নভেম্বর ১৩ ২০২১ :
নাগরিক বিবৃতি
রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে বিচারকের একপেশে ও
দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যবেক্ষণ নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়াবে
নারীর প্রতি চলমান সহিংসতার বিচার নিশ্চিত করা যেখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ সংবেদনশীল হওয়া কাম্য। বিদ্যমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেয়ারই সুযোগ পান না এবং মামলা হলেও নারী নির্যাতনের মামলায় অপরাধীর সাজা প্রায় হয় না বললেই চলে। সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এ রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে। রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাতসহ ৫ জন আসামীকেই খালাস দেয়া হয়।
গণমাধ্যমের বরাতে আমদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, মামলার বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করেছেন যা তাঁর এখতিয়ার বহির্ভুত এবং নারীর সাংবিধানিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা এ পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। উল্লেখ্য, এ মামলার শুরু থেকেই অত্যন্ত প্রভাবশালী আসামীদের পক্ষ থেকে প্রচুর চাপ এবং বাদীদের ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’সহ নানানভাবে হয়রানির বিষয় মিডিয়াতে এসেছে। আসামীদের আস্ফালন সে সময় পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হতো। সেই আসামীদের ক্ষমতার দম্ভই আজ রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
রায়ে বাদীদের আগের যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে তাঁরা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নন বলে বিচারকের পর্যবেক্ষণ ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের শামিল যা হাইকোর্টের নির্দেশনার সরাসরি ব্যত্যয়। আর সংবিধানের ১১১ ধারা অনুযায়ী উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে ট্রাইব্যুনাল বাধ্য। তাঁর এই পর্যবেক্ষণের ফলে জনমনে ভুল ধারণা হতে পারে যে, আগে যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থাকা কোনো নারী ধর্ষণের বিচার আশা করতে পারেন না। এর ফলে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়বে এবং বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়বে বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি আদালত নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো অপরাধকে স্বাভাবিকীকরণ করেছেন এবং জনমনে এই বিভ্রান্তিকর ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন যে, ধর্ষণের জন্য নারী নিজেই দায়ী। বাংলাদেশে নারীর উপর সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো এবং যৎকিঞ্চিত যে অগ্রগতি হয়েছে এহেন পর্যবেক্ষণ তাকে পেছনে ঠেলে দেবে। এ রায় নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়াবে বলে আমরা মনে করি।
ধর্ষণের ৭২ ঘন্টার মধ্যে মামলা করার বাধ্যবাধকতা তৈরী করা বা ডাক্তারি প্রত্যয়নপত্র ছাড়া ধর্ষণ মামলা না নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়ার কোনো এক্তিয়ারই এই ট্রাইব্যুনালের নেই। ধর্ষণের মতো ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে ৭২ ঘন্টা নয় বরং ৭২ বছর পরও মামলা করতে পারার অধিকার ভুক্তভোগীদের আছে। অথচ তাঁর এই পরামর্শের কারণে ধর্ষণের শিকার নারীর নিরাপত্তা আরো বেশি সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে যার দায় উল্লিখিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকের। এছাড়া মামলা তদন্ত করে আসামীর অপরাধ প্রমাণ করা যেমন রাষ্ট্রপক্ষের কাজ, তেমনি যেকোনো মামলার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা আদালতের কাজ। একটি মামলা দায়ের করে আদালতের সময় নষ্ট করার অভিযোগ তোলা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত ব্যক্তির কাজের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা না থাকার উদাহরণ। আমাদের প্রশ্ন হলো আদালতের কাজটা তাহলে কী?
উল্লিখিত মামলার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী আসামীপক্ষের খালাস পাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষের মামলার জন্য যথাযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন না করতে পারার দায়, বাদীদের হতে পারে না। অথচ তিনি সকল দোষ দুই ভুক্তভোগীর উপর চাপিয়েছেন। উপরন্তু বাদীদের চরিত্র সম্পর্কে তাঁর মতামত অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং যেকোনো নাগরিকের জন্য অসম্মানজনক। এছাড়াও দুইজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মামলাকে প্রভাবিত করেছে বলে বিচারকের মন্তব্য বলে দেয় যে, বাংলাদেশের সমাজ সম্পর্কে তিনি কোনো বাস্তব জ্ঞান রাখেন না। কারণ এ সমাজে ভুক্তভোগী নারীরাই প্রান্তিক এবং নিপীড়নের শিকার। উল্টোটা নয়। এ প্রসঙ্গে আমরা সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বিলুপ্তিরও জোর দাবী জানাই।
আমরা প্রত্যাশা করি রাষ্ট্রপক্ষ অনতিবিলম্বে এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যথাযথ আপীল দায়ের করবে কিংবা বাদীপক্ষ যাতে নিজেদের উদ্যাগে আপীল দায়ের করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমরা আরো দাবী জানাই যেন বিচারকদের সঠিক ও সময়োপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাঁদেরকে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষায় আরো দক্ষ করে তোলার ব্যবস্থা করা হয়।
আমরা মনে করি বহুল আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনার উপযুক্ত বিচার দেশের আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থার স্বার্থে অতীব জরুরী। নারীর বিরুদ্ধে সংহিসতা রোধে সরকারের যে ঘোষিত নীতি রয়েছে তার প্রতি সরকারের আন্তরিকতা এধরনের ঘটনায় ক্ষমতাশালী ও বিত্তশালী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমেই প্রমাণিত হতে পারে।
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply