নাসরিন সিরাজ এ্যানী
সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের লেকচার শুনতে শুনতে তাঁর একটা কথা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। ১৯৬০ দশকে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত ছিলেন এমন ব্যাকগ্রাউন্ডের এই অধ্যাপক বলছিলেন শিশুদের আমাদের থেকেও স্মার্ট হতে হবে। আর সেটা যদি তারা না হয় তাহলে আমাদের কপালে ব্যাপক ভোগান্তি আছে। কারণ তারাই ভবিষ্যত। আমরা তো জীবন কাটিয়েই ফেলেছি। আমরা দুনিয়া চালাবো না, চালাবে তারা। আজ সারাদিন ধরে একে খন্দকারের বই নিষিদ্ধ করা নিয়ে যে হৈচৈ হল তা লক্ষ্য করে আমার সেই সিঙ্গাপুরি অধ্যাপকের কৌতুকচ্ছলে বলা মন্তব্যটিই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
জাতীয় সংসদে একে খন্দকারের বই নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা হয়েছে সারাদিন সে নিয়ে আমার কিছু বলার নেই কারণ সেখানকার সদস্যদের উপর আমাদের আর কোন আশা নেই। কেন নেই? উদাহরণ আছে ভুরি ভুরি। শুধু আজ সকালের একটি খবরই যথেষ্ট। আর সেটা হল তাজরিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিক দেলোয়ারকে বীমার টাকা পাইয়ে দিতে কাজ করছে বিভিন্ন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। দেশের আপামর জনসাধারণকে কোন প্রকার বৈষম্য না করে যাদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিতসা, বাসস্থান, শিক্ষার সংস্থান নিশ্চিত করতে কাজ করার কথা তারা নিচ্ছে ক্রিমিনালদের পক্ষ। তারা নিজেরাই একেকজন ছোট বড় নানা ক্রাইমের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। দেশের মানুষের নিরাপত্তা বিধানের জন্য যে সব বাহিনী আছে তাদের লাগিয়ে দিচ্ছে তারা মানুষেরই জীবন অতিষ্ঠ ও নাশ করতে। লুটপাট রাহাজানি প্রতারণা কি করছেন না তারা? আইন কানুন ভদ্রতা সভ্যতা সব তারা থোড়াই কেয়ার করে। এদের নিয়ে কথা বলা স্রেফ সময় নষ্ট বলেই মনে হয়।
আশা আমাদের শিশুদেরই উপর। তাই তাদের মূর্খতা সহ্য করা যাচ্ছে না।
কথা সংক্ষেপে এতোটুকুই যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের শিশুদের অযথা ভাবাবেগে ভাসলে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর সে কারণেই একে চোখ কান খোলা রেখে জানার ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কোন প্রকার ইনটেনসিভ গবেষণা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কত মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে সেটা বিশ্বাস করা অন্ধত্বের নামান্তর আর এ বিষয়ে কোন গবেষক তার সন্দেহ প্রকাশ করলে তাকে ‘পাকি লাভার’ ‘খানকি’ ‘মাগী’ ডাকা স্রেফ সহিংসতা। ইতিহাসবিদরা বার বার বলেন যে ইতিহাস বলে একটি অখন্ড কোন সত্য নেই। ইতিহাস একপেশে, অসম্পূর্ণ, নানা মানুষ নানাভাবে তাদের অভিজ্ঞতায়, গল্পে, লেখায়, ছবিতে, আঁকায় ইতিহাস বলবে এটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু একে খন্দকার কেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর এবং তাজুল ইসলামের জীবনীমূলক বইগুলোতে লেখকরা যে ইঙ্তি দিচ্ছেন তাতে বোঝা যায় যে সেই সময়কার নেতৃবৃন্দের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐক্য ছিল না। বিশ্বের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে একেক জনের একেক রকমের বোঝাপড়া ছিল। তা কবেই বা সকলে একটি সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে? মতামত, সিদ্ধান্ত নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করা তর্কাতর্কি করাটা কি অন্যায়? রেসকোর্সের ময়দান থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি সেখানে শেষও হয়নি। এটি ছিল মানুষের উপর একটি দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দমন পীড়নের এবং সবশেষে গণহত্যার মত নৃশংসতার প্রতিবাদে সংগঠিত একটি লড়াই। শুধু বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা এতে অংশগ্রহণ করেছে এটা বলাটাও ভুল হবে। দেশের অন্য জাতির মানুষেরা যেমন এতে অংশগ্রহণ করেছে তেমনি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অনেক মানুষই এতে কোন না কোন ভাবে অংশগ্রহণ করেছে, এমনকি খোদ পাকিস্তানের ওয়াকিফহাল মানুষ মুক্তিযদ্ধের পক্ষে ছিল। শুধু রাইফেল তুলে গুলি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। একেকজন পালন করেছে একেক ভূমিকা। আবার যুদ্ধকে সুশৃংখলভাবে ঘটেছে সেটাও তো বলা যাবে না। যেমন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সদস্যরা যে শুধু সে সময় খুন, ধর্ষণ, লুটপাট করেছে তা নয়, এমনকি মুক্তিযোদ্ধারাও যে অনেকে যুদ্ধের ডামাডোলে অসদাচরণ করেছে এটা সে সময়কার অনেক মানুষই সাক্ষ্য দেন। আমার মা তো বলেন তাদের পাশের বাসার আপাত নিরীহ মানুষরাই তাদের বাসার সব মালপত্র লুট করেছে যখন তারা বাসা ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।
যুদ্ধ আসলে গন্ডগোল। মুক্তিযদ্ধের সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান (এখন বাংলাদেশ) এর প্রত্যেকটি মানুষের জীবন তখন তছনছ হয়েছে। গন্ডগোলকে গন্ডগোল হিসেবেই বোঝার চেষ্টা করা উচিত। সুশৃংখল ভাবে নয়।





Leave a reply to Nasrin Siraj Cancel reply