প্রসঙ্গঃ মাতৃত্ব, মিসক্যারেজ এবং আমাদের কিছু হিপোক্রেসি

নাফিসা তানজীম (অতিথি ব্লগার)

মা দিবস আবারও এসেছে। আবারও আমরা সবাই মাকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর স্ট্যাটাস দেবো। মায়ের জন্য উপহার কিনবো। আমাদের অনেকের মায়েরা এইসব উইশ-উপহার পেয়ে বেশ খুশিই হন। কেনই বা হবেন না ? বছরের পর বছর রক্ত পানি করে মা একেকজন সন্তানকে বড় করে তোলেন। আমাদের অনেকের বাবারাই অর্থ উপার্জন করে দায়িত্ব শেষ করেছেন। ঘরের কাজে হাত দেননি। বাচ্চার ন্যাপি বদল করেননি। অনেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে সমস্যা হয় বলে আলাদা ঘরে ঘুমিয়েছেন। ভীষণরকম কষ্টের স্বীকৃতি পেতে মায়েদেরতো ভালো লাগবেই।

আবার আমরা হলাম সেই সমাজ যেখানে সন্তানের সামনে ঝগড়া-ঝাঁটি, মারামারি করতে মা-বাবাদের বাঁধে না। কিন্তু আমরা কয়জন মনে করতে পারি যে মা-বাবা আমাদের সামনে একজন আরেকজনকে ভালোবেসে দুটো কথা বলেছে অথবা একটা হাগ দিয়েছে? আমাদের কতজনের মা-বাবার সাথে সেই মানসিক নৈকট্য আছে যে অ্যাডাল্ট বয়সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারবো “ভালোবাসি”? হেটেরোনর্মেটিভ রোমান্টিক বা সেক্সুয়াল সম্পর্কের বাইরে মা-বাবাকে ভালোবাসার কথা বলার মত শিক্ষা বা পরিস্থিতি আমরা বেশিরভাগই পাইনি। তাই আমরা অনেকেই মা দিবস উপলক্ষে ফেসবুকে মাকে নিয়ে দু-চারটা ভালো ভালো কথা লিখি। তাঁদেরকে উপহার দেই। আমাদের  বেশ ভালো লাগে। মায়েরাও খুশি হন। পুঁজিবাদী সমাজও “মা”-এর ব্র্যান্ডকে ক্যাপিটালাইজ করে মুনাফা তৈরির ভালো একটা উপলক্ষ পেয়ে খুশি হয়ে যায়।

কিন্তু মাতৃত্বকে আমরা আসলে ঠিক কতটা সম্মান করি? সম্মানতো ব্যাপকভাবে করি। নারীত্ব পূর্ণতা পেলো কিনা সেটা আমরা ঠিক করি একজন নারী মা হতে পারলো কিনা সেটা দিয়ে। মা হতে পারাটা নাকি একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। মা হতে না পারলে নাকি জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়।

কিন্তু সবধরণের মা আমাদের শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালোবাসার পাত্র হন না। সমাজের বেঁধে দেয়া নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ যদি মা হন, সেটা কিন্তু  তখন আর আমাদের পছন্দ হয় না।

  • যিনি ছেলের মা হতে পারলেন না, তাঁর জীবন বৃথা।
  • স্পেশাল নিড বাচ্চা আছে? আহারে, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মা কী করেছে যে বাচ্চাটা এমন হলো? আহারে কত বড় দুর্ভাগ্য এই মায়ের!
  • ডিভোর্সি মা? হায় হায়, বাবার পরিচয় ছাড়া সন্তান কেমন করে বড় হবে?
  • অবিবাহিত মা? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। কলিকাল চলে এসেছে!
  • দত্তক সন্তানের মা? বড় করছো করো কিন্তু সম্পত্তি লিখে দেয়া চলবে না। কোকিলের বাচ্চা ফুটায়া লাভ কী?
  • সমকামী মায়ের সন্তান? ওইসব ইংল্যান্ড-আমেরিকাতে হয়। আমাদের সমাজে এসব চলবে না।
  • আইভিএফ/স্পার্ম-এগ-এম্ব্রিও-ডোনেশানের মাধ্যমে মা হয়েছো? কম বয়সে বাচ্চা নিলে আর এইসবের প্রয়োজন হতো না! আর এগুলোতো মনে হয় জারজ বাচ্চা!
  • সারোগেট নিয়ে প্রিয়াংকা চোপড়া মা হয়েছে? আজকাল মেয়েরা ফিগার সুন্দর রাখার জন্য কী না করতে পারে?
  • সারোগেট মা? টাকার জন্য নিজের গর্ভ কেউ ভাড়া দিতে পারে? ন্যাক্কারজনক!

এই যখন হচ্ছে মায়েদের প্রতি আমাদের ভালোবাসার ধরণ, তখন মাতৃত্বের যাত্রাটা শুরু করেও যারা শেষ করতে পারেনি, তাদের অবস্থা যে সঙ্গিন হবে, সেটাতো বলাই বাহুল্য। আমি আজকে প্রেগন্যান্সি লস আর মিসক্যারেজ নিয়ে কথা বলতে এসেছি। বাংলায় মিসক্যারেজের জন্য একটা আলাদা শব্দও নেই। “গর্ভপাত” শব্দটি দিয়ে ইন্ডিউসড বা স্পনটেনিয়াস – সবধরণের অ্যাবরশন কাভার করা হয়। অ্যাবরশন আর মিসক্যারেজের প্রসিডিউর প্রায় একরকম হলেও দুটোর পরিস্থিতি, আইন আর মানসিক অবস্থায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। অ্যাবরশন নিয়ে অন্য কোনদিন লিখবো। আজকে লিখছি মিসক্যারেজ বা প্রেগন্যান্সি লস নিয়ে।

প্রতি চারটা প্রেগন্যান্সিতে একটা করে মিসক্যারেজ হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশে ৩৪ লাখের বেশি শিশু জন্ম নিয়েছিল। সেই হিসেবে গত বছরে দেশে ১১ লাখের বেশি নারীকে মিসক্যারেজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ১১ লাখ! বিশাল একটা সংখ্যা। এই ১১ লাখ নারী কোথায়? এদেরকে কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না কেন?

গত এক বছরে ফেসবুকে কতগুলো পোস্ট দেখেছেন নবজাতকের ছবি দিয়ে “ওয়েলকাম টু দ্যা ওয়ার্ল্ড” স্ট্যাটাস? কতগুলো প্রেগন্যান্সি ফটোশুট দেখেছেন যেখানে বিশাল বেবি বাম্প নিয়ে মা-বাবা হাসি-হাসি মুখে পোজ দিয়েছে। আর কয়টা পোস্ট দেখেছেন যেখানে নিজের প্রেগন্যান্সি লস নিয়ে কেউ কথা বলেছে?

এই ব্যাপারটা না বেশ অদ্ভুত। ধরুন আপনার পরিবারের কেউ মারা গেলো। আপনি কী করবেন? হয়তো আশেপাশের সবাইকে ফোন করে বা টেক্সট করে জানাবেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবেন। মানুষজন জানাজা পড়তে বা শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে আসবে। হয়তো সবাই একসাথে হয়ে স্মৃতিচারণ করবেন সেই মানুষটাকে নিয়ে। এই কাজগুলো করার মাধ্যমে আপনি “গ্রিভ” করবেন। এই গ্রিভ করাটা আপনাকে দুঃখজনক অভিজ্ঞতাটা “প্রসেস” করতে সাহায্য করবে। আপনাকে “হিল” করবে। দুঃখ কমবে না, কিন্তু একসময় আপনি দুঃখটা নিয়ে বসবাস করা শিখে যাবেন।

কিন্তু মিসক্যারেজ হলে কী হয়? এই চরম সেক্সিস্ট সমাজ প্রথমেই বসে মায়ের দোষ ধরতে। “উল্টা-পাল্টা কিছু খাইসিলা?”, “বেশি পরিশ্রম করসো নিশ্চয়!,” “বলসিলাম অফিসে যাওয়া বন্ধ করতে, তারপরও জোর করে কাজে গেছো!,” “বলসিলাম কম বয়সে বাচ্চা নিতে। বেশি বয়সে এইরকমই হয়!” এত এত কথা শোনার ভয়ে অনেকেই প্রথম ট্রাইমেস্টার না যাওয়া পর্যন্ত প্রেগন্যান্সির কথা নিজেদের বাইরে কাউকে জানাতেই চায় না। কিন্তু অবস্থাটা দেখেন। বাজে কথা বলে বলে আমরা এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছি যে একটা মেয়ে কনসিভ করার সাথে সাথে প্রিপারেশান নিয়ে নেয় যে মিসক্যারেজ হলে সে সম্পূর্ণ একা ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করবে। ধরুন তার পরিবারের কাছের কেউ মারা গেলে সে যেরকম সহানুভূতি-সাপোর্ট পেত, মিসক্যারেজ হলে সে কিচ্ছু পাবে না। একদম একা এই ভয়ংকর জার্নির মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হবে।

আর এইসব জাজমেন্টাল কথা-বার্তার অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। অনেক নারী “শেম” বা লজ্জা অনুভব করেন। অনেকে হতাশার গহবরে ডুবে যান যে তার শরীরের যে কাজটা করার কথা ছিল, সেই কাজটা শরীর করতে পারছে না। সবার শরীর কাজ করে, কিন্তু তার শরীর কাজ করে না। কেউ ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীত হয়ে পড়েন যে আদৌ তার শরীর একটা সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারবে কিনা। অনেকে আজাইরা কথা শুনতে হবে ভেবে মানুষের সাথে মেলামেশাই কমিয়ে দেন। ফলে সাপোর্ট সিস্টেমের অভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে।

অথচ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু আর্লি মিসক্যারেজ বেশিরভাগই হয় ক্রোমোজোমের সমস্যার কারণে। কোনকিছু খাওয়ার কারণে না, পরিশ্রম করার কারণে না। মানুষের এম্ব্রিও অংকে খুবই খারাপ। মানব এম্ব্রিও যখন মিয়োটিক বিভাজনের মাধ্যমে মা-বাবার ক্রোমোজোম ভাগাভাগি করে নেয়, তখন সে প্রায়ই ভাগ অংকে ভুল করে। একটা ক্রোমোজোম এদিক সেদিক হলেই হয় সেই এম্ব্রিওর বৃদ্ধি থেমে যায় না হয় শরীর মিসক্যারেজের মাধ্যমে অংক ভুল করা এমব্রিওকে শরীর থেকে বের করে দেয়। হাজারটা ভালো ভালো খেয়ে বা সারাদিন বিছানায় শুয়ে থেকেও কেউ অংক ভুল করা এমব্রিওকে রক্ষা করতে পারবে না।

কিন্তু এইসবতো আর আমাদের বিজ্ঞ মুরুব্বীসমাজ আর আত্মীয়-স্বজনকে বোঝানোর উপায় নাই। বিয়ে হলেই একটা কাপলকে তারা সরাসরি বা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করেন, “বাচ্চা কবে নিবা?” বা “এত দেরি করছো কেন? পরে কিন্তু আর বাচ্চা হবে না!” যেন শুধু এবং শুধু বাচ্চা নেয়ার জন্যই মানুষ বিয়ে করে। যেন একটা কাপলের দায় পড়েছে তাদের প্রজননবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে জবাবদিহিতা করবার। এইরকম পরিস্থিতিতে কেউ যখন কনসিভ করেও মিসক্যারেজের শিকার হয়, তার অবস্থা পরিবার-সমাজে পুরো কেরোসিন হয়ে যায়। আর কনসিভ করতে সমস্যা হলেতো সব শেষ। ফার্টিলিটি স্ট্রাগল নিয়ে আরেকদিন লিখবো না হয়।

মিসক্যারেজ বা প্রেগন্যান্সি লসের পরে ২০% নারীর ক্ষেত্রে ডিপ্রেশান এবং এংজাইটি অসুখের পর্যায়ে চলে যায়। সেই হিসাবে গত বছরে দুই লাখ নারী মিসক্যারেজের কারণে ভয়ংকর ডিপ্রেশান এবং এংজাইটিতে ভুগেছেন। তাদেরকে নিয়ে আমাদের কি কোন মাথা ব্যথা আছে? ডিপ্রেশান এবং এংজাইটির  সিম্পটমগুলো এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত বা তার চেয়েও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ফলে দৈনন্দিন কার্যকলাপ থেকে শুরু করে পরিবার, কাজের ক্ষেত্র, সামাজিক সম্পর্ক – সবকিছুতে এর প্রভাব পড়তে পারে। 

মিসক্যারেজ বা প্রেগন্যান্সি লস নিয়ে কথা হলে যাদের কথা আমরা সবসময় ভুলে যাই, তারা হলেন আমাদের পুরুষ সমাজ। আমাদের বেশিরভাগ ছেলে ছোটবেলা থেকে শিক্ষা পান যে তাদের হতে হবে শক্ত-সমর্থ-হিমালয়ের মত বলীয়ান। তারা কাঁদতে শেখেন না। তারা বন্ধুদের সাথে রাজনীতি, না হয় খেলা, না হয় সেক্স বা পর্ন কে কত ভালো পারেন তা নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসেন। কিন্তু মনের একেবারে গহীন কোণের দুঃখ, ভালনেরাবিলিটি কীভাবে প্রকাশ করতে হয়, তারা সেটা জানেন না। কেউ যদি ভুল করে ভালনেরাবিলিটি প্রকাশ করেও বসেন, সমাজ তাকে দূর দূর করে, দুর্বল-মেয়েলি-অথর্ব বলে আখ্যা দেয়। এই অবস্থায় মিসক্যারেজের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সেসব পুরুষ যান, তাদের অনেকেই এই অভিজ্ঞতাকে, দুঃখকে, হারানোর বেদনাকে ঠিকমত প্রসেস করতে পারেন না। ফলে অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি এংজাইটি – ডিপ্রেশানসহ নানাধরণের শারীরিক-মানসিক সমস্যার শিকার হন।

আমরা তাহলে কী করতে পারি?

প্রথমেই নিজের কথা-বার্তার ব্যাপারে আমরা সচেতন হতে পারি। মিসক্যারেজের পরে কেউ যখন হয়তো নিজেই নিজেকে দুষছে, তখন তাকে নতুন করে দোষ দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারি। “তোমার এটা করা উচিত ছিল” বা “ওটা করা উচিত হয় নাই” – এইসব কথা বলার কোন মানে নাই। “সবকিছুর একটা কারণ থাকে,” “যা হয় তা ভালোর জন্য হয়” – এই ধরণের কথা-বার্তা বলা বন্ধ করতে পারি। এইসব কথা-বার্তা মিসক্যারেজের “গিল্ট’ থেকে কাউকে মুক্তি দেয় না। “তোমার বাচ্চা অনেক ভালো জায়গায় আছে” – এটা বলার কোন মানে নেই। কোন মা চাইবে না তার বাচ্চা জন্মানোর আগেই মরে গিয়ে ভালো কোন জায়গায় চলে যাক।

কাউকে এটা বলার কোন মানে নেই যে “সম্ভবত অসুস্থ বাচ্চা হতো। অসুস্থ বাচ্চা হওয়ার চেয়ে আগে আগে মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়াটাই ভালো হয়েছে।” হ্যাঁ, মিসক্যারেজে মানুষ একটা ভ্রূণকে হারায়। একটা ভ্রুণ মানুষ না। কিন্তু কেউ যখন প্রেগন্যান্সি কন্টিনিউ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে তার সময়, আবেগ, শরীর – সবকিছু একটা অত্যন্ত দীর্ঘ এবং কষ্টকর প্রসেসের জন্য বিনিয়োগ করে। সে মনে মনে নিজেকে মায়ের ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত করা শুরু করে। আকাংক্ষিত প্রেগন্যান্সি হলে সে ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে। সেই স্বপ্নকে “ওহ, ভালো হয়েছে, অসুস্থ বাচ্চা হয় নাই” বলে অসম্মান বা ইনভ্যালিডেট করার কোন মানে নেই।

মিসক্যারেজের ফলে কী কী ভালো হয়েছে, সেটা নিয়ে কাউকে শিক্ষা দেয়ার দরকার নাই। গায়ে পড়ে “আহা-উহু” করারও দরকার নাই। তারা যদি আমাদের কাছের মানুষ হন, আমরা হয়তো খবর নিয়ে দেখতে পারি যে মানুষগুলো কেমন আছে, তারা কথা বলার অবস্থায় আছে কিনা, কথা বলতে চান কিনা, আমাদের কোন ধরণের সাহায্য তাদের প্রয়োজন কিনা, কোন থেরাপিস্ট/সাইকায়াট্রিস্টের সাথে যোগাযোগ করার ব্যাপারে সাহায্য লাগবে কিনা। আমরা আলাদা করে ছেলে পার্টনারদের খবর নিয়ে দেখতে পারি যে তারা কেমন আছে। কারণ ছেলেদের খবর এই সব ক্ষেত্রে সাধারণত কেউ নেয় না।

আমরা নিজেদের গল্পগুলো বলতে হবে আরো বেশি বেশি করে। নাটক-সিনেমা-সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা কী দেখি? ধুম করে একটা সেক্স (যেখানে কনসিভ করার জন্য অ্যাভেরেজে ছয় মাস থেকে এক বছর বা তারচেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে), তারপর পজিটিভ প্রেগন্যান্সি টেস্ট, তারপর একটা বিশাল বাম্প, তারপর একটা গুল্টু নবজাতকের ছবি এবং তারপর সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু গতবছর ১১ লাখ কাপলের গল্পগুলো এমন ছিল না। তাদের গল্পগুলো কোথায়? আমাদের ফার্টিলিটি স্ট্রাগলের গল্পগুলো বলতে হবে, মিসক্যারেজ-প্রেগন্যান্সি লস-স্টিল বার্থের গল্পগুলো বলতে হবে, বাচ্চাকে জন্ম দেয়ার এবং বড় করার প্রসেসটা যে অনেক কষ্টকর একটা অভিজ্ঞতা – সেই গল্পগুলো বলতে হবে।

ডাক্তার, গাইনোকলজিস্টদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময়েই তারা চিকিৎসার বাইরে অপ্রয়োজনীয় জাজমেন্টাল কমেন্ট করে বসেন, যেটা মিসক্যারেজের মধ্য দিয়ে যাওয়া নারীদের কষ্ট বাড়ায় বই কমায় না। নারীদের শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও চিকিৎসকদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে থেরাপিস্ট/সাইকায়াট্রিস্টের রেফারাল দেয়ার সিস্টেম চালু করা দরকার।

বাংলাদেশে সরকারি চাকুরিতে সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটির খুব চমৎকার একটা আইন আছে। কিন্তু প্রেগন্যান্সি লসের ব্যাপারে আমাদের আইন নীরব। জীবন্ত শিশুর জন্ম দিতে না পারলে নারী বা তার পার্টনার কোন সুযোগ-সুবিধা পান না। অথচ ইন্দোনেশিয়া, মৌরিতিয়াস, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, এমনকি ভারতেও প্রেগন্যান্সি লসের পরে নারী/তাদের পার্টনারদের জন্য সবেতন ছুটিভোগের আইন আছে। আমাদের আইনগত সংস্কার দরকার।

আর শেষের কথা হলো – আমাদেরকে মাতৃত্বকে রোমান্টিসাইজ করা বন্ধ করতে হবে। মাতৃত্ব একটা চয়েস – এটা নারীর জন্য বাধ্যতামূলক, অপরিহার্য কোন দায়িত্ব নয়। এটা একটা অসম্ভব সুন্দর এবং আনন্দময় – এবং একই সাথে অত্যন্ত কঠিন, পেইনফুল একটা অভিজ্ঞতা।

মা দিবসে আসুন আমরা সবধরণের মাতৃত্বকে সেলিব্রেট করি এবং মাতৃত্বকে মাথায় তুলে নেচে নারীদের ওপর অনর্থক চাপ তৈরি করা বন্ধ করার ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করি।

———————-

এই লেখাটি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত (মে ১৪, ২০২৩) লেখকের একটি লেখার ভাবানুবাদ।মূল লেখার লিংক: https://www.thedailystar.net/opinion/views/news/the-untold-story-unfinished-journey-motherhood-3319126

নাফিসা তানজীম যুক্তরাষ্ট্রের উস্টার স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী শিক্ষক। তার ওয়েবসাইট https://ntanjeem.org/ এবং ইমেইল ঠিকানা ntanjeem@worcester.edu



Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: