
তাইন্দং, মাটিরাঙা থেকে ফিরে, সমারী চাকমা ও সায়দিয়া গুলরুখ
আজ সকালে খাগড়া ছড়ি জেলা হাসপাতালে আলোরাণি ও সুকুমনি চাকমার একমাত্র পুত্র সন্তান আশামনি চাকমা (২মাস) মারা যায়। মৃত্যু সনদে লেখা হয়েছে নিউমনিয়াজনিত জটিলতায় শিশুটির মৃত্যু হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু। কোনও সুরতহাল রিপোর্ট লেখা হয়নি। কোন পোস্ট মর্টেমের প্রয়োজন পড়েনি। থানায় কোনও মামলা হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হালকা খয়েরি রঙের কম্বলে মুড়ে বাবা-মার কোলে মৃত সন্তানকে তুলে দিয়েছে। ছেলের লাশ বুকে করে খাগড়াছড়ি পানছড়ি, তাইন্দং বাজার পার হয়ে বান্দরসিং পাড়ায় ভাঙ্গা-চোরা ভিটেমাটির পাশে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নাম লেখা একটা সাদা তাবুতে ফিরে আসে আলোরাণি ও সুকুমণি চাকমা।
৩রা আগস্ট, ২০১৩ বেলা ১১টার দিকে বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার বান্দরশিং গ্রামের কারবারি, অতুল চাকমাকে ফোন করে বলে, তাইন্দং বাজার থেকে একটু দূরে ক্রশিং নামক জায়গায় বাঙালী পাড়ার একজন মটরবাইক চালক, কামাল যার নাম, শান্তিবাহিনীর হাতে ‘অপহৃত’ হয়েছে। পরিস্থিতি উতপ্ত। বাঙালীরা শ্লোগান দিচ্ছে, “কামালকে যদি না পাও, পাহাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও।” তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রামের কারবারী আর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডেকে পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য সবাই মিলে ‘অপহৃত কামালকে ’খোঁজ করা। পাহাড়িরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বিজিবি ও পুলিশের উপস্থিতিতে সুকুমনি, অতুল, উপল চাকমাসহ আরও এগারোজন পাহাড়ি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপর বাঙালী সেটলাররা হামলা করে। একপর্যায়ে আক্রমণকারী কয়েকজন বাঙালী সেটলার সুকুমনিকে টেনে-হিচড়ে ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সুকুমনি তখন ভেবেছিল, এবারে তাকে কেউ বাচাঁতে পারবেনা। কিন্তু ভাগ্যক্রমে পরিচিত এক বাঙালী, গিয়াস উদ্দীনের সাথে দেখা হয়। তিনি আক্রমণকারী দলটির সাথে কথা বললে তারা তাকে জানায়, চেয়ারমেনের সিরাজের নির্দেশে তারা তাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গিয়াসউদ্দীনের তাৎক্ষনিক সহায়তায় সুকুমনি জানে বেঁচে যায়।
অন্যদিকে, দুপুর ১২.৩০ মিনিট থেকেই সুকুমনির গ্রামে বাঙালীদের অগ্নিসংযোগ, ভাঙ্গচুর লুটতরাজ শুরু হয়। এর আগেই আলোরাণী আশামনিকে কোলে করে গ্রামের অন্যদের সাথে মাইলকে মাইল হেটে ভারত সীমান্তে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আলোরাণী ভেবেছিল, তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। সারারাত খোলা আকাশের নীচে থেকে পরদিন বগাপাড়ায় বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। সেখানেও দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। কখন কি হয়!
পাহাড়ি গ্রামগুলোতে দিনভর তান্ডব চললেও, বিকাল ৫টার মধ্যেই ‘অপহরণ’ ঘটনার অবসান ঘটে যায়। কামালকে কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কারা ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে –এই বিষয়ে কেউ সুনিশ্চিতভাবে কোনও তথ্য দিতে পারেনি। এদিকে ৩১শে জুলাই থেকেই তাইন্দং এলাকার বিভিন্ন মসজিদের মাইকে বাঙালীদের সতর্ক থাকতে আহবান জানানো হয় এই বলে, “শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা এলাকায় ঢুকবে।” তারপরদিন, ১লা আগস্ট, ২০১৩ তাইন্দং বাজারে সেটলার বাঙালীদের একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আমরা তাইন্দং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানতে পারি যে, এই সমাবেশের শ্লোগান ছিল, “একটা একটা পাহাড়ি ধর, পাহাড়িদের জবাই কর।” স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবি বিরাজমান অস্থিরতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, রাতে অতিরিক্ত টহলের উদ্যোগ নেয়া হলেও, দিনের বেলায় পাহাড়ি জনপদ অরক্ষিত থেকে যায়। বান্দরশিং পাড়া, তালুকদার পাড়া, সর্বেশ্বরপাড়া, এবং বগাপাড়ার ৩৩টি পাহাড়ি ঘরে বাঙালী সেটলাররা অগ্নিসংযোহ করে এবং ২০০ শতকেরও অধিক ঘর লুটতরাজের শিকার হয়, জানের ভয়ে আনুমানিক ১৯০০ পাহাড়ি নিকটস্থ ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নেয়।

পাঁচদিন পরে, ৮ই আগস্ট সুকুমনির, আলোরাণি ও আশামণির সাথে দেখা হয়। ইতিমধ্যে খোলা আকাশের নীচে বৃষ্টিতে ভিজে আশামণির জ্বর-কাশি হয়েছে। দুইমাসের ছোট্ট ছেলের কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে, চোখ-মুখ নীল হয়ে যায়। খাগড়াছড়ির ত্রান সংগ্রহ ও বিতরণ কমিটির নেতৃবৃন্দ আশামণিকে তাইন্দং থেকে সাথে করে নিয়ে এসে চিকিৎসার জন্য খাগড়াছড়ির জেলা হাসপাতালে ভর্তির ব্যাবস্থা করেন।আজ সকালে আশামণি খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে মারা গিয়েছে। আশামণি চাকমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
সরকারি ও বেসরকারি সংবাদমতে মাটিরাঙ্গায় সংগঠিত সাম্প্রতিকতম বাঙালী সেটলারদের আগ্রাসনের ঘটনায় কোনও মৃত্যু ঘটেনি। দুই (২) মাসের বয়সী শিশু আশামণি চাকমার মৃত্যুর পর এবং তার সৎকারের সময়, আমরা বার বার ভেবেছি, সত্যিই কি তাই ?
১০ আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭টা




Leave a reply to Kabita Chakma Cancel reply