনে। এইসব নানা কারণে র্বতমানে আলীকদম উপজলোয় চাকমা জাতির লোকসংখ্যা কম। আনুমানকি একশত পরবিাররে মত আমরা এখানে বর্তমান আলীকদমে স্থায়ীভাবে বাস করছি।
[ নোট : আমার প্রথম বই কাপ্তাই বাঁধ: বর-পরং বইটি প্রকাশিত হবার পর একদিন একজন মেসেঞ্জারে জানায় যে, চাকমা জাতির অনেক মানুষ বাঁধের পানিতে সব হারিয়ে মাতামুহুরী এলাকায় চলে যান এবং অনেকে সেখানে বসতি গড়ে তুলেন। আমি যেন পারলে তাঁদের সেই ‘স্মৃতি’ ধরে রাখার চেষ্টা করি। আমি সিডনি থেকে ফেসবুকের মাধ্যমে বান্দরবনে বসবাসরত চাকমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, এবং অনুপম চাকমা ও সুকুমার চাকমা নামে দুইজন ছাত্রের সাথে আমি মেসেজে যোগাযোগ করে বাবু পঞ্চবিহারীর সাথে কথা বলি ২০২১ সালের শেষের দিকে। এই দুইজন আবার জিদু বাবু পঞ্চবিহারী চাকমার নাতি। ইন্টারনেটের সমস্যার কারনে আমরা ঠিকমত কথা বলতে ব্যর্থ হলে আমি কিছু প্রশ্ন লিখে তাঁদেরকে পাঠায়, তাঁরা যেন বাবু পঞ্চবিহারী চাকমার সাথে কথা বলে আমার এই প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠান। এইভাবে কয়েকদফা কাজ করার পর খুবই ছোট এই লেখাটি শেষ করতে পারি। অবশ্য অনুপমের সাথে কথা বলার আগে আলীকদমের প্রিয়াংকা ত্রিপুরার সাথে আমায় যোগাযোগ করিয়ে দেয় জুপিটার। কিন্তু তখন কোভিডের সময় হওয়ার কারনে প্রিয়াংকার পক্ষে কাজটি করা সম্ভব হয়নি। আমি অনুপম, সুকুমার, প্রিয়াংকা এবং জুপিটার সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যদিও এই লেখাটি ছোট এবং অনেকটা এলোমেলো তবুও আমার কাছে অনেক গুরুত্বের। বাবু পঞ্চবিহারী চাকমা গতমাসে ১৪ জুলাই ২০২২ সালে খুব ভোরে ৮৪ বছর বয়সে (তাঁর ছেলে জ্যোতিলাল দা’র থেকে পাওয়া) আলীকদমের নিজ বাড়িতে প্রয়াত হন। তাঁর এই লেখাটির মধ্য দিয়ে আমি প্রয়াত বাবু পঞ্চবিহারী চাকমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তিনি সারাজীবন কাপ্তাই বাঁধের পানিতে ডুবে যাওয়া তাঁর জন্মভ‚মি, গ্রামের জন্য হাহাকার করেছেন।]
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, Opinion
Leave a Reply