বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার গুরুতর অভিযোগকে তদন্ত প্রতিবেদনে হোয়াইটওয়াশ করার কারণে পিবিআইয়ের প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছে জাস্টিস ফর মুনিয়া।
মঙ্গলবার ১৯শে অক্টোবর ২০২২ তারিখে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে বসুন্ধরা এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের প্রেমিকা কলেজ শিক্ষার্থী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা মোসাররাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগের সত্যতা খুঁজে না পাওয়ায় পিবিআই আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে আদালতে।
১৬-পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে আমাদের হাতে পৌঁছায়। আমরা এটিকে সযত্নে পাঠ করেছি।
রাষ্ট্রপতি হুসেইন মো. এরশাদের আমলে সরকারপক্ষের একটি স্লোগান জারি ছিল: “এরশাদের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র।” আমাদের মনে হয়েছে মামলার প্রধান আসামী বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর (ও তার পরিবার-বন্ধু বর্গকে) নির্দোষ হিসেবে নির্মাণ করার লক্ষ্যে পিবিআই একই মন্ত্র অবলম্বন করে তদন্ত করা/প্রতিবেদন লেখার কাজটি সম্পন্ন করেছে। পক্ষান্তরে, মোসারাত জাহান মুনিয়া, যিনি ভিক্টিম, এবং মৃত, তার চরিত্রকে পিতৃতান্ত্রিক ও শ্রেণীগত দম্ভের দৃষ্টিকোণ থেকে কলঙ্কিত করা হয়েছে, এমনভাবে যেন মনে হয় মুনিয়ার ভাগ্যে যা যা ঘটেছে তার জন্য ওই দায়ী। ওই দোষী। সংক্ষেপে বললে, আমাদের মনে হয়েছে victim-blaming এর পদ্ধতি অবলম্বন করে পিবিআই বিত্তশালীদের অপরাধের অভিযোগকে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত না করে হোয়াইটওয়াশ করার কাজটি করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে আনভীরের ”স্ত্রী” আছে (সাবরিনা সোবহান)। ”প্রেমিকা” আছে (সাইফা রহমান মীম)। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে মুনিয়ার সাথে আনভীরের শারীরিক সম্পর্ক ছিল, অর্থাৎ, ইঙ্গিত করা হচ্ছে মুনিয়া ছিলেন তার “যৌনসঙ্গী”। আনভীরের কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো জাজমেন্ট বা বিচারমূলক মন্তব্য করা হয়নি।
পক্ষান্তরে, মুনিয়ার বেলায় পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা একই স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করেননি। তার নমুনা তুলে ধরছি (উদ্ধৃত অংশে পিবিআইয়ের বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে): “ভিকটিম একা বসবাস করাবস্থায় [তার] কাছে চলচিত্র ব্যক্তিত্ত্ব রাজসহ আরো কতক পুরুষের যাওয়া আসা ছিল।” “তারা ভিকটিমের ভাড়া বাসায় রাত ১২ টা পর্যন্ত অবস্থান করত।” “[ভিকটিমের] চাল চলন পছন্দ না হওয়ায় বাড়ীর মালিক…ভিকটিমের বাসায় বিভিন্ন পুরুষদের আসা যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানালে…”, “কলেজে শুরু থেকেই অনিয়মিত”, “উচ্চতর গণিত বিষয়ে অকৃতকার্য”, “বনানীর বাসায় অবস্থান করাকালীন একাধিক পুরুষের সাথে সম্পর্কসহ চিত্রজগত ব্যক্তিত্ত্ব এবং বিত্তবান সমাজে গিয়ে নেশা সেবন ও মেলামেশা করে..”, “চিত্র জগতসহ প্রভাবশালী উঠতি বয়সী কতক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্বের সাথে ভিকটিমের পরিচয়…”, “[মুনিয়া] পারিবারিক পরিবেশের বাহিরে আনন্দ উচ্ছাসে ভরা উচ্চ বিত্তদের নতুন পরিবেশে যাদের সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে তাদের মাধ্যমে আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিজেকে অনেক উপরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে”, “নিজেকে আরো উপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিচিত অন্যান্যদের পাশাপাশি ১নং বিবাদী সায়েম সোবহান আনভীরের সাথেও এক ধরনের সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে”, “একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে অনেক বেশী উচ্চাভিলাসী জীবনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে“, ”[মা’র অসুস্থতাজনিত পারিবারিক ঋণ রয়েছে তাদের] “যার অনেক টাকা এখনও বাকী আছে”, “পিতা-মাতা নাই…বলে অন্যদের সহানুভূতি নেয়ার চেষ্টা করতো”, “প্রায় সময়ই বাহির হতে খাবার খেয়ে আসতেন বা বাসায় পার্সেল খাবার আনার ব্যবস্থা করতেন”, “বাসায় গেঞ্জী ও টাইটস পড়ে থাকতেন”, “পারিবারিক পরিবেশের বাইরে আনন্দ উচ্ছাসে ভরা গুলশান, বনানীর মতো আবাসিক এলাকার এক শ্রেণীর উচ্চবিত্ত্বদের ফ্রি-স্টাইলে চলাফেরার মতো নতুন পরিবেশে নিজেকে মেলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনেক উপরে যাওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্যই একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী হয়ে স্ব-ইচ্ছায় ১নং বিবাদী সায়েম সোবহান আনভীর এর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে”, “একজন কলেজ শিক্ষার্থী হলেও বনানী ও গুলশান এলাকায় বসবাসরত এলিট শ্রেণীর লোকজনদের সাথে তিনি চলাফেরা করতেন…”।
পিবিআইয়ের ওয়েবসাইট অনুসারে এক দশক আগে পুলিশের একটি নতুন ইউনিট হিসেবে পিবিআইকে প্রতিষ্ঠা করা হয় অধিক পেশাজীবীতার সাথে ক্রিমিনাল কেসের অনুসন্ধান সম্পন্ন করার লক্ষ্যে। কিন্তু মুনিয়ার ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ সংক্রান্ত যেই চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পিবিআই আদালতে জমা দিয়েছে তার সিংহভাগ ‘এফ’ গ্রেড সিনেমার ভ্যাম্প (নারী ভিলেন) চিত্রায়নের স্ক্রিপ্টের মতো। জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় বিত্তশালীদের অপরাধ সুষ্ঠু ভাবে তদন্ত না করে ভিক্টিমকে দোষারোপ করে হোয়াইটওয়াশ করার পন্থা অবলম্বন ন্যাক্কারজনক। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
এই তদন্ত প্রতিবেদনের অন্তর্নিহিত চিন্তা ও ভাষা প্রয়োগের প্রতি আমরা সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একইসাথে আমরা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম যথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই কারণ এই তদন্ত প্রতিবেদন বৃহত্তর সমাজে একমাত্র এই সিগনালই দিতে পারে যে আইন আইনের গতিতে চলে না, টাকার গতিতে চলে। অঢেল টাকার মালিক হলে ধর্ষণ ও হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হলেই বা কি। বাদীকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি পর্যন্ত হতে হয় না।
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply