
আমরা নিম্নসাক্ষরকারীগণ কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, তাবাসসুম ইসলাম ও তাদের সহযোগীদের হাতে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে লাঞ্চনা, অপমান ও যৌন আক্রমণের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি । একইসাথে, আমরা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি শাসকদলের ছাত্র সংগঠন এবং তাদের ছত্রছায়াদানকারী সুবিস্তৃত নেটওয়ার্কের প্রতি যারা সশব্দে বা নিঃশব্দে ঘটনার ভয়াবহতা হালকা করার ও দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে । তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়া ও নারী সংগঠনের একাংশ। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আর কিছু না করুক, ফুলপরীর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে।
সবার আগে আমরা ফুলপরী ও তার পরিবারকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। যুগ যুগ ধরে যৌন আক্রমণের শিকার নারীকে গোষ্ঠীর ইজ্জত বাঁচানোর কথা বলে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। মিডিয়া সূত্রে জানতে পেরেছি যে ফুলপরীর বাবা আতাউর রহমান-ই তাকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যোগান। ”তোর বাবা একজন ভ্যানচালক, কে তোর পাশে দাঁড়াবে?” – আক্রমণকারী সানজিদা চৌধুরীর তিরষ্কারকে মিথ্যা প্রমাণিত করে সমগ্র দেশের ন্যায়পরায়ণ মানুষ আজ ফুলপরী ও তার মেহনতী পরিবারের পাশে। আমরা মনে করি তার বাবা স্যুটেড-ব্যুটেড নন বলেই মাথা নত করেননি। ফুলপরীকে অনুসরণ করে ইতোমধ্যেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪ জন শিক্ষার্থী তদন্ত কমিটির কাছে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। আমরা তাদেরও অভিবাদন জানাই।
নির্যাতনের ঘটনাকে হালকা করার প্রচেষ্টায় শুরুর দিকে এটিকে ”পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ” এবং ”র্যাগিং” বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কদিন পর একটি ইউটিউব চ্যানেলে যখন ভুক্তভোগী সাড়ে চার ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতনের ঘটনা নিঃসঙ্কোচে বর্ণনা করেন তখন আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও আর সব ছাত্রলীগ আধিপত্যাধীন উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ ইত্যাদি) মতো। এখানেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজমান। এখানেও ছাত্রলীগের নেতা-নেত্রী-কর্মীরা শাসকদলের শারীরিক ও মতাদর্শিক লাঠিয়াল বাহিনী। এখানেও তারা অবাধে সীট বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করেন। এখানেও ভয়ের সংস্কৃতি বিদ্যমান। এখানেও অসাঢ় নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধাররা ‘প্রক্টর,’ ‘প্রোভস্ট,’ ‘অধ্যক্ষ,’ ‘ভিসি’ পদের বিনিময়ে ছাত্রলীগকে প্যারালেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান চালাতে দেন। এখানেও ছাত্রলীগের নেত্রীরা সহযোগীদের সাহায্যে টর্চার সেল চালান। এখানেও নেতা-নেত্রীদের ইচ্ছামতো যে কোনো স্থান – কি শিক্ষার্থীর রুম, কি নেত্রীর রুম, কি গণরুম – নিমেষে বনে যেতে পারে টর্চার সেল।
আর এসকল কারণেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের বক্তব্য, “অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য কিছু বিপথগামী”রা দায়ী, ধোপে টেকে না। সমস্যা ব্যক্তিক নয়, সমগ্র ব্যবস্থার।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও অপরাধের তালিকায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রীরা আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন: তারা ফুলপরীকে স্রেফ কিল-ঘুষি-চড়-থাপ্পড়-লাত্থালাত্থি-মুখে গামছা-পুরে-দেয়া, গামছা-দিয়ে-গলায়-ফাঁস-দেয়ার মতো ভয়াবহ কাজই করেননি তারা বি-গ্রেড হার্ডকোর পর্নোগ্রাফিক সিনেমায় নারীর প্রতি যে ধরনের পুরুষালী যৌনাত্মক সহিংসতা মঞ্চস্থ করা হয়, তার বাস্তব অনুকরণ করেন: “তোকে একদম নেংটা করে ছাড়ব”, “পায়জামা না খুললে জামা খোল,” “তোর নিচের ঐটার ভেতর বোতল ভরে দেব, চাকু কই, কেটে দেব,” “আমাকে একটা ময়লা গেলাস দিয়ে বলে এটা ছেলেদের ঐটা তুই চাট, আমার ভিডিও তোলে,” “আর বলে খারাপভাবে নাচ,” “আর বলে যে যদি হলের গেট খোলা থাকত, তোকে ভায়েদের হাতে তুলে দিতাম, তোকে ভায়েরা কি করত, তুই জানিস?““ওনারা আমাকে দিয়ে নাচাইসে পরে ভয় দেখাইসে আর একটা দরখাস্ত লিখে দিসে যে আমার যদি কোনো কিসু হয় এই জন্য কোনো আপু দায়ী থাকবে না। এখন যদি ফাঁসি দিয়ে তোকে ঝুলাই রাখি তাহলে কেউ দায়ী থাকবে না।” ফুলপরীর দোষ? ওর একজন চেনা-পরিচিত সিনিয়রের ঘরে ‘গেস্ট’ হিসেবে থাকতে গিয়েছিল সানজিদার অনুমতি না নিয়ে।
এখন শোনা যাচ্ছে এধরণের ঘটনা ক্যাম্পাসে অহরহই ঘটে। তফাৎ হচ্ছে এর আগে কেউ ফুলপরীর মতো সাহস করে বলেননি।
ফুলপরীর অভিযোগের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আইনের অধীনে আক্রমণ ও ব্ল্যাকমেইলের মামলা করার জন্য অভিযোগকারীকে আইনি পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু সেটি করা দূরে থাক, গণমাধ্যমে সূত্রে জানতে পারি যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্তের নামে উলটো ফুলপরীকে হয়রানি করছে। তদন্ত চলাকালীন তাকে যেখানে অনায়াসে নিরাপত্তা দিয়ে ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা করা যেত, সেখানে মেয়ে আর বাবাকে ভ্যান, নৌকা, ইজিবাইকে চড়ে রোজ ৮ ঘণ্টা ব্যয় করে বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল পরিবারকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলা আরেক ধরনের টর্চার! কিন্তু এখানেই শেষ নয়, তদন্তের তথ্য যাচাই-বাছাই করার নামে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি ফুলপরীকে তার নির্যাতনকারীদের মুখোমুখি করে “মাফ চাওয়ার” নাটকও সাজিয়েছে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমাদের নারী শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করা তো দূরে থাক, এখন পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। একই অবস্থা নারী প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য, সংরক্ষিত আসনের বাইরের নারী এমপি ও মূলধারার নারী নেত্রীদের। সম্ভবত তারা আশা করছেন গত বছর ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে জুনিয়র সহপাঠীদের পার্টির নেতা বা ব্যবসায়ীদের কাছে যৌন উপভোগের জন্য যেতে বাধ্য করার তদন্তটি যেভাবে ‘ম্যানেজ’ হয়ে গিয়েছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটিও একইভাবে ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষ দ্বারা গঠিত তদন্ত কমিটি “কোনো শিক্ষার্থীকে অনৈতিক কাজে বাধ্য করার কোনো সত্যতা” খুঁজে পায়নি।
এই পরিস্থিতিতে ফুলপরীকে যৌন নির্যাতন করার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জোর দাবি জানাই। একইসাথে আমরা ছাত্রলীগ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে আজ হোক কাল হোক তদন্ত ‘ম্যানেজ’ করার দিনের অবসান ঘটবে। এটি অবধারিত।
স্বাক্ষরকারী:
- অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
- মোশরেফা মিশু, সভাপতি, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম
- অধ্যাপক ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
- রাণী য়েন য়েন, আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকর্মী, চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা।
- নাজনীন শিফা, পিএইচডি গবেষক, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।
- কাজলী শেহরীন ইসলাম, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
- মার্জিয়া রহমান, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
- রোজীনা বেগম, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী
- ড. নাসরিন খন্দকার, নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক।
- ড. সামিনা লুৎফা, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
- দিলশানা পারুল, গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট।
- মারজিয়া প্রভা, অ্যাক্টিভিস্ট।
- ডা. সাদিয়া চৌধুরী, চিকিৎসক।
- ড. নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
- তাসলিমা আখতার, আলোকচিত্রী ও সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি।
- শ্যামলী শীল, সভাপতি, নারী সংহতি
- ইলিরা দেওয়ান, অ্যাক্টিভিস্ট
- লায়লা পারভীন, শিক্ষক ও সভানেত্রী, নোয়াখালী নারী অধিকার।
- শিল্পী বড়ুয়া, শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
- জান্নাতুল মাওয়া, শিক্ষক, আলোকচিত্রী।
- সায়েমা খাতুন, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী।
- সাদাফ নূর, গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
- হানা শামস আহমেদ, পিএইচডি গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।
- তাহেরা বেগম জলি, লেখক ।
- ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, এডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট।
- ড. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক ও গবেষক।
- রেহনুমা আহমেদ, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী।
Categories: আন্দোলন বার্তা
Leave a Reply