নাফিসা তানজীম
পেছনের কথা
একাত্তর টিভিতে প্রচারিত হওয়া একটা ইন্টারভিউতে তিনজন সাংবাদিক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন ডঃ মোঃ জাকির হোসেনকে। ডঃ হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। ORCiD প্রোফাইল অনুযায়ী তাঁর লেখা ৭০এর বেশি গবেষণাপত্র বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ধাতু দিয়ে কীভাবে পরিবেশ দূষিত হয়, এই দূষণ কীভাবে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে নষ্ট করে এবং তা প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করেন।
গত আগস্ট মাসের ২২ তারিখে অধ্যাপক হোসেনের গবেষণাদলের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। আর্টিকেলটির নাম হচ্ছে “Human health implications of trace metal contamination in topsoils and brinjal fruits harvested from a famous brinjal-producing area in Bangladesh”। আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্টিফিক রিপোর্ট নামে নেচারের একটি জার্নালে। ওপেন অ্যাক্সেস একটা জার্নাল। এদের আর্টিকেল পড়ার জন্য পয়সা দিতে হয় না। যে কেউ জার্নালের ওয়েবসাইটে গিয়ে আর্টিকেলটা পড়তে পারবেন। নভেম্বরের ৫ তারিখ পর্যন্ত মানুষজন ১৯৫৬ বার ওয়েবসাইটে গিয়ে আর্টিকেলটি দেখেছে।
আর্টিকেলের উপসংহারে বলা হয়েছে বিষাক্ত উপাদান দিয়ে খাদ্যদূষণ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে। গবেষণা দলটি জামালপুরে আবাদ করা বেগুন এবং বেগুন চাষের জমির মাটি পরীক্ষা করে দেখেছে। তাঁদের ছোট পরিসরের গবেষণায় দেখা গেছে রাসায়নিক সার , কীটনাশক, গোবর ও বর্জ্যপানি থেকে মাটিতে বিভিন্ন বিষাক্ত ধাতু মিশে যায়। এইসব বিষাক্ত ধাতু এক পর্যায়ে মাটি থেকে বেগুনেও চলে আসে। এই বিষাক্ত সবজি অনেকদিন ধরে খেলে ক্যান্সারসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা, যেমন থ্যালাসেমিয়া, ত্বকের অসুখ থেকে শুরু করে ব্রেইন ও কিডনির ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। গবেষণাদলটি মনে করছেন বেগুনের সাপ্লাই চেইনের একদম প্রাথমিক পর্যায়ের এই দূষণ বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখোমুখি করছে। তাঁরা বলেছেন যে আরো বড় পরিসরে গবেষণা করে অন্যান্য শস্য ও সবজিতেও এরকম ক্ষতিকর উপাদান আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
মোটামুটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু অধ্যাপক হোসেনের ইন্টারভিউ দেখতে দেখতে মনে হলো “ডোন্ট লুক আপ” সিনেমার অধ্যাপক র্যান্ডেল মিন্ডির কথা। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও র্যান্ডেল মিন্ডির চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন! অধ্যাপক মিন্ডি এবং তাঁর ছাত্রী কেট ডিবিয়াস্কি (জেনিফার লরেন্স) আবিষ্কার করেছিলেন যে এভারেস্টের সমান একটা ধুমকেতু পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পৃথিবীতে আঘাত হেনে মানবসভ্যতাকে ধবংস করে ফেলবে। কিন্তু তাঁরা কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারছেন না এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কতখানি। বুদ্ধি করে তাঁরা গেলেন টিভিতে ইন্টারভিউ দিতে। সেখানে দুজন সাংবাদিককে (তাঁদের একজন আবার চরম হট, সেক্সি নারী যাঁর সাথে আবার পরে মিন্ডির মন এবং আরো অনেককিছু দেয়া-নেয়া হয়) – আবিষ্কারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মিন্ডির নাকের পানি, চোখের পানি একাকার হয়ে যায়। সাংবাদিকরা গাধা গাধা প্রশ্ন করেন। মিন্ডি তথ্য-উপাত্ত-কঠিন কঠিন বিজ্ঞানের টার্ম দিয়ে ধৈর্য ধরে বোঝাতে চেষ্টা করেন কী হতে যাচ্ছে। মিন্ডি যাই বলেন, সবকিছু সাংবাদিকদের মাথার ওপরে দিয়ে চলে যায়।
একাত্তর টিভির ইন্টারভিউ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল ডোন্ট লুক আপের বাংলাদেশের ভার্সন দেখছি। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের গবেষণাদলের কেট ডিবিয়াস্কিরা টিভিতেও আসার সুযোগ পাননি। গবেষণাদলে আরো কয়েকজন ফার্স্ট অথর ছিলেন। কিন্তু ডঃ হোসেন গবেষণাটি সুপারভাইজ এবং গবেষণার ফান্ড যোগাড় করায় উঁনিই পুরো গবেষণাদলের পক্ষ থেকে ইন্টারভিউতে আসেন।
সাক্ষাৎকারের সময় সাংবাদিক উদিসা ইসলাম মোটামুটি পুরো সময় চুপচাপ ছিলেন। দুবার আস্তে করে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন কেন জাকির হোসেনের টিমের লোক বেগুন খেলে ক্যান্সার হয় এই কথাটা বলার পরও অস্বীকার করছে। তিনজনই ডঃ হোসেনের ওপরে চড়াও হয়েছে কথাটা ভুল।
বাকি দুজন সাংবাদিক ছিল অনেক বেশি আগ্রাসী। তাঁরা জাকির হোসেনের কথায় বারবার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলেন। মিথিলা ফারজানার মূল কনসার্ন ছিল জাকির হোসেনের কথা-বার্তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না। তিনি কি একটু সহজ করে বলতে পারবেন বেগুনে ক্যান্সার “জীবাণু” আছে কিনা? ফারজানা উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, এইসব তথ্য চট করে ভেরিফাইড না হয়ে সাধারণ মানুষের কাছে চলে আসা ঠিক না। বাই দ্যা ওয়ে, পাবলিশড হওয়া আর্টিকেলটা কিন্তু পিয়ার রিভিউড। তার মানে ওই ফিল্ডের প্রথিতযশা পন্ডিতরা গবেষণাটি নিরীক্ষা করে তারপরেই প্রকাশ করেছে। ফারজানা আরো বললেন যে, এইসব তথ্য সরকারেরই হ্যান্ডেল করা উচিত। কারণ “এটিতো পাবলিকের কোন কনসার্ন না।“ পাবলিক রাসায়নিক সার আর কীটনাশক দিয়ে দূষিত হওয়া বেগুন খাবে, বেগুন খেয়ে তাঁদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়বে – এটা কেন পাবলিকের কনসার্ন হবে না সেটি ঠিক বোঝা গেল না। ফারজানা যেখানে আর্টিকেলটি পাবলিশড হয়েছে, সেই প্ল্যাটফর্মের ভ্যালিডিটি নিয়েও বারবার প্রশ্ন করছিলেন। সায়েন্টিফিক রিপোর্ট সারা বিশ্বের পঞ্চম “মোস্ট সাইটেড” জার্নাল। অর্থাৎ এটা আলতু-ফালতু কোন প্ল্যাটফর্মে বের হওয়া রিসার্চ না।
মাসুদা ভাট্টি ছিলেন সবচেয়ে আগ্রাসী। তারঁ কনসার্ন ছিলঃ (১) বেগুনে ক্যান্সারের জীবাণু আছে এই খবর পেলে সাধারণ মানুষের মাঝে আতংক তৈরি হবে। (২) কেন বেগুন? কেন পাশের ক্ষেতের ঝিংগা না? (৩) সরকারি টাকায় রিসার্চ করে ভয়ংকর তথ্য বের করে সেই ভয়ংকর তথ্য সরকারের কাছে জমা না দিয়ে কেন পাবলিকলি প্রকাশ করা হলো? (৪) বেগুনে বিষাক্ত ধাতু পাওয়া গেলে সরকার বেগুন ব্যান করবে। সরকার কিছু করার আগেই কেন তাঁরা এই তথ্য পাবলিশ করলেন? সরকারের ওপরে তাঁর অপরিসীম আস্থা দেখা গেলো যে সরকার ভয়ানক তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে সেই তথ্য হাপিশ করে না দিয়ে বেগুন ব্যান করার মত উদ্যাগ নিতে পারে। (৪) বেগুনের দাম পড়ে যাবে। বেগুন চাষীরা বিপদে পড়বে। এটা ফৌজদারী অপরাধ। (৫) গবেষকদের সংবাদ সম্মেলন করে জবাবদিহি করতে হবে। (৬) জবাবদিহি না করলে বেগুন চাষীদের ক্ষতিপূরণ তাঁদের কাছ থেকে নেয়া হবে। (৭) গবেষকদের কথা-বার্তা ভেগ, অষ্পষ্ট কারণ তারা বড় পরিসরে আরো গবেষণা করে নিশ্চিত হওয়ার সুপারিশ করেছেন।
প্রচুর মানুষজন অলরেডি সায়েন্টিফিক রিসার্চ কীভাবে পাবলিশড হয়, কেন গবেষকরা যা করেছেন ঠিকই করেছেন তা নিয়ে লিখে ফেলেছেন। আমি সে আলোচনায় যাবো না। আমি এই পুরো ঘটনার লিঙ্গ রাজনীতি আর কর্পোরেশন-সরকারের যোগসাজশ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
ব্যক্তির পরিচয়কেন্দ্রিক লিঙ্গ রাজনীতি যখন প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে দেয়
জেন্ডার সেন্সিটিভ মানুষজন সাংবাদিকদের চরম সমালোচনা করছেন, কিন্তু সাংবাদিকদের নারী পরিচয়টি উল্লেখ করছেন না। খুব সাবধানে এই তথ্যটি সরিয়ে দিচ্ছেন। কারণ তাঁরা হয়তো মনে করছেন যে তথ্যটি সমালোচনার জন্য অপ্রয়োজনীয়। সাংবাদিক পুরুষ হলেও সমালোচনা একই থাকতো।
যাঁরা জেন্ডার সচেতন না, যাঁরা সেক্সিস্ট, তাঁদের আলোচনার মূল ফোকাস আবার “তিন মহিলা” কীভাবে একজন বিজ্ঞানীকে (যিনি আবার বেশ বয়স্ক, জ্ঞানী এবং ধৈর্যবান পুরুষ) হেনস্তা করেছেন। “তিন মহিলা” বেশকিছু ট্রলিং-এর শিকার হয়েছেন। মাসুদা ভাট্টি তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে বেশ লম্বা একটি পোস্ট দিয়ে “তিন মহিলার” “হেনস্তা”-র বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবী করেছেন, একই প্রশ্ন একইভাবে একজন পুরুষ সাংবাদিক করলে জনগণ সেটিকে “সাহসী সাংবাদিকতা” বলে তালি দিয়ে ফাটিয়ে দিত। কিছু নারীবাদী – যাদেরকে আমি বলবো নিওলিবারেল ফেমিনিস্ট বা নব্যউদারনৈতিকতাবাদী নারীবাদী – ভাট্টির পয়েন্টকেই বারবার সামনে নিয়ে এসে বলছেন নারী হওয়ার কারণেই সাংবাদিকরা এত সমালোচনার শিকার হচ্ছেন।
একদল সাংবাদিকদের “নারী” পরিচয়টি মুছে দিচ্ছেন। আরেকদল “নারী ও বেগুন” নিয়ে ট্রলিং করছেন। “নারী” পরিচিতির ওপরে ফোকাস করতে গিয়ে, আইডেন্টিটিকে অনেক বেশি সামনে নিয়ে এসে মাঝ দিয়ে আমরা কি কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভুলে যাচ্ছি? আমাদের সিস্টেম যে ঘুণে ধরা আর এখানে যে ব্যক্তি নারী, ব্যক্তি সাংবাদিক, ব্যক্তি বিজ্ঞানী ছাড়াও আরও কিছু ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান ঘুঁটি নাড়ছে, সেটা কি আমরা খেয়াল করছি?
কিছু প্রশ্ন
১। তিনজন সাংবাদিক – নারী বা পুরুষ যাই হোন না কেন – তাঁরা বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁদের বস আছে। তাঁদের ওপরে সম্ভবত নির্দেশ এসেছিল এই ইন্টারভিউটি করা্র জন্য। এই নির্দেশ কে দিল? কেন দিল? সরকারি টাকায় করা গবেষণার ফাইন্ডিংস গবেষণাপত্রে পাবলিশ না করে সরকারের কাছে জমা দেয়ার দাবী জানানো হলো। ইন্ডিপেন্ডেন্ট এক্সপার্ট রিভিউয়ার না, সরকার গবেষণার ফলাফল যাচাই-বাছাই করে তথ্য মনমত হলে তারপর জনগণের জন্য প্রকাশ করবে। এটা না হওয়ায় কাদের গা চুলকালো? শুধু “তিন মহিলা”কে গালি দিয়ে খুব বেশি লাভ নেই! তিন মহিলাকে সামনে ঠেলে দিয়ে পেছনে আরো অনেক পুঁজিবাদী, কর্পোরেট, টাকাওয়ালা, ক্ষমতাশালী পুরুষ এবং পুরুষবাদী প্রতিষ্ঠান কলকাঠি নাড়ছে।
২। বাংলাদেশের অনেকগুলো ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মালিক হলো সরকারের কাছাকাছি থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারি দলের অনেক এমপির নিজেদের মিডিয়া আউটলেট আছে। যেমন, মোরশেদ আলম আরটিভির মালিক। গাজী টিভির মালিক হলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। কামাল আহমেদ মজুমদার মোহনা টিভির মালিক। সাবের হোসেন চৌধুরী দেশ টিভির মালিক। শাহরিয়ার আলম দুরন্ত টিভির মালিক। ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি এবং দ্যা ডেইলি ইন্ডিপেনডেন্টের মালিক হলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সালমান এফ রহমান আবার অ্যাসোসিয়েশান অফ টেলিভিশন চ্যানেল ওনারস (অ্যাটকো)-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অ্যাটকোর একটা কাজ হলো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানকে টিআরপি রেটিং দেয়া। টিআরপি রেটিং-এর ওপরে ভিত্তি করে চ্যানেলগুলো কোন অনুষ্ঠানে কত টাকা বিনিয়োগ করবে, কী ধরণের জিনিস দর্শককে দেখাবে তা ঠিক করে। যে অনুষ্ঠানের যত বেশি টিআরপি, অ্যাডভারটাইজাররা সেই অনুষ্ঠানের সময় অ্যাড দেখানোর জন্য তত বেশি টাকা ঢালবে। আমরা কি সরকার এবং কর্পোরেশান মিলে মিডিয়াকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা দেখতে পারছি?
৩। ২০২২ সালের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী ১৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬২তম। এই দেশে সরকার বা সরকার সমর্থিত বড় কর্পোরেশানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলার মত অবস্থা বেশিরভাগ সাংবাদিকেরই নেই।
৪। ইন্টারভিউটি প্রচারিত হয় একাত্তর টিভিতে। একাত্তর টিভির মালিক হলো মোজাম্মেল হক বাবু এবং মেঘনা গ্রুপ। মোজাম্মেল হক বাবু একজন শক্ত সরকারী দলের সমর্থক। একাত্তর টিভিতে যে সরকারপন্থী মতবাদ প্রচার করা হবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মেঘনা গ্রুপের টিভি চ্যানেল ছাড়াও ফাইবার, পাওয়ার প্ল্যান্ট, শিপিং, রাসায়নিক, জাহাজ নির্মাণ, নিরাপত্তাসহ আরও অনেকধরণের শিল্পের মালিকানা আছে।
৫। ডঃ হোসেনের গবেষণাটিই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ফান্ডিং-এ করা একমাত্র গবেষণা নয়। ডঃ হোসেনের গবেষণাটি প্রচার হওয়ার মাত্র দু’মাস আগে শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণা দল একই মন্ত্রণালয়ের ফান্ডিং-এ একই ধরণের আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে International Journal of Environmental Analytical Chemistry নামের জার্নালে। তাঁদের আর্টিকেলের শিরোনাম হলো Status and health risk assessment of heavy metals in vegetables grown in industrial areas of Bangladesh। তাঁরা সাভারে উৎপাদিত লাল শাক, মূলা, বেগুন, শাক, লাউ, গাজর এবং মেথিতে কারসিনোজেনিক ভারী ধাতু – অর্থাৎ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ানো উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা ওই এলাকার বর্জ্য পানি থেকে সবজিতে এই ধরণের দূষণ হয়েছে বলে মনে করছেন। এই ধরণের গবেষণা আগেও অনেকবার হয়েছে। ডঃ হোসেনকে আলাদা করে সরকার সমর্থিত টিভি চ্যানেলে ডেকে এনে হেনস্তা করার পেছনের কারণ কী?
৬। আমাদের কি ২০১৯ সালের ঘটনা মনে আছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও তারঁ সহযোগী গবেষকরা দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি পাওয়ার ফল প্রকাশ করার পরে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ বিভাগের সচিব তাঁদের বিরুদ্ধে “ব্যবস্থা” নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। গবেষককে হুমকি দেয়া হয় যে তিনি নাকি গবেষণার “প্রটোকল” ঠিকমত মানেননি। অধ্যাপক ফারুক একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি সরকারি কর্মকর্তা ও কোম্পানির মালিকদের হুমকি, মামলার ভয় দেখানো এবং কটুক্তিতে বিপন্ন বোধ করছিলেন। সরকার ও কোম্পানীর স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন গবেষণার ফলাফলকে ধামাচাপা দেয়া, গবেষককে হয়রানি করা, ভয় দেখানো আমাদের দেশে নতুন নয়!
৭। গবেষণার টাকা যে দেবে, সে গবেষণার রেজাল্ট নিরীক্ষা প্রকাশ করবে, এটা খুব বিপদজনক একটা আইডিয়া। তামাক কোম্পানি যদি ধূমপানের ফলে ফুস্ফুসের কী ক্ষতি হয় সেই গবেষণার টাকা দেয় এবং গবেষণার ফলাফল নিরীক্ষা করে প্রকাশ করে, সেই ফলাফলকে ঠিক কতখানি বিশ্বাস করা যায়? একইভাবে সরকার গবেষণার টাকা দিলে সরকারই গবেষণার ফলাফল নিরীক্ষা করে ফল প্রকাশ করা হবে কি হবে না সেটা ঠিক করবে, সেটা আশা করাটা খুবই বিপদজনক। ফল যদি কোন কারণে সরকারের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, সরকার সেই ফল চেপে যাবে না তার গ্যারেন্টি কী? খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাবধান করা হয়েছিল যে একটা অতিমারী আসছে। আমেরিকার অর্থনীতির ক্ষতি হবে ভেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই খবর বেমালুম চেপে গিয়েছিল। ফলাফল হচ্ছে সময়মত ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে আমেরিকার লাখ লাখ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমরা কি বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশের এই অবস্থা হওয়া দেখেও কিছু শিখবো না?
৮। গত জুন এবং আগস্ট মাসে বের হওয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ফান্ডে করা দু-দুটো রিসার্চ সবজির স্যাম্পলে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের সন্ধান পেলো। দুটো রিসার্চই বলেছে এই বিষয়ে আরো বড় পরিসরে গবেষণা করে দেখা দরকার আমাদের খাদ্যের উৎসগুলো আসলেও কতটা দূষিত হয়েছে। এখন একজন গবেষককে সরকার সমর্থিত টিভি চ্যানেলে ডেকে এনে যেভাবে হ্যারাস করা হলো, তাতে ভবিষ্যতে গবেষকরা এই ধরণের ফাইন্ডিং পেলে মুখ খোলার সাহস করবেন? বড় পরিসরের গবেষণা তাহলে কে করবে? বাজারে যে সবজি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর অবস্থা আসলেও কী? মাটি দূষণ এবং খাদ্য দূষণ আমরা বন্ধ করবো কীভাবে? পরিবেশকে রক্ষা করার আইন ও নীতি তৈরি করার কথা সরকারের, কিন্তু তা না করে যদি গবেষকদের মুখ বন্ধ করার দিকে এত শক্তি খরচ করা হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কী? ডোন্ট লুক আপের মত ধুমকেতুর বাড়ি খেয়ে মরার আগে কি আমরা বিশ্বাস করবো যে আসলেও আমাদের কিছু করার আছে?
নাফিসা তানজীম যুক্তরাষ্ট্রের উস্টার স্টেট ইউনিভার্সিটির ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক। তার ওয়েবসাইট https://ntanjeem.org/ এবং ইমেইল ঠিকানা ntanjeem@worcester.edu
Categories: Opinion
Leave a Reply